অতঃপর প্রণয়,পর্ব:১৪

অতঃপর প্রণয়,পর্ব:১৪
অরিত্রিকা আহানা

আয়াজের জয়েনিং এর বাকি আর মাত্র চারদিন আছে। পরশু যশোর যাবে সে। এদিকে আজকে তাদের ব্যাচ থেকে খাওয়াদাওয়ার আয়োজন করা হয়েছে।সবগুলো জুনিয়র ব্যাচকে ইন্টার্ন ডাক্তাররা সবাই ট্রিট দেবে। গ্র‍্যান্ড ফিস্ট!পুরো ক্যাম্পাস সাজানো হয়েছে,কনসার্টও হবে,নামীদামী শিল্পিদের নিয়ে আসা হয়েছে,চারদিকে হৈচৈ পরিবেশ!

ইরিন জাম কালারের একটা শাড়ি পরে সুন্দর করে সেজে এসেছে,মাথায় ফুলের ক্রাউন!টুকটুকে সুন্দর লাগছে ওকে!
এসেই আয়াজকে খুঁজছে,কিন্তু তার দেখাই নেই!..উনি যেখানেই যান হাওয়া হয়ে যান। তবে আয়াজ অবশ্য ইরিনের অলক্ষে চুপিচুপি এসে কয়েকবার ইরিনকে দেখে গেছে।

ইরিন সেল্ফি তুলছে,কোথা থেকে ইত্তি এসে হাজির।উঁচু হয়ে ইরিনের মাথার ওপর দিয়ে সেল্ফি পোজ দিলো।তারপর নিজের ফোন বের করে ফটাফট কয়েকটা ছবি তুলে বলল,

—“তোর এত দেরী হলো কেন?”

—“বলবো না।”

ইরিন পার্লারে থেকে সেজে এসেছে। তাই তার দেরী হয়েছে। ইত্তি হাসলো,বেশ সুন্দরভাবে হাসলো।তারপর মিষ্টি গলায় জিজ্ঞেস করলো,

—“তুই কি রেগে আছিস?”

—“ছাগলের মত প্রশ্ন করছিস কেন?”

—“ওকে মানুষের মত প্রশ্ন করছি,…মিস তাসনিয়া ইরিন আপনি কি রেগে আছেন ?”

—-“মিস নয় মিসেস!”

—“ওকে মিসেস তাসনিয়া ইরিন এবার বলুন আপনি রেগে আছেন কেন?”

—“তুই আমার সেল্ফি গুলো সব নষ্ট করে দিয়েছিস!..আমি একটা ছবিও আপলোড দিতে পারবো না এখন!”

—“ওমা কেন?”

—“তুই বুঝবি না।যা সর,..খাম্বার মত সামনে দাঁড়িয়ে থাকিস না।

—“আমার সাথে দাঁড়ালে তোকে বাইট্টা দেখায় সেইজন্য?”

—“ইত্তি আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে।”

—“কুল,কুল,কুল!..এত হাইপার হচ্ছিস কেন?..আয় আরো কয়েকটা সেল্ফি তুলি?..তোকে নিয়ে সেল্ফি তুললে আমি সেলিব্রেটি হয়ে যাবো, আফটার অল তুই ক্যাম্পাসের চার্মিং হিরোর বউ!”

—“তোর গার্লফ্রেন্ড কই?”

—“আমাকে তো বলল পাঁচমিনিটের ভেতর আসছে।…তারপর থেকে ঘণ্টাখানেক হয়ে গেছে,এখনো আসার নামগন্ধ নেই,তোরা মেয়েরা কি যে এত সাজগোজ করিস আল্লাহই জানে!”

—“কেন সাজলে কি সমস্যা? তোর হিংসে হয়? তুই সাজবি? ”

ইত্তি আবারও হাসলো, ইরিন চোখ সরিয়ে নিলো।

—“তুই আমাকে নিয়ে পড়েছিস কেন?”

—“পড়বো! একশোবার পড়বো,আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই পড়বো, তুই একটা বলদ।”

—“আমি বলদের মত কি করলাম?”

—“বলদের মত কি করলি মানে?…তুই তো বলদই!..একেবারে অস্ট্রেলিয়ান বলদ!.শুধু বলদ না তুই একটা ছাগল!রাম ছাগল,..ব্লাক বেঙ্গল ছাগল!”

ইত্তি অনবরত হেসে যাচ্ছে,ইরিনের মুখ বন্ধ নেই,এত পরিমান কথা বলে যাচ্ছে। তার পেছনে আয়াজের এর উপস্থিতিটুকুও টের পায় নি। আয়াজ ইত্তিকে ইশারায় চুপ থাকতে নির্দেশ দিয়ে নিজে ইরিনের পেছনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। ইত্তির হাসি ক্রমাগত বাঁড়ছে।

—“ইত্তি আমি কিন্তু টেনে তোর চুল সব ছিঁড়ে ফেলবো বলে দিলাম।….তুই জানিস না তোর চেহারা বান্দরের মত!..তুই যে এমন বত্রিশটা দাঁত বের করে হাসছিস তুই জানিস তোর মুখ থেকে কি পরিমাণ বিশ্রী গন্ধ বের হচ্ছে. তুই জানিস? একেবারে পঁচা মাছের বিশ্রী গন্ধ!আমার বমি আসছে!..ওয়াক!”

সে বমি করার জন্য পেছনে ফিরতেই স্ট্যাচু হয়ে গেলো। আয়াজ লাফ দিয়ে দূরে সরে গেছে,ইত্তি অট্টহাসি ঠেকিয়ে মৃদু হেসে বলল,

—“আমি আসি আয়াজ ভাই!”

ইরিনের মুখ দিয়ে কোন কথা বেরোচ্ছে না।আয়াজ এগিয়ে গিয়ে ইত্তিকে একটা লিস্ট বুঝিয়ে দিলো।স্টুডেন্ট দের লিস্ট,কেউ বাদ পড়েছে কি না চেক করার জন্য!

ইত্তি চলে যেতেই আয়াজ ভ্রু কুঁচকে ইরিনের দিকে তাকালো। ইরিন ভ্রূজোড়া নাচিয়ে বলল,

—” এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? নজর লেগে যাবে তো।”

—“হাউ ফানি!”

—“বুঝি বুঝি হিংসে হচ্ছে না?”

—“থাক আমি কিছু বলবো না। কিছু বললে তো তুই আবার ইত্তির মত আমাকেও একগাদা কথা শুনিয়ে দিবি।”

—“লাগবে না আপনার বলা। আমি জানি আমাকে সুন্দর লাগছে।”

—“সেজেছিস তো আমার টাকা দিয়ে।”

—“আপনি আবার আমাকে টাকার খোঁটা দিচ্ছেন?”

—“হ্যাঁ দিলাম।”

—” আমার চাইতে আপনার টাকা বেশি হয়ে গেলো?”

—” অবশ্যই হলো না। আগে আমার টাকা তারপর তুই।”

—“ঠিক আছে আমি বাসায় গিয়ে আপনার টাকা আপনাকে ফেরত দিয়ে দেবো।”

—“থাক। আগে যখন মাফ করে দিয়েছি এবারের টাকাও মাফ করে দিলাম।”

ইরিম ক্রুর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ভেতরে ঢুকে গেলো ।

আয়াজ মুচকি হেসে গুনগুন করে গাইলো,

— “যখনই পড়েছে নজর, আমি তো হয়ে গেছি তোর!”

রাগে ইরিনের মাথানষ্ট হয়ে যাচ্ছে, আয়াজ তাকে আবারও টাকার খোঁটা দিয়েছে। এদিকে খোঁচা লেগে তার শাড়িও ছিঁড়ে গেছে। রাগে হল থেকে বেরিয়ে সোজা হোস্টেলের দিকে হাঁটা ধরলো সে। হোস্টেলে এসে ইরিন শাড়ি খুলে থ্রিপিস পরে নিলো।মেকাপ তুলে মুখ ধুয়ে নিলো। প্রোগ্রামে আর যেতে ইচ্ছে করছে না। হোস্টেল প্রায় ফাঁকাই, কেবল থার্ড ফ্লোরে ফার্স্ট ইয়ারের মেয়েরা আছে। খাওয়া শেষ করে তারা চলে এসেছে। তাদের কালকে পরীক্ষা আছে তাই। বাকিরা সবাই প্রোগ্রামে এটেন্ড করতে চলে গেছে।

খাওয়াদাওয়ার পর্ব প্রায় শেষ হতে চলেছে,আয়াজ পুরো অডিটোরিয়াম ঘুরেও ইরিনের দেখা পেলো না। ইরিন কি চলে গেছে নাকি?.খুঁজে পাক শুধু একবার,চড়িয়ে বেহুঁশ করে দেবে !আস্ত বেয়াদব একটা!যেখানেই যাবে তাকে পেরেশান করে ছাড়বে!

গেট দিয়ে বেরোতেই ইত্তিহাদের সাথে দেখা।সাথে মিতু। আয়াজকে দেখে লজ্জায় কাঁচুমাচু করছে। আয়াজ নিজেও অস্বস্তি নিয়ে ওর কাছে গেলো।

—“এই ইত্তিহাদ?”

—“জ্বী ভাই?…কিছু বলবেন?”

—“না মানে তোদের মেয়েরা সবাই খেয়েছে?”

—“জ্বী ভাই!…আমরা সবাই তো একসাথেই বসলাম।”

—“লিস্টের সবাই?..তুই সিউর?..কেউ বাদ পড়ে নি তো?”

—“না ভাই,আমার জানামতে তো কেউ বাদ পড়ে নি।”

—“আচ্ছা ঠিক আছে,…যা ভেতরে যা!”

আয়াজ গেট থেকে বেরিয়ে হোস্টেলের দিকে গেলো। আয়াজের ভেবে নিয়েছে ইরিন বোধহয় তার ওপর রাগ করে একা একা হোস্টেলে চলে গেছে। ইরিনের হোস্টেলের দিকে যাওয়ার পথে একটা ইটের টুকরার সাথে ধাক্কা খেয়ে নখ উলটে গেছে তার। গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে। পকেট থেকে রুমাল বের করে নখ বেধে নিলো সে।

হোস্টেলের নিচে এসে আয়াজ অনবরত ফোন দিয়ে যাচ্ছে। ইরিন ধরছে না।এবার মেসেজ টোন বেজে উঠতেই সে মেসেজ বক্সে গেলো।

—“তাড়াতাড়ি নিচে আয়!আমি অপেক্ষা করছি।”

—“আমি আসবো না। আপনি চলে যান।”

আয়াজ কোন রিপ্লাই দিলো না।মিনিট পাঁচেক ওয়েট করে অবশেষে ইরিন নিচে নামলো আয়াজ আলো থেকে সরে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ফোন টিপছে!
ইরিন কাছে গিয়ে ডাক দিলো,

—“কই আপনি?”

আয়াজ ফোন বন্ধ করে পকেটে ঢুকিয়ে নিলো।এবার আর কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না।এদিকে পুরো নিস্তব্দ!কেউ নেই!অন্ধজারে গা ছমছম করছে ইরিনের।হাতড়ে আয়াজের হাত ধরার চেষ্টা করলো কিন্তু পেলো না! আয়াজ ওর কাছ থেকে সরে দূরে দাঁড়িয়েছে।

বজ্রকন্ঠে ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—“তুই চলে এলি কেন?..হোস্টেলে একা একা কি করছিলি?”

ইরিন জবাব দেওয়ার জন্য মুখ খুললো কিন্তু কিছু বলার আগেই মুখ দিয়ে অস্পষ্টভাবে ‘আহ!’ শব্দ হলো। আয়াজ ঠাটিয়ে চড় মেরেছে তাকে।অন্ধকারে এতটা নির্ভুলভাবে কিভাবে কেউ টার্গেট করতে পারে? ইরিনের মাথা ভনভন করছে। সে আবারও কিছু বলতে নিলে আয়াজ খপ করে তার হাত টেনে ধরলো। শক্তভাবেই চেপে ধরেছে।

—“এত তেজ কেন তোর?..নিজেকে কি ভাবিস? একা একা হোস্টেলে আসলি কোন সাহসে? তোর কোন ভয় নেই?…দুনিয়াসুদ্ধ লোক ওইদিকে! তুই একা বের হয়েছিস কাকে জিজ্ঞেস করে?”

ইরিন মুখে কুলুপ এঁটে দাঁড়িয়ে আছে। থার্ড ফ্লোরে যে মেয়েরা আছে সেই কথা রাগে আয়াজকে বললো না সে। কি দরকার বলার? কোন কথাবার্তা ছাড়াই আয়াজ তাকে চড় মেরেছে। এবার মেরে ফেললেও ইরিন কিচ্ছু বলবে না। আয়াজ রাগে দাঁতমুখ খিঁচে বলল,”এই তুই চুপ করে আছিস কেন?..যা জিজ্ঞেস করেছি উত্তর দে!দে বলছি..একা হোস্টেলে বসে ছিলি কেন তুই?”

ইরিন ব্যাথায় কেঁদে দিলো। আয়াজ এবার হাতের চাপ কমিয়ে দিলো। ধমক দিয়ে বলল, “এই চুপ!একদম কাঁদবি না। কিছু হলেই চোখের পানি। একদম নাটক করবি না!”

ইরিন কান্না থামিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। সে কিছুটা শান্ত হতেই আয়াজ তার হাত ছেড়ে দিলো। একটু পরে আলতো করে ইরিনের ডানহাত ধরে জোরপূর্বক অনুষ্ঠানে নিয়ে গেলো, কিন্তু যাওয়ার পথে অসাবধানতা বশত আবার হোঁচট খেলো সে। রাগে সজোরে লাথি মারলো পাথর বরাবর। তাতে তার উলটে যাওয়া নখ দিয়ে রক্তের ফোয়ারা বইতে শুরু করেছে। তবু রাগে থামলো না। ইরিনের হাত ধরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে প্যান্ডেলের এর দিকে হাঁটছে। দ্রুত হাঁটার কারনে খুঁড়িয়ে হাটার ধরনটা বোঝা যাচ্ছে না। সারা রাস্তায় তার জুতো চুইতে রক্ত ফোঁটা ফোঁটা হয়ে পড়েছে। লাইটের আলোতে আসতেই ইরিনের হাত ছেড়ে দিয়ে বলল,

—“সোজা ভিতরে যা। আমি আসছি।”

ইরিন তখনও আয়াজের পায়ের অবস্থা খেয়াল করে নি। তার কথার প্রতি উত্তরে আগুনলাল চোখে একবার তার দিকে তাকিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলো।
হস্পটালে ঢুকে পায়ে ব্যান্ডেজ করিয়ে নিলো আয়াজ। তারা আসার আগেই খাওয়াদাওয়ার পর্ব শেষ হয়ে গেছে। একটু পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। প্লেটে করে খাবার নিয়ে ইরিনের কাছে এলো । তাকে দেখে ইরিনের বান্ধবীরা সরে দূরে গিয়ে বসেছে। ইরিনও উঠে যেতে নিলো। আয়াজ তার হাত চেপে ধরে বলল,

—“যাচ্ছিস কেন?”

—“আমি প্রোগ্রাম দেখবো।”

—“খাবার?”

—“কেন নিয়ে এসেছেন? আমি খাবো না!”

—“তোর জন্য কে এনেছে?আমি তো আমার জন্য এনেছি।”

—“তাহলে এখানে নিয়ে এলেন কেন?”

—“তুই খাইয়ে দিবি।”

ইরিন ঝাড়ি মেরে উঠে চলে যাচ্ছিলো। আয়াজের সাথে পেরে উঠলো না। আয়াজ তার হাত ধরে রেখেছে।

—“খাওয়া শেষ হলে তার পর যাবি।”

ইরিন চোখমুখ লাল করে বলল,

—” আপনি আমাকে আর একটা কথা বললে এখানে একটা সিন ক্রিয়েট হয়ে যাবে।”

—“হ্যাঁ। এই সিন ক্রিয়েট করা ছাড়া আর পারিস কি তুই?”

—“আপনি গায়ে পড়ে ঝগড়া কেন করতে চাইছেন? আমি আপনার সাথে কোন কথা বলতে চাইছি না আপনি বুঝতে পারছেন না?”

—“হ্যাঁ পারছি। কিন্তু গায়েপড়া তো তাই তুই না চাইলেও তোকে কথা বলতে হবে।”

ইরিনের মেজাজ খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে। বিনা দোষে তাকে চড় মেরেছে আয়াজ। আয়াজের সাথে বিন্দুমাত্র কথা বলতে ইচ্ছে করছে না তার। আয়াজ নিজেই ভাত মাখিয়ে তার মুখের সামনে ধরলো। ইরিনের বান্ধবীরা দূর থেকে মুখ টিপে হাসছে। ইত্তি এসেছিল আয়াজের পায়ের ব্যথার ওষুধ দিয়ে যেতে। ওষুধ আনতে তাকেই পাঠিয়েছে আয়াজ। ভেতরে ঢুকে থতমত খেয়ে আবার বেরিয়ে গেলো । ইরিন ঠেলে আয়াজের হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,

—“দরদ দেখানো লাগবে না। মেরে আমার হাড় মাংস গুঁড়া করে দিয়ে এখন এসেছেন দরদ দেখাতে?”

—“বাসায় গিয়ে তুইও আমাকে ইচ্ছেমত মারিস। এখন খেয়ে নে প্লিজ। ”

—“বললাম তো আমি খাবো না।”

—“লক্ষ্মী মেয়ে না তুই?”

ইরিন মুখ ফিরিয়ে বসে রইলো। আয়াজ হাতের প্লেট রেখে ইরিনের বাম হাত দিয়ে ইরিনের ডানহাতটা টেনে নিজের হাতের মুঠোয় নিলো। ইরিন আবারও ঝাড়া মেরে
ফেলে দিলো। বললো,

—“আমি খাবো না।”

—“না খেলে এখাম থেকে উঠতে পারবি ন।”

ইরিন জবাব দিলো না। আয়াজ ভাত মাখিয়ে বলল,

—“হাঁ কর?”

—“এবার আমি ছুঁড়ে ফেলে দেবো সব।”

বলতে দেরী ইরিনের ছুঁড়ে মারতে দেরী হয় নি। আয়াজ হতবম্ভ হয়ে নিচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা খাবারের দিকে তাকিয়ে আছে। আর অনেকগুলো চোখ তাদের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। ইরিনের দিকে তাকিয়ে বলল,

—“খুশি?”

ইরিন মৌনমুখে বসে রইলো। আয়াজ আয়াকে খাবার গুলো পরিষ্কার করতে বলে আরেক প্লেট খাবার নিয়ে এলো। নতুন করে খাবার মাখিয়ে ইরিনের মুখের কাছে ধরে বলল,

—“হাঁ কর।”

ইরিন জেদ বজায় রেখে বসে রইলো। আয়াজ প্লেট নামিয়ে কিছুক্ষন স্থির ভাবে ইরিনের মুখের দিকে চেয়ে রইল। ইরিনের চোখে পানি।আবারও ইরিনের মুখের সামনে খাবার তুলে ধরে অনুরোধের সুরে বলল,

—“দয়া করে হাঁ কর ইরিন।”

ইরিন হাঁ করলো না তো করলো না। আয়াজ সবার অলক্ষে তার গালে একটা চুমু খেয়ে পুনরায় অনুরোধের সুরে বলল,

—“কি করতে হবে বল? তোর পা ধরে মাফ চাইতে হবে? ”

ইরিন চমকে উঠে এদিক ওদিক তাকালো। এবার হাঁ করে লোকমাটা মুখে নিলো সে। আয়াজ তাকে খাইয়ে দিচ্ছে সে চুপচাপ খাচ্ছে। খাওয়া শেষ করে আয়াজ তার মুখ মুছিয়ে সাংস্কৃতিক প্রোগ্রামের দিকে নিয়ে গেলো। ওদেরকে বেরোতে দেখে ইত্তি হাতে ওষুধের প্যাকেট নিয়ে ওদের দিকে এগিয়ে দিলো। ওষুধ দেখে ইরিন জিজ্ঞেস করলো,

—“কি হয়েছে ইত্তি? ওষুধ কার জন্য?”

—“তুই জানিস না?”

ইত্তি অবাক হয়ে একবার আয়াজের দিকে একবার ইরিনের দিকে তাকালো। ইরিন অবাক হয়ে বলল,

—“কি?”

আয়াজ বলল,

—“কিছু না। তুই ইত্তির সাথে প্যান্ডেল গিয়ে বয়। আমি আসছি।”

ইরিন নড়লো না। গোঁ ধরে বলল,

—“ওষুধ কার জন্য?”

—“আমার জন্য। হোঁচট খেয়ে পা কেটে গেছে।”

ইরিন আয়াজের পায়ের দিকে তাকালো। পায়ের ব্যান্ডেজের ওপর দিয়েও খানিকটা রক্ত লেগে আছে। এই জন্যই আয়াজ তাকে নিয়ে বেরোনোর সময় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাটছিলো। ইত্তি চলে যাচ্ছিলো ইরিন পুনরায় তাকে ডাক দিয়ে বলল,

—“তুই একটা রিক্সা জোগাড় করে নিয়ে আয় তো।আমরা এখানে অপেক্ষা করছি। ”

আয়াজ বলল,” কেন?”

—“কেন আবার? বাসায় যাবো।”

—“অনুষ্ঠান?”

—” এই পা নিয়েও আপনার অনুষ্ঠান দেখার এত শখ?”

—“আমি আমার কথা বলছি না। তুই থাকবি না?”

ইরিন জবাব না দিয়ে ইত্তিকে রিক্সা আনতে পাঠিয়ে দিলো। ইত্তি রিক্সা নিয়ে আসতেই দুজনে রিক্সায় উঠে পড়লো। রিক্সায় উঠেই পায়ের ব্যথায় আয়াজের জ্বর চলে এসেছে। ইরিনের কাধে মাথা রেখে চুপচাপ বসে রইলো সে। ইরিন প্রথমে সরিয়ে দিতে চাইলো, কিন্তু জ্বর এসেছে বুঝতে পেরে চুপ করে গেলো। আয়াজ আবারও ইরিনের গালে চুমু খেয়ে বললো,

—“হরিণ আমার। তুই আমাকে ধাক্কা দিয়ে রিক্সা থেকে ফেলে দে কিন্তু এমন রাগ করে থাকিস না প্লিজ।”

ইরিন বিরক্ত কন্ঠে বলল,

—“আবোলতাবোল না বকে চুপচাপ আমাকে ধরে বসে থাকুন। ”

আয়াজ কিছুক্ষন নিরব থেকে হঠাৎ ইরিনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,

—“তুই কি নিষ্ঠুর রে ইরিন? একা একাই খেয়ে নিলি? আমি যে খেলাম না একবারও তো জিজ্ঞেস করিস নি!”

আয়াজ জ্বরের ঘোরে ছোট বাচ্চাদের মত ঢং করে কথা বলছে। ইরিন প্রথমে বুঝলো না। মুখ বাকিয়ে বলল,

—“খান নি কেন? আমি আপনাকে নিষেধ করেছি?”

—“তুই আমাকে জিজ্ঞেস করলি না কেন? আমি কতবার তোর মুখের দিকে তাকিয়েছি তুই জানিস? তুই একবারও আমাকে খেতে বললি না। ”

—“ঢং।”

আয়াজ তার কাধ থেকে মাথা সরিয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বসে রইলো। ইরিনের মায়া হচ্ছে। অসুস্থ মানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে কোমল কন্ঠে বলল,

—“এদিকে ফিরুন।”

—“না।”

—“না ফিরলে আমি আপনার সাথে আর কথা বলবো না।”

আয়াজ মুখ ফিরালো। ইরিন তার কপালের আউলাঝাউলা চুলগুলো গুছিয়ে দিয়ে বলল,

—“বাসায় গিয়ে আমি নিজ হাতে আপনাকে খাইয়ে দেবো। ঠিক আছে?”

—“দিবি তো?”

—“দিবো। এবার চুপ করে বসে থাকুন।”
.
.
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here