গল্পের নাম:প্রেম পায়রা,পর্ব ১০

গল্পের নাম:প্রেম পায়রা,পর্ব ১০
লেখনীতে:অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)

তিথি ওয়াশরুম থেকে ক্ষীণ স্বরে বলল,

—‘আমার হয়ে গেছে!’

সম্পদ দরজা ঠেলে স্বাভাবিক ভাবে ভেতরে ঢুকল।তিথি বেসিনে ভর দিয়ে দরজার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে।তার চোখ দুটো ক্রমাগত এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে।মুখে লজ্জার ছাপ স্পষ্ট।সম্পদ তাকে আরেক দফা লজ্জায় ফেলতে এক পা এক পা করে তিথির দিকে এগোল।

তিথি ভয়মিশ্রিত চোখে সম্পদের দিকে তাকিয়ে আছে।সম্পদের চোখ দুষ্টমিতে ভরপুর!সে এগিয়ে গিয়ে তিথির কয়েক ইঞ্চি সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল।কয়েক সেকেন্ড তিথির মুখের দিকে চেয়ে দু হাত প্রসারিত করে তিথির দু পাশ দিয়ে বেসিনের উপর রাখল।ঝুঁকে আরো একটু এগিয়ে গিয়ে মাঝের দূরত্ব টুকু ঘুচিয়ে ফেলল।

তিথি শুকনো ঢোক গিলে নিজের শরীরটা আরো একটু পেছন দিকে হেলে দিল।এলোমেলো সুরে বলল,

—‘ক-কি করছেন?’

তিথির মুখে বিন্দু বিন্দু জল।চোখের পাপড়ি ভেজা!মাথার খোঁপা করা চুল খসে পড়েছে।কপালের কাছে কিছু সিক্ত চুল লেপ্টে আছে।সে মুখের দিকে সম্পদ দীর্ঘক্ষণ ঘোর লাগা দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো।সম্পদের সে দৃষ্টি তিথির সহ্য হলো না।সে বাম হাত উঁচু করে সম্পদকে হালকা করে ধাক্কা দিয়ে বলল,

—‘সরে দাঁড়ান!’

সম্পদ সরলো না।তবে তার দৃষ্টির কিছুটা নড়চড় হলো।একটু তটস্থ হয়ে বাম হাতটা উঁচু করে তিথির কপালের ভেজা চুল গুলো ছুঁয়ে দিল।ফিসফিস করে বলল,

—‘ফিজিক্সের ভাষায়,কার্যকারণ ছাড়া পৃথিবীতে কিছুই ঘটে না।প্রতিটি কাজের পিছনে একটা করে কজ থাকবে।পরবর্তীতে সেই কজের ইফেক্ট পড়বে।কজ এবং ইফেক্ট!তোমার এই দূর্ঘটনার পিছনে হয়তো অদৃশ্য কোনো কারণ আছে।তার ইফেক্ট চোখের সামনে দেখতে পারছি।তুমি না চাইতেও কতটা কাছে চলে এসেছ আমার!’

তিথি চোখ বন্ধ করে টেনে শ্বাস নিল।সম্পদের কথাটাতে বিন্দুমাত্র মিথ্যে নেই।সত্যি সত্যি সে না চাইতেও সম্পদের অনেকটা কাছে চলে গেছে।এই মানুষটার মধ্যে কিছু একটা আছে।যা তাকে সব ভুলে চুম্বকের মতো কাছে টানে!মানুষটার প্রতিটি কথা,প্রতিটি কার্যকলাপ,ছোট-বড় কেয়ার গুলো বুকে অস্থির ঢেউ তুলে দেয়।সেই সাথে মনে টুকরো টুকরো অনুভূতির জন্ম দিচ্ছে।মানুষটার একটুখানি স্পর্শ তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চায় দূর থেকে সূদুরে!একদম বহুদূরে!

সম্পদের স্পর্শে তিথির ঘোর ভাঙে।সম্পদ তাকে কোলে তুলে নিয়েছে।তিথি আড়ষ্ট ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে গলা জড়িয়ে ধরতে সম্পদ দরজা ঠেলে রুমে প্রবেশ করে।খাটে হেলান দিয়ে তিথিকে বিছানায় বসিয়ে দেয়।বাম পা টা সাবধানে উঁচু করে একটা বালিশের উপর রাখে।

—‘আপনি খেয়ে আসুন!অনেক বেলা হয়েছে।’

তিথি নিচু স্বরে বলে ফেলে।তার কন্ঠ শুনে সম্পদ চোখ তুলে তাকায়।তিথির পাশে বসে বলে,

—‘তোমারও তো খেতে হবে!আগে তোমাকে খাইয়ে আমি খাব।’

—‘আমাকে খাওয়াতে হবে না।পা অকেজো।হাত নয়!’

—‘তবুও টাইমলি মেডিসিন খেতে হবে।’

—‘খেয়ে নিব।আপনাকে ভাবতে হবে না!’

—‘আমি না ভাবলে কে ভাববে?’

—‘আমার নিজের ভাবনা নিজেই ভাবতে পারি!মানুষ নিজের চাইতে কাউকে বেশি ভালোবাসে না!সো,আমার প্রতি এত দরদ দেখাতে হবে না।আমার নিজের লাইফের প্রতি আমার যথেষ্ট ভালোবাসা আছে।’

তিথির কন্ঠে কেমন কাঠিন্যতা মিশে আছে। সম্পদের কপাল কুঁচকে গেল।রাতে তো বেশ স্বাভাবিক ছিল তিথি।হঠাৎ রেগে যাচ্ছে কেন?কি সব বলছে!

সম্পদ তিথির একটা হাত চেপে ধরে বলল,

—‘কি হয়েছে?রেগে যাচ্ছো কেন?’

তিথি এক টানে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল।তার কি হয়েছে সে নিজেই জানে না!উল্টো পাল্টা কি সব বলে ফেলছে!কে বলেছে মানুষ নিজের চেয়ে কাউরে বেশি ভালো বাসতে পারে না?বছর ছয়েক আগে তাদের দুটো বিল্ডিং পরে একটা বাসার রান্নাঘরে আগুন লেগেছিল।সদ্য হামাগুড়ি দিতে শেখা বাচ্চাকে বাঁচাতে গিয়ে মা আগুনে ঝলসে মারা গেল।পৃথিবীতে কত শত ঘটনা নিত্যদিন ঘটছে।একজনকে বাঁচাতে গিয়ে আরেকজন অকাতরে প্রাণ হারাচ্ছে।নিজের জীবনের থেকে অন্যের প্রতি ভালোবাসা বেশি না থাকলে কি করে সম্ভব!

মানুষ জাতির কত গুণ!একমাত্র তাঁরা পারে নিজের জীবন তুচ্ছ করে অন্য একজনকে ভালোবাসতে।অন্য জীবের এই ক্ষমতা নেই।ক্ষমতা নেই উদ্ভিদের!

তিথির হঠাৎ কান্না পেল।সে নিজের উপর বিরক্ত।কেন নিশানকে ভালোবাসতে গেল?নিশান নিজেই তাকে স্বপ্ন দেখিয়ে মাঝপথে ছেড়ে চলে গেল!কেন তার জীবনে নিশান নামক ঝড়টা এলো?নিশানের আগে সম্পদ কেন আসল না?সে এত সহজে দ্বিতীয় বার ভাঙতে চায় না।পড়বে না নতুন করে সম্পদের প্রেমে!ভালোবাসবে না তাকে!তার মায়ায় জড়াবে না!

তিথি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না শুরু করলো।নিশানের বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠল।আরো একটু কাছ ঘেঁষে বসে চিন্তিত মুখে বলল,

—‘কান্না করছ কেন?পা ব্যথা করছে আবার?এই তিথি!’

তিথিকে চুপ থাকতে দেখে সম্পদ পরম মমতায় তার চোখের জল মুছে দিল।তিথি এক ঝটকায় সম্পদের হাত সরিয়ে বলল,

—‘আপনি একটা উদ্ভিদ!’

সম্পদের চোখে মুখে নতুন করে বিস্ময় ভর করল।তিথিকে শান্ত করার জন্য ঘন ঘন মাথা নেড়ে বলল,

—‘হ্যাঁ!একদম ঠিক বলেছ।আমি উদ্ভিদ।তা কেমন উদ্ভিদ?পরগাছা নিশ্চয়ই!অন্য একজনের আশ্রয়ে বেঁচে আছি।তাকে ছাড়া আমি অস্তিত্বহীন!সম্পদ ভ্যানিশ!’

তিথির কান্না থেমে গেল।চোখ মুছে বলল,

—‘আমার ক্ষুধা লেগেছে।’

সম্পদ মুচকি হেসে উঠে পড়ল।নিঃশব্দে দরজা ঠেলে বাইরে বের হলো।ডাইনিং এ সিদ্দিকুর রহমান বসে আছে।তার হাতে আজের খবরের কাগজ।সম্পদ কাছে গিয়ে বলল,

—‘বড় বাবা!ভেরি স্যরি।অনেক দেরি করে ফেললাম।’

সিদ্দিকুর রহমান বিস্মিত হলেন।এ যুগে এত বিনয়ী ছেলে সচরাচর দেখা যায় না।তিনি মানুষ চিনতে ভুল করেননি।এই ছেলেটাই একমাত্র তিথির উপযুক্ত।তিনি হাতের পেপার ভাঁজ করে বললেন,

—‘বসে পড়ো বাবা!কোনো সমস্যা নেই।ভোরবেলা এক কাপ চা খাওয়ার পর আমি এমনিতে অনেক দেরিতে খাই!জানো তো!নিশানের বউ তুলি মেয়েটা দূর্দান্ত চা বানায়!তিথি তাকে আমার জন্য চা বানানো শিখিয়ে দিয়েছে।’

সম্পদ চেয়ার টেনে বসে পড়লো।রেশমা রান্নাঘর থেকে বের হয়ে টেবিলে খাবার দিল।সম্পদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

—‘তিথি উঠেছে বাবা?’

—‘হুঁ!ওর খাবারটা রুমে পাঠিয়ে দিন একটু!’

তুলি রান্নাঘর থেকে প্লেট হাতে বের হয়ে বলল,

—‘আপুর খাবার আমি আলাদা করে রেখেছি।আপনি খান!আমি দিয়ে আসছি!’

তিথি প্লেট হাতে দরজার বাইরে থেকে একটা ডাক দিল।তারপর ভেতরে ঢুকল।তিথি গভীর দৃষ্টিতে তুলির দিকে তাকালো।তুলি মেয়েটা যেন পুরো মায়ায় জড়ানো!যে কেউ চট করে তার মায়ায় জড়িয়ে যাবে।নিশান ভাই এতদিনে হয়তো হার মেনেছে!

—‘বসো তুলি!’

তুলি এগিয়ে এসে তিথির পাশে বসলো।পায়ের দিকে চেয়ে বলল,

—‘আপু,তোমার পায়ের অবস্থা কেমন?’

—‘বুঝতে পারছি না।একটু বেটার হয়তো।রাতে অনেক ব্যথা করছিল!’

—‘ব্যথা উপশমের মানুষও তো সাথে ছিল!’

তুলির দুষ্টুমি ভরা কন্ঠে তিথি মিইয়ে গেল।মুখের সর্বত্র লজ্জার আভা!চকিতে তার রাতের কথা মনে পড়ল।সম্পদ তার ব্যথা উপশমের অন্য পন্থা না পেয়ে চুমু খেয়েছিল।ছি!কি লজ্জা!

নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,

—‘নিশান ভাই কি করে?’

—‘তিনি তো খেয়ে দেয়ে অফিসে চলে গেছে।’

—‘অহ!তুলি তোমার ব্যাপারে তেমন কিছুই জানি না।পড়াশোনা কত দূর তোমার? ‘

তুলি প্লেটটা এগিয়ে বলল,

—‘বলছি!তার আগে আমায় অনুমতি দাও!তোমায় নিজ হাতে খাইয়ে দিব।’

—‘তুমি খেয়েছ?’

—‘হুঁ!তোমায় খাইয়ে দিই?’

তিথি মেয়েটার ব্যবহারে মুগ্ধ হতে বাধ্য হলো।মেয়েটাকে তার ভীষণ ভালো লাগছে।জীবনে প্রথম বার একটা বোনের বড্ড অভাববোধ করল সে এবং বোনের জায়গাটা তুলি মেয়েটার জন্য বরাদ্দ করে দিল!

তুলি এক লোকমা খাবার তিথির মুখে তুলে দিয়ে বলল,

—‘আমার জন্ম অনেকটা বস্তি এলাকায়।অনেকটা বললে ভুল হবে।বস্তিই বলা চলে।বস্তির অনেক ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করতো।দুজন টিচারও ছিল।ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত বস্তিতেই মাটিতে বসে পড়েছি।অ আ ক খ শিখেছি!একটু বড় হওয়ার পর কাছের সরকারি হাইস্কুলে ভর্তি হই।ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়াশোনা করেছি।মূলত স্কুল থেকে উপবৃত্তি পেতাম।সেটার লোভেই সৎ মা স্কুলে যেতে বাধ সাধেনি!’

তিথির খাবার চিবানো বন্ধ হয়ে গেল।কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করলো,

—‘সৎ মা?’

—‘হুঁঁ!আমার নিজের মা নেই!নেই বলতে দুনিয়াতে নেই এমন না!দুনিয়াতে আছে!বেঁচে আছে।আমার ছয়-সাত বছর বয়সে সে এক কেরানির সাথে পালিয়ে গেছে।তারপর আর খোঁজ মেলেনি তার।শুনেছি বরিশালের ওদিকে গ্রামে থাকে।আমার মায়ের পেটের একা আমি!মা চলে যাওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে বাবা বস্তির এক বিধবা মহিলাকে বিয়ে করলেন।আমার সৎ মায়ের পেটের পিচ্চি পিচ্চি দুটো ভাই আছে।বুঝলে আপু,আমি বস্তি থেকে পালিয়ে এসেছি।সৎ মা আর বাবা মিলে বিশ্রী এক লোকের সাথে বিয়ে ঠিক করেছিল!সেজন্য মিরাজের কথায় পালিয়ে এলাম।’

তুলির প্রতিটি কথা তিথির মনে দুঃখের ছাপ ফেলছে।মুখের আধ চিবানো খাবার টুকু গিলে কোনো রকমে বলল,

—‘কোন মিরাজের কথা বলছ?নিশান ভাইয়ের এক বন্ধুর নাম মিরাজ।নিশান ভাইয়ের সাথে কয়েক বার এ বাড়িতে এসেছিল!’

—‘তুমি ঠিক ধরেছ।ওই মিরাজই!নিশানের বন্ধু।মিরাজের সাথে পরিচয় হয় আমার এসএসসি পরীক্ষার সময়।একে একে নয়টা পরীক্ষা শেষ!ধর্ম পরীক্ষার দিন মেইন গেট দিয়ে ঢুকে হঠাৎ করে ফাইলে চোখ গেল।দেখি এডমিট কার্ড নেই!বুকের ভেতর শীতল ঝড় বয়ে গেল যেন।হাত পা কাঁপা-কাঁপি অবস্থা।এলোমেলো ভাবে এদিক ওদিক খুঁজছি।প্রায় দৌঁড়ে যে রাস্তা দিয়ে হেঁটে এসেছিলাম সে রাস্তা দিয়ে খোঁজা শুরু করলাম।কিন্তু কিছুতেই পাচ্ছি না।

পরীক্ষা শুরুর বেশি সময় নেই।চিন্তায় পাগলপ্রায় অবস্থা আমার।হঠাৎ একটা বাইক এসে থামল সামনে।শ্যাম বর্ণের এক ছেলে এডমিট কার্ড বাড়িয়ে বলল,এটা খুঁজছ?তোমার ছবির সাথে মিল আছে।আমি প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে দৌঁড় শুরু করলাম।ছেলেটা পেছন থেকে ডেকে বলল,পরীক্ষার আর আট মিনিট বাকি!দৌঁড়ে গিয়ে ধরতে পারবে না।বাইকে উঠো!

আমি বাইকে উঠে পড়লাম।পরীক্ষা শেষে বাইরে বের হতে দেখি ছেলেটা বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।তাকে দেখে ভিড়ের মাঝে মিশে গেলাম।কিন্তু কিভাবে যেন খুঁজে বের করল।তারপর মাঝে মধ্যে দেখা হওয়া শুরু হলো।একটা সময় আমায় ভালোবাসা নিবেদন করলো।মাস ছয়েক পর আমি রাজি হলাম।ব্যস!তারপর হঠাৎ হঠাৎ আলাপ হতো।একদিন নিশানকে মিরাজ সাথে নিয়ে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল।তারপর নিশানের সাথে আর দেখা হয়নি।আমার কাছে ফোন ছিল না বলে মিরাজের সাথেও তেমন কথা হতো না।

এর মধ্যে সৎ মা বিয়ে ঠিক করলো।মিরাজকে জানাতে সে কাজি অফিসে বিয়ে করার কথা বলল।তার কথা মতো বিয়ের দিন সকালে পালিয়ে নির্দিষ্ট কাজী অফিসে আসলাম।চারটার দিকে নিশান আর মিরাজের দুটো ফ্রেন্ড আসলো যাদের মধ্যে আমি শুধু নিশানকে চিনি।মিরাজের তাড়াতাড়ি আসার কথা ছিল।কিন্তু সে আসলো না।আসলো না তো আসলোই না!রাত নটা পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করলাম।তারপরও মিরাজের দেখা মিলল না।এর মধ্যে আমি কেঁদে টেদে অস্থির।আমি সহজে কাঁদি না।এক ফোঁটা চোখের জল ফেলি না।আমার সৎ মা আমায় মারতে মারতে জখম করে দিত,আমার এক ফোঁটা চোখের জল দেখার জন্য।কিন্তু তার সে ইচ্ছে আমি কোনোদিন পূরণ করিনি।হাজারো মার খেয়ে নির্বিকার থাকতাম।

কিন্তু সেদিন ভয়েই কান্না করে দিলাম।মিরাজ না আসলে আমার কি হবে ভেবে পাগলপ্রায় অবস্থা।নিশান আমাকে আশ্যস্ত করে তার বাড়িতে নিয়ে যেতে চাইল।এর মধ্যে বাগড়া দিল একদল যুবক।আমাকে কাঁদতে দেখে হয়তো তারা কনফিউজড হয়েছিল।ভয় দেখিয়ে, জোর জবরদস্তি করে,নিশানকে দু চারটা কিল-ঘুষি দিয়ে বিয়ে পড়িয়ে দিল আমাদের।’

তুলি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফের বলল,

—‘আমাদের বস্তিতেও কিছু ছেলে-ছোকরা আছে এমন।এরা দলবেঁধে ঘুরে বেড়ায়।অনৈতিক কর্মকান্ড করে দলবেঁধে।এরাও রাস্তায় দুজন ছেলেমেয়ে একা দেখতে পেলে জোর করে বিয়ে পড়িয়ে দেয়।হয়তো ছেলেমেয়ে দুটো সম্পর্কে বন্ধু-বান্ধব বা কাজিন থাকে।কিন্তু তারা কোনো যুক্তি মানে না।আনন্দ পাওয়ার জন্য মজার ছলে এগুলো করে।এতে যে কারো কারো জীবন নষ্ট হয়ে যায় সেটা একবার ভাবে না!’

তিথির শরীর কাঁপছে।জগতের সমস্ত কথা হারিয়ে ফেলেছে যেন।একবার তুলি মেয়েটার জন্য কষ্ট হচ্ছে তো আরেকবার ভাগ্যের পরিহাসে দম বন্ধ হয়ে আসছে।সে এক হাতে বিছানার চাদর খামচে ধরে বলল,

—‘মিরাজ!মি-মিরাজ আসলো না কেন?’

—‘জানা নেই!সেদিনের পর থেকে মিরাজ আর যোগাযোগ করেনি।নিশান প্রায় প্রতিদিন মিরাজের খোঁজ করে।আমাকে না বললেও আমি বুঝি।আমার কি মনে হয় জানো?আমার মনে হয় মিরাজ আমার প্রতি মুগ্ধ ছিল।প্রথম দিন দেখে হয়তো আমার প্রতি মুগ্ধতা সৃষ্টি হয়েছিল।সে মুগ্ধতাকে ভালোবাসায় রূপ দিতে পারেনি।মুগ্ধতার স্থায়িত্বকাল অল্প।কেউ কারো প্রতি মুগ্ধ থাকলে এক সময় তার রেশ কেটে যায়।দিনশেষে ফুরিয়ে যায় মুগ্ধতা।কিন্তু ভালোবাসা ফুরোয় না।কাউকে মন থেকে ভালোবাসলে কখনো তার সুর কাটে না,রেশ কেটে যায় না।কেউ কারো কাছে পুরনো হয় না।যতদিন যায়, তত একজন আরেকজনের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।

কিন্তু আমাদের ভুল কোথায় জানো আপু?আমরা মুগ্ধতা আর ভালোবাসা এক করে ফেলি।মুগ্ধতাকে ভালোবাসা মনে করে বিয়ে করি।কিন্তু সংসার জীবনে গিয়ে একসাথে সময় কাটাতে কাটাতে,একত্রে বসবাস করতে করতে যখন মুগ্ধতা কেটে যায় তখন একে অপরের প্রতি বিরক্তির জন্ম নেয়।সময়ের ব্যবধানে সেই বিরক্তি ফুলে ফেঁপে একসময় ভয়াবহ রূপ ধারণ করে।এর পরিসমাপ্তি বিচ্ছেদে গিয়ে রূপ নেয়।

মিরাজ হয়তো শেষ মুহূর্তে গিয়ে বুঝতে পেরেছে সে আমার প্রতি জাস্ট মুগ্ধ।ভালোবাসে না আমায়!সেজন্য পিছিয়ে পড়েছে।’

তুলির কন্ঠ ভারী হয়ে এলো।তিথি ভেবেছে হয়তো কান্না করবে।কিন্তু তুলি বয়সের তুলনায় অনেক বেশি শক্ত।সে কাঁদল না।নিজেকে সামলে নিল।জোর করে আরেক লোকমা তিথির মুখে পুড়ে দিল।তিথি চিবোতে চিবোতে বলল,

—‘তুমি মিরাজকে ভালোবাসতে না?’

—‘ভালোবাসা কি জানি না!মিরাজের প্রতি কেমন ফিলিংস ছিল সেটাও জানি না।শুধু এখন জানি নিশানকে দেখে যে অনুভূতির জন্ম হয় তা সম্পূর্ণ নতুন।।এর আগে এসব অনুভূতির সাথে পরিচিত ছিলাম না।মিরাজের জন্য এমন দম বন্ধ করা অনুভূতি হতো না।এখন নিশান অফিস থেকে ফিরতে লেট করলে,খাবারে অনিয়ম করলে,তার একটু অযত্ন বা অবহেলা দেখলে ভেতরে ভাঙচুর হয়।দুমড়ে মুচড়ে যাই!জানিনা এটা ভালোবাসা নাকি বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনের বহিঃপ্রকাশ!’

তিথি নিরবে কাঁদছে।কান্নার কারণে ক্ষণে ক্ষণে তার শরীরে কাঁপুনি দিচ্ছে।তুলি বিস্ময় নিয়ে তিথির মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।তিথি হঠাৎ তুলিকে জড়িয়ে ধরলো।কিছুটা সময় নিয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে এনে বলল,

—‘আল্লাহর কালামের অনেক শক্তি তুলি।কবুল অনেক ভারী শব্দ।তিন কবুলের কাছে পৃথিবীর জাগতিক সব তুচ্ছ।একটা সময় গিয়ে ঠিক নিশান ভাই তোমার প্রেমে পড়বে,আর তুমি নিশান ভাইয়ের!তুমি সুখী হও!’

সম্পদ ঘরে ঢুকে ভড়কে গেল।গলা খাঁকারী দিয়ে নিজের উপস্থিতি বুঝাল।তিথি এক পলক বিরক্তি নিয়ে সম্পদের দিকে চেয়ে আবার তুলিকে জড়িয়ে ধরল।সম্পদ অস্পষ্ট সুরে বিড়বিড় করে বলল,

—‘আমাকে তো চোখে পড়বে না।আমি তো ভোলাটাইল মেটাল!নিজের বরকে তো চোখে পড়বে না!জানা কথা!গরুর মতো ঘাস চিবানোর জন্য বিয়ে করেছি!’

এগিয়ে এসে পানির গ্লাসটা তিথির দিকে এগিয়ে দিল। হাসিমুখে বলল,

—‘খাওয়ানো শেষ?’

তুলি তিথিকে ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো।বলল,

—‘শেষ।এবার আপনার ওষুধ খাওয়ানোর পালা।আমি আসছি!তিথি আপু, যাই আমি।’

তুলি দরজা ভিড়িয়ে চলে গেল।তিথি চোখ মুখ মুছে অন্য দিকে তাকিয়ে আছে।সম্পদ পাশে বসে বলল,

—‘তুমি এতো ছিচকাঁদুনে কেন?দুটো করে কথা বলবে,এক লিটার করে পানি খরচ করবে।’

তিথি রাগী চোখে তাকাতে সম্পদ বুকে হাত চেপে বলল,

—‘এভাবে তাকাবে না প্লিজ!এখানে জ্বলে পুড়ে যায়।’

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here