গল্পের নাম:প্রেম পায়রা,পর্ব ০৯
লেখনীতে:অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)
১৭.
ভোরবেলা ঘুম ভাঙতে উঠতে নিয়ে উঠতে পারল না তুলি।কেউ একজন তার উপর লেপ্টে শুয়ে আছে।মানুষটার সম্পূর্ণ ভর তার উপর!বিষয়টা বোধগম্য হতে তুলির হাত পা অসাড় হয়ে আসলো।বিস্ফারিত নয়নে মুখটা সামান্য উঁচু করে দেখল নিশান!
সঙ্গে সঙ্গে তুলির ভেতরে কিছু একটার পরিবর্তন হলো।পরিবর্তনটা সূক্ষ্ম নয়।বড়সড় পরিবর্তন।তার বুকের ভেতর ধড়ফড় করছে।হৃদয় কোথায় সে জানে না।তবে কোথায় যেন একরাশ অনুভূতি এসে জড়ো হয়েছে।স্পর্শহীন অনুভূতি!
বাম হাতটা উঁচু করে সে নিশানের ঘন চুলে রাখল।হালকা করে ছুঁয়ে দিল চুলগুলো।প্রেম ভালোবাসা কি তা তুলি জানে না।জানতে চায়ও না!সে চায় একটু বাঁচতে,আর দশটা মানুষের মতো স্বাভাবিক জীবন অতিবাহিত করতে।
তার চোখের কোণ ভিজে উঠল।বস্তিতে কাটানো মূহুর্তগুলো স্মৃতিপটে ভেসে উঠলো।প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করা জীবন থেকে সে মুক্তি চেয়েছিল।মুক্তি চেয়েছিল দারিদ্র্য, অত্যাচার আর প্রিয়জনদের নিষ্ঠুর কড়াঘাত থেকে।হয়তো সেটা মিরাজের হাত ধরে বা অন্য কারো হাত ধরে।
মিরাজের প্রতি তার অনুভূতি কেমন ছিল তা সে জানে না।শুধু জানতো মিরাজের হাত ধরে তার জীবন যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটবে।সে সাধারণ ভাবে বাঁচতে শিখবে।
মিরাজ নয়!নিশান নামক মানুষটার মাধ্যমে সে একটা সুন্দর জীবন পেল।এটাই তার ভবিতব্য!এতটুকুও তার স্বপ্নের মধ্যে ছিল না যে!ছিল না তার কল্পনার মধ্যে।প্রতিনিয়ত সংসারের সাথে যুঝতে থাকা জীবন থেকে তার মুক্তি মিলেছে সে এতেই খুশি।
তুলি উঠার চেষ্টা করে পারল না।নিশানের শরীরটা এই মুহূর্তে তার কাছে মৈনাক পর্বতের মতো ভারী মনে হচ্ছে।কি করে নিশানকে সরাবে?ধাক্কা দিবে?না কি ডাক দিলে ভালো হয়?
তুলি ডাকাডাকির মধ্যে গেল না।ঘুম ভেঙে নিজেকে এই অবস্থায় আবিষ্কার করলে উল্টো তাকেই বকা দিবে নিশান।সে সাবধানে নিশানের হাত দুটো সরাতে চাইল।কিন্তু বিন্দু মাত্র নড়াতে পারল না।উল্টো নিশান নড়েচড়ে আরো গভীর ভাবে ভেতরে ঢুকে গেল।তুলি কিছুক্ষণ ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল।এভাবে আর কিছুক্ষণ থাকলে সে নিশ্চিত দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে।নিজেকে সামলে হাত মুঠ করে অতি কষ্টে কাত ঘুরল।বড় করে শ্বাস নিয়ে এক ধাক্কায় নিশানকে নিচে ফেলে দিল।
নিশান হকচকিয়ে গেল।চোখ কচলে হুড়মুড় করে ফ্লোর থেকে উঠে দাঁড়ালো।তুলির দিকে তাকিয়ে বিস্মিত কন্ঠে বলল,
—‘তোমার সাহস তো কম নয়!আমাকে ধাক্কা দিয়ে বেড থেকে ফেলে দিলে?’
তুলি উঠে বসলো।কাপড় ঠিক করে মাথার চুল খোঁপা করলো।মুখে হাত রেখে লম্বা একটা হাই তুলল।নিতান্ত হেলাফেলা করে বলল,
—‘ভাগ্যিস লাথি দিয়ে ফেলে দিইনি।শুধু ধাক্কা দিয়েছি!’
—‘কি?আমায় লাথি দিয়ে ফেলতে চেয়েছিলে?’
—‘কথা তো সেরকমই ছিল।গতকাল রাতে বলেছিলেন যে আমি আপনাকে ছিঁটেফোঁটা স্পর্শ করলে লাথি দিয়ে ফেলে দিবেন।সেজন্য আমার অবচেতন মন অনেক সাবধান ছিল।ভুলেও আপনার দিকে এগোয়নি।আপনি নিজেই সারা রাত আমার বুকের উপর লেপ্টে ছিলেন!’
—‘মিথ্যে কথা।’
তুলি এক পলক নিশানের দিকে চেয়ে বলল,
—‘আপনি তো ভীষণ সাংঘাতিক মানুষ।আমার শরীর থেঁতলে দিয়ে বলছেন মিথ্যে কথা?আপনি তো প্রেগনেন্ট বানানোর পরও কসম খেয়ে বলবেন,আমি তোমাকে ছুঁয়েই দেখিনি!’
নিশানের মুখ হাঁ হয়ে গেল বিস্ময়ে।এই মেয়ে অকপটে কি বলছে?সিরিয়াসলি?নিজের বিস্ময় ভাব লুকিয়ে সে বলল,
—‘তুমি একটা বিচ্ছু।আমি নিশ্চিত তুমি নিজেই আমার কাছে গিয়েছিলে!’
তুলি উঠে দাঁড়ালো।বিছানার দিকে আঙুল তুলে বলল,
—‘আপনার দেখছি মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেছে।ঘুমানোর সময় ওপাশে ঘুমিয়েছিলেন।উঠলেন এ পাশ থেকে।স্মরণে পড়ছে না?’
নিশান কিছুক্ষণ থম মেরে রইলো।তুলি তো ঠিকই বলেছে।সে তো ওপাশে ছিল।এ পাশে আসলো কি করে?ঘুমের ঘোরে?হ্যাঁ,নিশ্চয়ই!
তবুও আমতা আমতা করে কাঠ গলায় বলল,
—‘তুমি!তুমি নিশ্চিত আমাকে টেনে এ পাশে নিয়ে এসেছ।তাই তো?’
—‘যাক বাবা!আমার সব কনফিউশান দূর হলো।আপনি আস্তো একটা রামছাগল।রাম ছাগল চিনেন?থুতনির কাছে যে একমুঠ দাঁড়ি থাকে!রাম ছাগলের বুদ্ধি গরুর গোবরের মতো।আপনারও সেইম।গরুর লাদি দেখেছেন?রামছাগলের প্রিয় খাবার।আপনি হচ্ছেন সেই ছাগল।আমার উপর শুয়ে এখন আমাকেই ব্লেম করছেন?’
—‘চুপ!একদম চুপ বলছি।’
তুলি ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াল।একবার পেছন ঘুরে তাকিয়ে বলল,
—‘আজ রাতে বুকের উপর আসবেন তো লাথি মিস হবে না!’
নিশান চেঁচিয়ে বলল,
—‘তুমি একবার লাথি দিয়ে দেখো শুধু!তোমার কি হাল করবো আমি নিজেই জানি না।আমার বাড়ি,আমার ঘর, আমার বিছানা, আমার বউ।বউয়ের বুকের উপর মাথা রাখব,জড়িয়ে ধরবো!প্রয়োজনে যা ইচ্ছে তাই করবো।তাতে তোমার কি?’
তুলি যেন বেকুব বনে গেল।চোখের সাদা অংশ আপনা-আপনি বড় হয়ে গেল।কি বলছে এই ছাগলটা?গোল গোল চোখে সে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলো।নিশান চট করে সরে গিয়ে তুলিকে পাশ কাটিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো।এক নজর তুলির দিকে চেয়ে ঠাস করে দরজা বন্ধ করলো।
তুলি টলমল পায়ে এগিয়ে বিছানায় বসল।তার মাথা ঘুরছে।মস্তিষ্কের ভেতর একটা কথাই বার বার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।সেটা হলো নিশানের মুখে বলা,’আমার বউ!’ কথাটা!
তুলি লজ্জায় দুহাতে মুখ ঢেকে ফেলল।
১৮.
“পাখি আমার নীড়ের পাখি
অধীর হল কেন জানি
আকাশ কোণে যায় শোনা কি
ভোরের আলোর কানাকানি।”
সুচিত্রা মিত্রের কন্ঠের গান শুনে সম্পদের ঘুম ভাঙলো।মস্তিষ্ক সজাগ হলেও চোখের পাতা মেলতে ইচ্ছে করছে না।মনে হচ্ছে চোখের পাতার উপর এক মণ ওজনের পাথর চাপিয়ে রাখা হয়েছে।
সে চোখ খুলল না।কান পেতে গান শুনলো এবং অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো ভোরবেলা রবীন্দ্র সংগীত শুনতে ভীষণ ভালো লাগছে।সিদ্দিকুর রহমান যে রোজ ভোরবেলা রবীন্দ্র সংগীত শোনেন তা সম্পদের অজানা নয়।
তার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল।
হঠাৎ তার বুকের মাঝে বাহুডোরে কেউ হালকা নড়ে উঠল।কারো নড়চড়ে সম্পদের খেয়াল হলো তার ভোরবেলা এত ভালো লাগার কারণ শুধু সুচিত্রা মিত্রের কন্ঠের গান নয়,তার বুকে জড়িয়ে রাখা মানুষটিও!
সে পরম আনন্দে চোখ খুলল।নিজের থুতনির কাছের তিথির মাথার চুল গুলো সরিয়ে নিচে তাকাল।তিথি তাকে জড়িয়ে গভীর ঘুমে।তিথির পিঠের কাছে জড়িয়ে রাখা বাম হাতটা সম্পদ সরাল।হাতটা উঁচু করে তিথির মুখের উপরের চুলগুলো সরাল।মাথাটা উঁচু করে ব্যথাতুর বাম পা টা চেক করল।বেকায়দায় নেই!ঠিকঠাক আছে।
সম্পদ আবার বালিশে মাথা রাখল।হঠাৎ নিজের ডান হাতের কথা মনে পড়ল।ডান হাতের অস্তিত্ব নেই যেন।চোখ ঘুরিয়ে দেখল তিথির মাথাটা তার হাতের উপর।সারা রাত এভাবেই ছিল।সম্পদ হাতটা মুঠ করার চেষ্টা করলো।হলো না, আঙুল গুলো অবশ হয়ে গেছে যেন।একটু নাড়ানোর চেষ্টা করেও পারল না।
সম্পদ স্লো গতিতে কাত ঘুরল।চিৎ হয়ে শুয়ে সাবধানে তিথির মাথাটা নিজের বুকের উপর রাখল।ডান হাতটা মুক্ত করে বড় করে একটা শ্বাস নিল।হাতটা বার কয়েক পুশ-আপ করল।
বাম হাতের আঙুল গুলো তিথির চুলে ভাঁজে হারিয়ে সম্পদ গুনগুন করে গাইল,
“আমার স্বপ্ন জুড়ে তুই,
আর তোর চিন্তারা শুধুই!”
মুখটা নিচু করে সে তিথির মাথায় চুমু খেল।দরজায় কেউ কড়া নাড়ছে।তার শব্দে সম্পদের হুশ ফিরল।ওয়াশরুমের পাশে জানালা ঘেঁষে রাখা টেবিলের উপর নজর পড়ল।টেবিলে রাখা এলার্ম ঘড়িতে দশটা বাজে প্রায়!সম্পদ চমকে গেল।এত বেলা হয়ে গেছে?শিট!
সে অসহায় মুখে তিথির দিকে তাকালো।তিথির গাঢ় ঘুম। অনেক রাত অবধি পায়ের ব্যথায় জেগে ছিল।এখন নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে।
তিথিকে আবার নিঃশব্দে বুক থেকে সরাল।বালিশে মাথাটা রেখে গায়ের উপর কম্বল জড়িয়ে দিল।তারপর সম্পদ আস্তে করে বিছানা ছেড়ে নামল।
দরজায় আবার কেউ কড়া নাড়ছে।এবার সাথে কন্ঠ শোনা গেল।তুলি বলছে,
—‘তিথি আপু!তোমার পা কেমন?বাবা জিগ্যেস করছে।’
সম্পদ বিছানার দিকে একবার চেয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল।ছিটকিনি খুলে দিয়ে বলল,
—‘তিথি ঘুমাচ্ছে।রাতের বেলা পায়ের ব্যথায় ঘুমাতে পারেনি।ভোর রাতের দিকে ঘুমিয়েছে।’
—‘অহ!আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন ভাইয়া।টেবিলে নাস্তা দিয়েছি।’
—‘আসছি!’
—‘একটু তাড়াতাড়ি আসবেন ভাইয়া।বাবা আপনার জন্য না খেয়ে আছে।একসাথে নাস্তা করবে।দেরি হলে উনার সকালের ওষুধ মিস হয়ে যাবে।’
—‘তাহলে দেরি করে ভারী অন্যায় করে ফেলেছি।’
—‘তা করেছেন!’
তুলি ক্ষীণ হাসল।উল্টো ঘুরে কয়েক পা গিয়ে আবার ফিরে আসল।বলর,
—‘তিথি আপুরো তো সকালে ওষুধ খেতে হবে।আপনি বরং আপুকেও ডেকে দিন।খেয়ে দেয়ে আবার ঘুমাবে।’
প্রতিত্তরে সম্পদ মাথা নেড়ে বলল,
—‘হুঁ!’
তুলি হাসিমুখে চলে গেল।সম্পদ দরজাটা ভিড়িয়ে সরে দাঁড়াল এবং মনে হলো তুলি চমৎকার একটি মেয়ে।নিশান ভাগ্য গুণে চমৎকার এই মেয়েটিকে পাশে পেয়েছে।
নিশানকে সে দেখেছিল কয়েক বছর আগে।বিজনেসের কেসের সময়।কোর্টে এই ছেলেটি সিদ্দিকুর রহমানের সাথে দেখা করতে গেছিল।দুজনের চেহারায় বহুমিল না থাকলেও কিছু একটা আছে যা দেখে চট করে ধরে ফেলা যায় এরা বাবা-ছেলে!
তিথির দিকে এক পলক চেয়ে সম্পদ ওয়াশরুমে ঢুকলো।
কিছুটা সময় নিয়ে সে চোখে মুখে পানি দিল। বেসিনের আয়নায় দিকে তাকাল।রাত জাগার ফলে চোখ দুটো হালকা লাল।সে আর সময় ব্যয় করল না।ফ্রেশ হয়ে বের হল।
তিথি উঠে গেছে।সম্পদ হন্তদন্ত হয়ে কাছে গিয়ে বলল,
—‘এখন কেমন লাগছে তোমার তিথি?পা ব্যথা করছে?মাথা ব্যথা কমেছে?’
তিথি গম্ভীর কন্ঠে বলল,
—‘আমি ঠিক আছি।আপনি মুখ মুছে আসুন।আপনার কপালের চুল থেকে আমার মুখে পানি পড়ছে!’
সম্পদ মুচকি হেসে উঠে দাঁড়ালো।সে লক্ষ্য করেছে তিথিকে ঘুমন্ত দেখে যতবার ওয়াশরুমে যাবে,এসে দেখবে উঠে পড়েছে।সে টাওয়াল দিয়ে হাতমুখ মুছে বলল,
—‘এখানে বালতিতে করে পানি এনে দিই।হাত মুখ ধুয়ে নাও!’
তিথি মাথা নেড়ে না জানাল।তাকে ওয়াশরুমে যেতে হবে ইমিডিয়েটলি।সে বলল,
—‘জলদি করে বড় মা বা তুলিকে পাঠিয়ে দিন তো!দরকার! ‘
সম্পদের কপাল কুঁচকে গেল।চিন্তিত কন্ঠে বলল,
—‘আমি থাকতে তাদের কেন জ্বালাতে হবে?আমাকে বলো তিথি।কি দরকার?’
—‘আপনাকে বলতে পারবো না।আপনি ওদের কাউকে পাঠিয়ে দিন তো।’
—‘আমাকেই বলতে হবে।আমি কাউকে ডেকে দিব না।বলো,কি প্রয়োজন?’
তিথি স্থির হয়ে গেল।বেশিক্ষণ স্থির থাকতে পারল না।পেট ধরে মোচড়ামুচড়ি শুরু করল।অসহায় চোখে মুখে কাঁদো কাঁদো হয়ে সম্পদের দিকে তাকাতে সে যেন সব বুঝে গেল।হাতের টাওয়ালটা রেখে এগিয়ে এলো।অতীব সাবধানে তিথিকে কোলে তুলে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো।
আস্তে করে কোল থেকে নামাল।তিথি বেসিনে ভর দিয়ে এক পায়ে দাঁড়াল।ছোট্ট একটা টুলের উপর তিথির বাম পা রেখে সম্পদ বলল,
—‘আমি বাইরে অপেক্ষা করছি।’
বলে সে ওয়াশরুমের দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে বাইরে অপেক্ষা শুরু করলো।
(চলবে)