কায়নাত,পর্বঃ১০
লেখিকাঃ টিউলিপ রহমান
আমি আমার রুম থেকে বের হলাম। সে আমার সামনে সামনে হেঁটে যাচ্ছে। আমাকে ফিসফিসিয়ে বলল
–ধীরে ধীরে আসো, আওয়াজ হলে কিন্তু সবাই জেগে যাবে আর আমরা ধরা খাবো। বুঝেছো??
আমি মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ বললাম।ভাইয়ার রুমে আলো জ্বলছে, তারমানে ভাইয়া জেগে আছে। এখন যদি দরজা খুলি, তাহলে ভাইয়া টের পেয়ে যাবে। আমি ইবাদতকে বললাম
— ভাইয়া শব্দ শুনে ফেলবে, তাহলে কিভাবে যাবো? ছাদে যেতে হবে না, রুমে চলো। সেখানেই বলবে। ( আমি ফিসফিস করে বললাম)
সে বলল
— আরে রাখো তো তোমার শুনে ফেলবে, শুনে ফেলবে করছো, আমি আছি! কেও কিছুই শুনবে না।চলো।
আমি ইবাদতের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আজ ও এমন করে আমার সাথে কেনো কথা বলছে! আমি চুপিচুপি গেট খুলে বের হয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে ছাদে চলে আসলাম। ছাদে হিমশীতল বাতাস বইছে। পিছনে তাকিয়ে দেখি ইবাদত নেই। জানি ও হয়তো কোথাও লুকিয়েছে। কারন এই দুষ্টুমি টা এর আগেও ও আমার সাথে করেছে। তাই আমি নিশ্চিন্ত মনে ছাদের এক পাশে চুপ করে দাড়িয়ে রইলাম। তারপর একটু আওয়াজ করে ওকে উদ্দেশ্য করে বললাম
— দেখো আমি জানি তুমি এখানেই আছো, আর দুষ্টুমি করতে হবে না। আমি হেরে গিয়েছি। তুমি জিতেছো। এখন প্লিজ বেরিয়ে এসে আমি যে কথাটা শুনতে চাই সেইটা বলো।
কিন্তু না ওর কোনো খবর নেই। বেশ কিছুক্ষণ সময় এভাবে পার করার পর মনে হলে আমার পিছনে কেও দাড়িয়ে আছে।আমি ধরেই নিয়েছি যে ইবাদত পিছনে দাড়িয়ে আছে। হয়তো পিছন থেকে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলবে ভালোবাসি। তাই মনে মনে অনেক খুশি হয়ে গেলাম। তখন মনের মধ্যে ওকে একবার ছুঁয়ে দেখার প্রবল আকর্ষণ অনুভব করলাম। তারপর পিছনে তাকিয়ে দেখে আমি রীতিমত চমকে গেলাম। এ আমি কি দেখছি! এটা তো আমার ইবাদত নয়! তাহলে ইনি কে বা কি ? আমি ভয়ে পিছনে সরে আসছিলাম আর তখন কিছু একটার সাথে ধাক্কা খেলাম। এখানেও তাকিয়ে দেখে আমি বিচলিত। কি অদ্ভুত ভয়ংকর দেখতে। চুলগুলো সাদা উস্কোখুস্কো, এলোমেলো। শরীরে একজনের কেমন কালো আলখেল্লা পড়া আর অন্যজনের বোধহয় চামড়া পুরে ঝুলে গিয়েছে এমন দেখাচ্ছে । তাদের চোখগুলো কেমন লাল লাল। আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হায় আল্লাহ! এ আমি কোথায় আসলাম! এখন নিজের উপর খুব রাগ হচ্ছে। কেনো কোনো কিছু বিচার বিবেচনা না করেই আমি সবকিছু বিশ্বাস করে ফেলি। আর এটাই আজ আমার কাল হয়ে দাড়ালো। অন্যান্য দিন তো ইবাদত আমাকে রক্ষা করে আজ ও কি আমাকে রক্ষা করবে না! খুব কান্না পাচ্ছে। মনে হচ্ছে আজই পৃথিবীর বুকে আমার শেষ রাত। দেখতে দেখতে পাশে আরো তিনটি নতুন ছায়া এসে দাড়ালো। সঙ্গে ছোট সেই শিশু টি, যাকে এর আগেও এখানে সেখানে দৌড়ে যেতে আমি দেখতাম। তার হাতে সেই বল!
আমার এগুলো দেখে কেমন মাথা ঘুরছে। তারপর কি হলো আমি জানি না আমি বোধহয় তখন মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম।
এরমধ্যেই ভাইয়া কিভাবে যেনো টের পেয়ে ছাদে চলে আসলো। এসেই দেখে আমি ছাদের রেলিং এর উপর দাড়িয়ে আছি চুপচাপ! দৌড়ে আমার কাছে এসে হাত ধরে টান দিয়ে নিচে নামাতে চাইলো। কিন্তু আমি সোজা শক্ত হয়ে দাড়িয়ে আছি। একচুলও আমাকে নাড়াতে পারেনি।ভাইয়ার ভাস্যমতে তখন আমার শরীরের বেশ পরিবর্তন হয়েছিল। আমার হাতগুলো নাকি বেশ মোটা মোটা হয়ে গিয়েছিল! আমি তেমন হ্যাংলাও না আবার মোটাও না, মাঝামাঝি পর্যায়ের শরীরের গঠন। কিন্তু তখন নাকি আমাকে দেখে মনে হচ্ছিল কোনো স্বাস্থ্যবান পুরুষ দাড়িয়ে আছে। মুখ থেকে গুঙ্গানির মত শব্দ বের করছিলাম। ভাইয়া আমার দুই হাত ধরে আবার টান দিয়ে নিচে নামিয়ে আমার গালে সজোরে একটা থাপ্পর দিলো। এতে আমি বেহুঁশ হয়ে ছাদের ফ্লোরে পড়ে রইলাম।
আমাকে কোলে তুলে আনতে ভাইয়ার তখন খুব কষ্ট হলো।তখন নাকি আমার শরীরের ওজন অনেক বেড়ে গিয়েছিল। ভাইয়া যেহেতু ডাক্তারী পড়ছে তাই ভাইয়ার ধারনা আমি ঘুমের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে ছাদে চলে গিয়েছি। সারাদিন আমি যে কাজটা করতে বেশী পছন্দ করি তাই নাকি ঘুমের মধ্যে করেছি। ছাদে যাওয়া আমি বেশ পছন্দ করি তাই নাকি ছাদে চলে গিয়েছি।অন্য কাজ পছন্দ হলে নাকি সেইটাই করতাম। মার বকাবকির জন্য আমি ছাদে যাওয়া বাদ দিয়েছি। ভাইয়ার মতে এই কষ্টটার জন্য আমার ব্রেনে প্রেশার পড়েছে আর আমি ঘুমের মধ্যে এই কাজ করেছি। ভালোভাবে রেস্ট করলে ঠিক হয়ে যাবে। তবে মেডিকেল টার্মে আমার হঠাৎ ওজন বাড়ার কোনো কারন ভাইয়া বলতে পারেনি। বাসায় এনে কাওকে না বলে আমাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ভাইয়া তার রুমে চলে যায়।
পরদিন যখন সকাল হয় তখন মা আমার কার্যকলাপ দেখে ভয়ে চিৎকার দেয়।রাতে আমি ছাদে গিয়েছি, অজ্ঞান হয়েছি এই পর্যন্তই আমার মনে আছে। তারপর কি হয়েছে আমার কিছুই মনে নেই। আমি উল্টোপাল্টা কাজ করেছি, ঘরে হুজুর হসে আমেকে পানি পড়া, তেল পড়া দিয়ে গিয়েছে এগুলো আমার কিছুই মনে নেই। কিন্তু যখন সুপ খাচ্ছিলাম আর ইবাদতকে দেখলাম তখন মনে হলো আমার জীবনটা স্বার্থক। ওকে আমি খুঁজে পেয়েছি। কিন্তু তখন মনে হলো ভাইয়া ওকে কোথায় পেলো? বা কিভাবে জানলো যে ওকে আমি খুব খুব ভালোবাসি?এগুলো চিন্তা করছিলাম আর তখন ভাইয়া বলল
–কায়া, ও আমার খুব ক্লোজ বন্ধু প্লাস রুমমেট। আমারা একসাথে ফোর্থ ইয়ারে পড়ছি। তুই অসুস্থ তাই ও তোকে দেখতে এসেছে।
এ আমি কি শুনছি, ইবাদত ডাক্তারী পড়ছে! ও আমাকে একবারও বলেনি যে ভাইয়াকে চিনে বা ও ভাইয়ার বন্ধু। তখন ওর উপর খুব অভিমান হচ্ছিলো।ও এসে আমাকে বলছে
— কেমন আছেন কায়নাত?
আমি কিছুই বললাম না। আমার হয়ে মা উত্তর দিল
–ভালো না বাবা, একটু আগে ওর ভীষণ পেট ব্যাথা হচ্ছিলো। শরীরটাও বেশ দুর্বল।( মা )
— জী, ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করলে ঠিক হয়ে যাবে।
তারপর ইবাদত ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বলল
— তৌসিফ, তোর সাথে আমার একটা কথা আছে অন্য রুমে গিয়ে বলা যাবে??
–হ্যাঁ অবশ্যই, চল, ওদিকে চল।
তারপর ওরা অন্য রুমে চলে গেল। ইবাদত ভাইয়াকে বলল
— সর্বনাশ হয়েছে?
–কিরে, কি হলো?
— পাঁচটা জ্বীন ওর শরীরে আছে। এর মধ্যে চারটাই হলো ইফ্রিদ জ্বীন।
–কি বলছিস তুই, তোর মাথা ঠিক আছে তো? বাবাও বলছে একই কথা। আমরা সাইন্স পড়ে এযুগে কি এসব বিশ্বাস করবো?
— সাইন্স পড়লেও ধর্মকে তো আর অমান্য করা যায় না! কুরআনে স্পষ্ট করে বলা আছে জ্বীন জাতির কথা। জ্বীন জাতি নিয়ে একটা সুরাও আছে সুরা জ্বীন। এগুলো কিভাবে অস্বীকার করবি!
–তা ঠিক আছে কিন্তু আমি তো কুরআনে হাফেজ না, আমার সেই জ্ঞানও নেই।
— এগুলো জানতে হলে কুরআনে হাফেজ হতে হয় না। এগুলো সাধারণ জ্ঞানের ব্যাপার। যাই হোক আমরা এগুলো নিয়ে পরে আলোচনা করবো। এখন কায়নাতার জীবন বাঁচানো জরুরী।
–তাহলে আমরা এখন কি করবো?
— তুইতো জানিস আমি কুরআনে হাফেজ। আমি একটু চেষ্টা করতে চাই যদি তোদের কোনো আপত্তি না থাকে।
–না আপত্তি থাকবে কেনো, এটা তো খুব ভালো কথা কিন্তু এতে তো হিতে বিপরীত হবে না?
— না না, আমার উপর ভরসা রাখ। আমি এখন ওর রুমে যাবো একা। তবে তখন অনেক রকম ভয়ংকর আওয়াজ হতে পারে এতে কিন্তু তোরা কেও বিচলিত হতে পারবি না। তাছাড়া ঐ জ্বীনগুলো ছলনার আশ্রয় নিবে, এতে তোদের গলে যাওয়া যাবে না।কোনো ভাবেই রুমে ঢুকবি না। মনে থাকবে?
–হুম।
— তাহলে আমি ওর রুমে যাচ্ছি, তুই দরজাটা বাহির থেকে আটকে অপেক্ষা কর, কেও যেনো ভিতরে আসতে না পারে।
–আচ্ছা।
ইবাদত আমার রুমে চলে আসলো। ভাইয়া মাকে রুম থেকে বের হয়ে যেতে বলল। তারপর ইবাদত আর আমাকে একা রুমে রেখে ভাইয়া দরজা বাহির দিয়ে আটকিয়ে দিলো।তখন আমি বিছানার টানটান হয়ে শুয়ে আছি। ইবাদত পাশে দাড়িয়ে বলল
— কায়নাত! কায়নাত! কথা বলো আমার সাথে।
আমি উপরের দিকে তাকিয়ে মনের আনন্দে পা দুলাচ্ছি।ইবাদত আবার বলল
— কায়নাত? খুব কি বেশী রাগ করেছো?
এখনো আমি পা দুলাচ্ছি।তারপর ও কতগুলো সুরা পড়া শুরু করলো। এতে আমার মধ্যে পরিবর্তন হওয়া শুরু করলো। আমি চুপচাপ শক্ত হয়ে শুয়ে আছি। ও অনবরত সুরা পড়েই যাচ্ছে। এক পর্যায়ে আমার ভিতরে থাকা শয়তানগুলো ভয়ংকর আওয়াজে বলে উঠলো
— কি এসেছো সোনা? তোমারইই কমতি ছিল। সেটাও তুমি পূরন করে দিলে। ( হাসতে হাসতে)
তা ছাড়া পেলি কি করে?
— আল্লাহ ছাড়া আমাকে কে আটকাবে? তোরা মনে করেছিস আমার অবর্তমানে তোরা কায়নাতকে মেরে ফেলতে পারবি? কিন্তু আল্লাহ যাকে বাঁচিয়ে রাখতে চায় তাকে কে মরবে বল?তোরা পারবি?
— বাহ! বাহ! স্বপ্ন দেখা ভালো। আজ তোর কায়নাতকেও মারবো তোকেও মারবো।
বলে কায়নাত লাফিয়ে ইবাদতের উপর পড়লো। কায়নাতের শরীরে এখন পাঁচটা বদজ্বীন আর ইবাদত একা, লড়াই করছে। এক পর্যায়ে কায়নাত ইবাদতের গলা চেপে ধরলো। ইবাদত সুরা পড়ছে আর কায়নাতের হাতে ফু দিচ্ছে। এই রকম কিছুক্ষণ চলার পর ইবাদত কায়নাতকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলল
–দেখ, তোরা এই নীরিহ মেয়েটাকে ছেড়ে দে। আমার সাথে লড়াই কর। আমাকে হত্যা করে ফেল। কিন্তু তার বিনিময়ে এই মেয়েটাকে মাফ করে দে। ওর জীবন ভিক্ষা দে।
— কখনই না। ওর জন্য আমার সন্তানের অপঘাতে মৃত্যু হয়েছে। ওকে এখন মরতে হবে। মরে ও এর প্রতিদান দিবে।
— ও বেচারি জানেও না যে তোর সন্তান ছাদে খেলছিল। তাহলে হয়তো ওমনটা ও করতোও না।
— যা হবার হয়েছে এখন ওকে আমাদের সাথে নিয়ে যাবো দেখি কে ঠেকায়।
বলেই কায়নাতকে দেওয়ালের সাথে জোরে একটা ধাক্কা দিল। এদিকে ভাইয়া, মা বাবা আর না পেরে দরজা খুলে দেখে রক্তাক্ত অবস্থায় কায়নাত দাড়িয়ে আছে আর ওর এক হাত যেটা কিনা সাত আট ফুট লম্বা হয়ে গিয়েছে, সেটা দিয়ে দেওয়ালে ইবাদতের গলা চেপে ধরে আছে। এটা দেখে মা চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে পড়ে গেল। ভাইয়া আর বাবা দৌড়ে আসছিল কিন্তু কায়নাত ওদের দিকে কতগুলো রক্তবমি ছুঁড়ে মারলো।ওরা এতে সাময়িক থেমে গেলেও যখন আবার এগুচ্ছিল তখন ইবাদত বলল
–দয়া করে আপনারা কেও এগিয়ে আসবেন না। ওর গাঁয়ে স্পর্শ করবেন না।
ইবাদত খুব কষ্ট করে কথাগুলো ওদের বলল।
তখন শয়তান রুপি কায়নাত বলল
— আরে এটা একটা ভন্ড। তৌসিফ জানিস তোর সামনে যে লোকটি দাড়িয়ে আছে সে কোনো মানুষ না। বলে হো হো করে হাসতে লাগল। তারপর আবার বলল
–এ হলো জ্বীন! হো হো! ভালো জ্বীন। তোর বোনের লাভার বয় জ্বীন।বলেই বিছ্রি করে হাসছে।
ভাইয়া, বাবা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।ভাইয়া বলল
— কি যা তা বলছিস, ও কিভাবে জ্বীন হয়!
— আমি মোটেও মিথ্যা বলছি না। মানি আমি খারাপ কিন্তু একটুও মিথ্যা বলছি না।
এই কথায় সবচেয়ে বেশী অবাক হয়েছে তৌফিক। কারন ওর কোনো ধারনাই ছিল না। চারটা বছর একটা জ্বীনের সাথে রুম শেয়ার করেছে। তারপর ঐ শয়তান টা আবার বলল
–কি বিশ্বাস হয়েছে এখন ? দাড়া তোদের সামনাসামনি প্রমাণ দেখাচ্ছি।
এটা বলেই ইবাদত কে রুমের দেওয়ালে ছুড়ে ফেলল। এতে ইবাদত ছিটকে পরে দেওয়াল ভেঙ্গে আবার সোজা হয়ে দড়ালো। তারপর ঘরে ঘূর্ণির মত সৃষ্টি হলো।
( চলবে)