শুক্লাদ্বাদশী,Part-4
Arishan Nur (ছদ্মনাম)
–মাস্টারমশাই জানেন! রাখাল পাড়ায় গ্রেনেড হামলা হয়েছে।
আরোশ সকালে যখন দুর্গাকে পড়াতে এলো তখন দুর্গা তাকে এই তথ্য দিলো। আরোশ অবাক হওয়ার ভঙ্গি করে, তাই নাকি!
— জি! তাই। আমাদের গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা এসে গেছে বলে এক গাল হাসল সে।
আরোশ সেই হাসির দিকে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকে।
দুর্গা বলে উঠে, রোজিনা আপা জানালো, মধ্য রাতে নাকি গ্রেনেড হামলা হয় পাকিস্তানি ক্যাম্পে। ওদের ক্যাম্প জ্বলে ছারখার। আজকে সকালেই ঘাটি ছেড়ে পাকসেনা গ্রাম ত্যাগ করেছে।
দুর্গার চোখ-মুখে আনন্দের ছাপ। আরোশ তা দেখে মুচকি হেসে বলে, তাহলে তো খুবই ভালো। আমরা এখনো নিরাপদ।
— জানেন পাঁচ মিনিট পর পর টানা পাঁচবার বিকট শব্দ হয়েছিল। কিন্তু আমি আওয়াজ পাই নি। আমার ঘুম খুব ঘণ। বাজ পড়লেও ঘুম ভাঙ্গে না
আরোশ ভ্রু কুচকে তাকাল।তার স্পষ্ট মনে আছে , গ্রেনেড হামলা একটাই করা হয়েছিল। সে নিজেই পাকসেনার ক্যাম্প গ্রেনেড দিয়ে উড়ালো। একবার ই বিকট শব্দ হলো। অথচ দুর্গা বলে কিনা পাঁচ মিনিট পর পর পাঁচবার শব্দ হয়েছিল। কি আজব কারবার!
দুর্গা প্রফুল্ল মনে বলে, ইশ! মুক্তিযোদ্ধাদের যদি একবার দেখতে পেতাম। পা ছুঁয়ে সালাম করতাম।
তোমার সামনেই বসে আছে বলতে গিয়েও থেমে যায় আরোশ। প্রসঙ্গ পালটে বলে, পড়তে বসো। আজকে ক্যালকুলাস পড়াব। খাতা বের কর।
দুর্গা মাথা চুলকায়৷ সে অংকে বড্ড কাঁচা। মাস্টারমশাইয়ের কাছে লজ্জা পেতে চায় না সে। সে তড়িঘড়ি করে বলে, আচ্ছা মাস্টার, আপনার নাম কি?
— আমার কোন নাম নেই।
মাস্টারমশাই তার নিজের নাম দুর্গাকে বলছে জন্য সে কিছুটা কষ্ট পেল। কেন যে উনি নিজের নাম বলে না কেন জানে?
পড়াতে গিয়ে আচমকা দুর্গার নরম হাতের সঙ্গে আরোশের হাত লেগে যায়। আরোশ কেপে উঠে নিজের অজান্তেই৷ দুর্গার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল সে। মেয়েটা অন্যমনস্ক হয়ে আছে৷
সে বলে উঠে, কি ভাবছো এতো?
দুর্গা আনমনে বলে উঠে, মুক্তিযোদ্ধাদের কথা ভাবছি। আচ্ছা মাস্টারমশাই মুক্তিযোদ্ধারা দেখতে কেমন?
— জানি না৷
— যুদ্ধ কিভাবে করে?
আরোশ বলে উঠে, জানি না। একটু পড়ায় মন দাও।
দুর্গা বিড়বিড়িয়ে বলে, আমি তো আমার মন আপনাকে দিয়েছি এখন পড়ায় কিভাবে দিব? আমার কি দুটো মন কিনা!
আরোশ উঠানে বসেই আকাশের দিকে তাকালো। ঝড়ো হাওয়া বইছে। দুর্গার হাতের স্পর্শ পাওয়ার পর থেকে মনটা কেমন বিষিয়ে গেছে। পঁচিশ বছর বয়সে এই প্রথম কোন মেয়েকে দেখে তার অন্তর কেঁপে উঠেছে। কোষের প্রতিটা নিউক্লিয়াসে ভালো লাগার আবেশ পৌঁছে গেছে কিন্তু হায় আফসোস সে- নারী তার জন্য নিষিদ্ধ।
আরোশ মাথা নিচু করে দুর্গাকে এক মনে পড়াতে লাগে। তখনি বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ কানে আসে। মূহুর্তেই উঠানেও বৃষ্টির ঝাপ্টা গায়ে এসে লাগতে লাগলো।
আরোশ বলল, আজকে এইটুকুই। কালকে আবারো পড়াব।
দুর্গা বই খাতা গুছাতে লাগে। আরোশ তাকে পাশ কাটিয়ে নিজের রুমে এসে বসে৷
দুর্গা বই-পুস্তক ঘরে রেখে এসে উঠান পেরিয়ে ফাঁকা জায়গায় এসে বৃষ্টিতে ভিজতে লাগে। ইশ! বছরের দ্বিতীয় বৃষ্টি। বৃষ্টির ফোটা গায়ে লাগতেই দুর্গা মন ভালো হয়ে গেল। হাত দুটো সামনে এগিয়ে এনে একসাথে করে হাতের তালুতে পানির ফোটা জমাতে লাগলো।
ক্ষনেই সে ভিজে জুবুথুবু হয়ে যায়। মাস্টারমশাই যেদিন বাড়ি এল সেদিন ও বৃষ্টি হয়েছিল।
দুর্গা গুনগুনিয়ে রবীন্দ্র সংগীত গাচ্ছে আর বৃষ্টিবিলাস করছে৷
আরোশ পেছনে থেকে তার দিকে অপলক নয়নে চেয়ে থাকে৷
আচমকা দুর্গার শাড়ি যথাযথ স্থান থেকে সরে গিয়ে ফর্সা পেট আরোশের নজরে এলো। সে চোখ সরিয়ে নেয়। এই মেয়েটাও না! শুধু হাতে-পায়ে বড় হয়েছে। বুদ্ধি হাঁটুতেই পড়ে আছে৷
আরোশ ঘরে ঢুকে পড়ে। আজকে রাতে আবারো বেরুতে হবে। কালকে দুর্গা ঘুমিয়ে পড়ার পর গিয়েছিল। কিন্তু আজকে আরো আগেই যেতে হবে। রাখাল পাড়া কাছে হওয়ায় দেরিতে রওনা দিয়েছিল কিন্তু আজকে সদরে যাবে। সময়ের ব্যাপার আছে। দেরি করা যাবে না। সদরের ক্যাম্পে যেকরেই হোক হামলা চালাতে হবে৷
বৃষ্টি থেমে যেতেই ভেজা কাপড়ে উঠানে এলো দুর্গা উঠান থেকে মাস্টারমশাই কে দেখতেই তার গায়ে হীম শিহরণ বয়ে গেল। সে কঠিন এক সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ মাস্টারমশাই কে প্রেমপত্র লিখবে।
দুর্গা চটজলদি নিজের ঘরে গিয়ে খাতা বের করলো। এই ভেজা কাপড়েই নিজের মনের অবক্ত্য কথা গুলো লেখায় প্রকাশ করবে৷ দুর্গা অনেকটা সময় নিয়ে খাতায় লেখালেখি করলো। কিন্তু এই চিঠি দিবে কিভাবে??
★★★
সুদীপ মল্লিক খালি গায়ে বসে আছেন। সকালের দিকে বৃষ্টি হলেও সন্ধ্যার পরপর থেকে প্রচন্ড গরম পড়েছে। ভ্যাপসা গরম যাকে বলে৷ খালি গায়ে উঠানে বসে আছেন তিনি। দুর্গা ভাত রান্না করছে।
আরোশ নিজের ঘর থেকে বের হয়ে উঠানে গেল। তাকে দেখে সুদীপ মল্লিক এক গাল হেসে বলে, কেমন আছো বাবা?
আরোশ এক কথায় উত্তর দেয়, ভালো৷ আপনি?
— আমিও ভালো। কিন্তু এইবার যা গরম পড়েছে। সহ্যের বাইরে। আমার মনে হয় এইবার সবচেয়ে বেশি গরম পড়লো।
আরোশ কিছু বললো না। উনি বলতে লাগলেন, তোমার কথামতে দুর্গাকে তোমার সত্য পরিচয় বলি নি। ও জানে তুমি আমার দূর সম্পর্কের ভাগ্না৷
— ও। ভালো করেছেন৷
— মেয়েটা আমার সহজ-সরল। কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলে কখনোই মিথ্যা বলে না।
— ওহ।
আরোশ এতোক্ষন চুপচাপ বসে থাকলেও, এবারে মুখ খুললো। সে বলে উঠে, আজকে আমাকে রাতে বাইরে যেতে হবে। কাজ আছে।
সুদীপ মল্লিকের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে৷ তিনি বলে, কালকে তোমরাই গ্রেনেড হামলা করেছিলে তাই না?
— জি।
— সাবাশ! বাঘের বাচ্চা তোমরা।
আরোশ স্মিত হাসলো। উত্তরে নিরব রইল।
দুর্গা গরম গরম ভাত আর কাঁঠালের বিচি ভর্তা উঠানে পরিবেশন করলো।
আরোশ হাত ধুয়ে খেতে বসলো। সে এর আগে বহুবার কাঁঠালের বিচির ভর্তা খেয়েছে কিন্তু দুর্গার হাতের ভর্তাটা অসাধারণ।
খাওয়ার পর্ব চুকিয়ে ঘরে ফিরলো আরোশ
ঝিঁঝিঁ পোকা এখনো ডাকা শুরু করে নি আজকে।
রাত আরেকটু বাড়তেই চাদর গায়ে বেরিয়ে যায় সে।
সোজা হাটা ধরলো মেঠোপথ বেয়ে লাল মসজিদের দিকে। এইখানেই সবাই একত্র হবে৷ সে পৌঁছে দেখে কাওছার ভাই ইতিমধ্যে টর্চ হাতে দাঁড়িয়ে আছেন।
তাকে দেখে সালাম দিলো আরোশ। তিনি বলে উঠে, সারা গ্রামে হৈচৈ উঠে গেছে৷
— জানি৷
— শালা পাকিস্তানি গুলো ভয়ে পালাইছে একটা
গ্রেনেড এর ধোয়া সহ্য করতে পারে না আবার বাঙালীদের সঙ্গে লড়তে আসছে!
আরোশ কিছু বলল না। বরাবরের মতো চুপ থাকে। আজকে সদরে যাবে। সেখানে বিশাল ক্যাম্প বানানো হয়েছে। পুরা ক্যাম্প শেষ করতে তিনটার মতো গ্রেনেড লাগবে। আরোশ ছাড়া কেউ গ্রেনেড হামলা করতে পারে না। সাব্বির রাইফেল চালাতে পারে ভালো। কিন্তু গ্রেনেড ছুড়ে মারতে পারে না৷ তার নাকি ভয় লাগে। যা করার আরোশকেই করতে হবে। পরপর তিনটা গ্রেনেড মারা খুবই দুষ্কর কাজ। ধরা পড়লেই শেষ। মনোবল শক্ত রেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। কাওছার ভাই একটা সিগারেট খেতে দিলো তাকে।
সিগারেট ফুকতে থাকে সে।অস্থিরতায় হাত কাপছে তার৷ ভয়, আনন্দ, টেনশন সব মিলিয়ে মিশ্র অনুভূতি।
একে একে সাব্বির, বল্টু আর এরেক চলে আসলে তারা গন্তব্য রওনা হয়।
চৌরাস্তার মোড়েও ক্যাম্প। বাইরে দিয়ে চারজন পাক সেনা গুলি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷
কাওছার ভাইয়ের পরিকল্পনা মতে, সাব্বির এগিয়ে গিয়ে একজন পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে কথা বলা শুরু করে দিলো।
আরোশ সুযোগ মতে পেছনের দিকে চলে যায়। এখন কেবল অপেক্ষার পালা। উত্তেজনায় হাত-পা কাপছে। বুকের হৃদপিন্ড কাপছে৷
মিনিট বিশ পর রেডিও থেকে ভেসে আসলো, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম৷
সকল অস্থিরতা কে দূরে পিষে ফেলে আরোশ হেসে দিলো এবং সঙ্গে সঙ্গে সে গ্রেনেড ছুড়ে মারে ক্যাম্পের দিকে। গতকালকের মতো আজও বিকট শব্দ হলো। চোখের সামনে পাকদের পরাজয় দেখে উল্লাস প্রকাশ করে সে।
চলবে।