#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_৩৬
#Esrat_Ety
দু’জনে দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুসময়ের জন্য পুরো কামরা নিস্তব্ধ হয়ে আছে। ভেজা গাল দুটো অস্বস্তি দিচ্ছে উর্বীকে।উর্বী হাতের পিঠ দিয়ে গাল মুছে নেয়।
বাইরে থেকে দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হয়। রাওনাফ মাথা ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকায়। দরজার বাইরে একজন জুনিয়র নার্স দাড়িয়ে,বলে ওঠে,”স্যার ম্যাম….”
“ম্যাম একেবারেই ঠিক আছে আফসানা। তুমি যাও।”
আফসানা রাওনাফের কথায় চলে যায়। কেবিনের বাইরে ইমার্জেন্সি ডেস্কে বসা দুজন নার্স মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। একজন চাপা স্বরে অপরজনকে বলছে,”দরজা বন্ধ করে কি করছেন স্যার!”
আরেকজন নার্স গলা খাঁকারি দিয়ে নিচু গলায় বলে,”হয়তো স্যার তার ওয়াইফকে জীবনমুখী শিক্ষা দিচ্ছে।”
রাওনাফ ঘা’ড় ঘুরিয়ে উর্বীর দিকে তাকায়। তারপর ঠান্ডা গলায় বলতে থাকে,”আমাকে দেখে একটুও অবাক হয়ো না তুমি। এখন আমি হা’র্ট সা’র্জন রাওনাফ করীম খান নই। আমি মৃদুলা উর্বীর স্বামী রাওনাফ করীম খান। এই বন্ধ কামরার ভেতরে আজ কোনো অ’ভিজ্ঞ ডাক্তার কিংবা পে’শেন্ট নয় বরং দুজন স্বামী স্ত্রী আছে উর্বী। কোনো ডাক্তার তোমার সাথে কথা বলছে না,তোমাকে দেখছে না, একজন ডাক্তারের চোখে তুমি সহানুভূতি ডিজার্ভ করো এই অবস্থায়, কিন্তু একজন স্বামী নিজের বিধ্বস্ত অনূভুতি পাশে সরিয়ে রেখে তোমাকে দেখবে না। এতোটা মহান ভেবো না আমাকে। বোঝাপড়া দুজন স্বামী স্ত্রীর হচ্ছে, অনুভূতির দ্বন্দ দুজন স্বামী স্ত্রীর হচ্ছে।”
উর্বী চুপ করে আছে। রাওনাফ বলতে থাকে,”চলো হিসেব শুরু করি। তুমি গত সাত বছরে অনেক কিছু সহ্য করেছো উর্বী। আমি জানি! যেগুলোর সিকিভাগও আমি সহ্য করিনি জীবনে। গত কয়েকদিনে তোমার ওপর দিয়ে কি বয়ে গিয়েছে আমি সব জানি উর্বী। কোনো কিছুই আমার অবগতি, উপলব্ধির বাইরে নয়।
কিন্তু তুমি জানো না উর্বী,এতো কিছু সহ্য করার পরেও যে মেয়েটা কখনো সুই’সা’ইডের কথা মাথায় আনেনি সে মেয়েটা শুধুমাত্র কিছু ভুল ধারণার ওপর ভিত্তি করে,কিছু ভুল ধারণাকে আকরে ধরে নিজের জীবনটা খোয়াতে বসেছিলো। শুধু নিজের জীবন নয়,সাথে আরো একটা প্রাণ।
উর্বী তোমার ধারণা গুলো যদি সত্যি হতো তাহলে আমি বিন্দুমাত্র আফসোস করতাম না,কিন্তু তোমার ধারণা সব ভুল উর্বী। ওটা বিতৃষ্ণা ছিলো না মৃদুলা উর্বী, ওটা একজন স্বামীর অধিকারবোধ ছিলো স্ত্রীর প্রতি। অধিকারবোধ কখনো বিতৃষ্ণা হতে পারে না। আমি তো প্রশ্ন তুলেছিলাম কেনো আমাকে ভরসা করতে পারলে না। সেটা কিভাবে তুমি বিতৃষ্ণা ধরে নিলে? উর্বী আমি একটা রক্ত মাংসে গড়া মানুষ। আমি যদি তোমার মনের মতো প্রতিক্রিয়াই দিই তবে আমার স্বকীয়তা কোথায়? একজন মানুষ কখনও আরেকজন মানুষের মনের মতো সাডেন রিয়াক্ট চাইলেও করতে পারে না,তবে অপর মানুষটা চাইলেই বোঝার চেষ্টা করতে পারে। যেটা তুমি করোনি।
কি? এখন নিশ্চয়ই এটা বলবে যে আমি কেবল আমার বাচ্চার কথাই ভেবেছি, বাচ্চার কথা ভেবে তোমার জন্য কষ্ট পেয়েছি । কারন আমি শুধু বাচ্চার প্রতিই কনসার্ন দেখাচ্ছি। তোমার এই পরিস্থিতিতেও আমি শুধু বাচ্চা বাচ্চা করছি। বাচ্চাটা না থাকলে এতটা কনসার্ন দেখাতাম না। এটাই বলবে তো তাইনা? বলো ,বলো, ট্রাস্ট মি উর্বী! আমি একটুও অবাক হবো না তুমি এখন এমন বললে। কারন তোমার চরিত্র অনুযায়ীই তো তুমি বলবে।”
উর্বী চুপ করে থাকে। রাওনাফ বলতে থাকে,”হ্যা,এটা যদি তুমি বলো তাহলে ঠিকই বলবে,কারন সত্যিই আমার কনসার্ন শুধু আমার বাচ্চার জন্যই। আমি কোনো মৃদুলা উর্বীকে নিয়ে ভাবিই না। আমি খুব খারাপ একজন স্বামী,যাকে ভরসা করা যায়না।”
উর্বী রাওনাফের দিকে তাকায়, নীরবতা ভেঙে বলে ওঠে,”আমি এমন কিছু ভাবিই নি। আমি তো বললাম, চিঠিতে লিখলাম, আমি বেঁচে থাকলে এমন ভুল হতেই থাকবে, আর আমার জীবনের ফুলগুলো কষ্ট পাবে তাই….”
_আর মরে গেলে? মরে গেলে ফুলগুলো আর কষ্ট পাবে না? অতঃপর তারা সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল। এমন হবে? তাইতো?
উর্বী রাওনাফের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে কিছু বলতে যাবে তখনই রাওনাফ উর্বীকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
“শর্মী….উর্বী শর্মীর কষ্ট তোমার জন্য, তোমার ভুলের জন্য হয়েছে কি হয়নি সেই যুক্তিতর্কে যেতে চাচ্ছি না। আমি শুধু জানি শর্মীর এই অবস্থার জন্য মৃদুলা উর্বী কিছুটা হলেও দায়ী থাকলেও একজন মা কখনও দায়ী নয়। উর্বী আমি তো অনেকদিন আগে থেকেই এমন ভেবে ফেলেছি। তুমি ভাবতে বাধ্য করেছো। সেখানে আমি একজন মা উর্বীকে কিভাবে দোষারোপ করবো? এতোটা ধৃষ্টতা আমার নেই! আমি তো অভিযোগ করেছি আমার স্ত্রী উর্বীকে! সেটুকু কি আমার অধিকারের মধ্যে পরেনা উর্বী?”
উর্বীর দু’চোখ বেয়ে দুফোঁটা তরল গড়িয়ে পরে। মাথা নাড়িয়ে অস্ফুট স্বরে বলে,”পরে।”
_অভিযোগের ধরনটা ভুল ছিলো,নাকি তোমার বোঝাটা ভুল সেগুলো নিয়েও যুক্তিতর্কে যাবো না। কিন্তু উর্বী,তুমি গোটা ব্যাপারটা যাস্ট “আমি আবারও ভুল করেছি শর্মীর পাপা!” বলে শেষ করে দিলে!
তোমার একটা ভুলে,আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিলো উর্বী। পুরোটা সময় ছ’ট’ফ’ট করেছি,বলেছি উর্বী শুধু আমাকে ভুল বুঝে যেও না। তোমার কাছে আমার অসহায় অনুভূতির সমর্পণকে তুমি আমার বিতৃষ্ণার বহিঃপ্রকাশ ভেবে চলে যেও না। আমি কখনো অভিযোগ তুলবো না,যত ইচ্ছে বোকামি করো!”
উর্বী পুনরায় ফুঁপিয়ে ওঠে। মাথাটা রাওনাফের গায়ে ঠেকিয়ে বলতে থাকে,”ক্ষমা চাচ্ছি।”
রাওনাফ একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে নিজের হাতের দিকে তাকায়। তারপর বলে,”একটা সময় মনে হয়েছে তুমি নেই! চলে গিয়েছো। সব শেষ,আমি হারিয়ে ফেলেছি তোমাকে!”
রাওনাফের সে কথায় উর্বী টের পায়,কি প্রগাঢ় ভালোবাসা উর্বী হারাতে বসেছিলো অভিমানের বসে। পোড়াকপালি। কপাল তো আজীবনেরই পোড়া। সে নিজেই কি না বাকি টা শেষ করে দিচ্ছিলো। তার সাথে যে তার মধ্যে বেড়ে উঠছিলো,তাকেও কি না! আবারো সেই একই মহাপাপ। সে কত জঘ’ন্য!
উর্বী হাউমাউ করে কেঁদে বলতে থাকে,”পাপ করেছি আমি। মহাপাপ।”
রাওনাফ উর্বীর গাল দুটো ধরে,নরম গলায় বলে,”কাঁদতে হবে না। এবার একটু থামো! এটা ছাড়া কি আর কিছুই পারো না তুমি? থামো এবার। থামো! ”
রাওনাফ পুনরায় নিজের হাতের দিকে তাকায়। তারপর অসহায়ের মতো উর্বীর দিকে তাকায়। তারপর বলে,”আমি কঠোর হয়ে থাকতে পারিনা উর্বী। চাইলেও পারিনা। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি,আর কখনো কোনো ধরণের অধিকারবোধ দেখাবো না,যা তোমাকে অস্বস্তি দেয়। ”
উর্বী বেডের চাদর খামচে ধরে। কন্ঠে আকুতি নিয়ে বলে,
_কেনো দেখাবেন না! একশো বার দেখাবেন! হাজার বার দেখাবেন! আমি ক্ষমা চাইছি তো!
রাওনাফ তাকিয়ে থাকে। উর্বী বলতে থাকে,”ক্ষমা করে দিন আমাকে! ক্ষমা করে দিন না। আমি প্রমিজ করছি, আজকের পর থেকে আমি আর কোনো ভুল করবো না যা আপনাকে কষ্ট দেয়! আমার জীবনের ওপর আপনার,আপনাদের পূর্ণ অধিকার আছে! আপনারাও এই জীবনের দাবিদার। প্রমিজ করছি আপনাদের অনুমতি ব্যাতীত এই জীবনকে আর কষ্ট দেবো না আমি।”
রাওনাফ চোখ সরিয়ে নেয়। অবিশ্বাস আর অভিমানে। উর্বী তা বুঝতে পারে। দু হাতে রাওনাফের গাল আগলে ধরে মুখটাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয়। তারপর কাতর কন্ঠে বলে,”শর্মীর পাপা!”
রাওনাফ হাত মুঠো করে ফেলে। ভেতরটা অনুভূতি তোলপাড় করলেও বাইরে কাঠিন্যতা বজায় রেখে চুপ করে থাকে। উর্বী পুড়ছে। অ’প’রা’ধ বোধ হচ্ছে তার ভীষণ। নরম গলায় বলে,”একজন সুই’সা’ইডের পেশেন্টকে চ’ড় মারা,এখন তার থেকেই মুখ ঘুরিয়ে থাকা। অযোগ্য ডাক্তার ,আপনিও যে খুব হৃদয়হীন। আমার মতো হৃদয়হীনার সাথে পাল্লা দিতে চাচ্ছেন নাকি!”
রাওনাফ নিজের গাল থেকে উর্বীর হাত সরিয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নেয়। উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে,”সাত বছর। সাতবছর তুমি মানুষের গঞ্জনা শুনে কাটিয়েছো উর্বী। আর গত চব্বিশটা ঘন্টা আমি নিজে নিজেকে গঞ্জনা দিয়েছি। ঐ সাত বছর আর এই চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই উর্বী!”
উর্বী ঢোক গিলে নেয়। রাওনাফ ধীরে ধীরে নিজের হাতটা উর্বীর গালে রাখে। কাঁপা গলায় বলে,”তুমি মুখে বললেও তুমি এখনও এটাই মানো তুমি তোমার জীবনের একক দাবিদার। সেখানে অন্যকারো কোনো অংশ নেই!”
_না মানি না,যখন আপনি আমাকে চ’ড় মেরেছেন। ঠিক সেই মুহূর্তে আমি আপনার প্রতি করা আমার অবিচারের পরিমাণ উপলদ্ধি করেছি। আমি একটুও নারাজ হইনি ঐ সময়টায়। বরং আমি আমার স্বামীকে অনুভব করতে পেরেছি।
রাওনাফ উর্বীকে কাছে টানে । দু’হাতে আঁকড়ে ধরে দুই গালে অগণিত চু’মু দিতে থাকে। পরম স্পর্শে শিক্ত হয়েও উর্বী স্বস্তি পাচ্ছেনা। মানুষটা তাকে ক্ষমা করতে পেরেছে তো! দু’চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিয়ে বলতে থাকে,”নিজেকে আরেকটি বার শুধরে নিতে আপনার সাহায্য দরকার। কথা দিচ্ছি, নতুন উর্বীকে পাবেন।”
রাওনাফ চু’মু দিয়ে ভরিয়ে দেয় উর্বীর দুই গাল। তারপর উর্বীর দুই গাল হাত দিয়ে আগলে ধরে উর্বীর চোখে চোখ রাখে,বলে,”বাড়িয়ে ছিলাম হাত সাহায্যের জন্য। তুমিই নিলে না। এখন একা একাই করতে হবে তোমাকে।”
উর্বী আহত হয়, রাওনাফের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”তবে কেন বলেছিলেন “আমি আছি,আমি থাকবো!”
রাওনাফ বলে,”সেটা এখনও বলছি। বরাবর বলবো,”আমি আছি, আমি থাকবো।” কিন্তু পুরনো উর্বীকে ভাঙতে হবে তোমায় নিজের,গড়তে হবে নিজের।”
উর্বী নিজের অসহায় অনুভূতি ঢাকতে শুকনো হাসি হাসে। মানুষটার এহেন আচরণ অস্বাভাবিক কিছু নয়। উর্বী বুঝতে পারছে উর্বীকে একটা লম্বা জার্নি শেষ করতে হবে উর্বীর জীবনে মানুষটার গুরুত্ব কতখানি এটা মানুষটাকে বোঝাতে। তার জীবনে মানুষটার দাবি আছে,অংশের মালিকানা আছে এটা মানুষটাকে বোঝাতে তাকে কাঠখড় পোড়াতে হবে।
উর্বী চোখ মোছে। রাওনাফ গাল থেকে হাত সরিয়ে নেয়,উর্বী রাওনাফের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”এ কদিনে বেশ বুড়ো হয়ে গেছেন আপনি শর্মীর পাপা।”
রাওনাফ ম্লান হাসে। বলে,”তোমাকেও কোনো তেইশের তরুণী লাগছে না মৃদুলা উর্বী।”
উর্বী হাসে। একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে নেয়। বাইরে থেকে আবারও দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হয়। রাওনাফ বলে,”আফসানা তোমাদের ম্যাম ঠিক আছে।”
_স্যার, আপনার মা এসেছে।
রাওনাফ উঠে দাঁড়ায়। উর্বী তার দিকে তাকিয়ে আছে। রাওনাফ বলতে থাকে,”সবাইকে তোমার নিজের ফেস করতে হবে। আমার কিছু করার নেই। আমি চাই তুমি অ’প’রা’ধ বোধে ভোগো।”
রাওনাফ উঠে গিয়ে দরজাটা খুলে দেয় কেবিনের। রওশান আরা কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। তার সাথে মোহনা এবং অন্তরা। রাওনাফ তাদের কিছু না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
****
রওশান আরা উর্বীর মুখোমুখি বসে আছে। উর্বী মাথা নিচু করে বসে আছে। তার এই মুহূর্তে তার শাশুড়ির দিকে তাকানোর সাহস নেই।
অন্তরা আর মোহনা তাদের শাশুড়ি ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে আছে।
রওশান আরা উর্বীর মুখের দিকে তাকিয়ে অন্তরাকে ডাকে,”ছোটো বৌমা।”
অন্তরা দ্রুত উত্তর দেয়,”জ্বী মা।”
“তুমি আজ কালের মধ্যেই সামিউলের ওখানে চলে যাবে। ছেলেটা একা পরে আছে। এখানটা বড় বৌমা দেখবে। সে তো সুস্থ হয়ে গিয়েছে। মেজো বৌমা তুমিও চট্টগ্রাম চলে যাবে। তোমার বড় জা পুরোপুরি সুস্থ।”
অন্তরা তার শাশুড়ির মুখের দিকে তাকায়,”মা ভাবীর এই সময়ে আমি….?”
_এই সময়ে মানে? পোয়াতি হয়েছে। তাতে কি হয়েছে? আমরা বাচ্চা পেটে নিয়ে সংসার দেখিনি? এখনকার যুগের বৌরা আরাম পেয়ে পেয়ে উচ্ছন্নে যাচ্ছো। বেশি আরামে থাকলে অলস মষ্তিস্কে শয়তান বাসা বাধে। তোমার বড় জা এর ক্ষেত্রে ঠিক সেটাই হয়েছে। তুমি কালই রাজশাহী যাবে। মেজো বৌ চট্টগ্রাম।এদিকটা বড় বৌমা দেখবে।
উর্বী তার শাশুড়ির দিকে তাকায়, নরম গলায় বলে,”মা….”
রওশান আরা তার উত্তর না দিয়ে রাওনাফকে ডাকে।
“এই রাওনাফ,বাড়ি নিবি কখন বৌমাকে। তোর হসপিটালে তো রোগীর চেয়ে তোর ফ্যামিলির লোকজনই আস্তানা গেরে বসে থাকে বারো মাস। এই রাওনাফ,বৌমা কি খাবে ? আমার নাতির তো খাওয়ার সময় হয়েছে নাকি!”
উর্বী আবারও ডাকে,”মা।”
রওশান আরা শুনেও না শোনার ভান করে চুপ করে থাকে। উর্বীর ডাকে সাড়া দেয় না। উর্বী আকুল হয়ে ডাকতে থাকে,”মা। আপনি অন্তত এমন করতে পারেন না।”
_আর তুমি করতে পারো বৌমা?
উর্বীর দিকে সরাসরি তাকিয়ে রওশান আরা বলে। উর্বী শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে, রওশান আরা বলতে থাকে,”তোমার জন্য আমার কষ্ট হয়েছে ভেবো না। আমার শুধু আমার নাতী-নাতনির জন্য কষ্ট হয়েছে। আমার নিজের জন্য কষ্ট হয়েছে। একদিন তোমাকে এ বাড়িতে এনে আমি যাদের কষ্ট দিয়েছি, তারা আজ আবারও কষ্ট পাচ্ছে তুমি চলে যাচ্ছিলে বলে। আমি সেই নাতনিদের জন্য কষ্ট পাচ্ছি।”
এ পর্যন্ত বলে রওশান আরা থামে। তারপর দরজার দিকে তাকিয়ে বলে,”দাদু ভেতরে এসো।”
উর্বী দরজার দিকে তাকায়। দরজার পর্দাটা ধীরে ধীরে সরিয়ে মাথা নিচু করে ভেতরে ঢোকে শায়মী। ধীরপায়ে হেঁটে এসে সে বেডের সামনে দাঁড়ায়। রওশান আরা উঠে দাঁড়ায়, মোহনা আর অন্তরা শাশুড়িকে ধরে ধরে নিয়ে যায়।
শায়মী মাথা নিচু করেই দাঁড়িয়ে আছে। সে চোখ তুলে তাকায় না উর্বীর দিকে। উর্বী নরম গলায় বলে,”শায়মী তাকাও।”
শায়মী তবুও দাঁড়িয়ে থাকে মাথা নিচু করে। উর্বী আবারও বলে,”তাকাও শায়মী।”
শায়মী এবার ধীরে ধীরে মাথা তুলে তাকায়। তার দু’চোখ ভর্তি পানি। উর্বী একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে আছে। শায়মী চোখ বন্ধ করে ফেলে। পানি গড়িয়ে পরে বন্ধ চোখের কার্নিশ বেয়ে। উর্বী কিছু বলেনা, তার ভেতরটা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে।
কিছুসময় দু’জনেই চুপচাপ, উর্বী বলে,”শাস্তি দেবে পাপা আর দাদুর মতো? মুখ ঘুরিয়ে রেখে আমার থেকে?”
শায়মী ছুটে গিয়ে উর্বীকে জরিয়ে ধরে। ক্লান্ত শরীরে উর্বী শক্তি ফিরে পায়। ডানহাতে আগলে ধরে অভিমানী সপ্তদশীকে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। শায়মী কাঁদছে, শব্দহীন কান্না। একটু পরপর কেঁপে কেঁপে উঠছে সে।
****
শেফালী নিজের ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ওয়ার্ড বয় এসে উচ্ছাসকে একটা শার্ট পরিয়ে দিয়ে যায়। উচ্ছাস বেডে হেলান দিয়ে বসে আছে।
শাখাওয়াত চৌধুরী জানালার কাছ থেকে সরে আসে। শেফালী হাতের খাবারটা ছেলের মুখের সামনে তুলে ধরে,বলে,”তোর মনে আছে আমার হাতের হালুয়া খাওয়ার জন্য তুই সবসময় কেমন পাগলামি করতিস!”
উচ্ছাস ম্লান হেসে খাবারটা মুখে নিয়ে খায়। শাখাওয়াত চৌধুরী একটা চেয়ার টেনে উচ্ছাসের সামনে বসে। উচ্ছাস বাবার দিকে তাকায়। শাখাওয়াত চৌধুরী বলতে থাকে,”সামনের সপ্তাহে রায় ঘোষণা হবে।”
উচ্ছাস অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে বলে,”ভালো কথা।”
শেফালী আগের মতো হুহু করে কেঁ’দে ওঠে না,খুব স্বাভাবিক ভাবেই নিজের নিয়তিকে মেনে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়, শাড়ির আঁচল দিয়ে নিজের আদরের ছেলের মুখ মুছিয়ে দিতে থাকে।
শাখাওয়াত চৌধুরী ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”কেনো করলে!”
উচ্ছাস বাবার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে, মুহূর্তেই বুকের ডান পাশে যন্ত্রনা অনুভব করে। হাত দিয়ে ব্যান্ডেজ চেপে ধরে যন্ত্রনাটুকু হজম করে। খানিক বাদে নিজেকে ধাতস্থ করে বলে ওঠে,”কখনও ভালো ছেলেও হতে পারিনি, না হতে পেরেছি ভালো প্রেমিক। ভাবলাম সেরা খারাপ মানুষ হই।”
উচ্ছাস হাসতে হাসতে হেলান দিয়ে দু’চোখ বন্ধ করে ফেলে। শাখাওয়াত চৌধুরী অসহায়ের মতো ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। শেফালী ছুটে কেবিন থেকে বেরিয়ে শাড়ির আঁচল মুখে চে’পে ধরে কাঁদছে।
কেবিনের বাইরে পাহারা দিতে থাকা কনস্টেবল দু’জন তাকে দেখছে তাকিয়ে তাকিয়ে।
***
“ম্যাম আপনি এখানে!”
নার্সের ডাকে উর্বী পিছু ফিরে তাকায়। নার্স মেয়েটা উর্বীর কাছে এগিয়ে এসে বলে,”ম্যাম কোথায় যাচ্ছেন আপনি!”
উর্বী আশেপাশে তাকিয়ে বলে,”তিনতলায়। শর্মীর কাছে।”
_ক্ষেপেছেন ম্যাম? স্যার জানতে পারলে আমি বকা খাবো। আপনি কেবিনে চলুন।
_কিচ্ছু হবে না। তোমার স্যারের সব বকা আমি খেয়ে নেবো। আমি একটু যাই শর্মীর কাছে।
নার্স উর্বীর দিকে তাকিয়ে থাকে। উর্বীর কন্ঠে অনুরোধের সুর।
“এখন কেন যেতে চাইছো!”
রাওনাফের কন্ঠস্বর শুনে চমকে ওঠে দু’জনেই। রাওনাফ দাড়িয়ে আছে তাদের পেছনেই। উর্বী মাথা ঘুরিয়ে তাকায়। রাওনাফ নার্সের দিকে একপলক তাকায়। নার্স চলে যায়। মাথা ঘুরিয়ে উর্বীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে রাওনাফ। তারপর বলে,”এখন কেনো শর্মীকে দেখতে যেতে চাইছো!”
উর্বীর অভিমান হয়। টানা একটা দিন কঠিন কঠিন কথা শুনিয়েও মন ভরেনি। এখন রাতদুপুরে এসেছে কথা শোনাতে। উর্বীর ইচ্ছে করলো দুটো কথা শুনিয়ে দিতে, ইচ্ছে করলো বলতে, হার্ট সার্জন আপনার নিজের হার্ট কই? কিন্তু সে বললো না,নিজেকে শুধরে নিয়ে নিজেকে নিজে বললো,”মেনে নে উর্বী। তুই দোষী। এই গোস্বা টুকু মেনে নে।”
চোখ সরিয়ে নিচু গলায় উত্তর দেয়,”মরলে তো সব চুকেই যেতো। যেহেতু মরিনি তাই আমি আমার মেয়ের কাছে যাচ্ছি।”
কথাটা বলেই উর্বী ধীরপায়ে হেঁটে চলে যায়। রাওনাফ দাড়িয়ে থাকে চুপচাপ।
চলমান…….