অতঃপর প্রণয়,পর্ব:১০,১১

অতঃপর প্রণয়,পর্ব:১০,১১
অরিত্রিকা আহানা
পর্ব:১০

একটু পর আবার ফিরে এলো ইরিন।আয়াজ তখন উপুড় হয়ে শুয়েছিলো।ইরিনের গলার আওয়াজ পেয়ে সামনে ঘুরলো।ইরিন ইতস্তত করে বলল,

—“একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?”

আয়াজ মোটামুটি আন্দাজ করে নিয়েছে ইরিন কি জানতে এসেছে।হেয়ালি করে বলল,

—“শুধু একটা?”

ইরিন প্রসঙ্গ পাল্টাতে দিলো না।সরাসরি প্রশ্ন করলো সে,

—“আপনি হুট করে এখানে কেন এসেছেন আয়াজ ভাই? আপনি কি আগে থেকেই জানতেন আমি বিয়েতে আসছি? কিন্তু কীভাবে? কার কাছ থেকে?”

আয়াজ হাসলো।রহস্যজনক হাসি।ইরিন ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছে।

—“কি হলো? চুপ করে আছেন যে?”

আয়াজ টেবিলের পাশে রাখা তার ফোনটা ইরিনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

—“চার্জে লাগিয়ে দে তো।”

ইরিন হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিলো। কিন্তু সাথে সাথে কানেকশন দিলো না। বলল,

—“আমার উত্তর?”

—“আমি জানি না।”

—“আপনি তাহলে বলবেন না?”

ইরিন রেগে গেলো।আয়াজ আবারও হাসলো।হাসি হাসি মুখে বলল,

—“তোর এত কৌতুহল কেন? তুই আমাকে রিকোয়েস্ট করেছিলি আমি যেন তোর এখানে আসার কথা আন্টিকে না জানাই,আমি জানাবো না বলেছি।বাকি কে,কি,কেন এলো এসবের তোর কি দরকার?”

—“এর মানে কি দাঁড়ালো? আপনি আমাকে বলবেন না তাইতো?”

—“ইয়েস।নাউ গো ফ্রম হিয়ার।”

ইরিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোনটা চার্জে লাগালো।আয়াজের মুখ থেকে কোন কথা বেরোবে না সে ভালো করে বুঝে গেছে।ফোন চার্জে লাগিয়ে বেরিয়ে এলো।

আয়াজ হাসলো।ইরিন বড্ড বোকা।সে জানে না,তার বিশ্বস্ত বন্ধু ইত্তিহাদই আয়াজের ইনফর্মার।অসম্ভব ভালো একটা ছেলে।সে-ই ইরিনের লুকিয়ে লুকিয়ে বিয়েতে এটেন্ড করার ঘটনা আয়াজকে জানিয়েছে।পরিবারের কাউকে না জানিয়ে ইরিনের একা একা বন্ধুদের সাথে বেরিয়ে পড়াটা ইত্তি সমর্থন করতে পারে নি।যদিও সে মনে প্রানে চাইছিলো ইরিন তাদের সাথে যাক।কিন্তু কাউকে না জানিয়ে যাওয়াটা রিস্কি।বিপদ আপদের কোন সময়জ্ঞান নেই।কখন কি হয়ে যায় বলা যায় না।তাই অবশ্যই ফ্যামিলি মেম্বার দের কাউকে জানিয়ে যাওয়া উচিৎ।ইরিনকে অনেক বুঝিয়েছে সে।কিন্তু ইরিন কিছুতেই বাসায় জানাবে না।অবশেষে বাধ্য হয়ে আয়াজকে খবরটা দিলো সে।আয়াজের সাথে তার ভালো সম্পর্ক।এমনকি ইরিনের সাথে আয়াজের বিয়ের কথাটা একমাত্র তাকেই জানিয়েছে আয়াজ।


বিয়েতে খুব সাজলো ইরিন,একেবারে জমকালো সাজগোজ! লাল টুকটুকে লেহেঙ্গার সাথে ম্যাচিং গোল্ডেন স্টোনের গয়না!ভারী মেকাপ, বেশ গর্জিয়াস লাগছে ওকে।ইতিমধ্যে অনেকের কাছ থেকেই প্রশংসামূলক অনেক কিছু শুনে ফেলেছে সে।

সোহাগ ছেলেটাকে আয়াজের সুবিধার লাগছে না,রিতুর খালাতো দেবর,এসেছে থেকেই ইরিনের ওপর চোখ! চোখে চোখে রাখতে হবে ব্যাটাকে।

একটুপরই শোরগোল শুরু হলো।বর এসে গেছে ইরিন ফুলের ডালা নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠছিলো,অসাবধানতাবশত সোহাগের সাথে ধাক্কা খাওয়ায় ফুল সব দুজনের মাথার পড়ে,ইরিনের ওড়নাটা হিন্দি ফিল্মের নায়িকাদের মত সোহাগের বাহুতে আটকে যায়।

আর তখনই সিঁড়ি দিয়ে নামছিলো আয়াজ!..পড়বি তো পড়,একেবারে মালির ঘাড়ে?

ইরিন ভয়ার্ত দৃষ্টিতে আয়াজের দিকে তকিয়ে আছে।আয়াজ একমুহূর্ত চেয়ে থেকে পাশ কাটিয়ে নেমে গেলো!!
সোহাগের মুগ্ধতার সাগর তখন আবেগে টইটুম্বুর!!
মোহনীয় দৃষ্টিতে ইরিনের দিকে তাকিয়ে আছে সে।ইরিনের মেজাজ বিগড়ে গেলো।কিন্তু সেটা সোহাগের চোখে ধরা পড়লো না।

আসার পর থেকেই মেয়েটিকে ওর ভালো লাগে।এমনিতেই বাসায় ওর বিয়ের কথাবার্তা চলছে।
তার দৃঢ় বিশ্বাস ওর মত হ্যান্ডসাম,বিসিএস কেডার প্রফেসরকে যে কোন মেয়ের বাবাই জামাই বানাতে রাজী হয়ে যাবে।
তাই আগে খানিকটা বাজিয়ে দেখতে চাইছে ইরিনকে।

ইরিনের মুখ খুলতেই ওর আবেগের সাগর নিমিষেই মরুভূমির মত শুকিয়ে গেলো।

—“চোখ পকেটে রেখে হাঁটছিলেন??…সব ফুল পড়ে গেলো!…হাঁ করে আছেন কেন?..মুখ বন্ধ করুন!”

—“এভাবে কথা বলছো কেন?..মেয়েদের কথা হবে নমনীয়,এমন কর্কশ নয়।”

—“আপনি আমার কে লাগেন যে আমি আপনার সাথে লুতুপুতু গলায় কথা বলবো?”

—“অপরিচিত কারো সাথে ভদ্রভাবে কথাবলা নরমাল ম্যানার্স এর মধ্যে পড়ে।”

—“আর অপরিচিত একজন মেয়েকে তুমি বলা?…রামছাগল!”

ইরিন গটগট করে চলে গেলো।সোহাগ দাঁত খিঁচড়ে দাঁড়িয়ে আছে।
কতবড় সাহস হাটুর বয়সী একটা মেয়ে ওকে রাম ছাগল বলে গেলো?..ওর মত ব্রিলিয়ান্ট একজন প্রফেসর এর এই মর্যাদা?..দেশ আসলেই রসাতলে যাচ্ছে!


ইরিন স্টেজে বউয়ের পাশে বসে ছিলো।ইত্তি এসে তার পাশে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলল,

—“তোকে আয়াজ ভাই ডাকছে।”

—“কেন?”

—“আমি জানি না।আমাকে বলেছে তোকে ডেকে নিয়ে যেতে।”

ইরিন চারপাশে চোখ বুলালো।স্টেজ থেকে কিছুটা দূরে আয়াজ ফোনে কথা বলছে।ভালো করে খেয়াল করলো সে।আয়াজের মুড কি ঠিক আছে? সে কি ইরিনের ওপর রেগে আছে? সোহাগ গাধাটা এখনো ইরিনের পিছু ছাড়ছে না।স্টেজের পাশে ঘুরঘুর করছে।ইরিন বিরক্ত হয়ে উঠে আয়াজের কাছ চলে গেলো।

আয়াজ সরাসরি ইরিনের দিকে তাকিয়েই কথা বলছে।অস্বস্তি লাগছে ইরিনের। ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে রইলো।আয়াজের মতিগতি কিছু বোঝা যাচ্ছে না।ভয় লাগছে তার!সকালের ঘটনার জন্য আয়াজ কি এখন তাকে বকাঝকা করবে?..উফফ!কেন এই বিয়েতে এসেছিলো সে?..আসার পর থেকেই একটা না একটা গ্যাড়াকলে ফেঁসেই যাচ্ছে।আয়াজ ফোন রেখে শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

—“সোহাগ তোকে কি বলেছে?”

—“কোন সোহাগ?”

—“যাকে তুই ফুল দিয়ে বরণ করেছিস,সেই সোহাগ!”

—“আই লাভ ইউ!”

—-“কী?”

—“আই লাভ ইউ।”

আয়াজ হতবম্ভ হয়ে চেয়ে রইলো।ধীরে ধীরে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তার।চাপা কন্ঠে বলল,

—“ইরিন আমি তোর সাথে মজা করছি না।আমি জানতে চাইছি সোহাগ তোকে কি বলেছে?”

—“আই লাভ অউ।”

—“ইরিন শেষবারের মত জিজ্ঞেস করছি,এবার কিন্তু ঠাস করে গালে একচড় বসিয়ে দেবো।”

—“কি আশ্চর্য আয়াজ ভাই? আপনি কানে শুনতে পান না? আমি কতবার করে আপনাকে বলছি,সোহাগ আমাকে আই লাভ ইউ বলেছে।তাও আপনি আমার ওপর রাগ দেখাচ্ছেন? এর মানে কি?”

—“ফালতু কথা বলবি না একদম।ও তোকে প্রথম দেখাতেই আই লাভ ইউ বলতে যাবে কেন? তুই আমার সাথে মশকরা করিস?”

—“প্রথম দেখাতে কে বলল? সে নাকি আমাকে স্বপ্নে দেখেছে।আমি নাকি তার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যার মত সুন্দরী!”

—“ইরিন? আমার সহ্যের সীমা অতিক্রম করিস না।”

—“সত্যি বলছি তো।বিশ্বাস হচ্ছে না? আপনাকে ছুঁয়ে বলবো?”

—“তুই কি এখানে এসেও আমার হাতে মার খেতে চাস? এখন যদি আমি তোর গালে কষে একটা চড় লাগাই,তারপর কি বলবি? আয়াজ ভাই খারাপ,আয়াজ ভাই জঘন্য,আয়াজ ভাই অসভ্য…..”

—“আপনি তো খারাপই।আপনাকে ভালো বললো কে?”

—“তুই বলবি না সোহাগ তোকে কি বলেছে?”

ইরিন না-সূচক মাথা দোলালো।দুষ্টু হেসে বলল,

—“আপনিও তো আমাকে বলেন নি,আপনি কার কাছ থেকে আমার বিয়েতে আসার খবর পেয়েছেন? তাই আমিও বলবো না।”

ইরিন ওড়না দোলাতে দোলাতে চলে গেলো।আয়াজ চোখমুখ লাল করে বসে আছে।তার ধারণা ভুল।এই মেয়ে মোটেও বোকা নয়।হাড়ে হাড়ে শয়তান!
.
.
চলবে

অতঃপর প্রণয়
অরিত্রিকা আহানা
পর্ব:১১

ঘটনা এতদূর গড়াবে ইরিন স্বপ্নেও ভাবে নি।মাস তিনেক বাদে সোহাগ বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে। হাদারাম লোকটাকে এত অপমান করার পরেও বেহায়ার মত আবার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। বিয়ে বাড়িতে তো কম অপমান করেনি তাকে।
একে একটা শিক্ষা দিতে হবে সেই সাথে আয়াজকেও। মনে মনে ফন্দি এঁটে নিলো সে।মায়মুনা বেগম যতই না করতে চান ইরিন ততই উৎসাহ দেখায়। অবশেষে মায়মুনা বেগমকে তার সিদ্ধান্ত জানালো। বিয়ে করলে সোহাগকেই করবে। মায়মুনা বেগম অস্থির হয়ে হেলাল সাহেবের সাথে আলাপ করেছেন। হেলাল সাহেব হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন। উনার ধারণা ইরিন আয়াজের সাথে ঝগড়া বাধিয়ে এমন কথা বলছে। কিন্তু মায়মুনা বেগম তো নিজের মেয়েকে চেনেন। উনার পেটের হলে কি হবে, আগাগোড়া শয়তানিতে মোড়া। দুশ্চিন্তায় উনার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।

এদিকে আয়াজের ইন্টার্নি শেষ!বিসিএসও হয়ে গেছে।পনেরো দিন পর জয়েনিং!বেসরকারি একটা হস্পিটালে ডিউটি ডাক্তার হিসেব জয়েন করেছে আপাতত।সকাল দশটায় বেরোয় ফিরে রাত নয়টায়।সারাদিন আর বাসায় আসা হয় না।

আজকে ডিউটি শেষে বাসায় ফেরার সময় লিফটে ইরিনের সাথে দেখা হয়ে গেলো ওর।হাতে একগাদা শপিং ব্যাগ,সাথে ওর কাজিনরা। আয়াজের সাথে চোখাচোখি হতেই চোখ সরিয়ে নিলো। আয়াজও এত লোকের মাঝখানে কিছু জিজ্ঞেস করলো না।

রাতে খেতে বসে মুক্তা জানালো আগামী কাল ইরিনের গায়ে হলুদ!আয়াজ হাত মন্থর হয়ে গেলো,প্লেটের চারপাশে আঙ্গুল বোলাচ্ছে আর ভাবছে,ইরিন কি সত্যি সত্যি বিয়ে করছে?..আশ্চর্য!ওকে একটাবার জানালোও না?
খাওয়া ছেড়ে উঠে গেলো সে। তার খানিকক্ষণ বাদে মায়মুনা বেগম ওদের ফ্ল্যাটে এলেন আয়াজের সাথে পরামর্শ করতে। সব শুনে আয়াজ কিছুই বললো না। কেবল শান্তকন্ঠে বললো,

—“ওর যা ইচ্ছে ওকে করতে দিন আন্টি।”

অনেক রাত পর্যন্ত মায়মুনা বেগম আয়াজদের ফ্ল্যাটে বসে ছিলো। কিন্তু কোন সুরাহা করতে পারে নি। ইরিনের বাবা না থাকলে মেরে পিঠের চামড়া তুলে ফেলতেন উনি। বদ মেয়ে, নিজের বিয়ের পাত্র নিজে ঠিক করেছে। বেহায়ার মত আবার শপিং নিজে করছে।

পরেরদিন সকালে আয়াজ আর থাকতে পারলো না। ফ্রেশ হয়ে সোজা ইরিনদের ফ্ল্যাটে গেলো। ইরিন তখন মাত্র শাওয়ার দিয়ে বেরিয়েছে।আয়াজকে দেখেই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—“কি ব্যাপার আয়াজ ভাই?..আপনি আমার রুমে?..জানেন তো আজকে আমার হলুদ কালকে বিয়ে।কে কোনখান দিয়ে দেখে ফেলে..এভাবে আমার রুমে আসাটা আপনার একদমই ঠিক হয় নি।”

——-“তুই যে একটা ম্যানিয়াক পেশেন্ট তুই জানিস?”

——“না তো?..তাই নাকি?..আপনি প্লিজ কাউকে কিছু বলবেন না আমার বিয়ে ভেঙ্গে গেলে সর্বনাশ!..অনেক কষ্টে আমার জন্য একটা ভালো পাত্র জোগাড় হয়েছে।বিসিএস কেডার, কে জানেন?..সোহাগ!.. চিনেছেন? রিতুর খালাতো দেবর,যাকে আমি ফুল দিয়ে বরণ করেছিলাম,সেই সোহাগ! ”

আয়াজ রাগে ফেটে যাচ্ছে। বিয়ে বাড়িতে ইরিনকে সোহাগের ব্যাপার নিয়ে অনেক কথা শুনিয়েছে আয়াজ। তাই বলে ইরিন এভাবে শোধ নিবে সে ভাবতেই পারে নি।
ফট করে ইরিনের চুলগুলো মুঠোয় নিয়ে বলল,

—“তুই আমার সাথে তেজ দেখাচ্ছিস?..আমি তোর তেজের ধার ধারি?..এতবড় সাহস তোর হলো কি করে? বিয়ে করার খুব শখ হয়েছে না?

—“হয়েছে তো। খুব শখ হয়েছে। রিতুর বিয়ে দেখে আরো বেশি করে হয়েছে। আপনিও করে ফেলুন। বয়স তো আর কম হয় নি।”

—” চুপ বেয়াদপ।”

—“এখানে বেয়াদপির কি হলো?”

আয়াজ হতাশ হয়ে বলল,

—“আমি আগে জানলে তোকে মানসিক ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতাম।”

—“আপনি বসবেন না বেরোবেন?”

আয়াজের রাগ ক্রমাগত বাড়ছে,সে এত রাগ দেখাচ্ছে অথচ ইরিনের ভাব দেখে মনে হচ্ছে কিছুই হয়নি,ওর বিয়ের দাওয়াত খেতে এসেছে আয়াজ! রাগ সামলানোটা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। এইমুহূর্তে ইরিনের সামনে থেকে চলে যাওয়াটাই উত্তম। ইরিনকে ছেড়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলো সে।

মায়মুনা বেগম ঘর আটকে বসে আছে। তার মেয়ে এভাবে সবার সামনে তাকে ছোট করবে তিনি ভাবতেই পারেন নি। হেলাল সাহেবের সামনে যেতে উনার লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে। গতকাল সোহাগের বড় বোন এসে ইরিনকে আংটি পরিয়ে গেছে। তিনি হাঁ হয়ে বসে ছিলেন। মেহমান এলে তো আর তাকে ঘাড় ধরে বের করে দেওয়া যায় না? অবশেষে ওরা চলে গেলে ইরিনকেই ডেকে বললেন,

—“তোর সাথে আয়াজের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে সেটা কি তুই জানিস?

ইরিন রীতিমত আকাশ থেকে পড়লো। মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল রক্তস্রোত বয়ে গেলো। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না সে। খুশিতে লাফিয়ে উঠতে মন চাইছে। মনে হচ্ছে পাগল হয়ে যাবে সে। কিন্তু প্ল্যান? সোহাগকে তো একটা শিক্ষা দিতে হবে। আজকে হলুদের প্রোগ্রামের আয়োজনও হয়ে গেছে।ইরিনের ইচ্ছে ছিলো হলুদ অনুষ্ঠান করে একটু মজা নিবে সোহাগের সাথে। তারপর বিয়ের দিন ফোন বন্ধ করে কোন এক বান্ধবীর বাসায় উঠবে। সেই সাথে আয়াজেরও একটা শিক্ষা হয়ে যাবে। তার দৃঢ় ধারণা আয়াজ তাকে ভালোবাসে। কিন্তু স্বীকার করছে না। কিন্তু এখন যখন আয়াজের সাথে তার বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়ে আছে তখন সোহাগকে একটা শিক্ষা দেওয়াই যায়। তাই ইত্তিহাদের সাথে পরামর্শ করে বাসার কাউকে কিচ্ছু জানালো না সে।

এদিকে সব কথা খুলে বলার পরেও মেয়ের সাহস দেখে মায়মুনা বেগম অবাক হয়ে যাচ্ছেন। তিনিও মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন, এর শেষ তিনি দেখে ছাড়বেন। করুক সোহাগকে বিয়ে ইরিন। তিনি আর কিচ্ছু বলবেন না।

সন্ধ্যার দিকে আয়াজ সেজেগুজে ছাদে এসে হাজির হলো,এসেই হুলস্থূল!..চারদিকে ছোটাছুটি দৌঁড়াদৌঁড়ি, ইরিনের বিয়ের সব দায়িত্ব যেন সে একাই নিয়েছে।ইরিন হাঁ করে শুধু তার কান্ড দেখে গেলো।ইরিনের কাজিনগুলোর সাথে আয়াজের মাখামাখি দেখে গা শিরশির করে উঠলো তার,ইচ্ছে করছে স্টেজ থেকে নেমে সবকটার গালে চুনকালি মাখিয়ে দিতে!..আর আয়াজ?..ওকে তো গোবরপানিতে চুবাতে মন চাইছে, ইরিন সামান্য একটু হাত ধরলে তার হাতে যেন ফোস্কা পড়ে যায় ,অথচ এখন মেয়েগুলোর সাথে দিব্যি ফষ্টিনষ্টি করছে,ছিহ!ডা.আয়াজ রহমান!ছিহ!এই আপনি?..এই আপনার ভালোমানুষি?

মজার ব্যাপার হচ্ছে মুরুব্বি গোছের কেউই নেই।এমনকি ইরিনের বাবাও নেই। ইরিনের কাজিনরা,বন্ধুবান্ধব এরাই মজা করছে।ইরিনের সন্দেহ হচ্ছে আয়াজ কি কোনভাবে তার প্ল্যান সম্পর্কে জেনে গেছে? এত নির্লিপ্ত থাকছে কি করে সে? আয়াজকে রাগাতে কি উলটো ইরিনের মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। ছাদ থেকে নেমে সোজা মায়মুনা বেগমের ঘরের দিকে গেলো সে।মায়মুনা বেগম হাই পাওয়ারের ওষুধ খেয়েও প্রেশার কন্ট্রোল করতে পারছে না।এই মেয়ে শক দিয়ে দিয়ে উনাকে মেরে ফেলবে! কি পেয়েছে টা কি সে?..সে যা বলবে তাই হবে?..কলেজে উঠার পর থেকেই এই মেয়ের লাগামছাড়া চালচলন শুরু হয়েছে,দিনদিন বাড়ছে তো বাড়ছে!…কত বড় স্পর্ধা বিয়ের সব আয়োজন করে,হলুদ প্রোগ্রাম করে এখন বলছে বিয়ে করবে না?..উনি কিছুতেই রাগ সামলাতে পারছেন না।ঘাড়ের রগ চিনচিন করছে,এই মেয়ে উনাকে কবরে নিয়ে শান্তি পাবে। ঠাস করে চড় মারলেন ইরিনের গালে। ঠেলে ঘর থেকে বের করে দিলেন ওকে।

প্রচন্ড রাগে সে কিছু বলার আগেই সোহাগই তাকে গড়গড় করে অনেক কিছু শুনিয়ে দিলো। সোহাগ যা বলল তাতে ইরিনের আর কিছুই করা লাগলো না। সোহাগের পক্ষ থেকেই বিয়ের জন্য না করে দেওয়া হলো। কেন সেটা ইরিনকে বলা হলো না।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে গুনগুন করছে ইরিন। বিয়েটা ভেঙ্গে গেছে,কি কারনে ভেঙ্গেছে সেটা ওর কাছে ইম্পরট্যান্ট জানে না,ভেঙ্গেছে এই এটাই ইম্পরট্যান্ট!

আয়াজ কফি নিয়ে বারান্দায় দাঁড়ালো। ইরিন গলা চড়িয়ে ডাক দিয়ে বলল,”আমার বিয়ে ভেঙ্গে গেছে আয়াজ ভাই!”

—“জানি, কিন্তু তুই এত খুশি কেন?..বিয়ে বিয়ে করে তো পাগল হয়ে গেছিলি?..এখন কি হলো?

—“কি যে বলেন না আপনি?..আমি ভীষণ দুঃখিত হয়েছি,সকাল থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে কেঁদেছি,ওয়াশরুমে ঢুকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছি,দুঃখে আমার কলিজাটা ফেটে যাচ্ছে,কত ভালো ছিলো সোহাগ মিয়া মানুষটা!..তার সাথে বিয়ে হলে আমার জীবনটা আনন্দে ভরে যেত!…কি থেকে কি হয়ে গেলো বলুন তো?”

———“তুই আমার সাথে ফাজলামো করছিস?”

ইরিন জিভ কেটে না বোঝালো।

——“ছি!ছি!..আপনি আমার গুরুজন আপনাকে আমি বড় ভাইয়ের মত শ্রদ্ধা করি!..আপনার সাথে কেন ফাজলামো করবো?..তাছাড়া সোহাগকে নিয়ে ফাজলামো করা যায়?..ও কি ফাজলামো করার মত ছেলে?..প্রফেসর মানুষ!”

আয়াজের ইচ্ছে করছে গরম কফিটা ইরিনের গলায় ঢেলে দিতে,ওর এইসব গা জ্বালানো কথাবার্তা বন্ধ হবে!

—“আমার এত বড় সর্বনাশ কে করলো আয়াজ ভাই?..আল্লাহ তার বিচার করবে!..তার বিয়ের আগেই বউ মরে ভূত হয়ে ঘাড় মটকাবে!…সে জীবনেও…!”

—“চুপ!…বেয়াদব!তোর সাথে কে কথা বলছে?..কান ঝালাপালা করে দিয়েছিস!তখন থেকেই বাচালের মত বকবক বকবক করেই যাচ্ছিস,থামাথামি নেই।!

—“আপনি রাগ করছেন কেন? আমি মনের দুঃখ থেকে বলছি,আপনাকে বলছি নাকি?..আপনি কি আমার বিয়ে ভেঙ্গেছেন?”

—“আমার আর খেয়ে দেয় কাজ নেই আমি তোর বিয়ে ভাঙবো!..তুই যাদের জন্য সেজেগুঁজে কলেজে যেতি তাদের ভেতর কেউই হয়ত এই আকাম করেছে, আমার এখন মাথার ঘায়ে কুত্তা পাগল অবস্থা তোর এইসব নিয়ে ভাবার সময় আছে?..এইতো নেক্সট উইকে জয়েন করতে হবে!..তুই আছিস তোর তালে!”

আয়াজ ভেতরে চলে গেলো। ইরিন হাসছে। তার দৃঢ় ধারনা বিয়েটা আয়াজই ভেঙ্গেছে। বাস্তবিকই তাই। বিয়েটা আয়াজই ভেঙ্গছে। ইত্তির সাথে পরামর্শ করে সোহাগের কাছে গিয়েছিল সে। সেখানে গিয়ে অবশ্য কিছু মিথ্যে কথা বলতে হয়েছে তাকে। অনেক কষ্টে সে আর ইত্তি মিলে সোহাগকে বিশ্বাস করাতে পেরেছিলো তার সাথে ইরিনের অ্যাফেয়ার চলছে। তার সাথে রাগ করে ইরিন সোহাগকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। এই ছাড়া আয় কোন উপায়ও ছিলো না আয়াজের কাছে। ইত্তি তাকে আগেই বলেছিলো ইরিন হলুদের পর পালিয়ে যাওয়ার প্ল্যান করছে। ইত্তি অবুঝ নয়, ঝোঁকের বশে ইরিনের পাগলামিতে তাল দেওয়ার মত বোকাও সে নয়। ইরিনের এইসব ছেলেমানুষি কর্মকান্ড যে শেষমেশ ইরিনের ক্ষতিই করবে সেটা সে ভালো করেই বুঝতে পেরেছিলো। পালিয়ে গেলে আয়াজের ফ্যামিলি, ইরিনের ফ্যামিলি যে খুব সহজভাবে তাকে গ্রহন করবে সেটা ইরিনের মাথায় না এলেও ইত্তির মাথায় কিন্তু ঠিকই এসেছিলো। তারপর এজ ইউজুয়্যাল আয়াজকে পুরো ঘটনা খুলে বললো সে। ইত্তির কাছ থেকে সব শুনে আয়াজ সময় নষ্ট করলো না।যে করেই হোক ছেলেপক্ষ থেকেই আগে বিয়ে থামাতে হবে। ওদেরকে কিছুতেই অপমানিত হতে দেওয়া যাবে না। তারা নিশ্চই ছেড়ে কথা বলবে না? যেই মেয়ে বিয়ের দিন পালিয়ে যায় তার সম্পর্কে অনায়াসে যে কোন বদনাম তুলে দেওয়া যায়। যদিও সে জানা ইরিন বোকা বলেই এমন একটা পরিকল্পনা করেছে। সোহাগকে নাজেহাল করতে গিয়ে নিজের গায়ে কাদা ছোঁড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বোধ মেয়েটা। তাই দেরী না করে ইত্তিকে নিয়ে সোহাগের বাসায় গিয়েছিলো সে। সোহাগ প্রথমে বিশ্বাস করে নি। ইত্তি আরো ঘনিষ্ঠ দুএকজন বন্ধুবান্ধবকে খুলে বললো পুরো ঘটনাটা। অবশেষে সবাই মিলে ইরিনের অলক্ষেই এই ঘটনার সমাধান করলো। অবশ্য সবটাই আয়াজ এবং ইত্তি হেলাল সাহেবের সাথে পরাশর্ম করে করেছে।হেলাল সাহেব ইরিনের ছেলেমানুষি তে বিন্দুমাত্র অবাক হলেন না।তিনি এবং তার স্ত্রী ছোটবেলা থেকেই এই মেয়েটির স্বল্পবুদ্ধিতার বহু প্রমাণ পেয়েছেন। এবং তাদের ছেলে যে এই বোকা মেয়েটিকে প্রাণাধিক বেশি ভালোবাসে সেটাও তাদের অজানা নয়। অতএব হেলাল সাহেব ছেলের পরিকল্পনাতে সামিল হলেন। বাসার কোন মুরুব্বিকে তিনি কৌশনে হলুদ প্রোগ্রামে আসতে দেন নি। এদিকে মনে মনে কঠিন সিদ্ধান্ত নিলো আয়াজ। ইরিনের এসব পাগলামি আর বাড়তে দেওয়া যাবে না। এবার শিক্ষা দেওয়ার পালা আয়াজের। তাকে এভাবে দৌড়ঝাঁপ করার সাজা ইরিনকে ভোগ করতে হবে। এসব উদ্ভট পরিকল্পনা যেন আর কোনদিন না করতে পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। নাউ ইটস টাইম টু ইরিনের বারোটা বাজানোর।
.
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here