রহস্যেঘেরা শহর চট্টগ্রাম,পর্ব-৬ (অন্তিম পর্ব)
শাহ্রিয়ার আবিদ
একেবারে উঠতে উঠতে তাইশার কোলের উপর চড়ে বসলো মিল্টন৷ আমি এখনো বসে হাঁপাচ্ছি আর ছেলেমেয়ে দুটিকে ভালো করে পরখ করছি৷
-” কিছু মনে না করলে তোমাদের কে একটা প্রশ্ন করবো? ”
ছেলেটি আমার দিকে একবার তাকালো৷
-” হ্যাঁ, করেন৷ ”
-” তোমরা এখানে কি করছো দুজনে?”
তাইশা আর ছেলেটি একে অপরের দিকে তাকালো, মনে হলো চোখে চোখে কথা বলে নিচ্ছে৷ তাইশা ছেলেটির উপর থেকে চোখ ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
-” আমরা পাঁচজনের একটা দল, এখানে রিসার্চ করতে এসেছি৷ আমরা একটা খবর শুনি, চট্টগ্রাম শহর নাকি বিক্রি হয়ে যাবে।”
শেষ কথাটি শুনে আমি বেশ অবাক হলাম! একথাটি তো যথেষ্ট পরিমাণ গোপন রাখা হয়েছে৷ তাহলে এরা জানলো কিভাবে?
-” একটু দাঁড়াও, তোমরা এ খবর কোত্থেকে জেনেছ? ”
এবার ছেলেটি বলে উঠলো,
-” আমার বাবা এদেশের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের একজন। আমি খুব স্পষ্টবাদী। আর আপনাকে এগুলো বলার কারণ, আপনাকে দেখে মনে হয়েছে আপনাকে ভরসা করা যায়৷ কিন্তু তারপরও আপনাকে আমার যথেষ্ট ভয় লাগছে। আপনার কোমরে গোঁজা রিভলবারটা আমি দেখেছি৷ যদি আপনি কে সেটা আমাদের নিশ্চিত করলে খুশি হবো। ”
আমি হেঁসে উঠলাম,
-” আমি আসলে কি সে উত্তর আমি নিজেই খুঁজে পায়নি আর তোমাকে কি বলবো? ”
-” মানে ঠিক বুঝলাম না। ”
-” আচ্ছা বাদ দাও, এটা মনে রাখো আমি তোমাদের কোনো ক্ষতি করবো না৷ তা তোমাদের বাকি সদস্য কোথায়? ”
-” বন্দী হয়ে আছে৷ ”
-” মানে! তোমরা কিসের উপর রিসার্চ করতে এসেছো? আর তার সাথে চট্টগ্রাম শহর বিক্রি হওয়ার কি সম্পর্ক? আর কে-বা তোমাদের বন্ধুদের বন্দী বানাবে? একটু পরিষ্কার করলে বিষয়টা ভালো হতো না। ”
-” জানি না আমি ঠিক, আপনাকে কিভাবে বুঝাবো৷ এমন আধুনিক যুগে এসেও আমি এধরণের কথা বললে আপনি আমাকে পাগলও ভাবতে পারেন। কিন্তু আমি যাই দেখেছি তাই বলছি৷ ”
-” অসুবিধা নেই তুমি বলো। একটা কথা মনে রাখবে,
‘এ পৃথিবী যতটা বিচিত্র, তার চেয়ে বিচিত্র সৃষ্টিকর্তা, আর তার চেয়েও বিচিত্র তার সৃষ্টি। ‘
এতে পাগল ভাবার কিছু নেই তুমি আমাকে নিঃসংকোচে বলতে পারো। ”
-” আমাদের সঙ্গীদের বন্দী বানিয়েছে, এক অপূর্ব সুন্দরি যাদুকরী নারী! তার পরনে ছিলো সবুজ জামা। চুলগুলো সাদা রঙ্গের ছিলো, আর তার সাথে ছিলো সবুজ যাদুর ড্রাগন। আমি চট্টগ্রামের ছেলে, তাই চট্টগ্রাম শহর বিক্রি হয়ে যাবে ভেবে মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। তাই আমার বাবার কাছে জানতে চাইলে এর বিকল্প উপায়৷ তিনি বলেন, কোনো একটা কালো যাদুকর আমাদের চট্টগ্রামের উপর ভাগ বসাতে চাই৷ আর আমরা যদি সেটা রুখতে পারি, তাহলে চট্টগ্রাম শহর থেকে বিপদ মুক্ত হবে বিক্রিও হবে না৷ মূলত ‘আউট অফ কন্ট্রোল’ হওয়ার কারণে চট্টগ্রাম শহর বিক্রি করতে হচ্ছে। ”
আসলে আমি কথা গুলো শুনার পর কিছু একটার সাথে হিসেব মিলে যাচ্ছে আমার। আমি চট করে বলে উঠলাম,
-” আমাকে নিয়ে যেতে পারবে জায়গাটাতে? ”
দুজনে বেশ অবাক হয়ে গেলো!
-” আপনি ওখানে গিয়ে কি করবেন? ”
-” তোমাদের কথা শুনে মনে হচ্ছে, আমি যার সন্ধান করছি গত বেশ কয়েক বছর যাবৎ। তোমাদের বর্ণনার সাথে তেমনই মিলে যাচ্ছে৷ ”
আমার কথা গুলো শুনে দুজনের চোখ গুলো বড় হয়ে যেতে লাগলো, মনে হচ্ছে এখনই বেরিয়ে আসবে।
-” আপনি সত্যি করে বলেন তো, এখানে কেন এসেছেন? ”
ছেলেটা আমার কথা শুনে প্রশ্ন না করে আর পারলো না৷ আমি বুঝতে পারছি তার ব্যাপারটা৷ তার জায়গায় আমি থাকলে আমিও এ প্রশ্ন টায় করতাম। ছেলেটার নাম তাইফ। তাদের দুজনকে সংক্ষেপে যতটুকু বোঝানো যায় প্রায় ততটুকুই বোঝালাম।
আমার কথাগুলো শুনে দুজনে হাঁ করে আমার দিকে চেয়ে রইলো!
.
-” এবার বলো তোমরা কি আমাকে সাহায্য করবে? ”
তাইফ উঠে দাঁড়াল কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে নিলো৷ সাথে তাইশাও দাঁড়িয়েছে। তাইফের দিকে তাকিয়ে বললো, ” ভাইয়া তোর কাছে পানি আছে? ” তাইফ ব্যাগ থেকে বোতলটা বের করে দেখলো। পানি নেই। আমার ব্যাগ থেকে পানির বোতলটা তাইশার দিকে বাড়িয়ে দিলাম৷ তাইফ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ” যেতে যখন হবে, সময়ক্ষেপণ করে লাভ নেই। ”
বুঝতে পারলাম, ওরা প্রস্তুত। মুচকি একটা হাসি দিলাম তাইফের কথার বিপরীতে৷ এদিকে মিল্টনও ‘ঘেউ ঘেউ’ করে উঠলো সেও প্রস্তুত জানিয়ে দিলো।
আমি প্রথমে গিয়ে সুড়ঙ্গ মুখটা চেক করে দেখলাম। কুটিয়ে কুটিয়ে দেখছি সুড়ঙ্গের দরজাটা। তাইফ আমাকে বলেছিল, সুড়ঙ্গ মুখটা নাকি কেউ ঢুকলে সাথে সাথে আপনা আপনি বন্ধ হয়ে যাই৷ তাই আমি সুড়ঙ্গ মুখটা দেখছি৷
আমি আপাতত একটা ধাতব দন্ড দিয়ে কুটাচ্ছিলাম সুরঙ্গ মুখ৷ হঠাৎ একটা জায়গায় গিয়ে দাতব কোনো কিছুর সাথে লাগলে যেমন আওয়াজ হয় তেমনি একটা আওয়াজ হলো৷ আমি জায়গাটা আরো ভালো করে কুটিয়ে দেখলাম৷ অবশেষে বের করে আনলাম দাতব জিনিসটা৷ একটু নাড়াচাড়া করে দেখতেই বুঝতে পেরেছি কি এটা৷ আমার পাশে এসে মিল্টন দাঁড়াল।
-” ঘেউ ঘেউ। ”
-” হ্যাঁ কি এটা আমি চিনেছি। ”
-” ঘেউ ঘেউ। ”
-” তুই কিভাবে চিনবি? তুই কি এরকম আগে কখনো দেখেছিস৷ ”
-” ঘেউ ঘেউ। ”
-” ওহ্ আচ্ছা তাই নাকি! এটা হলো সেন্সর, খুব ভালো ক্ষমতাসম্পন্ন। এটার কারণে কেউ সুরঙ্গ মুখ অতিক্রম করে গেলে দরজাটা নিজে নিজে বন্ধ হয়ে যাবে। ”
-” ঘেউ ঘেউ। ”
-” আমি বলছি তারপর জানছিস আরকি৷ ”
-” ঘেউ ঘেউ। ”
-” কিহ্ তুই আগে থেকে জানতিস৷ তাহলে বলিসনি কেনো? ”
-” ঘেউ ঘেউ। ”
-” আমি জানি কিনা পরীক্ষা করছিলি৷ বাহ্ তুই তো দেখি বেশ পাকনামি করছিস আজকাল। ”
মিল্টান লেজ নাড়াতে নাড়াতে তাইশার কাছে চলে গেলো।
তারমানে সুরঙ্গ পথে শক্তিশালী সেন্সর লাগিয়ে রাখা হয়েছিলো যাতে কেউ ভেতরে প্রবেশ করার পর বের হবার সুযোগ না পাই৷ কিন্তু আমিতো সেন্সর বের করে ফেললাম এবার আর নিজ থেকে বন্ধ হবে না৷
আমি তৈরি হয়েছি ভেতরে যাওয়ার জন্য৷ আশপাশটা ভালোভাবে দেখে নিলাম শেষবারের মতো, বাকিদেরও ডাক দিলাম৷ রিভলভারটা চেক করে নিচ্ছি ঠিকঠাক আছে কিনা?
আল্লাহর নাম নিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লাম৷ নিকষ কালো অন্ধকার, মনের ভেতর ভয়টা আরো দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। কিছুদূর এভাবে আশার পর আমি কিছু একটার গন্ধ পেলাম৷ পকেট থেকে রুমাল বের করে নাকে চাপা দিলাম৷ বাকিদেরও করতে বললাম৷ তারাও ঠিক তাই করলো৷ গন্ধটা আমার পরিচিত। এটা আমি প্রায়ই ব্যবহার করে থাকি। এই গন্ধটা যে কারো শরীরে প্রবেশ করলে, তখনি সে মনে মনে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে, মস্তিষ্ক ভালোভাবে কাজ করতে পারে না৷
নাকে রুমাল চাপা দিয়ে আরো কিছুটা দূর চলে এলাম৷ সামনে সামনে হাঁটছে তাইফ যেহেতু সে এর আগে এখানে এসেছে পথটা তার চেনা আছে৷ সুরঙ্গ পথটা বেশ সরু কোনো রকমে একজন হাঁটা যায়। সবার প্রথমে তাইফ তারপরে তাইশা এরপর আমি আর সবার পিছনে মিল্টন । একটা জায়গায় পথটা খুব সরু হয়ে গেল৷ এবার আরও দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছে না৷ তাই সবাই হামাগুড়ি দিয়ে চলতে শুরু করলাম । মিল্টন প্রথম থেকেই হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটে তার আর নতুন করে হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটার প্রয়োজন পড়ে নি৷ আরো বেশি অন্ধকার হয়ে আসলো এবার সুরঙ্গটা। মোবাইলের ফ্লাশ জ্বালিয়ে দিলাম৷ আরও কিছুক্ষণ এভাবে চলার পর একটা আলো দেখতে পেলাম। খুব নিকটে চলে এসেছি৷
.
তাইফ আমাকে ইশারা করে দেখালো৷ আমি কোমরে গোঁজা রিভলবার বের করলাম। দুহাতে মুষ্টি বদ্ধ করে ধরলাম৷ আমি লুকিয়ে লুকিয়ে কাজ কর্ম গুলো দেখছি ভেতরের। মিতুলকেও দেখতে পেলাম৷ তাকে দেখার পর মনে হলো আমার হৃদ স্পন্দন বন্ধ হয়ে যাবে তখনি৷ তারপরেও নিজেকে সামলিয়ে নিলাম৷ মিল্টনও আমার সাথে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখল। সেখান থেকে ফিরে এসে সবাইকে বুঝিয়ে দিলাম কি করতে হবে৷
অবশেষে সবাই তৈরি, প্রথম আক্রমণ করলো মিল্টন, দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রহরীর উপর৷ সে আক্রমণ করার সাথে সাথে আমি তান্ত্রিকের উপর গুলি চালালাম৷ দ্বিতীয় গুলি করলাম বন্দীদের সেলের তালার উপর৷ ওখান থেকে তিনজন বের হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো আরেক প্রহরীর উপর। তাইশা গিয়ে পেছন থেকে মিতুলের গলায় পরিহিত লাল হারটা ছিড়ে ফেললো৷
.
অল্পক্ষণের মধ্যে এতো কিছু করে ফেলতে পারবো কল্পনাও করিনি৷ অবশেষে যতটা ভেবেছিলাম তার চেয়েও বেশি ভালো হয়েছে৷ রেঞ্জ রোভারটা করে এসেছিলাম আমি আর আমি আর মিল্টন। আর এখন যাচ্ছি আমরা আটজন৷ বেচারা মিল্টনের জায়গা হলো মিতুলের কোলের উপর৷
আপনাদের বিষয়টা আরেকটু পরিষ্কার করি৷ আমি যখন লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছিলাম তখনি খেয়াল করেছি একজন প্রহরীর গলায় লাল হার পড়িয়ে দেবার পর সে এক রকম আচরণ করে আর হারটা খোলার পর আরেকরকম আচরণ করে৷ খেয়াল করলাম সবার গলায় এমন লাল হার৷ বুঝতে পেরেছি এটা, তান্ত্রিক তার লাল হার পড়িয়ে সবাইকে তার আয়ত্তে নিয়েছিলো৷ সে কল্পনাও করতে পারেনি হঠাৎ করে এমন একটা আক্রমণ হয়ে যাবে৷ কারণ সে তার সুরঙ্গা যেভাবে সাজিয়েছিলো সে হিসেব মতে কোনো মানুষ ওখানে প্রবেশ করলে নিশ্চিত ধরা পড়ে যেত। কিন্তু এসব বিষয় আমি আগে জানতাম বলে এমনটা হয়নি। তান্ত্রিক অবশ্য এখন তার সুরঙ্গে পড়ে রয়েছে মৃত হয়ে৷
হয়তো এতদিন পর আবার আমি মনে খুলে হাসতে পারছি৷ সৃষ্টিকর্তার কাছে একবার শুকরিয়া আদায় করে নিলাম৷ তাইফের দিকে তাকালাম,
-” বেঁচে গেলো তাহলে চট্টগ্রাম। ” সবাই সমস্বরে জবাব “হ্যাঁ “। আবার শুরু করতে নতুন করে৷ আমার সামনে থাকা আয়নাটা মিতুদের দিকে ঘুরিয়ে দিলাম, আয়না দিয়ে দেখছি তাকে সেও তাকাচ্ছে আমার দিকে। হাতে হাত রাখলাম গান বাজিয়ে দিলাম মিনার রহমানের ‘ আবার’ গানটা,
‘ তুমি কি আমার হাসি মুখের আবার কারণ হবে,
তুমি কি শতভুলের আবার বারণ,
দেবো না জল আসতে চোখে কোনো দিনও আর,
আর একটিবার দাও যদি জল মোছার অধিকার৷ ‘
সমাপ্ত..