#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_৪০ [অন্তিম পর্ব]
#Esrat_Ety
[১ম অংশ]
দুইশো আট নাম্বার কেবিনের বদ্ধ কামরায় একটা বেডে টানটান হয়ে শুয়ে আছে উর্বী। তার দু’চোখ বন্ধ। এটি মূলত হসপিটালের রেডিওলজি বিভাগের কামরা। যেখানে সবসময় দুজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার থাকেন। তবে আজ রাওনাফ নিজেই উর্বীর ইউএসজি করছে। সে বসে আছে আল্ট্রাসাউন্ড স্ক্যানারের সামনে,তার সামনে থাকা মনিটরে নিজের সন্তানের উপস্থিতি অবলোকন করে রাওনাফ ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে।
এই ব্যাপারটা সে প্রচণ্ড উপভোগ করেছে নাবিল-শায়মী আর শর্মীর বেলাতে। শিমালার ইউএসজি সবসময় সে নিজেই করতো।হসপিটালে আল্ট্রসাউন্ডের কামরায় সবসময় ওয়াইফের সাথে হাজবেন্ডকে থাকতে দেওয়া হয় রাওনাফের নির্দেশে। রাওনাফ বিশ্বাস করে নয়মাস ধরে একটা নারীই শুধু একটু একটু করে মা হয়না বরং একজন পুরুষও একটু একটু করে বাবা হয়। তাই দুজনে মিলে উপভোগ করা উচিৎ সবকিছু।
হাতের ট্রান্সডিউসারটা উর্বীর তলপেটের উপরে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সন্তানের সার্বিক অবস্থা নিশ্চিত করছে সে।
কামরায় তারা দুজন ব্যাতীত আর কেউ নেই। রাওনাফই টুক টাক কথা বলছে,উর্বীর থেকে কোনো জবাব আসেনা।
“লোয়ার এবডোমেন খিচিয়ে থেকো না, আমার অসুবিধে হচ্ছে। বি ইজি।”
মনিটরে দৃষ্টি রেখে রাওনাফ বলে।
উর্বী হাত পা ছড়িয়ে একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে। রাওনাফ হাত থেকে ট্রান্সডিউসার টা সরিয়ে রেখে বেবির ইমেজ প্রিন্ট করে নেয় উর্বীকে দেখাবে বলে। চোখ থেকে রিডিং চশমা খুলে ফেলে সে। তারপর উর্বীর দিকে তাকায়, দু চোখ বন্ধ মেয়েটার। কোর্টে অচেতন হওয়ার পরে সরাসরি এখানে নিয়ে আসা হয়েছে,জ্ঞান ফিরেছে ঘন্টাখানেক হয়ে গিয়েছে অথচ এখন অবধি একটি কথাও বলেনি। রাওনাফ খেয়াল করেছে,এমনিতে সবসময় ঠিকই থাকে তবে অতীত সম্পর্কিত বিষয়ের মুখোমুখি হতে গেলেই মেয়েটা ভয়াবহ মানসিক চাপে পরে যায়, তারপর জ্ঞান হারায়।
রাওনাফ উঠে দাঁড়ায়,টিস্যু পেপার দিয়ে উর্বীর তলপেটে লেগে থাকা লিকুইড মুছিয়ে দিয়ে উর্বীর পেটিকোটের ফিতে ঠিক করে লাগিয়ে শাড়ির কুঁচিগুলো কোমরে গুজে দেয়। উর্বী চোখ মেলে রাওনাফকে দেখে। রাওনাফের মুখভঙ্গি শান্ত, বরাবরের মতো।
রাওনাফ উর্বীর একটা হাত ধরে আরেকটা হাত মাথার নিচে রেখে বলে,”এখন উঠে বসো, সরাসরি উঠবে না। আগে কাত হও খানিকটা, তারপর ওঠো, ধীরে ধীরে।”
উর্বী উঠে বসে। রাওনাফ একগ্লাস পানি দেয় উর্বীর হাতে। উর্বী গ্লাসের দিকে একপলক তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নেয়,সরিয়ে নেয় হাত।
হাতের গ্লাসটা সরিয়ে রেখে রাওনাফ উর্বীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে উর্বীর থুতনি ধরে মুখটা উঁচু করে ধরে উর্বীর চোখে চোখ রাখে, তারপর একটা চেয়ার টেনে মুখোমুখি বসে।
উর্বী তাকিয়ে আছে। রাওনাফ নিচুস্বরে বলে,”মাথার কোন পোকাটা কিলবিলিয়ে উঠলো? আমাকে বলো,সরিয়ে দিই।”
উর্বী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে ওঠে,”আমার সাত বছরের মৃত্যুযন্ত্রণা একটা শব্দ দিয়ে ব্যাখ্যা করা হলো। বেঈমান। ভালোবেসে আটকে রাখতে আরো অনেক উপায় আছে। সে বেছে নিলো প্রেয়সীকে কলুসিত করে তাকে বাধ্য করা থাকতে। সম্পর্কটাকে এতটাই সম্মান করতো যে প্রেয়সীর অসম্মান করতেও দু’বার ভাবেনি। তখন আমার বুক ফাটা আর্তনাদও তার কানে পৌঁছায়নি।”
রাওনাফ হাসে। উর্বী তার দিকে অবাক হয়ে তাকায়। রাওনাফ হাসি থামিয়ে বলে,”হাসছি কেনো জানো? তুমি বরাবর একই রকম থেকে যাবে। তোমার কোনো উন্নতি হবে না। যতখানি দোষ না তোমার ছিলো তার থেকে বেশি লাঞ্ছিত হয়েছো তুমি নিজের দোষে। এই যে আজও নিজের জবাব গুলো ওর মুখের ওপর দিয়ে এলে না, জ্ঞান হারিয়ে ফেললে আর এখন আমার সামনে নিজেকে প্রশ্নবিদ্ধ করছো যেখানে আমার কাছে কোনো জবাবদিহিতার কোনো প্রয়োজন নেই।”
_সত্যিই কোনো দোষ আমার ছিলো?
প্রশ্নটি করে উর্বী তাকিয়ে আছে রাওনাফের দিকে। রাওনাফ শুকনো হাসি হাসে, তারপর বলে ওঠে,”তা তো আমি জানি না। উর্বী জানে। ঘটনাগুলো উর্বীর সাথে ঘটেছে।”
উর্বী চেঁ’চি’য়ে বলতে থাকে,
_না ছিলো না, কোনো দোষ ছিলো না। আমি চেয়েছিলাম তাকে শোধরাতে, চেষ্টা করেছিলাম। তারপর যখন ব্যর্থ হলাম তখন হাতটা ছেড়ে দিয়েছিলাম।
_তাহলে দোষ নেই।
ঠান্ডা গলায় বলে রাওনাফ। কিছুক্ষণ পরে আবারও বলে ওঠে,”এখন অস্বস্তি হলে চলো, ও এখনও পুলিশ কা’স্টডিতে আছে, জেলখানায় নেওয়ার আগে তোমার জবাব টা দিয়ে আসবে! সবসময় তো চুপ করেই থাকলে,আজ ওকে কিছু কথা শুনিয়ে দিয়ে আসবে চলো।”
উর্বী চুপ থাকে। রাওনাফ হাসতে থাকে। তারপর কিছুক্ষণ পর মুখটা শুকনো করে একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে,”তোমাকে একজন মানুষ প্রশ্নবিদ্ধ করলো মাত্র। আর আমাকে রোজ,রোজ দুনিয়ার মানুষ প্রশ্নবিদ্ধ করে।”
উর্বী রাওনাফের দিকে তাকায়। রাওনাফ বলতে থাকে,”মানুষের চোখে তোমার প্রতি আমার অনুভূতি আসাটাকে শিমালার প্রতি আমার শ্রদ্ধা ভালোবাসাকে পানসে করে দিয়েছে। সেদিন বন্ধুদের মধ্যেও একজন মজার ছলে বলে ফেলেছে। এরকম টা আমি সবসময় ফেস করি উর্বী। করতে হয়। করতে হবে। তাই বলে কি শিমালার প্রতি আমার শ্রদ্ধা ভালোবাসা ফিকে হয়ে যাবে? মানুষ তোমাকে বিচার করবে উর্বী। কিন্তু যেহেতু নিজের অনুভূতি নিজেকে বয়ে বেড়াতে হয় সেহেতু নিজের অনুভূতির বিচার তুমি নিজে করে যে ফলাফল টা পাবে,সেটা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবে। তুমি নিজের অনুভূতি বিচার করে দেখেছো তুমি উচ্ছাসের এই অবস্থার জন্য দায়ী নও,তাহলে তুমি দায়ী নও। মানুষ তো তোমাকে কাঠগড়ায় তুলবেই উর্বী। আমি রোজ উঠি, চেনা পরিচিত মানুষের চোখে, আমার অবুঝ ছেলেটির চোখে। আর এমনিতেও মানুষ শিমালার স্থানে নিজেকে বসিয়ে আমাকে অযোগ্য বেঈমান স্বামী বলবে,আর উর্বীর স্থানে নিজেকে বসিয়ে আমাকে যোগ্য স্বামী বলবে। কিন্তু একটাবার কেউ রাওনাফের স্থানে নিজেকে বসিয়ে দেখবে না। তাই নিজের অনুভূতি নিয়ে জবাবদিহিতা আমি মানুষকে করতে বাধ্য নই। তুমিও বাধ্য নও মানুষের কাছে কৈফিয়ত দিতে।”
রাওনাফ থামে। উর্বী তাকিয়ে আছে মানুষটার দিকে তারপর বলে ওঠে,”রাওনাফের সম্পর্কে অনুভূতি কি জানাবো?”
রাওনাফ বলতে থাকে,”তুমি জানো!”
_নিজেকে কার স্থানে বসিয়ে দেখবো? শিমালার?
_বলো।
_শিমালা খুব ভাগ্যবতী।
_কেনো বলছো! আমি তো অবিচার করেছি তার প্রতি, মানুষের চোখে।
_অবিচার করেও যার কাছে প্রতিদিন আপনি জবাবদিহিতা করেন। নিজের অজান্তেই এক সমুদ্র অ’প’রা’ধ বোধ নিয়ে বাচ্চাগুলোর সামনে তাদের মাম্মার গল্প বলেন। এমন প্রতারক স্বামী কজন পায়? যার দীর্ঘশ্বাস নাম জপে তার,যার সাথে সে অবিচার করেছে।
রাওনাফ একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে উর্বীর দিকে। কিছুসময় পরে বলে ওঠে,”আর উর্বীর যায়গায় বসিয়ে কি দেখলে?”
_উর্বী এই লোকটাকে ডি’জার্ভ করে না। একদমই করে না। এই অসম সম্পর্কটি আদতেই একটি অসম সম্পর্ক। শুধু অসম বয়সের নয়, অসম মানসিকতার। একজন শুদ্ধ পুরুষকে ভাগ্যক্রমে পেয়ে গিয়েছে একজন আত্মকেন্দ্রিক, লোভী, স্বার্থপর মেয়ে।
কথাগুলো বলতে বলতে টপটপ করে উর্বীর চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পরতে থাকে। রাওনাফ বলতে থাকে,”আর রাওনাফের স্থানে নিজেকে বসিয়ে কি দেখতে পাচ্ছো।”
উর্বী নিশ্চুপ কেঁদে যাচ্ছে। রাওনাফ বলে,”বলো।”
উর্বী রাওনাফের বুকে ঝাঁপিয়ে পরে রাওনাফের শার্ট খামচে ধরে থাকে চুপচাপ। খানিক বাদে আটকে আটকে বলে,”ধৃষ্টতা নেই আমার এই মানুষটার স্থানে নিজেকে বসিয়ে তার অনূভুতি ব্যাখ্যা করার। শুধু বলবো মাথায়,মনে, যায়গা না হলেও পায়ে একটু স্থান চাই এই মানুষটার। আমার মতো স্বার্থপর মেয়েকে আপনার মতো করে শাস্তি কেউ দিতে পারবে না শর্মীর পাপা।”
রাওনাফ ম্লান হাসে। উর্বী কাঁদছে। একটু পরপর কেঁপে কেঁপে উঠছে। একহাত উর্বীর মাথায় রেখে রাওনাফ একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে। উর্বীর মাথাটাকে বুকের সাথে চেপে ধরে বলতে থাকে,”স্বার্থপরতার শাস্তি পেতে চাও নিজের মনের মতো করে,আসলেই স্বার্থপর তুমি!”
****
মোট তিন হাজার আটশো সাইত্রিশ টাকা।
খুচরা টাকা গুলো পরপর তিনবার গুনেও অর্থের পরিমাণ বাড়ানো কিংবা কমানো গেলো না। মোট টাকা তিন হাজার আটশো সাইত্রিশ। শর্মীর অর্থায়ন। যা সে গত চার মাস ধরে,যবে থেকে স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে সেদিন থেকে নিজের পকেট মানি থেকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে জমিয়েছে।
এই টাকা গুলো শর্মীর কাছে অনেক কিছু,কারন শর্মী একটা বিশাল পরিকল্পনা করেছে।
শায়মী হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকতেই শর্মী তার দিকে তাকিয়ে খিকখিক করে হেঁসে উঠে বলে,”তিন হাজার আটশো সাইত্রিশ টাকা।”
_হবে। আমার কাছেও পাঁচ হাজার আছে। আট হাজারেই হয়ে যাবে।
শর্মী তার চার ইঞ্চির মতো লম্বা চুল গুলোকে রাউন্ড হেয়ার ব্যান্ড দিয়ে পেছনে ঠেলে রেখেছিলো। ব্যান্ড টাকে একটানে সরিয়ে মাথাটাকে এদিকে ওদিকে দুলিয়ে নিজের সিল্কি চুলে আঙুল চালাতে চালাতে বলে,”আপু আমরা ভিডিও গেমস সেট কিনি? সেদিন ঝুমুর খালামনির ছেলে প্রান্তর জন্য ওর বাবা একটা নিয়ে এসেছে দেখলাম, লেটেস্ট একেবারে।”
শায়মী মুখে চ কারন্ত শব্দ করে বলে,”তোর মাথায় সবসময় গোবরই থাকবে মাথামোটা। বেবি কি জন্মেই ভিডিও গেমস দিয়ে খেলবে? কি খাস রে তুই!”
শর্মী লজ্জিত ভঙ্গিতে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে,”তাও ঠিক! তবে আমরা দেবো টা কি! দাদু গোল্ড দেবে, চাচ্চু চাচীরা গোল্ড দেবে,ফুপিরা গোল্ড দেবে। আমরা কি দেবো? গোল্ড তো দেবো না।”
_তুই আমার কাছে টাকাটা দে। আমরা কি দেবো সেটা পরে দেখতে পাবি।
এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে নাবিল ওদের ঘরে ঢোকে। তাড়াহুড়ো করে শায়মীকে বলে,”আন্ডাবাচ্চা গুলো চিৎকার চেঁচামেচি করতে করতে মাথা ধরিয়ে ফেলেছে। আমার হেডফোন খুজে পাচ্ছি না কোথাও,তোরটা দে।”
শায়মী মাথা নেড়ে তার হেডফোন খুঁজতে থাকে। শর্মী টাকাগুলো নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। শর্মীর হাতে টাকাগুলো দেখে নাবিল বলে,”এসব কি!”
_আমার।
_দেখে তো মনে হচ্ছে ভিক্ষে করেছিস। সব খুচরা নোট।
কথাটা বলে নাবিল হেসে দেয়।
শর্মী তেতে উঠে বলে,”জমানো টাকা।”
_বুঝতে পেরেছি। চেচাচ্ছিস কেনো! অভদ্র হয়েছিস! এসব তোদের নতুন মায়ের শিক্ষা?
শর্মী কপাল কুঁ’চ’কে দাঁড়িয়ে থাকে। বিরক্তিকর একটা ছেলে,একবার নতুন ভাই পৃথিবীতে আসুক। শর্মী পাত্তাই দেবে না এই ভাইটাকে।
নাবিল বলতে থাকে,”কি করবি এতো টাকা দিয়ে? চল পিৎজা অর্ডার করি।”
নাবিল টাকা গুলো মজার ছলে ছিনিয়ে নিতে যায়। শর্মী দুকদম পিছিয়ে গিয়ে বলে,”নতুন ভাইয়ের জন্য গিফট কিনবো।”
নাবিল থেমে যায়। শর্মীর মুখের দিকে তাকায়। তারপর কপাল কুঁ’চ’কে বলে ওঠে,”যত্তসব।”
“নাবিল বিহেভ ইওরসেল্ফ!”
শায়মী ধ’ম’কে ওঠে। নাবিল বলে ওঠে,”এসব আদিখ্যেতা আমার ভালো লাগে না।”
শর্মী বলে ওঠে,”ভাইকে তুমি আদর করবে না?”
নাবিল শর্মীর দিকে তাকিয়ে বলে,”কোন দুঃখে?”
_আমাদের ভাই! তাই!
_আমার কেউ না। ও পাপা আর তার বৌয়ের বেবি। আমার কেউ না! বুঝেছিস তোরা! আমার কেউ না কেউ না কেউ না। তোরা যা ইচ্ছা কর। আমাকে টানবি না এসবে!
_তো জানতে চাস কেনো আগ বাড়িয়ে,ফালতু ছেলে।
চেঁ’চি’য়ে ওঠে শায়মী। শর্মী আহত গলায় নাবিলকে বলে,”তুমি সত্যিই আদর করবে না ভাইকে!”
_জীবনেও না, কখনোও না। যত্তসব!
কথাটা বলে নাবিল শায়মীর হাত থেকে থাবা মেরে হেডফোন টা নিয়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।
শর্মী আর শায়মী একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে মুখ শুকনো করে।
আজ তারিখ কত! পাঁচ না ছয়! এমন হচ্ছে গত তিন মাস থেকে। কিছু মনে রাখতে পারছে না উর্বী। যত সময় ঘনিয়ে আসছে ততই তার হুঁশ জ্ঞান হারাচ্ছে সে। সময়ের তাল খুজে পায়না,আজ কি বার মনে করতে পারে না। শুধু বিছানায় শুয়ে হাঁসফাঁস করতে থাকে। বেশিরভাগ সময় কাটে তার খোলা বারান্দায়।
হাত বাড়িয়ে টেবিলের ওপর থেকে ছোটো নকশি কাঁথাটা তুলে নেয় সে। এটা সে অর্ধেকটা সম্পূর্ণ করেছে, তারপর অলসতার জন্য করেনি। দু তিন দিন ধরে পরে আছে টেবিলের ওপর। অবশ্য রাওনাফ এসব দেখলে খুব রেগে যায়। তাই রাওনাফ বাড়িতে থাকাকালীন সময়টাতে উর্বী হাত লাগায়না এসবে।
বাড়ি থেকে তহুরা অসংখ্য নকশিকাঁথা সিলিয়ে পাঠিয়েছে। উর্বী হাত বাড়িয়ে ফোনটা তুলে নেয়। ও বাড়ির লোক গুলোর সাথে উর্বীর কথা হয়না অনেকদিন হয়ে গিয়েছে। তাই উর্বী ফোন লাগায় রেজাউলের কাছে। ওপাশ থেকে রেজাউল ফোনটা রিসিভ করেই বলে ওঠে,”ভুল করে ফোন দিলি!”
উর্বী হাসে,মুখে বলে,”হ্যা।”
রেজাউল বলতে থাকে,”মা খুব দেখতে চাইছে তোকে।”
_তো নিয়ে আসো। কেনো আসছো না এখনও তোমরা!
_মায়ের ইচ্ছে একেবারে নাতী নাতনির মুখ দেখবে গিয়ে। আর এদিকেও অনেক কাজ আছে। তোর শশুর বাড়ির জন্য এটা সেটা কত কিছু প্রস্তুত করছে নিয়ে যাবে বলে। নাতী নাতনির জন্য তার জমানো টাকা দিয়ে একটা আংটি গড়েছে।
_উনি রাগ করবে ভাইয়া শুনলে। ওসবের প্রয়োজন নেই।
_আছে। মা প্রথমবারের মতো নানী হচ্ছে। তার আনন্দটুকু বোঝ!
উর্বী হাসে। তহুরা রেজাউল কবিরের হাত থেকে ফোন নিয়ে অনেকটা দূরে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,”কোনো অসুবিধে বুঝিস?”
_না ভাবী। ঠিকঠাক সব।
_শোন। আমরা দুদিন আগেই চলে আসবো সবাই। উপমাও যাবে। তুই ঘাবড়াস না! অসুবিধা ঠেকলে রাওনাফ ভাইকে জানাবি। পারিস তো মুখে তালা লাগিয়ে বসে থাকিস।
_ওনাকে কিছু জানাতে হয়না ভাবী। উনি আমার জানার আগেই সব কিছু জেনে যায়।
ফোনের ওপাশে থাকা তহুরা দেখলো না কথাটা বলতে গিয়ে উর্বীর চোখেমুখে কতরাজ্যের লজ্জা এসে ভীড় করেছে।
তহুরা জবাব দেয়,”হু। ডাক্তার স্বামী পেয়েছিস। আর এদিকে তোর ভাইকে দেখ। যদি বলি শুনছো,আমার শরীরটা কেমন করছে। বলে একটা নাপা খেয়ে নাও।”
উর্বী হাসে ভাবীর কথায়। হাসে তহুরাও। কথায় কথায় আটত্রিশ মিনিট কাটিয়ে ফোনটা কেটে দেয় উর্বী। ফোনের স্ক্রিনে আজকের তারিখ টা দেখে। আজ মার্চের সাত তারিখ। উর্বীর ভেলিভারির তারিখ ইউএসজির রিপোর্ট অনুযায়ী সতেরো তারিখ। এখনও হাতে দশদিন বাকি।
ফোনটা রেখে উর্বী ধীরে ধীরে নিজের পেটে হাতটা রেখে আয়নার দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে নিজেকে। এতগুলো মাসে উর্বীর শারীরিক গঠন এবং চেহারার সাথে সাথে অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়েছে। রাওনাফের তার প্রতি যত্নের পরিমাণ বেড়েছে দ্বিগুণ, শর্মী শায়মীর আন্তরিকতা বেড়েছে বহুগুণ। যেটা কখনও বদলায়নি সেটা হচ্ছে নাবিল উর্বীর সম্পর্ক। না উন্নতি ঘটেছে,না অবনতি।
উর্বী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। দোতলার লিভিং রুমে আজমেরী আর রুমার বাচ্চারা হৈচৈ করে ক্যারাম খেলছে। গোটা রওশান মঞ্জিল গমগম করছে। চট্টগ্রাম থেকে মোহনা শাফিউল এসেছে, অন্তরা সামিউল এসেছে। মোহনার ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে এ বাড়ির সবাই নিমন্ত্রিত। তাই আজমেরী,রুমাও যার যার শশুরবাড়ি থেকে চলে এসেছে।
উর্বী আয়নার সামনে থেকে সরে দাঁড়ায়। আজ রাওনাফের লাঞ্চের আগেই বাড়িতে ফেরার কথা। এখনও ফেরেনি। দিন দিন লোকটা ভীষণ ব্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। অবশ্য তাতে পরিবারকে সময় দেওয়ায় খুব একটা ব্যাঘাত ঘটে না।
উর্বী একটা সুতি কাপড়ের ম্যাটার্নিটি পোষাক পরে আছে। ঘর থেকে বেরোনোর আগে সে ও’ড়না দিয়ে পেটটাকে ভালো করে ঢেকে নেয়,এভাবে বাড়ি ভর্তি মানুষ,ননদদের স্বামীরা,দুজন দেবর, এদের সামনে হেঁটে বেড়াতে ভীষণ লজ্জা লাগে তার। তাই সে সকাল থেকে ঘর থেকে বেরোয় নি। কিন্তু এভাবে কতক্ষন ঘরে থাকা যায়! সবাই কিচেনে কত মজা করছে , হাসাহাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। সন্ধ্যায় বাড়িতে মেহমান আসবে মোহনাদের বাড়ি থেকে,সবাই কাল মোহনার বাপের বাড়িতে যাবে বিয়ের অনুষ্ঠানে অংশ নিতে,তাই সব পরিকল্পনা করে নিচ্ছে।
ওড়নাটা মাথায় টেনে উর্বী ঘর থেকে বের হওয়ার জন্য দরজার দিকে যায়। উর্বী আর রাওনাফ দোতলা থেকে নিচতলায় নাবিলের ঘরের পাশের ঘরটিতে শিফট করেছে আরো তিন মাস আগে। এই অবস্থায় উর্বীর সিড়ি ভাঙা সেফ না তাই।
দরজার বাইরে পা রাখার আগেই রাওনাফ হুট করে ঘরে ঢুকে পরায় উর্বীর সাথে ধাক্কা লেগে যায় তার। মুহুর্তেই শক্ত হাতে উর্বীকে আগলে নেয় রাওনাফ। উর্বী হাপাচ্ছে। কিছুটা ভয় পেয়েছে সে। রাওনাফ উর্বীকে দাড় করিয়ে বলতে থাকে,”দৌড়াচ্ছো কেন?”
_দৌড়াচ্ছিলাম না তো।
কথাটা বলে উর্বী রাওনাফের ক্লান্ত মুখটার দিকে তাকায়। মার্চের গরমেই ঘেমে নেয়ে একাকার! রাওনাফ বরাবর ছিলো মেদহীন একজন পুরুষ,এই কমাসে স্বাস্থ্য যেন আগের থেকেও কিছুটা কমেছে। চেহারায় খানিকটা মধ্যবয়সী ছাপ তো আছেই কিন্তু বডি দেখে কখনোই রাওনাফের বয়স আন্দাজ করা যাবে না। যেসব পুরুষ খুব আরামে থাকে, চল্লিশের পরে তাদের মুটিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে ডক্টর খানের জীবনে আরাম বলতে তো কিছুই নেই,শুধুই ছোটাছুটি, পরিশ্রম। তার ওপর উর্বী নামের আস্ত একটা ঝামেলা কাঁধে তার! তাই সে ফিট।
রাওনাফ বলতে থাকে,”এক্ষুনি পরে যেতে!”
উর্বী বলে,”আমি ঠান্ডা ঠান্ডা শরবত নিয়ে আসছি। দুপুরে যা গরম পরতে শুরু করেছে। আপনি ফ্রেশ হোন।”
উর্বী ঘর থেকে বেরোতে গেলে রাওনাফ তার হাত টেনে ধরে। উর্বী রাওনাফের দিকে তাকায়। রাওনাফ টেনে উর্বীকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলে,”প্রয়োজন নেই। আপনাকে অসংখ্য অসংখ্য ধন্যবাদ।”
উর্বী হাসে। রাওনাফ উর্বীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,”তোমাকে এখন আর হাসের ছানা লাগছে না।”
_কি লাগছে তবে।
_বলবো না,রেগে যাবে।
_আপনাকে কেমন লাগছে বলবো?
_বুড়ো লাগছে! আই নো!
উর্বী হাসে,হেসে মাথা নেড়ে বলে,”হ্যান্ডসাম লাগছে। হ্যান্ডসাম পাপা অব থ্রি চাইল্ড!”
_ফোর…ফোর চাইল্ড!
উর্বীকে শুধরে দেয় রাওনাফ। রাওনাফের কথায় উর্বী মাথা নিচু করে মুচকি হাসে।
রাওনাফ টাইয়ের নট খুলতে গেলে উর্বী উঠে নিজে খুলতে থাকে। সে তাকিয়ে আছে উর্বীর দিকে। বলে,”মেয়েরা তাদের ভাইদের জন্য একটা টয় সেট অর্ডার করেছে। তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে চাচ্ছে। ওরা যখন জানবে ওদের ভাই না,বোন আসবে তখন ওরাই সারপ্রাইজড হয়ে যাবে। আমাদের উচিত ওদের সাথে শেয়ার করা।”
উর্বী মাথা নেড়ে বলে,”না। বলবো না। দেখি দুটোতে কি করে!”
রাওনাফ হাসছে। হাসতে হাসতে বলে,”তোমার স্বভাব থেকে বাচ্চামো গেলো না।”
উর্বী বলে,”আপনার স্বভাবে এতো লাই মিশে আছে তাই!”
ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে রাওনাফ বলে,”আমি তিনদিন হসপিটালে যাচ্ছি না।”
_ওমা কেনো!
_মোহনার বাপের বাড়ি থেকে এতো করে বললো। সবার যাওয়া উচিত। আমি ভাবছি আমি থেকে যাবো বাড়িতে, তোমার কাছে। সবার আনন্দ কেন নষ্ট করবো!
_আর আপনার আনন্দ?
প্রশ্নটা করে উর্বী তাকিয়ে থাকে রাওনাফের দিকে,কয়েক মুহূর্ত পরে আবারও বলে,”আপনার আনন্দ?”
রাওনাফ ম্লান হাসে। একটা হাত বাড়িয়ে উর্বীকে বলে,”এদিকে এসো।”
উর্বী দরজা চাপিয়ে দিয়ে রাওনাফের কাছে এগিয়ে যায়। রাওনাফ আদুরে হাতে উর্বীকে আগলে নিয়ে তার একটা হাত উর্বীর পেটের ওপর রেখে বলে,”আমার আনন্দ এখানে।”
****
লিভিং রুমে সবাই আড্ডা দিচ্ছে। মোহনার বাপের বাড়ি থেকে তার মা এবং বড় বোন এসেছে সবাইকে নিয়ে যেতে।
উর্বী তার ঘরে শুয়ে আছে। শরীরটা খুব একটা ঠিক নেই। খানিকটা অস্বস্তি লাগছে।
লিভিং রুমে রওশান আরার সাথে মোহনার মায়ের তর্কাতর্কি চলছে। রওশান আরার কথা,তার বড় বৌয়ের এই অবস্থাতে সে কিছুতেই যাবেনা কোথাও। বাকিরা গেলে যাক।
মোহনার মা আর বোন আপত্তি জানিয়েছে ।শুধু তাই নয় তারা চায় উর্বীকেও সাথে করে নিয়ে যেতে।
রওশান আরা চোখ কপালে তুলে বলে,”খেপেছেন বেয়ান? বৌমার এই অবস্থায় ও যাবে বিয়ে খেতে? অসম্ভব।”
মোহনার মা আফসানা বেগম একপর্যায়ে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করা শুরু করে দেয়। রওশান আরা চিন্তায় পরে যায়।
রাওনাফ বলে,”মা তোমরা যাও না। উর্বী থাকুক। আর আমি তো আছিই। আমীরুন আছে। তোমরা না গেলে সাদিফ কষ্ট পাবে। আমাকে কিছুক্ষণ আগেও ফোন করেছিলো। দুটো দিনেরই তো ব্যাপার। খালাম্মা কষ্ট পাচ্ছেন।”
উর্বী ঘর থেকে বের হয়ে গুটি গুটি পায়ে লিভিং রুমে আসে। তার এভাবে আসতে ভীষণ লজ্জা লাগছে। তার পরনে একটি সুতি কাপড়ের ম্যাক্সি। ওরনা দিয়ে পেট ঢেকে রেখেছে।
আফসানা বেগম দেখে বলে,”ওই যে এলো বড় বৌ। আহারে! কি চাদপানা মুখটা একেবারে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। থাক ওকে আর কষ্ট দেবো না। একেবারে নাতী সহ বৌকে নিয়ে যাবো আমার বাড়িতে একদিন।”
রওশান আরা সাথে সাথে বলে,”আমিও থাকি বেয়ান। প্লিজ মনে কিছু নেবেন না। কখন কি হয়ে যায়, দুশ্চিন্তা হয়তো খুব।”
নাবিল এতক্ষন বসে ছিলো। উর্বীকে দেখে সে উঠে দাঁড়ায়। তারপর পাপার দিকে তাকায়। রাওনাফের মুখ হাসি হাসি। তাকে ভীষণ খুশি লাগছে। খুশি তো হবেই। তার আদরের বাচ্চা আসতে চলেছে। যাকে পেয়ে পাপা নাবিলকে ভুলে যাবে।
আফসানা বেগম নাবিলকে বলে,”কি দাদু ভাই। তুই দাড়িয়ে গেছিস কেনো। বস।”
_না, তোমরা গল্প করো দাদু। আর হ্যা, সাদিফ মামাকে বলে দিও তার বিয়েতে না যেতে পেরে দুঃখিত আমি। আসলে এই ডিবেট কম্পিটিশন টা আমার কাছে খুব ইম্পরট্যান্ট। মামাকে বুঝিয়ে বলো।
নাবিল চলে যায়।
আফসানা রওশান আরার দিকে তাকিয়ে বলে,”ব্যাস হয়ে গেলো। কি আর করা, এখন আপনি আর বাড়ির সবাই সব গুছিয়ে নিন। বেশি না,মাত্র দু’দিন কষ্ট দেবো সবাইকে।
রওশান আরা চিন্তিত ভঙ্গিতে উর্বীর দিকে তাকায়। তার মন একটুও সায় দিচ্ছে না।
****
বাড়ির সবাই সকাল সকাল ঝুম বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে পরেছে। দশ তারিখে একটা বন্যা হওয়ার সম্ভাবনা আছে তাই আবহাওয়া বৈরী কিছুটা। বাড়িতে আছে শুধু উর্বী, রাওনাফ, নাবিল এবং আমীরুন।
নাবিল নিজের ঘরে বসে পড়ছে। বাইরে ঝুম বৃষ্টি পরছে, রাজধানীতে শুধু বৃষ্টিপাত হলেও দক্ষিনাঞ্চলের অবস্থা ভয়াবহ।
সন্ধ্যা পেরিয়ে প্রায় রাত হয়ে এসেছে।
রাওনাফ আর উর্বী তাদের ঘরে। উর্বীকে জরিয়ে ধরে রাওনাফ শুয়ে আছে।
উর্বী হাপাচ্ছে। রাওনাফ বলে,”কি হয়েছে? কষ্ট হচ্ছে?”
উর্বী মাথা নাড়ায়। সে রাওনাফের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে বসতে চায়।
রাওনাফ টেনে ধরে,”কোথায় যাচ্ছো।?”
_আপনাকে কিছু একটা বানিয়ে দেই। বৃষ্টি পরছে বাইরে। নাবিলকেও দেই।
রাওনাফ উর্বীকে জোর করে শুইয়ে দেয়, ধ’ম’কে বলে ওঠে,”বাড়াবাড়ি টা কম করলে হয়না?”
উর্বী উদাস ভঙ্গিতে তাকায়।
রাওনাফ উর্বীর কপালে চু’মু খেয়ে বলে,”আজ মনটা একটু খারাপ মনে হচ্ছে! কি হয়েছে?”
উর্বী মাথা নাড়ায়। কিছুই হয়নি তার। শুধু বৃষ্টি দেখলে তার ভালো লাগে না। বৃষ্টি তাকে সেদিনের কথা মনে করিয়ে দেয়।
রাওনাফ বলে,”আমার শাশুড়িকে ফোন করে আসতে বলেছি। দিন দুয়েকের মধ্যেই চলে আসবে। এখন ও মন খারাপ?
উর্বী মাথা নাড়ায়। মাথাটা রাওনাফের বুকে রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এই মানুষটা তার জীবনে না এলে সে কি করতো! আদৌও কি এতদিন বেঁচে থাকতো! সেটাই ভাবছে সে।
রাওনাফ আর কোনো প্রশ্ন করার আগে তার ফোন বেজে ওঠে। সে বুক থেকে উর্বীর মাথাটা আলতো করে ধরে সরিয়ে দিয়ে উঠে ফোনটা রিসিভ করে।
কিছুক্ষণ পরে সে উঁচু গলায় ফোনে বলতে থাকে,”মানে টা কি? আমি তো আমার এস্কেজিউল ক্যানসেল করেছি আগে ভাগেই। আমার পক্ষে এখন সম্ভব না।”
ওপাশ থেকে লামিয়া বলছে,”বুঝতে পেরেছি রাওনাফ। তবে রোগীর অবস্থা খুব খারাপ। তারা এসে আমার হাতে পায়ে ধরছে। বড্ড মায়া লাগছে। তুমি ছাড়া এত বড় রিস্ক আমি নিতে পারবো না রাওনাফ। রোগীর পরিবার তোমার ভরসাতে আছে। প্লিজ রাওনাফ, বোঝার চেষ্টা করো।”
রাওনাফ ফোন কানে চেপে ধরেই উর্বীর দিকে তাকায়। উর্বী এদিকেই তাকিয়ে আছে।
ফোনের ওপাশ থেকে লামিয়া বলতে থাকে,”রাওনাফ একটু বোঝো! প্লিজ।”
_ঠিক আছে আমি জানাচ্ছি তোমাকে।
শুকনো গলায় জবাব দেয় রাওনাফ।
তারপর ফোন টা রেখে দিয়ে উর্বীকে ডাকে,”উর্বী!”
_জি। কি হয়েছে? কার ফোন ছিলো।
উর্বী পেটে হাত চেপে ধীরে ধীরে উঠে বসে।
রাওনাফ চিন্তিত ভঙ্গিতে তার পাশে গিয়ে বসে, উর্বী একটু ঝামেলায় পরে গেছি। আজ একটা পেশেন্টের ওপেন হার্ট সার্জারির কথা ছিলো। ক্রি’টিক্যাল কনডিশন। আজ অপারেশন টা না হলে হয়তো একটা অঘটন ঘটে যাবে। এটা ডক্টর মাহমুদের কেস ছিলো। ওর শাশুড়ি হঠাৎ মা’রা গিয়েছেন। এই মুহূর্তে পেশেন্টকে অন্য হসপিটালে শিফট করলে সেটা রিস্কি!
_সেকি কথা। আপনি যান এখনই।
রাওনাফ শুকনো গলায় বলে,”তোমার এই অবস্থায়!”
উর্বী রাগ দেখিয়ে বলে,”মানে টা কি! আজব লোক তো আপনি! মাত্র কিছু ঘন্টার ব্যাপার। আর এখনও হাতে ঢের সময়। আপনি এখনই এতো টেনশন শুরু করে দিয়েছেন। আরে আমি ঠিক আছি। এইযে দেখুন, একেবারে ঠিক।”
উর্বী উঠে টান টান হয়ে দাঁড়িয়ে রাওনাফকে তার সুস্থতা দেখায়।
রাওনাফ ই’তস্তত করে।
উর্বী বলে,”রোগীর জীবনটা বেঁচে গেলে আল্লাহ খুশি হবেন আর সেটাতে আমাদের সন্তানদের ভালো হবে। আপনি যান। আমীরুন আছে না? ওকে ডেকে আমার রুমে পাঠিয়ে দিয়ে যান। আমি এখানেই শুয়ে থাকবো আপনি না আসা পর্যন্ত। একটুও নড়বো না,লাফাবো না,কথা দিচ্ছি।”
রাওনাফ বসে থাকে। উর্বী রাওনাফকে ঠেলতে ঠেলতে বলে,”যান বলছি!”
রাওনাফ একরাশ অনিহা নিয়ে,চিন্তিত ভঙ্গিতে রেডি হয়ে চলে যায়।
যাওয়ার সময় আমীরুনকে আলাদা ডেকে নিয়ে বলে,”সারাদিন উল্টো পাল্টা কিসব ভাবে আর দুশ্চিন্তা করে। একটু চোখে চোখে রাখিস।”
আমীরুন বলে ,”আপনে একটুও চিন্তা করবেন না ভাইজান। আমি ভাবীর কাছ থেকে নরুমই না।”
চলমান…..
[শেষ পর্বের ২য় অংশ রাত ৮টায় পোস্ট করা হবে। সবাই অনুগ্রহ করে চেক করে নেবেন!]