শুক্লাদ্বাদশী,Part-5

শুক্লাদ্বাদশী,Part-5
Arishan Nur (ছদ্মনাম)

সকাল দশটা বাজে। সুর্যের তেজ এখনো প্রখর হয়নি। সুমিস্টি তাপ বিকিরণ করছে সূয্যিমামা। আরোশ উঠানে বসে বসে গায়ে তাপ মাখাচ্ছে। সূর্যের আলোর ভিটামিন ডি নিজের গায়ে বিনামূল্যে নিচ্ছে সে।আরোশ শহরের ছেলে। জন্ম থেকেই ঢাকায় থাকে। গ্রামে সচারাচর আসা হয়নি৷ আসলেও তিন-চার দিন থেকে বাড়ি ফিরে গেছে। এবারই প্রথম গ্রামের পরিবেশ উপভোগ করছে সে।আরোশের কাছে প্রথম প্রথম গ্রামটাকে একদমই ভালো লাগত না। কিন্তু দিন যতো যাচ্ছে সে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। আগে কলপাড়ে গোসল করতে বেশ বিব্রতবোধ করত৷ আজ-কাল আর করে না। অতিরিক্ত ঝাল দিয়ে তৈরি করা ভর্তা খেতে কষ্ট হত। আজ-কাল সেই ঝালযুক্ত ভর্তা সুস্বাদু লাগছে৷

আরোশ উঠানে বসতেই দুর্গা হাজির হলো। আজকে দুর্গার ছুটি। সে আজকে কিছুতেই পড়বে না। আরোশ জোড়াজুড়ি করছিল পড়ানোর জন্য কিন্তু জোড় করে বিয়ে করানো লেগেও পদার্থ বিজ্ঞান পড়ানো যায়না। কাজেই না চাইতেও দুর্গাকে ছূটি দিয়েছে সে।তবে কালকের হোমওয়ার্ক চেক করবে সে।এই ব্যাপার মাফ পায়নি দুর্গা।

দুর্গা আজকে কালো রঙের একটা শাড়ি পড়েছে। মেয়েটা সবসময়ই শাড়ি পড়ে থাকে।শাড়ি পড়ার জন্য মেয়েটার বয়স ছয়-সাত বছর বেশি লাগে। আজকে আবার মোটা করে কাজল দিয়েছে চোখে। চুল গুলো পরিপাটি করে বেনুনি করা। অমায়িক সৌন্দর্য তাকে গ্রাস করে ফেলেছে। তার থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়া দায়। কিন্তু মাঝে মাঝে দায়বদ্ধতা নিয়ে কিছু কাজ করতে হয়৷ কাজেই আরোশ চোখ ফিরিয়ে নিল।

দুর্গা খাতা বের করে দিলো। তিন সাবজেক্টের হোমওয়ার্ক চেক করবে আরোশ৷

চঞ্চল দুর্গা বলে উঠে, আমি আপার বাসায় যাই তাহলে?

আরোশ সাবলীল ভাবে বলে, না থাকো। কোন ভুল করলে সেগুলো ধরিয়ে দিচ্ছি।

দুর্গা ক্যাংগারুর মতো লাফ মেরে উঠানের নিচে নেমে গেল এবং বেশ সহজ গলায় বলে, উহু। আজকে আমার ছুটি। আজকে আমি পড়াশোনা থেকে দুই মাঈল দূরে থাকব৷ আমি চললাম। আপনি আমার খাতাগুলো মোড়ায় রেখে দিয়েন।

আরোশকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই দুর্গা সদর দরজা অতিক্রম করলো।আরোশ জিজ্ঞাসা করতে চাইছিলো আজকে কোন বিশেষ দিন কিনা — তা আর হলো না।

সে মনোযোগ দিয়ে খাতা কাটা শুরু করলো।গতকালকে সে দুর্গাকে বাংলা, ইংরেজি আর অংক করতে দিয়েছিল৷ প্রথমে বাংলা হোমওয়ার্ক চেক করে যেই না অংক খাতা বের করলো। সে পিলে চমকে উঠে। হোমওয়ার্কের খাতা সম্পূর্ণ সাদা ও ফাঁকা কিন্তু শুণ্য খাতায় একটা খামসহ চিঠি দেখলো সে।খামটা হাতে বানানো। খামের ভাঁজে ভাঁজে ভাত লেপ্টে আছে। আঠা হিসেবে ভাত গেলে দেয়া হয়েছে৷ আরোশ খুবই যত্ন সহকারে খামের ভাজ খুলতেই বেরিয়ে এলো চিঠিটা।

সে বড্ড আগ্রহ নিয়ে চিঠি খুললো। গুটিগুটি লেখা গুলো চোখে পড়তেই আরোশ চিনে ফেললো, চিঠির লেখিকাকে। তার অনুগত ছাত্রী দুর্গার হাতের লেখা এটা। সে ভ্রু কুচকে চিঠি পড়া শুরু করে৷ চিঠির প্রথমেই লেখা,

প্রিয় মাস্টারমহাশয়।

আমার অংক খাতা শুন্য দেখে নিশ্চয়ই রেগে গেছেন। রাগবেন না কেমন? এই নিয়ে দশবার আপনাকে চিঠি লেখার প্র‍য়াস করে ব্যর্থ হয়েছি।কালকে বৃষ্টিতে ভিজে কাকভেজা হয়ে আপনার জন্য চিঠি লিখলাম কিন্তু মন মতো না হওয়ায় ছিঁড়ে কুঁচিকুঁচি করে ফেলে দিয়েছি। এই চিঠিটা ভোরবেলায় লিখেছি।আপনি কি জানেন, আমার অংক খাতাটাই কেবল শূন্য কিন্তু আমার মনে ভালো লাগার আবেশে কানায় কানায় ভরপুর৷ আমার মনের প্রতিটা ভালো লাগার অনু, পরমাণু তে কেবল আপনার নাম লেখা যদিও বা আপনার নাম আমি জানি না।

আপনি কি জানেন? সম্বোধন হীন সম্পর্ক গুলো বেশি মজবুত হয়। মনের অজান্তে একটা বড়সড় ঘটনা ঘটে গেছে তাহলো আমি আপনাকে আমার মন দিয়ে ফেলেছি। প্রেম-ভালোবাসা সম্পর্কে আমার ধারণা ও ছিলো না৷ আমি হচ্ছি সেই মেয়ে যে এখনো কানামাছি, দাড়িয়াবান্ধা খেলি। সে কিভাবে আপনার মতো জ্ঞানী মানুষ কে ভালোবেসে ফেললো তাও আমার অজানা। আপনি কি জানেন, আপনি কেবল আমায় রয়াসনের বিক্রিয়া শেখান নি বরংচ ভালোবাসতে শিখেয়েছেন।আপনি যখন মাথা নিচু করে পড়ান, আমি বেহায়ার মতো আপনাকে দেখি। আপনি কি জানেন, আপনি আর আমি মিলে ওই সংযোজন বিক্রিয়ার মতোন! দুই মন মিলে এক হবো আমরা!

ইতি
মাস্টারমশাইয়ের দুর্গা মল্লিক৷

আরোশ চিঠিটা পড়ে থ মেরে যায়। নিস্তব্ধ সে।বুঝতে পারে নি দুর্গার মনে এমন কিছু চলছে। নিজের প্রতি ধিক্কার বোধ হচ্ছে তার কেন সে আগে এই মেয়েটার মনের কথা বুঝলো না? কবে থেকে ভালোবাসতে শুরু করেছে দুর্গা তাকে? আচ্ছা! ভালোবাসার ও কি উপযুক্ত সময় স্থান কাল প্রয়োজন? নাকি এমনি এমনি প্রাকৃতিক ভাবে ঘটে যায়৷ আরোশের পিপাসা লাগতে শুরু করে।সে উঠানে বসেই আছে। হাত-পা ভীষণ রকমের ব্যথা করছে। মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে তার। দুর্গা কেন তাকে চিঠি লিখলো? দুর্গা কি জানে না সে মুসলিম! কেন এমন নিষিদ্ধ আবদার করে বসলো সে?

আরোশ প্রায় অনেকক্ষণ ঝিম করে বসে রইল। বেলা বাড়লে দুর্গা ফিরে এসেই চমক খায়। মাস্টারমশাই এখনো উঠানেই বসে আছে। এই প্রথম দস্যি, চঞ্চল দুর্গা লজ্জা, সংকোচ, ভয়ে মিইয়ে গেল। মাস্টার কি তার লেখা চিঠি পড়েছে?

সে আগানোর সাহস পাচ্ছে না৷ একবার ভাবলো, বাসার সদর দরজা থেকে আবারো রোজিনা আপার বাসায় ফিরে যাবে। কিন্তু তার আগেই মাস্টারের সঙ্গে তার চোখাচোখি হলো। সে হাসার চেষ্টা করলো। এবার তো পালানোর উপায় নেই।

দুর্গা বাসার ভেতরে ঢুকল। আজকে বাবা ঘরে নেই। সে একা বাসায়।

উঠানের সামন থেকে নিজের ঘরে ঢুকে যেতেই আরোশ থমথমে গলায় বলে, দুর্গা এদিকে আসো!

দুর্গা কেঁপে উঠে। সে শুকনো ঢোক গিলে।
আরোশ তার সামনে সে বলে, কানে ধরো।

দুর্গার চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম। সে কেন কানে ধরবে?

— কি হলো? কথা কানে যায় না? কানে ধরে নিল ডাউন দাও বলছি।

দুর্গা কাদো কাদো হয়ে বলে, কেন?

— কেন এর উত্তর তুমি জানো। সাহস কিভাবে হয় আমাকে প্রেম পত্র দেয়ার? আমি এখানে প্রেম করতে এসেছি?

দুর্গা উত্তর দিলো না৷

— কি হলো জবাব দাও! (ভীষণ রাগী গলায়)

আরোশের ধমক খেয়ে দুর্গার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো।

দুর্গা আহত গলায় বলে, আপনি এমন কেন? সুন্দর ভাবে কথা বলতে পারেন না?

— না। পারিনা। তোমার মতো মেয়ের সঙ্গে ভালোভাবে কথা বলিও না৷

— আমার মতো মেয়ে মানে?

— বেহায়া মেয়ে কোথাকার।

দুর্গা পুনরায় আহত হলো। তার গাল বেয়ে টসটসে তাজা দুটো ফোটা অশ্রু বিসর্জন হলো। এরপর মাথা নিচু করে বলে, ভালোবাসায় এক-আধটু বেহায়া হতে হয়৷

আরোশ তা শুনতে পায়নি। সে গর্জে উঠে বলে, কানে ধরো।

দুর্গা ভয়ে ভয়ে তার দু’হাত দিয়ে দু’কান চেপে ধরে। লজ্জা, অপমানে তার নাক, কান দিয়ে ধোয়া বের হতে লাগে৷

আরোশ এতেও শান্ত হলো না। সে ধমকে উঠে বলে, এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকো৷

দুর্গা অতিমাত্রায় বিষ্মিত হলো। সে এক পায়ের হাটু ভাজ করে গুটিয়ে নিয়ে, এক পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। সামনে থাকা সুদর্শন পুরুষ টাকে তার পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্ঠুর যুবক বলে মনে হলো।হিটলার ও এরচেয়ে মায়াবান ছিলো বোধহয়। হুহ।

আরোশ মিনিট ছয় চুপ থেকে বলে, ঠিক আছে। যাও।

দুর্গা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। সে পা জমিনে ফেলে দুই পায়ে ভর দিয়ে আচমকা কেঁদে দেয়৷

আরোশ হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে। দুর্গা কান্না করতে করতে বলে, আজকে আমার জন্মদিন। আর আপনি এভাবে আমাকে অপদস্ত করলেন।

দুর্গা কান্না মাখা চেহারা দেখে আরোশ ঘাবড়ে যায়। সে কি বলবে বুঝে পাচ্ছে না। নিশ্চুপ রইল।

দুর্গা এবারে শব্দ করে কান্না করে বলে, ভালোবাসি বলে সাজা দিলেন মাস্টারমশাই?

দুর্গার প্রশ্নে অন্তর কেপে উঠে আরোশের। সে দুর্গাকে উপেক্ষা করে কলপাড়ে চলে গেল। দুর্গাদের বাসায় বিশাল কুয়া আছে। কুয়ার সঙ্গে লাগানো বাঁশে দড়ি বাঁধানো আছে। দড়ির মুখে বালতি বেঁধে কুয়া থেকে পানি তুলতে হয়৷ আজকে সৌভাগ্যক্রমে বালতিতে পানি ছিলো৷ আরোশ বালতি থেকে পানি নিয়ে চোখে মুখে ঝাপ্টা মারলো। চোখ জ্বালা করছে। মন জ্বালা করছে। চোখের জ্বালা তো পানি দিয়ে মিটালো কিন্তু মনের জ্বালা কিভাবে মেটাবে সে?

সেদিন বিকেলে, সুদীপ মল্লিক দুটো হাঁস নিয়ে বাড়ি ফিরলো। দুর্গার জন্মদিন উপলক্ষে দুর্গার প্রিয় লজেন্স ও এক প্যাকেট এনেছেন।দুর্গা পোড়া হাস ভুনা খেতে পছন্দ করে। বাড়ি ফিরতেই তার মন খারাপ হয়ে গেল।কারন দুর্গার চোখ মুখ ফুলে একাকার। চোখ মুখ লাল। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে এতোক্ষন যাবত কাদছিলো।

তিনি দৌড়ে দুর্গার কাছে গিয়ে বুঝলো, তার আদরের মেয়ের ভীষণ জ্বর এসেছে। তাও উঠানে চুপচাপ বসে আছে। আরোশ কোথায়?

সুদীপ মল্লিক দুর্গার দিকে তাকিয়ে ঘাবড়ে গেল।মেয়েটা কি কষ্ট পাচ্ছে কোন কারণে?

★★★

আরোশ কলপাড় থেকে সোজা বাসার বাইরে চলে এসেছে। কাওছার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে নিজের থাকার জায়গা বদলে নিবে সে।দুর্গার চেহারা আর সে দেখতে চায় না।

কাওছার ভাই নিজের ঘরেই ছিলো। আরোশকে তার বাসায় আসতে দেখে তিনি হেসে বললো, এতোদিনে আমার বাসায় ঘুরতে আসার সময় হলো তোমার?

আরোশ ভদ্রতাসূচক হাসি হেসে বলে, ভাই একটা হেল্প লাগবে৷

— বলো।

— আমি সুদীপ মল্লিকের বাসায় থাকব না।

কাওছার ভাই বলে, কিছু হয়েছে?

আরোশ আকাশের দিকে উদাসিন হয়ে তাকিয়ে থেকে বলে, আগুন আর কেরোসিন একসঙ্গে রাখতে নেই।দুর্গার বয়স কম। অবিবাহিত। আমিও যুবক।গ্রামের লোকে বাজে কথা রটাবে। আমি তা চাই না।

কাওছার ভাই কিছু একটা ভেবে বলে।,তো বেশ। আমার সঙ্গে থাকো। সমস্যা কোথায়? ইয়ং ম্যান। নাও একটা সিগারেট খাও৷ টেনশন নেয়া বন্ধ করো। টেনশন এখন পাকিস্তানিরা করবে।

কাওছার ভাই সবাইকেই একটা করে সিগারেট খেতে দেয়। আরোশ নিজে থেকে কোন দিন সিগারেট কিনে খায় না। কেউ দিলে সেটা আলাদা ব্যাপার। আব্বা রাগ করত সিগারেট খেতে দেখলে।আব্বার কথা ভাবতেই তার মন হুহু করে কেঁদে উঠে। সে তৎক্ষানিক নিজেকে সামলে নেয়। কাঁদবে না সে।বরং শক্ত হয়ে প্রতিশোধ নিবে। নিজের দেশের সহজ-সরল মানুষদের সঙ্গে হওয়া অবিচারের প্রতিশোধ তো তাকেই নিতে হবে। কাঁদলে চলবে কি?

কান্না তো দুর্বলতার অলংকার। বাঙালী দুর্বল নয় বরং সাহসী জাতী। লড়াকু সৈনিক তারা।

কাওছার ভাই বলে উঠে, একটা জরুরি কথা আছে।

— কি?

— এই গ্রামের কয়েকটা ছেলে যুদ্ধ করতে চায়। ওদের ট্রেনিং দিতে হবে৷

— দিবেন।

— দিব বলা কি এতোই সহজ? অনেক কিছু
লাগবে। একটা নিরিবিলি জায়গা ও দরকার।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here