আরেকটি_বার #পর্বসংখ্যা_২০ #Esrat_Ety

#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_২০
#Esrat_Ety

একটা পরিচিত অনুভূতি ঘিরে ধরে রেখেছে উর্বীকে আপাদমস্তক।সে তাকিয়ে আছে, তাকিয়ে আছে মানুষটার দিকে। যে এসেছিলো অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে। সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে। আর আজকের এই আসাটা? এটা অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে কি?

রাওনাফ ভিজে জবজবে হয়ে গিয়েছে । উর্বী মোমবাতি হাতে নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। রাওনাফ কাঁপছে, ফরসা রঙের পরিনত মুখটা ঠান্ডায় জমে নীলাভ হয়ে গিয়েছে। কাঁপতে কাঁপতে উর্বীর চোখে চোখ রেখে বলে,”কি?”

উর্বী অস্ফুট স্বরে বলে,”কি?”

_আমি তো সেটাই বলছি, কি? আরে ভেতরে আসতে দেবে না আমাকে? দরজা আটকে দাঁড়িয়ে আছো তুমি!

উর্বী লজ্জা পেয়ে সরে দাঁড়ায়। বাইরে যে মানুষটা ভিজছে সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করেইনি এতক্ষন। দরজার পাশে সরে দাঁড়িয়ে মোমবাতিটা কিছুটা নিচু করে হাতে ধরে রাখে। রাওনাফ ভেতরে ঢোকে। সে অনবরত কাঁ’প’ছে।

উর্বী দরজা লাগিয়ে দেয়। রাওনাফ উর্বীকে একপলক দেখে, সে ঠকঠক করে কাঁপলেও কন্ঠস্বর স্বাভাবিক রেখে বলে,”এখন আমার ইচ্ছা করছে একটা সিগারেট খেতে।”

উর্বী দরজা লাগিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে ঠান্ডা গলায় রাওনাফকে বলে,”আমার ভাইয়া সিগারেট খায়। তার প্যাকেট থেকে একটা এনে দেবো?”
রাওনাফ কাঁপতে কাঁপতেই হেসে ফেলে,
_না থাক। তুমি আমাকে এক কাপ চা দাও। ইটস এ্যান ইমার্জেন্সি।

কথাটি বলেই রাওনাফ উর্বীর ঘরের দিকে যাওয়া শুরু করে।
উর্বী তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে রাওনাফকে। রাওনাফকে দেখে তার মনে হচ্ছে সে বহুবার এবাড়িতে এসেছে। অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে সে সোজা উর্বীর শোবার ঘরে ঢোকে।
উর্বী কয়েক মুহূর্ত দাড়িয়ে থেকে তার পিছু পিছু যায়।

রাওনাফ রীতিমতো হাঁচি দিতে শুরু করেছে। উর্বী আলমারি থেকে একটা পরিষ্কার তোয়ালে বের করে রাওনাফের দিকে এগিয়ে দেয়।

“নিন,মাথাটা মুছে ফেলুন। সর্দি লেগে যাবে।”

রাওনাফ নিশ্চুপ হাসি দিয়ে তোয়ালে টা নিয়ে মাথা মুছতে থাকে।

উর্বী ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে আসে। তার হাতে কিছু কাপড়।

রাওনাফ তোয়ালে রেখে তাকায়, বলে,”কি ওগুলো?”

_ভাইয়ার ধোয়া পাজামা আর পাঞ্জাবী। সব তো ভিজিয়ে ফেলেছেন। এখন এভাবে থাকবেন? নিন,এটা পরে নিন। আপনার ফিট হয়ে যাবে। আমি চা নিয়ে আসছি।

রাওনাফ হাত বাড়িয়ে কাপড় গুলো নিয়ে নেয়।

উর্বী চা বানিয়ে নিয়ে এসে দরজায় টোকা দেয়,”আসবো?”

_হ্যা এসো।
উর্বী ভেতরে ঢোকে। চায়ের কাপটা রাওনাফের দিকে এগিয়ে দেয়। রাওনাফ চায়ের কাপটা নিতে নিতে বলে,”একটু লেবু হলে ভালো হতো।”

উর্বী অবাক হয়। এ আজ এতো স্বামীদের মতো আবদার করছে কেনো !
কয়েক মুহূর্ত রাওনাফের দিকে তাকিয়ে থেকে উর্বী লেবু আনতে রান্নাঘরে যায়।
রাওনাফ হাতে চায়ের পেয়ালা নিয়ে বসে থাকে।

লেবু চিপে রাওনাফের কাপে দিতে দিতে উর্বী বলে,”আপনি এখানে কেনো এসেছেন? আমি তো আপনাকে মেসেজ দিয়েছি। পড়েননি ঠিকভাবে?”
রাওনাফ কাপে চুমুক দিয়ে গা ছাড়া ভঙ্গিতে বলে,”হ্যা পড়েছি। আমি এখানে,এই কাছেই এসেছিলাম একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে, ভাবলাম তোমার সাথে দেখা করে যাই। অন্যায় করে ফেললাম?
উর্বী মাথা নিচু করে মাথা নাড়ায়, অস্ফুট স্বরে বলে,
_না।
তারপর আবারও থেমে থেমে জিজ্ঞেস করে,”কি গুরুত্বপূর্ণ কাজ আপনার এখানে?”

রাওনাফ চা শেষ করে, তারপর নিচুগলায় বলে,
_বলবো, তার আগে আমাকে কিছু খেতে দাও। খিদেয় আমার অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছে।

উর্বী লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসে। মানুষ টা এতদূর থেকে এলো,তার উপরে এই অবস্থা। উর্বীর শুরুতেই মাথায় রাখা উচিত ছিলো। কিন্তু এই রাতে রাওনাফকে কি খেতে দেবে সে। অলসতার জন্য উর্বী নিজের জন্য কিছুই রান্না করেনি রাতে।
সে রাওনাফের দিকে তাকিয়ে বলে,”আমাকে বিশ মিনিট সময় দিন,আমি আসছি।”
রাওনাফ মাথা ঝাঁকায় , উর্বী দৌড়ে রান্না ঘরে যায়। তাকে ঝটপট কিছু বানাতে হবে। কিন্তু কি করবে সে ! টেবিলে দুপুরের কিছু শুকনো ভাত ছাড়া তো আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তখনি তার মাথায় একটা উপায় আসে। সে পেঁয়াজ,ক্যাপসিকাম কুচি করে কাটতে থাকে। তার হাতের গতি তীব্র।

হঠাৎ রাওনাফ রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়ায়, উর্বীর পেছনে দাঁড়িয়ে বলে, “তুমি শর্মীর ফোন ধরছিলে না কেনো?”

“মাগো!”
উর্বী আচমকা ভয় পেয়ে লাফিয়ে ওঠে। সে বুঝতেই পারেনি রাওনাফ এখানে এসেছে। বুকে থুথুরি দিয়ে সে রাওনাফকে বলে,”আপনি এখানে এসেছেন কেনো?”

রাওনাফ হতভম্ব হয়ে উর্বীর দিকে তাকিয়ে আছে। এভাবে উর্বী ভয় পেয়ে যাবে সে বোঝেনি। সে এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে,”এখানে কোথাও তো লেখা নেই আমি আসতে পারবো না ! তাই চলে এসেছি!”

_পুরুষ মানুষের রান্নাঘরে ঢোকা আমার একেবারে পছন্দ না। আপনি রুমে গিয়ে বসে থাকুন। আমি আসছি।

রাওনাফ উর্বীর হাতের দিকে তাকিয়ে বলে,”এটা কি করছো?”

_ভাত ভাজি করছি।

_সেটা আবার কি?

_ফ্রাইড রাইসের বাংলা ভার্সন ! ছোটবেলায় মা ঝটপট করে বানিয়ে দিতো স্কুলে যাওয়ার আগে।

_ওও আচ্ছা। ইন্টারেস্টিং। খেয়ে দেখতে হয় তবে। আচ্ছা তুমি কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর দিলে না, শর্মীর ফোন ধোরছো না কেনো?

উর্বী হাতের কাজ থামিয়ে মাথা নিচু করে ফেলে। তারপর একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে ওঠে,
_আপনাকে তো মেসেজে বললাম। আমি একটু স্পেস চাই। সবাই যেনো আমাকে ফোন না দেয়। তাহলে আমি কারো ফোন কেনো ধরবো?

রাওনাফের দৃষ্টি উর্বীর নিচু করে রাখা মাথার চুলের সিঁথিতে নিবদ্ধ। সে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় বলে ওঠে,

_তাহলে আমীরুনকে বারেবারে ফোন দিয়ে শর্মী কি করছে, স্কুলে টিফিন ঠিকঠাক মতো নেয় কিনা, মা ওষুধ খায় কিনা, আমি হসপিটাল থেকে ফিরেছি কিনা, অন্তরার শরীর খারাপ করে কিনা, নাবিল-শায়মীর রেজাল্ট কবে দেবে এসব কেনো জানতে চাও? তখন স্পেস নিতে অসুবিধা হয়না তোমার মৃদুলা উর্বী?

উর্বী ধাক্কার মতো খায়। চ’ম’কে উঠে মাথা তুলে তাকিয়ে হাত থেকে ছু’ড়ি ফেলে দেয়। আমীরুন সব বলে দিয়েছে ! কি অস্বস্তিকর একটা ব্যাপার। উর্বীর চোখ মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায় মুহুর্তেই। এমনটা উর্বীর অপ্রত্যাশিত ছিলো! আমীরুনের ওপর ভীষণ রাগ হচ্ছে উর্বীর।

উর্বী ঘামতে থাকে। রাওনাফ তার দিকে তাকিয়ে আছে,তার মুখ ভাবলেশহীন! উর্বী তোতলাতে তোতলাতে বলে,”এমনিই। আমার আর পাঁচ মিনিট লাগবে। আপনি কি এই রান্নাঘরে বসে খাবেন? নাকি রুমে যাবেন?”

_যাচ্ছি।
অস্ফুট স্বরে বলে রাওনাফ চলে যায়। উর্বী ফ্যাকাশে মুখ নিয়ে আগুনের দিকে তাকিয়ে থাকে।

***
রাওনাফ খাচ্ছে। উর্বী রাওনাফের সামনে বসে ছিলো। মোমবাতির টিমটিমে আলোয় তাকে কিছুক্ষণ দেখে উর্বী উঠে দাঁড়ায়। রাওনাফের ভেজা কাপড় গুলো মেলে দিতে হবে । তাই সে বেলকোনিতে চলে যায়। কাপড় গুলো মেলে দিয়ে নিজের এহেন কান্ডে সে যারপরনাই অবাক হয়! এমন কাজ সে কখনোই করেনি। আজ করলো কেন! কেন একজন স্ত্রীর দায়িত্ব পালন করার মতো এই সহজাত আচরণ টা করে ফেললো অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে! কোনো সংকোচ ছাড়াই!
কাপড় মেলে দিয়ে উর্বী ধীরপায়ে রাওনাফের দিকে এগিয়ে আসে। বাইরে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। বিদ্যুৎ চম’কাচ্ছে।

রাওনাফ চামচ দিয়ে খাচ্ছে। খেতে খেতে বলে,”আসলেই বেশ ভালো খেতে এটা।”

_তেমন ভালো নয় তবে আপনার পেটে খিদে ছিলো তাই বেশি ভালো লাগছে।
উর্বী নিচুস্বরে বলে। মানুষটাকে খেতে দেখতে তার ভালো লাগছে খুব। আরো ভালো কিছু খাওয়াতে না পেরে একটা সূক্ষ্ম অ’প’রা’ধবোধ হচ্ছে মনে, কিন্তু সময় যে খুবই অল্প। তাই ঝটপট করে যা পেরেছে করেছে।

খাওয়া শেষ করে রাওনাফ তার হাত থেকে ঘড়িটা খুলে রেখে দেয়।
উর্বী বলে,”এবার বলুন, এখানে কি এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে এসেছিলেন আপনি হাসপাতাল,ডাক্তারি রেখে?”

হঠাৎ ধপপ করে আওয়াজ হয়। শব্দটা বাইরের আঙিনা থেকে এসেছে। রাওনাফ মাথা তুলে উর্বীর দিকে তাকায় জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে। উর্বী বলে,”বাড়ির কয়েকটা ঘরের রেনোভেশনের কাজ চলছে। বাইরের স্টোর ঘরে ভাইয়া কিছু সিমেন্টের বস্তা রাখিয়েছিলেন,সেখানের টিনের আলগা ছাউনি সম্ভবত খুলে পরে গিয়েছে ঝড়ো বাতাসে। আমি যাই, ঠিক করে দিয়ে আসি নয়তো বস্তাগুলো সব ভিজে যাবে।”

“কিন্তু তুমি ভিজে যাবে যে….”
রাওনাফের কথা শেষ হবার আগেই উর্বী হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে যায়। রাওনাফ উর্বীর যাওয়া দেখে বিছানার একপাশে চুপচাপ বসে থাকে।

টিনের ছাউনি তুলে ধরে বেশ কিছুক্ষণ ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছে উর্বী। ঠিক যায়গা মতো সেট করতে পারছে না। কিন্তু বৃষ্টি তাকে পুরোপুরি ভিজিয়ে দিয়েছে। পায়ের কাছে স্তুপ করে রাখা বালি ভিজে যা তা অবস্থা। সবকিছুই রেনোভেশনের জন্য কিনে রেখেছিলো রেজাউল কবির। ঘন ঘন বিদ্যুত চম’কাচ্ছে।‌ উর্বীর এবার বেশ ভয় ভয় করছে!
বৃষ্টির পানি অসম্ভব ঠান্ডা, এখন বোঝা যাচ্ছে কেন রাওনাফ ওভাবে ঠকঠক করে কাঁপছিল।

ছাউনি ঠিক করে দেওয়ার আগেই খুব নিকটে বিকট আওয়াজে পরপর দু’টো বাজ পরে।

রাওনাফ বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে যায়। দ্রুতপায়ে হেঁটে সদর দরজা পেরিয়ে বৃষ্টি উপেক্ষা করে আঙিনায় চলে যায় স্টোর ঘরের কাছে। উর্বী আ’ত’ঙ্কি’ত মুখে কান চে’পে ধরে বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছিলো। কয়েক মুহূর্ত আগে তার শরীর থেকে প্রানটা বেরিয়ে গিয়েছিল কিছু সময়ের জন্য। রাওনাফ বৃষ্টি গায়ে মাখিয়ে এগিয়ে যায়। উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে,”আর ইউ ওকে!”

উর্বী নিজেকে ধাতস্থ করে বলে,”ঠিক আছি।‌ আপনি এলেন কেনো। ভিজে গেলেন যে!”

কথাটা বলে উর্বী পুনরায় টিনের ছাউনি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরে, রাওনাফ পেছন থেকে বলে,”মে আই হেল্প ইউ!”

_না,তার দরকার……

বাকিটা বলার আগেই ধপ করে উর্বী ছাউনিটা হাত থেকে ফেলে দেয়। ঝড়ো হাওয়া ছাউনিটাকে খানিকটা সামনে উড়িয়ে নিতেই উর্বী ধরতে গেলে পা পিছলে পরে যায়।
রাওনাফ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উর্বীর চঞ্চলতা অবলোকন করছিলো। কাজটা যতটা সহজ ভাবে করা যেতো এই মেয়ে জটিল করছে!

উর্বীকে বালির স্তুপে মুখ থুবড়ে পরতে দেখে সেও ছুট লাগায় উর্বীকে টেনে তোলার জন্য। হাত বাড়িয়ে দিতেই উর্বী নির্দ্বিধায় রাওনাফের হাতে হাত রাখে। রাওনাফ টেনে তোলে। বালি-পানিতে পুরো মাখামাখি অবস্থা। উর্বীর গা গুলিয়ে উঠছে।
রাওনাফ উর্বীর দিকে এক পলক তাকিয়ে সামনে এগিয়ে যায়। ছাউনিটা তুলে এনে যায়গা মতো রেখে কয়েকটা ইট দিয়ে প্রাথমিক ভাবে চাপা দিয়ে দেয়। যদিও শেষ রক্ষা হয়নি, সিমেন্ট ভর্তি বস্তাগুলো ভিজে গিয়েছে ইতিমধ্যে। তবে বাকিটা রাত আর ভিজবে না। বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। অবশ্য বিদ্যুৎ চমকানো কমেছে। রাওনাফ ঘাড় ঘুরিয়ে উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে,”এই হালকা ছাউনি টা ঠিক করে দিতে পারছিলে না এতক্ষণ ধরে?”

_আমি আপনার মতো লম্বা নই! তাই বেগ পেতে হচ্ছিল।

নিচুস্বরে জবাব দেয় উর্বী।

রাওনাফ বলে,”ঠিকাছে। চলো ভেতরে। তোমাকে একটা হাসের ছানার মতো লাগছে। মনে হচ্ছে এই মাত্র কাদাপানিতে সাঁতার কেটে ডাঙায় এসেছো।”

কথাটা বলে রাওনাফ ঘুরে হাঁটতে থাকে। উর্বী লাজুক হাসি হাসে,কয়েক মুহূর্ত লজ্জিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থেকে রাওনাফের পিছু পিছু যায়।

ঘরে ঢুকে উর্বী রেজাউল কবিরের আরেক সেট পাজামা পাঞ্জাবী রাওনাফকে বের করে দিয়ে নিজে ফ্রেশ হতে চলে যায়। দীর্ঘসময় নিয়ে সে গোসল করে বেরিয়ে আসে তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে। কিন্তু তার মন এখনও খুঁতখুঁত করছে। মনে হচ্ছে শরীরের কোথাও না কোথাও বালিকণা থেকেই গিয়েছে।

ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে উর্বী রাওনাফকে জায়নামাজে আবিষ্কার করে। এশার সালাত আদায় করে মোনাজাত ধরেছে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে সে। তারপর চোখ সরিয়ে নেয়।

সালাত আদায় করে রাওনাফ জায়নামাজ যথাস্থানে রেখে, হাতে ফোনটা নিয়ে নেয়। ফোনটা পুরো সুইচ অফ হয়ে আছে। শর্মীকে জানানো হয়নি। এখানে এমন লোড শেডিং থাকবে কে জানতো!

উর্বী তোয়ালেটা হাত থেকে যায়গা মতো রেখে রাওনাফের দিকে ঘুরে তাকায়। গায়ে তার বেগুনী রঙের একটা সুতি শাড়ি। ভেজা চুল বেয়ে টপটপ করে পানি পরছে তার। ফরসা গাল দুটো ঠান্ডায় গোলাপী আভা ধারণ করেছে। গভীর এবং সরল ঐ বাদামী চোখের চাহনি।
রাওনাফ চোখ সরিয়ে নিয়ে চোখ নামিয়ে রাখে। উর্বী অত্যন্ত ঠান্ডা গলায় বলে,”বলুন! কি কাজ ছিলো এই মফস্বলে? কোনো সেমিনার?”

রাওনাফ দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিভু নিভু জ্বলতে থাকা মোমবাতির দিকে তাকায়, সেও অত্যন্ত ঠান্ডা গলায় বলে,

_মা বলেছে এখান থেকে তার পুত্রবধূ কে নিয়ে কাল সকালেই ঢাকায় ফিরে যেতে। তাই এলাম।

উর্বী তাকিয়ে আছে। রাওনাফের দৃষ্টি মোমবাতির দিকে। উর্বী একদৃষ্টে তাকিয়েই থাকে রাওনাফের দিকে। সামান্য একটা বাক্য শুনে তার এমন দুর্বল লাগছে কেনো, হাত পা কাঁপছে কেনো!

নিজের অনূভুতিকে পাত্তা না দিয়ে সে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলে,”আপনাকে তো বলেই এসেছি, কিছুদিন স্পেস চাই। তা জানা স্বত্তেও এলেন কেনো?”

রাওনাফ এবার উর্বীর দিকে তাকায়। স্বাভাবিক এবং স্পষ্টভাবে বলে,
_বলেছো স্পেস চাও, দেবো। ডি’ভোর্স চাইলেও পাবে। তবে তার জন্য ঢাকা তোমাকে ফিরতেই হবে। এভাবে হুট করে তো কিছু হয়না মৃদুলা উর্বী তাইনা? আর তাছাড়া তোমাকে না নিয়ে গেলে আমাকে মেলা ঝামেলা পোহাতে হবে,তা তো নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছো এতদিনে তাই না?

উর্বী ম্লান হাসে, একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
_ওওও তার মানে, যাতে আপনাকে কোনো ঝামেলা পোহাতে না হয় সেজন্য আপনি এসেছেন নিতে আমায়?

রাওনাফ এবার সরাসরি উর্বীর চোখের দিকে তাকায়, গলার স্বর যথেষ্ট নমনীয় রেখে প্রশ্ন করে,”কেনো তুমি কি আশা করো আমার আসার পেছনে অন্য কোনো কারন থাকুক? বিশেষ কোনো,ব্যক্তিগত কোনো কারন থাকুক?

উর্বী চোখ সরিয়ে নেয়। নামিয়ে নেয় চোখ। হাত দিয়ে শাড়ির আঁচল খামচে ধরে শক্ত করে।
রাওনাফ ডাকে,”মৃদুলা উর্বী!”

_বলুন।
অত্যন্ত ক্ষীণ কন্ঠে বলে উর্বী।

_এদিকে তাকাও।

উর্বী তাকায় না। রাওনাফ বলে,”এতো দোটানায় কেনো ভুগছো উর্বী? তুমি কি বুঝতে পারছো না তুমি কি চাও?”

উর্বী চুপ করেই থাকে, হঠাৎ তার চোখ থেকে মুক্তোর দানার মতো দুফোটা পানি গাল বেয়ে গড়িয়ে পরে।
রাওনাফ সেদিকে তাকিয়ে আছে। হুট করে হাত বাড়িয়ে সেই পানির ফোটা সে ছোঁয়। উর্বী নড়েচড়ে ওঠে।

রাওনাফ বলে,”চোখের পানি যদি কোনো কাজে লাগতো,যেমন ধরো কোনো ওষুধ বানাতে কাজে লাগতো তাহলে তুমি এতদিনে কোটিপতি হয়ে যেতে মৃদুলা উর্বী।”

উর্বী কিছু বলে না।
রাওনাফ বলতে থাকে,”ডি’ভো’র্স চাও? দিয়ে দেবো। তাতে কাঁ’দতে হয় এভাবে প্রতিদিন? দু’জনে বসে আলোচনা করার বিষয় এটা। একা একা রাতে ফুঁপিয়ে কাঁদার বিষয় না।”

উর্বী চেঁচিয়ে ওঠে,”আপনাকে আমি বলেছি আমি ডি’ভো’র্স চাই? আমি ডিভোর্সের জন্য কাঁদি? কেনো একই কথা বারবার বলছেন।!”

_আচ্ছা আচ্ছা। রিল্যাক্স! শান্ত হও। ডি’ভোর্স চাওনা। তার মানে সংসার করতে চাও তাইতো?

উর্বী চুপ করে থাকে। রাওনাফ বলতে থাকে,
_কি জ্বালা। বলবে তো! হয় ডিভোর্স,নয় সংসার। যেকোনো একটা তো চাইতে হবে উর্বী!

উর্বী নিরবতা ভেঙে ফুঁপিয়ে ওঠে।

রাওনাফ মৃদু স্বরে বলে,”উর্বী। আমি বুঝতে পারছি তুমি কোথাও আটকে গিয়েছো। কোনো সমস্যা হচ্ছে তোমার। কোনো ভয়াবহ সমস্যা। যা থেকে তুমি ছাড়া পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছো। যেকোনো সমস্যা সমাধান করতে হলে অবশ্যই কারো সাহায্য দরকার হয়। আমি কি তোমার সেই উপকারী বন্ধুটি হতে পারি? যার সাথে যেকোনো সমস্যা মন খুলে বলা যায়? সাইক্রিয়াটিস্টের সাথে আমি নিয়মিত কথা বলি উর্বী। তুমি নিজে না চাইলে এই সমস্যা থেকে বের হতেই পারবে না।”

রাওনাফ ক্রন্দনরত উর্বীর দিকে তাকিয়ে থাকে কথা গুলো বলে।

উর্বী কান্না থামিয়ে রাওনাফের দিকে তাকায়। তারপর ধরা গলায় বলে,”আমি যদি বলি আমি আপনার সাথে সংসার করতে চাই। ওই বাড়িতে ফিরতে চাই তাহলে আপনি কি করবেন?”

_আমি তোমায় কাল সকালেই নিয়ে যাবো।
ঠান্ডা গলায় জবাব দেয় রাওনাফ।

_আর যদি আপনি জানতে পারেন আপনি যাকে নিজে হাতে ধরে আপনার সংসারের ঘরনী করে নিয়ে গেছেন সে একটা অতি ফালতু,দুশ্চরিত্রা, ন’ষ্টা মেয়ে মানুষ তাহলে আপনি সেদিন কি করবেন?

রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকিয়ে থাকে কথাটি শুনে। উর্বী বলে ওঠে,

“কি হলো! চুপ হয়ে গেলেন কেনো! বলুন কি করবেন? তখনো কি নিজের জীবনের সাথে আপনি আমাকে জড়াতে চাইবেন? বলুন?”

রাওনাফ ম্লান হাসে, ঠান্ডা গলায় বলে,”আমার মনে হয় আজ থেকে পাঁচ মাস ১৩ দিন আগেই আমি একজন অতি ফালতু,ন’ষ্টা,দুশ্চরিত্রা মেয়ের সাথে নিজের জীবন অত্যন্ত নাটকীয়ভাবে জরিয়ে ফেলেছি, দ্বিতীয়বার আবার কিভাবে জড়াবো?”

উর্বী তাচ্ছিল্যর হাসি হাসে,”মজা ভাবছেন আপনি তাই না? আপনি যদি আমার অতীত জানতে পারেন তাহলে ভুলেও চাইবেন না আমায়। শুধুই ঘৃনা করবেন আমায়। থুতু ফেলবেন আমার নামে।”

রাওনাফ দীর্ঘসময় উর্বীর দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর বলে ওঠে,
_আচ্ছা বলো তো তোমার অতীত। কখনো কাউকে ঘৃণা করিনি। এই ঘৃণার টেস্ট কি রকমের? স্বাদ নিতে চাচ্ছি আমি!

বলতে বলতে রাওনাফ বিছানায় দুহাত মাথার পেছনে দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে পরে। উর্বীর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
_ওও আরেকটা কথা। আরেকটা মোমবাতি জ্বালিয়ে দাও প্লিজ। এটা তো ফুরিয়ে গেলো। অন্ধকারে তোমার অতীত শুনতে ভালো লাগবে না।

উর্বী কান্না থামিয়ে অবাক হয়ে রাওনাফের দিকে তাকিয়ে আছে। দেখছে সে তার সামনে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বসে থাকা পুরুষটিকে।

চলমান……

[ এখন থেকে নিয়মিত গল্প পাবেন না সম্ভবত। পরীক্ষা দরজায় কড়া নাড়ছে। একটু বইটা নিয়ে নড়াচড়া করতে হয় যে! অসুস্থতা, পরীক্ষা সব বিপদ উতরে আবার নিয়মিত হবো। রাগবেন না প্লিজ!]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here