কায়নাত সিজেন ২,পর্বঃ১

কায়নাত সিজেন ২,পর্বঃ১
লেখিকাঃটিউলিপ রহমান

আমি বধূবেশে দাড়িয়ে আছি জানালার পর্দা ধরে। বেশ রাত হয়ে গিয়েছে। কিছুক্ষণ আগে আমি যা করলাম জানি না কিভাবে করলাম। আমার এত সাহস হলো কি করে। আমি, আমার বিয়ের আসর থেকে পালালাম। বাসার প্রত্যেক মানুষ আমার দরজার সামনে দাড়িয়ে, আমাকে ডেকে ডেকে ক্লান্ত হয়ে হয়তো এতক্ষনে শুয়ে পড়েছে। আহনাফ নিজে এসেও আমাকে অনেক ডাকাডাকি করে অবশেষে হয়তো চলে গিয়েছে। আর আমি দাড়িয়ে দাড়িয়ে ইবাদতের কথা চিন্তা করছি। যার জন্য আমি বিয়ের আসর থেকে পালালাম এখন তারই কোনো খবর নেই।তখনি তাকিয়ে দেখি দুরে বৃষ্টির মধ্যে সাদা পোশাকধারী কেও একজন দাড়িয়ে আছে। আমারই দিকে তাকিয়ে আছে । তার শরীর থেকে আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে।

ভালোভাবে তাকিয়ে দেখি সেটা আর কেও না। আমারই ইবাদত।কি করবো ভেবে পাচ্ছি না। ধীরে ধীরে ঘরের দরজা খুললাম। তখন রাত দুইটা বাজে। বাসায় নিরবতা বিরাজ করছে। আমি চারপাশ তাকিয়ে দেখে সোজা দরজা খুলে নিচে নেমে এলাম।প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। প্রকৃতি যেনো আমার সুরে তাল মিলিয়ে কাঁদছে। ইবাদত স্হির হয়ে দাড়িয়ে আছে। দৌড়ে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলাম।ইবাদত বলল

— তুমি এটা কি করলে?
–তুমি জানো না আমি কি করেছি? কেনো করেছি?
— কাজটা ভালো হলো না। তোমার আব্বা আম্মার কথা চিন্তা করার দরকার ছিল। তারা কতটা কষ্ট পেয়েছেন তুমি জানো?
–হুম।
— হুম মানে কি? আহনাফ খুব ভালো ছেলে। তোমাকে অনেক সুখে রাখতো। তুমি ভালো থাকতে।
–কে বলল আমি ওর সাথে ভালো থাকতাম? আমি তো এখনই ওকেছমেনে নিতে পারছি না! পরে শুধু শুধু তিনটা জীবন নষ্ট হতো। ওর সাথে আমি কখনও সুখী হতে পারতাম না।
— আগেই তুমি সব কিভাবে বলে দাও? সুখ দুঃখ এগুলো আল্লাহ নির্ধারণ করে দেন। আমরা নির্ধারন করতে পারি না।
–আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না। তোমাকে অনেক ভালোবেসে ফেলেছি। বাঁচবো না তোমাকে ছাড়া।
— তোমার আর আমার একসাথে কোনো ভবিষ্যৎ নেই। আমাদের মিলন কখনই সম্ভব নয়, কেনো তুমি বোঝ না!
–ওও,আমি বুঝেছি শিউলি কে খুব পছন্দ হয়েছে তাই না?
— কি যে বলো না। তোমার মাথা ঠিক নেই। তুমি নিজেও জানো না এখন তুমি কি বলছো।

আমি ওকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিলাম। তারপর বললাম
— প্লিজ আমাকে ফিরিয়ে দিও না। আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না। মরে যাবো।

ইবাদত আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। দুজনেই বৃষ্টিতে ভিজে একাকার। সময়টা রোমান্টিক হতে পারতো কিন্তু আমরা দুজনই দো-টানের মধ্যে আছি!
ইবাদত বলল
–তা এখন কি করবে? চলো তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি। অনেক রাত হয়েছে।আমিও বাড়ি ফিরবো।
— না আমি বাসায় যাবো না। আমি তোমার সাথে যাবো।
–আমার সাথে তুমি কোথায় যাবে? তুমি জানো আমি কেমন জায়গায় থাকি? ওখানে কি কোনো মানুষ টিকটে পারে?
— কেনো? কি সমস্যা তোমার বাড়িতে?

ইবাদত হেসে দিলো। বলল
–ভুতের বাড়িতে থাকতে কি খুব মজা নাকি?
— ওখানেই আমি থাকবো, চলো।
–নাহ, যদি যেতেই হয় তাহলে এভাবে পালিয়ে নিয়ে তোমাকে বিয়ে করবো না। তোমার আব্বা আম্মাকে বলবো, যদি তারা রাজি থাকেন তাহলেই আমাদের বিয়ে হবে। এছাড়া আমার আব্বা হুজুরকেও জানাতে হবে। তাকে না জানিয়ে আমি কোনো কাজ করি না।
— প্রেম করেছো কি তাকে জানিয়ে?
–না, তা করিনি, ওটা কি বলে কয়ে হয়?
— তাহলে? কাওকেই কিছু জানাতে হবে না। আমরা নিজেরা নিজেরা বিয়ে করে পরে গিয়ে তাদের পা ধরে বসে থাকবো।দেখো ঠিকই মাফ করে দিবে। দেখো নি সিনেমায়?
–আরে বোকা মেয়ে জীবনটা কি সিনেমা?
— আমি কিছু জানি না, তুমি সব ঠিক করে দাও। ঐ আহনাফকে সব ভুলিয়ে দাও। ও যেনো আমাকে ভুলে যায়।

ইবাদত খিলখিল করে হেসে দিল। পাগলী মেয়ে। চলো ভিতরে যাই, বেশী বৃষ্টিতে ভিজলে তোমার ঠান্ডা লেগে যাবে।

.
আমাদের ড্রইং রুমে, ইবাদতের পাশে আমি মাথা নিচু করে বসে আছি। সামনে বাবা, ভাইয়া আর মা বসে আছে। দুরে দাদী, ফুফু আর শিউলী দাড়িয়ে আছে। রাত তিনটাটা বাজে। সবাই আমাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। তাদের চোখে আছে প্রচুর জিজ্ঞাসা।বাবাই প্রথমে জিজ্ঞেস করলেন
— কিরে মা, এমন করলি কেনো? আমরা কি কোনো ভুল করেছি?
–(আমি হাউমাউ করে কেঁদে বললাম) না বাবা, তুমি এভাবে বলো না, আমার কষ্ট লাগে।
–তাহলে কেনো বিয়ের আসর থেকে চলে গেলি? আহনাফের বাবা মার কাছে আমি একদম ছোট হয়ে গেলাম। তাছাড়া কোয়ার্টারের সবাই ছি! ছি!করছে। কাজটা একদম ভালো হলো না।
— আমি ইবাদত কে পছন্দ করি। তোমরা অনুমতি দিলে ….
–তোর ওকে পছন্দ আমাদের আগে বললেই পারতি, ও খুব ভালো ছেলে।আমরা ওর বাবা মায়ের সাথে কথাবার্তা বলতাম কিন্তু বিষয়টা এখন কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো না?

ভাইয়া আমার দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে আছে।

তখনই ইবাদত বলল
— জী, অনুমতি দিলে আমি একটা কথা বলতাম?
— তুই কিন্তু কাজটা ঠিক করিসনি।( ভাইয়া ইবাদতের দিকে তাকিয়ে)
— আমি আপনাদের সবার কাছে ক্ষমা প্রার্থী। তবে একটা বিষয় একটু খুলে বলা দরকার।(ইবাদত)
–হুম বলো।( বাবা)

আমার দিকে ইবাদত একবার তাকিয়ে বলা শুরু করলো
— জী আপনারা আমাকে যেমনটি দেখছেন আমি আসলে তেমন নই।
–মানে কি? তোমার আর্থিক অবস্থা ভালো না সেটা তো! তাতে সমস্যা কি থাকার কথা?(বাবা)
— জী না, ব্যাপারটা তা না। আসলে ….

যখনই বলতে নিলো তখনই বাসার কলিং বেলটা বেজে উঠলো।বাবা বলল

— এই সময় কে আসলো?( ঘড়ি দেখতে দেখতে)
উঠে দরজা খোলা মাত্র সালাম শুনতে পেলেন। বাবা দেখলো লম্বা তিনজন সাদা আলখেল্লা পরিধেয় লোক দাড়িয়ে আছে।এক নজরে দেখে যে কেও ভয় পেয়ে যাবে। ইবাদত বসা থেকে উঠে দৌড়ে বাবার পাশে এসে দাড়ালো। তারপর তাদের সালামের উত্তর দিয়ে বাবাকে বললেন

— চাচাজান, তিনি আমার আব্বা হুজুর।
বাবা তাদের দেখে হা করে তাকিয়ে রইলেন। তারপর হাত মিলিয়ে তাদের ভিতরে নিয়ে আসলেন। তখন মা, দাদী, ফুফু, শিউলি এবং আমি অন্য রুমে চলে আসলাম।
ইবাদত তখন বলল
–চাচাজান আমি আপনাকে এখন যে কথাটি বলবো জানিনা আপনি কি ভাবে নিবেন তবে যাই হোক আজ আমি সত্যটা বলবোই। আমি ইবাদত, আমি একটি জ্বীন।

শব্দ টা মনে হলো সারা ঘরে প্রতিধ্বনিত হলো। দাদী শুনে চোখ বড় বড় করে সেখানেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। মা মুখে কাপড় গুজে বসে আসেন। শিউলি, ফুফুকে জড়িয়ে ধরে বসলো।বাবা বলল

— কি? মানে কি বলছেন? ( বসা থেকে দাড়িয়ে গেলেন)
আমরা যদি কোনো ভুল করে থাকি তাহলে আমাদের ক্ষমা করে দিবেন। আপনাদের কাছে আমার বিনীত অনুরোধ।

— ছি, ছি কি বলছেন, তা হতে যাবে কেনো? আমরা এভাবে অসময়ে এসেছি সে জন্য আপনাদের কাছে আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। কিন্তু কি করবো বিষয়টা এতটা যে নাজুক হবে তা ভাবিনি। আমার পুত্র ইবাদত অনেক ভালো। আমার পুত্র সেজন্য বলছিনা। আসলেই সে ভালো মনের অধিকারী। আপনার যদি আপত্তি না থাকে তাহলে আমরা এখন এই মুহূর্তে আপনার কন্যা কায়নাতের সাথে বিবাহ দিতে চাই।(ইবাদতের বাবা)

বাবা যেনো আকাশ থেকে পড়লো।ইবাদত যদি মানুষ হতো তাহলে চিন্তার কোনো ব্যাপার ছিল না কিন্তু কোনো বাবা কি চাইবে যে তার আদরের মেয়েটা কোনো জ্বীন ভুতের সাথে সংসার করুক! বাবা ভাইয়ার দিকে তাকালো। ভাইয়াও বাকরুদ্ধ হয়ে দাড়িয়ে আছে। তারপর বাবা ইবাদতের বাবাকে বলল
–জী, কিছু যদি মনে না করেন তাহলে আমি কি আমার মেয়েটার সাথে এইই ব্যাপারে একটু কথা বলতে পারি?
— অবশ্যই, আমরা অপেক্ষা করছি, আপনি কথা বলুন।

বাবা আর ভাইয়া আমাদের রুমে এসে বললো
–তৌসিফের মা, আমাকে একটু পানি দাও। আমার যেনো কেমন লাগছে।
মা তাড়াতাড়ি এক গ্লাস পানি বাবাকে দিয়ে বলছে
— এগুলো কি শুনছি!
— ধীরে কথা বলো ধীরে, তারা শুনতে পাবে।

বাবা আয়াতুল কুরছি পড়ে নিজের গায়ে ফু দিয়ে, তারপর উপরের দিকে ফু দিয়ে আবার বলল
— মা কায়া, তুই যে ইবাদত কে বিয়ে করতে চাস, সে তো কোনো মানুষই না। সে একটা জ্বীন! তুই কি এটা জানিস?
— জী বাবা, আমি জানি।( মথা নিচু করে বললাম)
— মানে? তুই সব জেনে শুনেই কি ওকে বিয়ে করতে চাস?
–জী, ও আমাকে আগেই বলেছে। জ্বীন হলে কি হবে,ও খুব ভালো। ও অন্য সব জ্বীনদের মত নয়। তাইতো ওকে এতো ভালো লেগেছে। আমি ওকে ছাড়া অন্য কাওকেই বিয়ে করবো না।

— লজ্জা শরমের কি মাথা খেয়েছিস? কিভা‌বে তুই বাবার সামনে এগুলো বলে ফেললি ? একটা চড় নিয়ে তোর গাল ফাটিয়ে ফেলবো। প্রেম করার জন্য আর কাওকে পেলো না! (ভাইয়া)

— আরে করছিস কি!এভাবে চিৎকার চেঁচামেচি করে কোনো লাভ নেই। আর ওরা শুনতে পেলে ক্ষেপে যাবে। তখন হিতে বিপরীত হবে। দোষ তো ওদের না দোষ তো আমাদের মেয়েরই। সে জ্বীন বিয়ে করতে চায়। আহনাফের সাথে বিয়ের ব্যপারে ইবাদতের কোনোই আপত্তি ছিল না। বিয়ের আসর ত্যাগ করেছে আমাদের মেয়েই।

— কেমন অলুক্ষুনে মেয়েরা বাবা! জাত বাত সব খেলো। আমি আগেই জানতাম যে এই মেয়ে কোন অঘটন ঘটাবে। আগে ভুতে ধরে মান সম্মান খেয়েছে এখন আবার জ্বীনের প্রেমে পড়েছে।আমি সকাল হলেই এখান থেকে চলে যাবো। আর এক মুহুর্তও এখানে থাকবো না। আল্লাহ! আপনি আমাকে রক্ষা করুন। (দাদী)

— মা কায়নাত, তুই কি ডিসিশনটা ভেবে চিন্তে নিয়েছিস? কারন বিয়েটা একটা মেয়ের জীবনে অনেক বড় ব্যাপার। একবার বিয়ে হয়ে গেলে কি হবে আমি জানি না। তারা কোথায় থাকে আমি চিনি না। কিছু হলে দেখতে যাবো কিভাবে তাও জানিনা।সুতরাং আবার একটু চিন্তা করে দেখ।

— চিন্তা করেই বলছি।যদি বিয়ে করতেই হয় তাহলে ইবাদত কেই করবো, নতুবা নয়।

— একটা থাপ্পড় দিবো। বেয়াদপ মেয়ে! বাবার সাথে কেও এই ভাবে কথা বলে! আদব কায়দাও ভুলে গিয়েসিছ? তুই পাগল হয়ে গিয়েছিস। পাগল না হলে কেও জ্বীন ভুতকে বিয়ে করতে চায়!

— তোমরা থামো, কেও আমার মেয়ের অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা করছো না! বুঝলাম ও ভুল করেছে। কিন্তু তাই বলে কি এভাবে ভুল সোধরানো যায়! মা তুই আমার কথাটা শোন, ইবাদতের সাথে তোর কোনো ভবিষ্যৎ নেই। তুই ওর সাথে সংসার করবি কিভাবে? তুই সন্তান জন্ম দিবি কিভাবে? আর খাওয়া দাওয়া কি করবি? তুই কি জানিস ওরা কি খায়? (মা)

— আমি কিছুই জানতে চাই না, কিছুই শুনতে চাই না, কিছু বুঝতেও চাই না। শুধু এতটুকুই বলবো ওকে আমি না পেলে মরে যাবো।
–নাউযুবিল্লাহ! এসব কি কথা? ওর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আর দেরী না করে বাবা ওর বিয়ে দিয়ে দে। পরে মেয়েকেও হারাবি।( দাদী)

জীবনে এই প্রথম দাদীর কোনো কথা আমার এত ভালো লাগলো। বাবা তাদের জানিয়ে দিল এই বিয়েতে আমাদের কোনো অমত নেই। ঠিক সেই মুহুর্তে কাজী ডাকা হলো বিয়ে পড়ানোর জন্য।ফজরের পর শুভ কাজ সম্পন্ন করা হবে। সমস্তটা ঘর কেমন একটা সুন্দর গন্ধে ভরে গেল। আমার যেনো খুশি আজ বাঁধ মানছে না। আমি যেনো বিশ্বাসই করতে পারছি না যে ইবাদতের সাথে আজ আমার বিয়ে। কোথা থেকে যেনো সুন্দর সুন্দর অনেকগুলো শাড়ি, গহনা, সাজসজ্জার জিনিস হাজির হয়ে গেল। বাসায় খাবার দাবার হাজির হয়ে গেল। চার পাঁচজন বোরখা পরিহিত মহিলা হাজির হলো। তাদের আপাদমস্তক নেকাবে ডাকা। আমাকেও একটা বোরখা দিলো।আত্নীয় স্বজন, পাড়া-প্রতিবশী সবাই কে জানানো হবে ইবাদতের সাথে বিয়ে হচ্ছে কিন্তু এটা জানানো হবে না যে ও একটা জ্বীন। আমাকে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে বিয়ের জন্য তৈরী করা হলো। সবাই ফজরের নামাজ শেষে কাজী নিয়ে বসে বিয়ের আয়োজন করছে।

কাজী সাহেব এলো, সঙ্গে বাবা আর একজন লোক এলো। আমাকে তিনবার কবুল বলতে বলা হলো তখন আমার মনে পড়লো এই বিয়ে হওয়ার জন্য আমি কত পাগলামি করলাম আর আজ এই মুহুর্তে বাবা মার জন্য খুব খারাপ লাগছে। কাজী সাহেব আমাকে আবার কবুল বলতে বলল, সঙ্গে বাবাও, তখন আমি বললাম
— কবুল, কবুল, কবুল!!

( চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here