শুক্লাদ্বাদশী,Part-6
Arishan Nur (ছদ্মনাম)
সুদীপ মল্লিক চিন্তিত হয়ে দুর্গার মাথার কাছে একটা মোড়ায় বসে আছেন। মেয়েটা জ্বরে কাঁপছে।ঠোঁট দুটোও থেকে থেকে একটু করে কাঁপছে।মুখটা মলিন হয়ে আছে।
বড়ই আহ্লাদী মেয়ে তার। মা-মরা মেয়েকে সুদীপ মল্লিক কোন দিন বকেনি। হাজারো দুষ্টমি করেও বাবার কাছে একবিন্দু বকা খায় নি দুর্গা। মেয়ে অবশ্য পড়ালেখায় ভালো কাজেই স্কুলের শিক্ষকও দুর্গাকে স্নেহ করে। জন্ম থেকে দুর্গা এই গ্রামেই বেড়ে উঠেছে। গ্রামের প্রতিটা মানুষ দুর্গার আপনজন।সবার সঙ্গে দুর্গার খাতির। জেলের বৌ থেকে শুরু করে ল্যাংরা মামা, লেজ-ফিতা বিক্রি করা লোকটাও দুর্গাকে চেনে।
আঠারো বছর বয়সী মেয়েটাকে এর আগে কোনদিন কাঁদতে দেখে নি সুদীপ মল্লিক।সবসময় হাসি-খুশি থাকে তার মা টা। জন্মদিনের দিন যে দুর্গা কেঁদেছে এটা ভাবতেই তার বাবার বুকটা হুহু করে উঠে৷ তিনি দুর্গার কপালে জলপট্টি দিয়ে দিচ্ছেন। লজেন্স গুলো বিছানায় পড়ে আছে। অন্য সময় হলে দুর্গা লজেন্স খেয়ে ঠোঁট লাল করে খিলখিল করে হেসে রোজিনার বাসায় চলে যেত৷ মেয়ে অসুস্থ হলে সুদীপ মল্লিকের ভালো লাগে না। দুর্গা ঘুমাচ্ছে। রাত হয়ে আসছে। আরোশের কোন সাড়াশব্দ ও নেই। ছেলেটা যে ঘরে নেই তা ইতিমধ্যে বুঝে গেছেন সুদীপ মল্লিক। কোথায় গেল ছেলেটা? আরোশের দায়িত্ব সুদীপ মল্লিককে কাওছার দিয়েছে। আরোশ তার বাসায় থাকতে আসার আগে কাওছার বারবার করে বলেছে, নিজের ছেলের মত যত্নে রাখবেন। দেশের জন্য লড়াই করছে ছেলেটা।
সেই ছেলে এখনো বাড়ি ফেরেনি। কোথায় আছে সে জানে না। রাতে খেল কিনা কে জানে?
তার কপালে চিন্তার ভাজ গাঢ় হলো।
তখনি দুর্গা উঠে বসে মৃদ্যু গলায় ডাকে, বাবা?
সুদীপ মল্লিক মেয়ের কন্ঠ শুনে নড়েচড়ে উঠে৷
দুর্গা উঠে বসেছে। চোখ গুলো লাল হলেও তাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে না যে সে দুঃখী। অনুভূতি গোপন করে রেখেছে বাবার কাছ থেকে।
সুদীপ মল্লিক বলল, এখন কেমন লাগছে তোর মা?
— ভালো।
–ভাত খাবি?
— হ্যাঁ। ক্ষুধা পেয়েছে। চল খেয়ে নিই।
— চল।
বাবা-মেয়ে উঠানে এসে বসলো। মন ভোলানো মাতাল হাওয়া বইছে। গা জুড়িয়ে গেল দুর্গার৷ ক্লান্তি ভাব ঘুঁচে গেল তার।
সুদীপ মল্লিক একটা থালায় ভাত আর আলু ভর্তা নিয়ে বলে উঠে, কই ভাবলাম তোর জন্মদিনে পোড়া হাঁস ভুনা আর গরম গরম ভাত খাব৷
— থাক বাবা। আজকে না। খাওয়ার রুচি নেই৷
— জ্বর এলে রুচি থাকে না। দেখি কালকে তোর জন্য সদর থেকে ঔষধ কিনে আনব৷
দুর্গা আতকে উঠে বলে, না বাবা। তুমি সদরে যাবে না ভুলেও। ওদিকে পাকসেনা টহল দেয়। আমার জ্বর সেড়ে গেছে৷
সুদীপ মল্লিক স্মিত হাসলেন। মেয়ে মিথ্যা বলে বাবাকে ভোলাচ্ছে যেন সদরে না যায়।
সে দুর্গার পাশে বসলেন এবং ভাত মাখাতে মাখাতে বলল, আচ্ছা যাব না।
এরপর দুর্গাকে খাইয়ে দিতে লাগলেন। দুর্গাও সাবলীলভাবে খাচ্ছে।
সাধারণত দুর্গার বয়সী মেয়েদের সঙ্গে বাবাদের একটা অদৃশ্য দূরত্ব এসে যায়৷ কিন্তু দুর্গার বেলায় তা ব্যতিক্রম। সে বাবা ভক্ত মেয়ে।
সুদীপ মল্লিক দুর্গাকে প্রশ্ন করেন, তোর মাস্টারমশাই কই রে?
দুর্গা থমকে গেল। চোখ গুলো এলোমেলো হয়ে খুঁজতে লাগলো লম্বা যুবকটাকে। কিন্তু তার জায়গাটা ফাঁকা। দুর্গা জানে না মাস্টারমশাই কোথায়। কিন্তু কলপাড় থেকে সে সোজা বাসার বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিল। যাওয়ার আগে তাদের দুজনের মধ্যে একবার চোখাচোখি হয়েছিলো। দুর্গার চোখে ছিল আকুলতা আর উনার চোখে ছিলো আগুন ঝলসানো রাগ!
সে ফোঁস করে দম ছেড়ে বলে, জানি না বাবা।
— তুই খেয়ে শুয়ে পড়। আমি ছেলেটার খোঁজে যাচ্ছি।
দুর্গা ডাগর চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে, লজেন্স কই আমার?
এতোক্ষণে সুদীপ মল্লিকের মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠে।
সে আনন্দিত হয়ে বলে।,তোর ঘরে আছে।
দুর্গা মুচকি হেসে উঠে দাঁড়ালো। বাবার গোমড়া মুখ তার একদমই পছন্দ না। সে নিজের ঘরে এসে বসলো।
বাবা চাঁদর গায়ে বাইরে বের হলেন। দুর্গা লজেন্স গুলো নেড়েচেড়ে রেখে দিলো। খাওয়ার ইচ্ছা নেই তার। লজেন্স পাশে রেখেও সে তা না খেয়ে কিভাবে বসে আছে? অন্য দিন হলে একটার পর একটা লজেন্সের প্যাকেট খুলে খেয়ে ফেলত!
আরোশ কাওছার ভাইয়ের সঙ্গে রাতের ভাত খেয়ে বাইরে বের হয়েছে। হাতে সিগারেট। দুজনের মধ্যে টুকটাক কথা হচ্ছে। গ্রামের ছেলেদের কিভাবে ট্রেনিং দেয়া যায় সেটা নিয়ে কাওছার ভাই বেশ বিচলিত। আরোশ বলে উঠে, আপনাদের চন্দনপুর গ্রামে হিন্দু-মুসলমান একসঙ্গে থাকেন?
— হ্যাঁ। সবাই মিলেমিশে থাকি আমরা।
বুঝলি এই গ্রাম হলো আমার দ্বিতীয় মা।
আরোশ হেসে বলে, আপনাদের সবার মাঝে অনেক মিল তাই না?
— হ্যাঁ। গ্রামের সবাই নিজের আত্মীয়ের মতো। মনেই হয় তারা পর! সবাই আপন, সবাই আমার ভাই-বোন।
— দুর্গাকেও নিজের বোন ভাবেন?
— অবশ্যই। দুগ্গা আমার সবচেয়ে আদরের ছোট্ট বোন। একটু দুষ্টু এইজন্যই বেশি স্নেহ করি।
আরোশ অদ্ভুত চোখে তাকালো তার দিকে। তখনি তাদের সামনে এসে দাড়ালো সুদীপ মল্লিক।
আরোশ বেশ বিষ্মিত হলো সুদীপ মল্লিক কে দেখে। উনি কিভাবে যেন তার হাতে থাকা সিগারেটটার দিকে তাকিয়ে আছেন যার জন্য আরোশ বিব্রত হয়ে মাটিতে ফেলে দিলো সিগারেট টা।
সুদীপ মল্লিক বলে, বাবা তুমি এখনো বাসায় ফিরছো না কেন?
কাওছার ভাই বলল, আরোশ আজকে থেকে আমার সঙ্গে থাকবে কাকা৷
— সেকি কেন?
— আসলে ট্রেনিং শুরু করব আমরা। সেইজন্য কাজ করতে হবে সবাইকে। আরোশের উপর দায়িত্ব বেশি।
— ওহ।
কাওছার ভাই নিজ থেকে বলে উঠে, দুগ্গা কেমন আছে?
— আজকে মেয়েটার জন্মদিন কিন্তু দেখো কি কান্ড! মেয়েটা জ্বরে কাতরাচ্ছে।
আরোশ দুর্গার অসুস্থতার খবর শুনে পিলে চমকে উঠে। কেমন খারাপ লাগা তাকে গ্রাস করে ফেলে মূহুর্তের মধ্যে। সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
কাওছার ভাই বিভিন্ন আলাপ জুড়ে দিলো সুদীপ মল্লিকের সঙ্গে। এরপর কিছুক্ষন পর উনি চলে গেলে কাওছার ভাই আরোশকে উদ্দেশ্য করে বলে, বেচারা দুগ্গা আজ অসুস্থ। তুই তো জানিস না! দুগ্গা নিজের প্রতি জন্মদিনে মায়ের শাড়ি পড়ে সেজেগুজে সবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে দোয়া নেয়। এইবার আর তা করা হলো না মেয়েটার৷
আরোশের নিজেকে অপরাধী লাগতে লাগলো
কম বয়সী মেয়ে দুর্গা। এই বয়সে এমন আবেগ আসেই।আরোশের উচিত ছিল দুর্গাকে সুন্দর করে বুঝিয়ে বলা। তাছাড়া মেয়েটা তো তার আসল পরিচয় জানেও না। সে জানেও না আরোশ মুসলিম। বাচ্চা মেয়ে একটা ভুল করে বসেছে। কোথায় আরোশ তার ভুল শুধরে দিবে তা না করে সে কিনা দুর্গাকে শাস্তি দিল।নিজের প্রতিই রাগ লাগছে তার।
কাওছার ভাই বলে উঠে, কিছু হয়েছে?তোকে উদাসিন দেখাচ্ছে?
আরোশ জোড়পূর্বক হেসে বলে, না ভাই। সব ঠিক আছে। ঘুম পাচ্ছে খুব।
— ঘরে যাবি?
— হু।
— আয়। আমার সাথে — বলে কাওছার ভাই তাকে ঘরে নিয়ে এলো। কাওছার ভাইয়ের রুমেই আরেকটা চৌকি আছে। সেখানেই আরোশের শোয়ার ব্যবস্থা হলো।
আরোশ নিজের সমস্ত ভার বিছানায় বিলিয়ে দিলো।চোখে রাজ্যের ঘুম। কিন্তু আফসোস চোখে ঘুম থাকা সত্তেও সে ঘুমুতে পারছে না।চোখ বুজলেই দুর্গার আঁকাবাঁকা দাঁতের হাসি মাথায় কিলবিল করছে। কালকে থেকে কি সে আর দুর্গাকে পড়াবে না?
আচমকা তার মন অতিরিক্ত পরিমানে খারাপ হয়ে গেল৷ কিন্তু কেন? মন খারাপ ভাবটা কার জন্য হচ্ছে? উত্তর কি জানে আরোশ?
চলবে