কায়নাত ২,পর্বঃ২

কায়নাত ২,পর্বঃ২
লেখিকাঃ টিউলিপ রহমান

সবাই আলহামদুলিল্লাহ বলুন, বলল কাজী সাহেব। বাবা, আমার হবু শ্বশুর সহ আরো দুই চারজন এসে পাশে দাঁড়ালো, তারাও বলল – আলহামদুলিল্লাহ। পরে তারা ইবাদতের কাছে গিয়ে বিয়ের বাকি কাজ সম্পন্ন করলো। বাড়িতে তখন একটা উৎসব মুখর পরিবেশের সৃষ্টি হলো। আজ এতোদিনে আমার মনটা মনে হয় একটু স্হিরতা অনুভব করছে। এই কয়টা দিন একটা দোটানের মধ্যে ছিলাম।যা ঘটছে তার সবকিছুই আমার কাছে কেমন স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি হয়তো জেগে দেখবো সব মিথ্যা। কিছুক্ষন পর নেকাব পড়া মহিলাগুলো আমার পাশে এসে বসল। নেকাব পড়া মহিলা গুলোর কন্ঠ খুবই মিষ্টি। তাদের মধ্যে একজন আমাকে বলছে

–ভাবি তুমি কি কিছু খেয়েছো?

আমি মাথা নেড়ে না সূচক উত্তর দিলাম।
— আচ্ছা, ভাইজানের সাথে এক সাথে খেও। আমাদের ওখানে নিয়ম আছে, স্বামী ছাড়া খেতে নেই।

এখনও আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলাম।তারপর ওরা নিজেদের মধ্যে কিছু আলোচনা করে আমাকে বোরখা পড়তে বলল। আমি উঠে বোরখাটা পড়ে নিলাম। এর মধ্যে ইবাদত উঠে আমাকে দেখতে এলো। আমাকে দেখে মুচকি হেসে দিল । নেকাব পড়া মহিলাদের মধ্যে একজন বলল

— কি নতুন জামাই, বউকে দেখে মুচকি মুচকি হাসা হচ্ছে কেনো? মনে মনে কি দুষ্টুমি করছো?

তার কথায় ইবাদত লজ্জায় একেবারে লাল হয়ে গেল। এত সুন্দর একটা মানুষ লজ্জায় লাল হলে দেখতে একদম আপেলের মত দেখায়। যদিও ও মানুষ না তারপরও ! লজ্জা পেয়ে ও চলে যাচ্ছিলই আর তখন মহিলাদের মধ্যে একজন বলল

–বউয়ের সাথে বুঝি কথা বলতে এসেছো? আচ্ছা বলো আমরা বের হয়ে যাচ্ছি।
বলে তারা রুম থেকে বের হয়ে গেল। ইবাদত ধীরে ধীরে আমার কাছে এসে আমাকে খুঁটে খুঁটে দেখছিল। তারপর বলল

— মা শা আল্লাহ, খুব সুন্দর লাগছে তোমাকে ।
— হুম বলেছে? আমারকে দেখায় যাচ্ছে না আর বলছে সুন্দর লাগছে!
–কে বলেছে দেখতে পারছি না! আমি জ্বীন। নেকাবের উপরেও দেখতে পাই।
— তাই নাকি?
–হুম, নারীর আসল সৌন্দর্য তো পর্দায়! নেকাবে! আর আমি অবশ্যই চাইবো না যে আমার সুন্দরী বউকে অন্য কোনো মানুষ বা জ্বীন দেখুক!

— হ্যাঁ, হ্যাঁ, এসেছে আমার সাধু জামাই। শুধু তিনি একাই দেখবেন সব নারী আর পরীদের! আর আমাকে দেখলেই দোষ!
–যাও! আমি কাওকেই দেখি না।

এটা বলার সাথে সাথেই আমি জোরে ওর হাতে একটা চিমটি কেটে দিলাম। আর ওমনি ও আল্লাহ করে চিৎকার দিল। আমি সাথে সাথেই আমার হাত দিয়ে ওর মুখ চেপে ধরলাম। আর ও সাথে সাথেই আমার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরল ওর মুখের সাথে। আমি নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ায় আপ্রাণ চেষ্টা করছি কিন্তু ও হাতটা ধরেই রেখেছে।আমি বললাম

— ছাড়ো কি করছো? বাসা ভর্তি মানুষ। কেও দেখলে কি বলবে?
–কি বলবে ? আমার বিয়ে করা বউ কে ধরেছি। এতে কারো কি কোনো সমস্যা হওয়ার কথা?
— ছি! ছাড়ো আমার লজ্জা লাগছে।

তখনই ইবাদত আমার দু ‘হাত শক্ত করে ধরে আমাকে কাছে টেনে নিল। এইবার আমি ওকে সত্যিই ভয় পাচ্ছি। আর তখনই পিছন থেকে মা কাশি দিয়ে বলছে

— মা কায়া?
সঙ্গে সঙ্গেই আমরা দুজন দুদিকে সরে গেলাম। মা ও বোধহয় লজ্জা পেয়েছে ইবাদতের কান্ড দেখে।মা বলল

–কায়া তোর শ্বশুর বলছে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা রওনা হবেন, তোর প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র কি গুছিয়ে নিয়েছিস?
— না মা, কোনো কিছুই কষ্ট করে নিতে হবে না। আমি ওর প্রয়োজনীয় সব জিনিস আগেই আমাদের বাড়িতে সাজিয়ে রেখেছি। আশা করি সেখানে ওর কোন কিছুর অভাব হবে না।( ইবাদত)

মার চেহারাটা দেখে মনে হচ্ছে সে খুব ভয় পাচ্ছে। কারণ ইবাদতের সাথে আগেও কথা বলেছে তখন এত ভীতি তার চেহারায় দেখিনি। তবে আজ মাকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে। ইবাদত কিছু একটা চিন্তা করে মাকে বলছে
— মা আপনি একটুও ঘাবড়াবেন না, আমি ওকে সুখেই রাখবো, ইনশাআল্লাহ। আপনি শুধু আমাদের জন্য দোয়া করবেন। বলে মাকে সালাম করে আমাদের মা মেয়েকে রুমে একা রেখে বের হয়ে গেল।

— কায়া, আমার খুব ভয় করছে। তুই কিভাবে একটা জ্বীনের সাথে থাকবি? আমার তো মাথায়ই ঠুকছে না। মানে কিভাবে কি?( মা )
— মা চিন্তা করো না। সব কিছু ঠিকই হবে। আল্লাহর হুকুম ছাড়া গাছের একটা পাতাও নড়ে না তুমিই তো বলো! নাকি?
–তারপরও! আমি কিভাবে তোর সাথে যোগাযোগ করবো?
— আমি আসবো তো তোমার বাসায়! এসে থাকবো। তোমাকে না জ্বালালে আমার কি চোখে ঘুম আসবে?বলো?

বলে মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলাম। মাও আমাকে ধরে কেঁদে দিলেন। আমাদের কান্নার শব্দে বাবা এসে দরজায় দাড়িয়ে রইলেন। আমি জানি বাবার অন্তরটা ফেটে যাচ্ছে কিন্তু কাওকে কিছু বুঝতে দিবেন না।
কেনো জানি খুব খারাপ লাগছে। হয়তো প্রতিটা মেয়েরই বিদায়ের বেলায় এমন লাগে। ইবাদত এসে বলল
— কায়নাত, চলো। আমাদের এখন যেতে হবে। (বলে আমার দিকে ওর হাতটা বাড়িয়ে দিল )

আমি চোখ মুছে নেকাব দিয়ে মুখটা ঢেকে নিলাম।
তখনই হনহন করে নওরিন আমার রুমে হাজির। এসেই বলল
— তুই এটা কি করলি? কেনো করলি ? (বলে কেঁদে দিল)
— দেখ দোস্ত, সরি। আমি ইচ্ছা করে করিনি।
–ইচ্ছা করে করিনি মানে? তুই আমার জানটাকে নিয়ে গেলি! একেবারে বিয়েই করে ফেললি? তাহলে আমি কাকে বিয়ে করবো?
— সত্যি সত্যিই আমি সরি রে দোস্ত। ইবাদত ই আমাকে প্রপোজ করেছে, আমি না! সত্যি!ওকে জিজ্ঞেস কর!
–বিয়ে তো হয়েই গিয়েছে এখন আর কি করা। তা আমার জন্য কি গিফ্ট আছে?
— গিফ্ট তোকে ইবাদত দিবে, আমি এগুলোর কিছুইই জানি না।
–আমি চাইতে পারবো না।যাই হোক ভালো থাকিস। তোর শ্বশুরবাড়ি কোথায়?

আমি ওর দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করছি আর তখন ইবাদত এসে বলল
— জী, আমাদের বাড়ি বঙ্গোপসাগরে, যাবেন?
— হুম হয়েছে এখন আর এত দরদ দেখাতে হবে না। স্বপ্ন দেখিয়ে সেটা তো পূরন করলেন না!( নওরিন)
— আমি স্বপ্ন দেখিয়েছি?
–থাক বাদ দেন। এখন এসব বলে কি হবে।
— আচ্ছা, আমাদের যাবার সময় হয়ে গিয়েছে, আপনার বান্ধবীকে বিদায় দিয়ে দিন, প্লিজ। ( ইবাদত )

নওরিন আমার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলছে
–শোন কি কি হলো আমাকে কিন্তু সব বলবি, বুঝেছিস!আমি তোকে কল দিবো, ভালো থাকিস।

আমি হেসে দিলাম। পাগল একটা মেয়ে। সরল সহজ মেয়েরা মনে হয় এমনই হয়। তবে ওর মনটা অনেক ভালো।তারপর আমি বাবা মার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠলাম। মনে হচ্ছে আমার কলিজাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে। বাবা এসে ইবাদত কে বলল

–বাবা আমরা কোনো ভুল করলে ক্ষমা করে দিও। আমার মেয়েটার দিকে খেয়াল রেখো। আমার অনেক আদরের একটা মেয়ে। মনে করো আমার কলিজাটা তোমাকে দিয়ে দিলাম, তার যত্ন নিও। ও হ্যাঁ, আমার মেয়েটা একটু রাগী, ছোট মনে করে মাফ করে দিও।

— জী, অবশ্যই। আপনি একদম চিন্তা করবেন না। আমি মাকেও বলেছি। যখনই আপনাদের মন চাইবে কায়নাতের সাথে দেখা করতে তখনই আপনারা মনে মনে ওর কথা চিন্তা করবেন আর আমি ওকে নিয়ে হাজির হবো । তাহলে এখন আমাদের অনুমতি দিন আমরা আসি, আল্লাহ হাফেজ।আর হ্যাঁ নিজের শরীরের যত্ন নিবেন।

–হ্যাঁ, তোমরাও। (বাবা চোখ মুছতে মুছতে )

আমরা রওনা করলাম। গাড়িটা খুব সুন্দর ফুল দিয়ে সাজানো। তবে এখন দিন, অথচ গাড়ির ভিতরে পুরো অন্ধকার। আমার কেমন যেনো ভয় করছিল যদিও ইবাদত ছিল। তারপরও! ইবাদত আমাকে বলল
— কি মন খারাপ?
–হুম, বাসার জন্য খারাপ লাগছে।
— আমরা মাঝে মাঝেই সেখানে বেড়াতে যাবো ঠিকাছে?
আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম। তারপর জানালা দিয়ে আমি বাহিরে দেখলাম। মনে হচ্ছে ঝড়ের বেগে গাড়ি চলছে। খুব অবাক লাগলো। আমি বললাম
–আচ্ছা, তোমার বাড়ি কোথায়?
— তখন বললাম না! বঙ্গোপসাগর।
–সাগরে?
— হুম, ওখানে একটা দ্বীপ আছে সেখানে আমরা থাকি। সেখানে কোনো মানুষ থাকেনা আর এই দ্বীপের নকশাও মানচিত্রে নেই।
–মানে? আমরা এখন ওখানে যাচ্ছি?
— হুম।
–এতক্ষণ গাড়িতে বসে থাকবো কি করে?
— কি যে বলো না, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তুমি তোমার শ্বশুরবাড়িতে অবস্থান করবে, আল্লাহ যদি চান।

আমি অবাক হয়ে গেলাম। পরে মনে মনে বললাম ওরা তো জ্বীন! ওরা চোখের পলকেই নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করতে পারে। দেখতে দেখতে চলে এলাম।গাড়ি এসে আলিশান একটা প্রাসাদের সামনে থামলো। গাড়ির ভিতরে বসেই আমি এর উচ্চতা অনুমান করতে পারলাম না কারন এটা এতটাই উঁচু। খুব সুন্দর নকশা করা প্রাসাদের দেওয়ালে। সূর্যের আলোতে খুব সুন্দর চমকাচ্ছে। আশেপাশে অনেক মানুষ দাড়িয়ে আছে। এরা কি মানুষ না জ্বীন, আল্লাহ জানে। ও হ্যাঁ, ইবাদত বলেছিল এখানে কোনো মানুষ থাকে না, তাহলে এরা জ্বীন। আল্লাহ! তাই বলে এতো! এখন তো একটু ভয়ই করছে। দেখলাম হাতে ফুল নিয়ে অনেকগুলো মেয়ে দৌড়ে এসে গাড়ির দরজা খুলে আমাকে বের হতে বলল।আমি ইবাদতের দিকে তাকালাম। ও আমাকে ইশারা করলো বের হতে। আমি বের হয়ে দাঁড়ালাম। খুব সুন্দর হিমেল বাতাস বইছে সঙ্গে সুন্দর ফুলের সুবাসও।

আমাকে ফুলের মালা পরিয়ে বরন করে নিয়ে একজন বৃদ্ধ লোকের সামনে দাড় করালো। তার চেহারাটা ভীষণ রাগী রাগী। তারপর পাশ থেকে ইবাদত বলল
–কায়নাত, তিনি আমার শ্রদ্ধেয় দাদাজান, সালাম করো।
তাকে দেখেই আমার কেমন যেনো শরীর কাঁপতে লাগলো। তিনি আমার দিকে আরো কর্কশ দৃষ্টিতে তাকালেন।

( চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here