শুক্লাদ্বাদশী,বোনাস পার্ট

শুক্লাদ্বাদশী,বোনাস পার্ট
Arishan Nur (ছদ্মনাম)

আজকে সম্ভবত পূর্ণিমা। আকাশে বিশাল এক ফালি চাঁদ উঠেছে থালার মতো। মধ্য রাতে জেগে জেগে আকাশের ওই চাঁদটা দেখায় ব্যস্ত আরোশ। কি করবে সে?ঘুম আসছে না তাফ। চাঁদ দেখতে ভালোই লাগছে । চাঁদের আলোয় ক্লান্তি ভাব না কমলেও স্বস্তিবোধ হচ্ছে তার। চোখে রাজ্যের এক গাদা ঘুম থাকলে সে টানা চার ঘন্টা বিছানায় এপাশ-ওপাশ করেও ঘুমাতে পারেনি কাজেই জানালা দিয়ে আকাশ, আকাশের বুকে ভেসে বেড়ানো মেঘ আর চাঁদটা দেখছে সে।

আরোশ স্মৃতিচরণ করতে লাগলো। কি সুন্দর পুতুল খেলার মতো দিন ছিলো তার। বাবা-মায়ের আদরের একমাত্র ছেলে সে।ঢাকায় নিজের বাড়ি। বাবা ঢাকা ভার্সিটির প্রফেসর । সম্মান, টাকা কিছুরই অভাব ছিলো না তার জীবনে। সে নিজেও ছোট বেলা থেকে দারুণ ব্রিলিয়ান্ট তাই তো নিজের স্বপ্ন ইঞ্জিনিয়ার হওয়াও পূরিপূর্ণ হলো। যেদিন সে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ তথা বুয়েটে ভর্তি হলো, বাবা কত খুশি হয়েছিলেন। খুশি হয়ে নিজের ব্যবহৃত কলমটা আরোশকে উপহার দিয়ে বলল, মে আল্লাহ ব্লেস ইউ মাই সান!

আরোশের অজান্তেই চোখ চিকচিক করে উঠলো। আরোশের মাঝে মাঝে মনেই থাকে না বাবা তার নেই!

২৫ শে মার্চ রাতের “অপারেশন সার্চ লাইট” এ দাউদাউ করে জ্বলেছিল পলাশীর বস্তি, বিদ্রোহ ইপিআর ও রাজারবাগ পুলিশ লাইসেন্স সঙ্গে বিভিন্ন স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠান। রাতের শেষ প্রহরে নিরপরাধ বাঙালীদের উপর যে অবিচারে।মৃত্যু মিছিল ঘটেছিল যার জন্য ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চকে কালরাত বলা হয়, সেই রাতে আরোশের পিতাও হত্যা হন। আরোশরা তার বাবার লাশটাও পায়নি৷ কোথায় যে মাটি চাপা দিয়ে গুম করে দিলো হানাদার বাহিনীরা তা অজানাই রয়ে গেল। ২৫ শে মার্চ সন্ধ্যায় তার বাবা ঢাকা ভার্সিটির ক্যাম্পাসে কাজে গিয়েছিলো আর ফেরেনি। আরোশ আর তার মা অপেক্ষায় ছিল তিনি আসবেন। একদিন, দুইদিন, তিনদিন গড়িয়ে আজকে কাটায় কাটায় দুই মাস হয়ে গেল, বাবা আর ফিরে এলো না। আরোশের বুকটা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে।

মায়ের অবাধ্যতা করে সে যুদ্ধে নাম লেখালো। ট্রেনিং নিল। মাকে তার নানুবাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে সে ট্রেনিংয়ের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে। অবশেষে দুই মাস ব্যাপি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার পর সে গ্রেনেড হামলা করায় বেশ পটু হয়ে যায়। কিন্তু রাইফেল তেমন একটা ভালো চালাতে পারেনা।

আরোশ চোখ মুছলো। ২৫ শে মার্চ থেকে শুরু করে এই মে মাসের শেষ দিন পর্যন্ত না জানি কত মায়ের কোল খালি হলো, কত সন্তান এতিম হলো, কত নারীকে সিঁদূর বির্সজন দিতে হলো! হিসেব নেই। কেউ কি এই অত্যাচারের হিসাব রাখছে?

আরোশ ফোস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে রজনী গুলো এতো কেন দীর্ঘময় হচ্ছে? আচ্ছা এমন কি হতে পারে না? বাবা মারা যান নি। বেঁচে পালিয়েছেন কোথায়? এমন হওয়া কি খুব অসম্ভব? জানা নেই তার৷ মাকে খুব মনে পড়ে। বারবার আকুতি করব বলছিল, যেন যুদ্ধে না যায়। আরোশ তখন নিজের মধ্যে ছিল না। এক মায়ের কথা মেনে নিয়ে তার দ্বিতীয় মায়ের অস্তিত্ব তো বিলীন হতে দেওয়া যাবে না! তাকে তো লড়তেই হবে। নিজের জন্য, তার বাবার হত্যার প্রতিশোধের জন্য, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুরক্ষার জন্য তাকে যেতে হবে।

সময় আর নদীর স্রোত কারো জন্য নাকি থামে না কিন্তু আরোশের কাছে জীবন থেমে গেছে। দিন কখন হচ্ছে, কখন রাত হচ্ছে তার হিসেব রাখে না সে।আরেকটা দীর্ঘ রাত পাড় করে দিলো সে।

সকালে সে আর কাওছার ভাই গ্রামের দোকানে গেলেন। আজকে অনেকেই বের হয়েছে। অনেলে সদরে যাচ্ছে৷ কারণ দূর-দূরান্তে পাক বাহিনী নেই। সদর আর রাখাল পাড়ার পাক সেনার ঘাঁটি মুক্তিযোদ্ধারা উড়িয়ে দিয়েছে। এখন আর ভয় কিসের?

গ্রামের ছোট্ট চায়ের দোকানে অনেকে গল্প করছে। সব গল্প-জল্পনার মূলে হলো মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে। তারা কোথায় লুকিয়ে আছে? সামনে আসছে না কেন? কে তারা? এইসব নানা কথা।

আরোশ চা খেতে খেতে গ্রামের মানুষের কথা শুনছে। আজকে নাকি অনেকে হাঁট বসাবে।
কাওছার উল্লাসের সঙ্গে আরোশের কানে ফিসফিস করে বলে, এরা কিন্তু তোকে নিয়েই কথা বলছে।

আরোশ কিছু বললো না। তার দৃষ্টি আটকে গেল হেলেদুলে হাঁটতে থাকা কমলা শাড়ি পড়া দুর্গার দিকে। দুর্গা এইদিকে কি করছে?

দুর্গা দোকানের সামনে এসে বলে, চাচা চিনি দাও তো এক কেজি।

দুর্গা আরোশকে দেখেও না দেখার ভান ধরলো। আরোশ যে তার পাশে দাঁড়ানো সে যেন তা দেখতেই পেল না। দুর্গার এহেন কান্ডে আরোশ হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে।

চিনির ঠোঙ্গা হাতে নিয়ে ঘুরে দাড়াতেই আরোশ তার সামনে এসে দাড়ালো। দুর্গা ভ্রু কুচকে তাকালো।

আরোশের নিজের উপর রাগ হতে লাগে। কি দরকার ছিল দুর্গার সামনে এসে দাঁড়ানোর?

— কেমন আছো দুর্গা?

দুর্গা কিছু না বলে অন্যদিকে ফিরে তাকালো।আরোশ উত্তরের আশায় রইলো। কিন্তু দুর্গা কিছু বলল না। সে হতাশ না হলে ও কিছুটা বিব্রতবোধ করে।

দুর্গা তাকে উপেক্ষা করে বড় বড় পায়ে বাড়ি ফিরে যেতে লাগলো।

কাওছার ভাই সবটা দেখে প্রশ্ন করে, তোমার দুর্গার সাথে লেগেছে নাকি?

— না তো।

— মনে হলো দুর্গা তোমার উপর অভিমান করেছে৷

আরোশ আতকে উঠে। সেকি! দুর্গা তার উপর অভিমান কেন করবে? অভিমান করার জন্য একটা অধিকার লাগে। আরোশ সেই অধিকার দুর্গাকে দেয়নি আর কখনো দিবেও না!

সে চায়ের কাপ রেখে হাঁটা ধরলো। আজকে গ্রাম ঘুরবে সে।দুর্গার গ্রাম ঘুরে দেখবে।

চন্দনপুর আকারে খুব ছোট্ট এক গ্রাম। বিশটা বাড়ি মিলে এই গ্রাম। গ্রামের পাশ ঘেঁষে নদী চলে গেছে। সদরে যাওয়ার রাস্তা হলো এই নদী পথে নৌকা করে যাওয়া। নদীর ঘাট সোজা সদরের চৌরাস্তায় মিলেছে। এছাড়াও একটা পুকুর আছে। স্বচ্ছ সেই পুকুরের পানি।

ছোট ছোট মাটির ঘর,ঘরের উপরটা টিনের চালা দেয়া প্রায় প্রতিটা বাড়িতে।

গাছ-গাছালিতে ভরপুর গ্রামটা। চারিদিক সবুজ আর সবুজের সমাহার। গ্রামের শুরুতেই বিশাল এক বট গাছ।এই বট গাছে নাকি পেত্নি আছে। এইসব আজগুবি কথা তাকে দুর্গা শুনিয়েছে ।

আরোশ দুর্গাকে রিলেটিভিটির সুত্র বোঝাচ্ছিল, ওমনি দুর্গা বলে উঠে, জানেন মাস্টারমশাই! আমাদের গ্রামের বটতলায় পেত্নি থাকে। রোজিনা আপা দেখেছে। রাত করে পেত্নিটা সুন্দরী মেয়েদের ধরে,,,,,,

আরোশ বিরক্তি ভাব দেখিয়ে বলেছিল, তুমি তো সুন্দর না কাজেই তুমি গেলে কিছু হবে না। এবার বলো– ই ইকুয়াল টু কি? দুর্গা উত্তর দিতে পারছিলো না।

আরোশ চমকে উঠে। আঁকাবাঁকা দাঁতের মেয়েটার কথা তার ক্ষণে ক্ষণে কেন মনে পড়ছে?

★★★

চারদিন কেটে গেছে। গ্রামের পরিবেশ স্বাভাবিক। সবাই আগের মতো বের হচ্ছে। দোকানে আসর পেতে আড্ডা দেয়। আরোশ ও সেই আসরে উপস্থিত থাকে। বিভিন্ন জ্ঞানী কথা বলে নিজের একটা ব্যক্তিত্ব এই চার দিনে সে তৈরি করে ফেলেছে৷

আজকে সকাল থেকে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে জন্য বাইরে বের হয় নি। কাওছার ভাই ঘরে নেই। আরোশ একা আছে। উনি ট্রেনিং করানোর জন্য জায়গা খুঁজতে বের হয়েছে শফিককে নিয়ে। সাব্বির আর এরিক এই গ্রামে থাকছে না কাজেই তাদের সঙ্গে তেমন দেখা হয় না।

আরোশের প্রচন্ড চায়ের পিপাসা পেয়েছে৷ এমন বৃষ্টি মুখর দিনে চা ছাড়া চলে? কিন্তু বানিয়ে দিবে কে? খড়ির চুলায় চা বানানো সম্ভব না তার জন্য। দুর্গা থাকলে একটা কথা ছিল। চায়ের সঙ্গে পিঁয়াজু বানিয়ে আনত নিশ্চয়ই। আজকে সকাল থেকে দুর্গার।কথা মনে পড়ছে। বৃষ্টি হলে বুঝি দুর্গাও ময়ুরের মতো পেখম তুলে নাচে! সেদিনের দুর্গার বৃষ্টিতে ভেজার দৃশ্যপট তার চোখে ভাসছে। চারদিন ধরে আরোশ কেবল দুর্গাকে নিয়েই ভেবে যাচ্ছে। দুর্গার লেখা এলোমেলো অগোছনো চিঠিটাও যত্নে তুলে রেখেছে সে!

তখনিই কাওছার ভাই ফিরে এলেন। মুখটা তার মেঘের মতো কালো।

আরোশ জিজ্ঞেসে করে, ভাই কিছু হয়েছে?

কাওছার ভাই অন্যমনস্ক হয়ে বলে।,সর্বনাশ হয়েছে রে আরোশ৷

— কি হয়েছে

— সদর থেকে চারটা মেয়েকে পাক বাহিনী তুলে নিয়ে গেছে।

— সেকি!

— হ্যাঁ রে।খুব চিন্তায় আছি। সদর থেকে আমদের গ্রামে আসা খুব সহজ।

— কিন্তু রাস্তা বোধহয় ওরা চেনে না।

— চেনে না কিন্তু চিনিয়ে দেয়ার লোক আছে।

— মানে?

— মানে হলো এই গ্রামে এক-দুইটা বেঈমান ও আছে। কুদ্দুস কে চিনিস? শান্তি কমিটিতে নিজের নাম লিখিয়েছে। শালার জবান ছিঁড়ে ফেলতে মন চাচ্ছে। কেমন হারামখোর ব্যাটা। নিজের মায়ের সঙ্গে বেঈমানী। এরা হচ্ছে জারজ।

— ভাই আপনি উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন। এক কাজ করি, কুদ্দুসকে ধরে আনি৷

— ও বাসায় নাই। আরোশ তুই এক কাজ কর, ওর বাসার সামনে গিয়ে পাহাড়া দে। যেই না আসবে ব্যাটার টুটি চেপে ধরে আমার কাছে আনবি৷

— আচ্ছা।

অগত্যা আরোশ বের হয়ে কুদ্দুসের বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। এদিকে কেউ নেই। নিশ্চুপ চারিদিক। আরোশ দাঁড়িয়ে থেকে কুদ্দুসের অপেক্ষায় রইল। সিগারেট ধরালো সে।কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে কে জানে? সূর্য তখন মাথার উপরে। দু-একটা হাঁসের প্যাক প্যাক ডাক কানে এসে বাঁধছে।

আচমকা এদিকে দুর্গা আর রোজিনা এলো। তখন দুপুর প্রায়। আজকেও দুর্গা শুধু শাড়ি পড়ে আছে। ব্লাউজ নেই পরনে। তারা কি এই পথ ধরে পুকুরে স্নান করতে যায়? রোজিনা তার দিকে সরু চোখে তাকালো এরপর দুর্গা কে নিয়ে যেই গতিতে হাঁটছিল তার চেয়ে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলো।দুর্গা একবার ও তার দিকে তাকালো না। কিন্তু আরোশের চোখ দুর্গার খোলা চুলের দিকে আটকা পড়লো! এইজন্যই হয়তোবা বলে, নিষিদ্ধ কোন কিছুর উপর আমাদের মন ও মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে।

দুর্গারা যখন ফিরে গেলে তখনো আরেকবার তাদের সাক্ষাৎ হলো। আরোশ এবারে হাসার চেষ্টা করলো। দুর্গার মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া দেখলো না সে।

সন্ধ্যা মেলাবার আগে কুদ্দুর মাথায় টুপি পড়ে বাড়ি ফিরতেই আরোশ তাকে ধরে ফেলে। কুদ্দুস একা এবং আক্রমনের জন্য অপ্রস্তুত ছিল কাজেই তাকে হাত করতে আরোশের সময় লাগে নি। তার মুখ বেঁধে, সন্ধ্যার নিলাভ আকাশের নিচে হেঁটে হেঁটে, কুদ্দুসকে জোড় করে কাওছার ভাইয়ের বাড়ি নিয়ে এলো। মাগরিবের আযান পড়ে গিয়েছিলো তখন৷ ঝোপঝাড় থেকে এক প্রকার লুকিয়ে আরোশ তাকে ধরে-বেঁধে এনেছে সবার চক্ষু আড়ালে।

কাওছার ভাই কুদ্দুসকে হাতের নাগালে পাওয়া মাত্র কিল-ঘুষি মারতে লাগলো।কুদ্দুস মার খেতে খেতে বার বার মাফ চাচ্ছিল। কিন্তু ভাই দমার পাত্র না। সে কুদ্দুসলে সমান তালে মারতে লাগে এবং সব কিছু প্রকাশ করার জন্য বাধ্য করে।

এরপর তারা যা শুনলো তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না। মিলিটারি বাহিনী নাকি এই গ্রামে এসেছে। বটতলায় আছে এখন। জিপ নিয়ে এসেছে। মোট পাঁচ জন এসেছে রাইফেলসহ। হিন্দুদের একটা তালিকা করিয়েছে কুদ্দুসকে দিয়ে তারা। আজকে নাকি কেবল হিন্দুদের উপর আক্রমণ চালাবে৷

আরোশের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। কুদ্দুসের মতে, সেই তালিকায় সবার আগে সুদীপ মল্লিকের নাম!

আরোশ বিড়বিড়িয়ে বলে উঠে, আল্লাহ রক্ষা কর।

তার গায়ের প্রতিটা লোমকূপ খাঁড়া হয়ে গেল।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here