ধূসর পাহাড়,পর্ব_১৫
লেখিকা আমিশা নূর
কুয়াশা আর অরণ্যকে হুমকি দিয়ে অরিন নিচে নেমে গেলো।কিছুক্ষণ পরিবেশটা নিরব হয়ে গেলো।নিরবতা ভেঙে অধ্রী প্রশ্ন করলো,
“তোরা দুজন রিলেশনে কবে গেলি?”
“চুপ বান্দর।আমরা কেনো রিলেশনে যাবো?অরিনকে এমনি বললাম কথাটা।আর তাছাড়া আমাদের ধর্ম আলাদা ভাগ্যিস কথাটা অরিন জানে না নাহলে এতোক্ষণে তুলকালাম কান্ড করে দিতো।”
এতক্ষণে কুয়াশা’র হুস আসলো।সত্যি তো তাদের ধর্ম আলাদা।কুয়াশা যা ভাবছিলো তা তো আধোও সম্ভব না।কিন্তু অরণ্য’কে তার এতো ভাবনা কেনো?কেনো তার ভাবতেই কষ্ট হয় অরণ্য তার না?লক্ষ্য কী তার বাঝে মনটার?
“কুয়াশা?”
“হু..হু।”
কুয়াশা পেছন ঘুরে চোখের জল মুচে নিলো।সবার মধ্যে ওদের অসস্তি হচ্ছে দেখে অধ্রী বললো,
“তোরা দুজন কথা বল আমরা সামনে এগোচ্ছি।”
অধ্রীরা সামনে এগিয়ে গেলেও অরণ্য আমতা আমতা করতে লাগলো।তা দেখে কুয়াশা বললো,
“ইটস ওকে অরণ্য।”
“সরি কুয়াশা আমার জন্য হয়তো তোমার বফ..”
“আমার বফ নেই।সেদিন সামায়রা কল করেছিলো ওর বিয়ে ঠিক হয়েছে এইটা জানাতে।আর বিষয়টা নিয়ে আমি মজা করেছি মাত্র।”
“ওহ।”
“অরিনের সাথে তোমার সম্পর্কটা ঠিক বুঝিনি আমি।”
“অরিন আমার এক্স গার্লফ্রেন্ড।”
কথা বলতে বলতে ওরা উপরে উঠা শুরু করলো।একটি বাক্যে কুয়াশা সন্তুষ্ট হয়নি দেখে অরণ্য আবার বলতে শুরু করলো,
“এক বছর আগে অরিনের সাথে আমার পরিচয়। কিছুদিনের পরিচয়ে আমার মনে হয়েছিল অরিনকে আমি ভালোবাসি তাই প্রপোজও করি।রিলেশনে যাওয়ার এক মাসের মধ্যেই আমি বুঝতে পারি অরিনের প্রতি আমার এট্রাকশন ছাড়া আর কিছুই নেই।তখনই আমি ব্রেকআপ করে ফেলি আর তা নিয়ে অরিন সব সময় আমার ফ্রেন্ডসদের দোষ দেয়।এইখানে আসার পথে অরিনকে আগেই দেখতে পাই আমি যার কারণে তোমার সাথে টুপি নিয়ে ঝগড়া করি।”
অরণ্যের ব্যখ্যা শুনে কুয়াশা সন্তুষ্ট হলো।অরণ্যকে আর ভূল বুঝবে না বলে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো।হাটতে হাটতে তারা একদম উপরে উঠে এলো।প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের মাঝে কুয়াশা নিজেকে হারাতে চাইছে।
সবশেষে হিমছড়ির কৃত্রিম ঝর্ণা দেখে তারা সেই স্থান ত্যাগ করলো।
১৭.
একদল শিথল হাওয়া কুয়াশা’কে ছুয়ে দিলো।ঠান্ডায় কুয়াশা বাহু চেপে ধরলো।নাফ নদী বেয়ে দুতালা জাহাজটি ধীরগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে।জাহাজের সামনের দিকে কেউ একজন গিটার বাজাচ্ছে আর রৌদ্রময় সেই তালে গান গাইছে।কুয়াশা তাদের থেকে একটু দূরেই আছে।হঠাৎ তার মোবাইলটি ভাইব্রেট হলো।স্কিনে তাকিয়ে দেখলো মেসেঞ্জারে গ্রুপ কল হচ্ছে। মুচকি হেসে কুয়াশা গ্রুপ কলে জয়েন করলো।
“বান্দর,হনুমান,চুন্নিবিল্লি,কোকচুল্লি,গরু,মহিষ,এলিয়েন,…”
“শব্দ থেমে যা একটু।”
“কী থামবো চুন্নি?তুই আমাদের ছাড়া কক্সবাজার গেছিস কোথায় নেই তোর সাথে।”
“উফ চুপ করতো ঢংগী।তিহি কথা বলিস না কেনো?”
“মিস.রেডিও অন হয়েছে তাই আমি অফ।”
“হাহাহা।”
“একটা নিউজ জানিস?”
“কী?
” সামায়রা বিয়েতে না করে দিয়েছে।”
কথাটি শুনে কুয়াশার মুখের হাসি উধাও হয়ে গেলো।আজ সকালে যখন সামায়রা’র সাথে কথা হলো তখন তো এই বিষয়ে কিছু বলেনি।তাহলে এখন তিহান আর শব্দকে কেনো বললো?বিয়ের খবর টাও কুয়াশাকে পরেই জানানো হয়।কিন্তু কেনো?সামায়রা সব কিছু কুয়াশা’র সাথে কেনো ভাগাভাগি করে না?কেনো সামায়রা একটুও বুঝতে চাই না কুয়াশা’র মন কী চাই?কেনো সে কুয়াশা’র সাথে ফ্রী হতে পারে না?সামায়রা কেনো বুঝতে চাই না কুয়াশা শুধু তাকেই বেস্টফ্রেন্ড মনে করে!বড্ড অসহায় লাগে কুয়াশার যখন সামায়রা’র জন্য কাঁদতে হয়।
আর কোনো কথা না বলে কুয়াশা কল কেটে দিলো।তারপর ছোট্ট মেসেজে জানিয়ে দিলো সে এখন ব্যস্ত।নাহলে যে ওরা বুঝে যাবে কুয়াশা এখন কাঁদছে!চোখ থেকে দুফোঁটা জল সমুদ্রের জলের সাথে মিশে গেলো।এখন সেই চোখের জলের কোনো অস্তিত্ব নেই!ঠিক তেমনভাবে সামায়রা যখন সবার সাথে থাকে তখন কুয়াশা’রও কোনো অস্তিত্ব থাকে না তার কাছে।এসব ভেবেই কুয়াশা চোখ বন্ধ করে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলো।চোখ খুলে দেখলো কেউ একজন তার চোখের জল হাতে নিয়েছে।প্রথম বারের মতো সমুদ্রে বিলীন হওয়া থেকে রক্ষা করেছে চোখের জল’কে।
“কাঁদছো কেনো?”
অরণ্যের কথা শুনে কুয়াশা পাশ ফিরে চোখের জল মুচে নিলো।তারপর ভাঙা কন্ঠে উত্তর দিলো,”কই কিছু না তো।ধুলো পড়েছে হয়তো।”
“ওহহ”
অরণ্য জানে কুয়াশা মিথ্যা বলছে তবুও কিছু জিজ্ঞেস করলো না।তবে মেয়েটা খুবই নিখুতভাবে কাঁদতে পারে।কোনো শব্দ ছাড়া,চোখ বন্ধ করে!উফ এইটা যেনো একটা আর্ট!অরণ্যের চোখ কুয়াশার চোখেই আটকে রয়েছে।চেয়েও দৃষ্টি ফেরাতে পারছে না দুজন দুজনের চোখ থেকে।যেনো এক অদৃশ্য শক্তি তাদের একই শিকলে আবদ্ধ করে রেখেছে।
“অরণ্যওও।”
অধ্রী দ্বিতীয় বারের মতো অরণ্যকে ডেকে বিরক্ত হলো।তাই সে সরাসরি অরণ্যে সামনে গিয়ে চেচিয়ে উঠলো।
“কী হয়েছে?”
“কী হয়েছে? কখন থেকে তোদের ডেকে যাচ্ছি।ইউ আর গিভিং নো সাড়া।”
“তুই আর তোর ইংলিশ।”
ওদের দুই বন্ধুর কথোপকথন শুনে কুয়াশা হেসে ফেললো।
বন্ধু তো ওদের মতোই হওয়া উচিত!
হাসবেও ওরা কাঁদাবে ওরা!
বিপদে পাশে থাকবেও ওরা!
সবসময় ছায়ার মতো লেগে থাকবে ওরা!
একজন রাগ করলে,রাগ ভাঙাবেও ওরা!
এসব ভাবতে ভাবতে কুয়াশা সে স্থান ত্যাগ করলো।
“মেয়েটা কী অদ্ভুত তাই না অরণ্য?”
“কুয়াশা?”
“হুম।খুব ইমোশনাল।”
“হু।”
“তোর মনের কথা বলবি কখন কুয়াশাকে?”
।
জাহাজে ভিতরের সিটে বসে আছে কুয়াশা।অনা- বরত চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে।জাহাজের সব মানুষ বাইরে থাকায় তার চোখের জল কেউ দেখছে না।একটু আগে শব্দ ফোন করে বলেছে সামায়রা বিয়েতে রাজী হয়ে গেছে।প্রথমে বিয়েতে না করার কারণ ছিলো তার হবু বর ‘মাহির’!তার সাথে ঝগড়ার কারণে সামায়রা এমনটা করতে বাধ্য হয়।সব কথা সামায়রা নিজে শব্দকে বলেছে কিন্তু কুয়াশা তার বিন্দু মাত্র জানতো না।কথায় কথায় সামায়রা কুয়াশাকেই বেস্টফ্রেন্ড বলে কিন্তু তার মনের কথা সব শব্দই আগে জানতে পারে।মুখে বললেই তো আর বেস্টফ্রেন্ড হয়ে যায় না!কাজে কর্মেও তা প্রকাশ পেতে হয়!নিউ ইয়ারের দিন ও সামায়রা এমনটা করেছিলো।সব ঘটনা মনে পড়তে কুয়াশা’র কান্না আরো বেড়ে গেলো।তবে সেই কান্নার কোনো শব্দ নেই।
(চলবে)