#প্রণয়ে_প্রলয়ের_সুর
#লেখা: জবরুল ইসলাম
#পর্ব_১১
.
নির্জন ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে কিছু বলতে যাচ্ছিল। তখনই জানালার সামনে কেয়াকে দেখতে পেল। ওর দৃষ্টি লক্ষ্য করে তরুও তাকিয়ে দেখে কেয়া মিটমিট করে হাসছে।
– ‘ফুপু কিছু বলবে?’
কেয়া জবাব না দিয়ে ভেতরে এলো। তার মন-মেজাজ ভালোই মনে হচ্ছে। পাশে এসে বসে বললো, ‘ফুপুকে রেখে একা একা আইসক্রিম এনে খাচ্ছিস?’
‘তোমরা গল্প করো আমি গিয়ে পানি নিয়ে আসি’ বলে নির্জন বসা থেকে উঠে চলে গেল।
তরু পুনরায় ওকে আইসক্রিম খেতে বলতে গিয়েও ফুপুর জন্য পারলো না৷ ভেতরে কেমন একটা খচখচ করতে শুরু করলো। কেয়া ওর উরুতে চিমটি দিয়ে বললো, ‘ঘটনা কি? তুই না ভাব দেখাইতি? আমার ছেলে গুন্ডাদের মতো, চোখ মার্বেলের মতো। এখন দেখি পিছু নিয়েছিস?’
– ‘আজাইরা বকবে না তো ফুপু। পিছু নিয়েছি কে বললো।’
– ‘তাহলে আইসক্রিম নিয়ে এখানে কেন?’
তরু বলতে যাচ্ছিল ‘থ্যাংকস’ দিতে এসছিলাম। কিন্তু বললো না। শেষে ফুপু আরও বেশি খোঁচাবে। ইতস্তত করে বললো, ‘বারান্দা থেকে শব্দ শুনে এদিকে এসেছিলাম। এটা নিয়ে তোমার কাছেই যেতাম। নাও খাও আইসক্রিম। যা গরম পড়ছে না।’
কেয়া আইসক্রিম নিয়ে মুখে দিয়ে বললো, ‘চকলেট আইসক্রিম ভালো লাগে অনেক। আচ্ছা শোন, তোর মোবাইল মনে হয় রুমে রেখে এসেছিস।’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘তোর আম্মা কল দিয়েছিল।’
– ‘কেন?’
– ‘তোর মামাতো বোনের বিয়ে পরশুদিন। তোকে যাওয়ার জন্যই কল দিয়েছে।’
– ‘ওমা এত তাড়াতাড়ি বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। শুনেছিলাম কথাবার্তা চলছে।’
– ‘তাড়াতাড়িই তো দিব। তোদেরকে ঘরে রাখা যাচ্ছে না। ছেলেদের জিমের ঘরে চলে যাচ্ছিস।’
তরু দাঁত কটমট করে তাকিয়ে রইল। কেয়া রহস্য করে হাসছে৷ তরু মনে মনে বলছে, ‘কত রূপ যে দেখাইবা ফুপু। এই রোদ এই বৃষ্টি৷ মুড সুইং এর মান-ইজ্জত শেষ করে দিচ্ছ।’
‘এত ঠান্ডা’ বলে কেয়া আইসক্রিম ফিরিয়ে দিয়ে বললো, ‘বিয়েতে যাবি?’
– ‘হ্যাঁ, আম্মুর সঙ্গে কথা বলে দেখি। তুমিও চলো। বিয়ের পরেরদিন চলে আসলাম।’
– ‘আমি?’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘তোর মা যেতে বলে নাই, তাই যাব না।’
– ‘আম্মু বলবে।’
– ‘তুই বলাবি। তাই বাদ, যাব না। এক কাজ কর। নির্জনকে নিয়ে যা। শ্রীমঙ্গলের পাহাড় জঙ্গলে দুইজন ঘুরে বেড়াবি..।’
– ‘ফুপু তুমি অতিরিক্ত বকছো কিন্তু।’
কেয়া খিলখিল করে হেসে উটলো। নির্জন জলের বোতল নিয়ে এসে বললো, ‘কি অবস্থা? কি নিয়ে কথা হচ্ছে?’
কেয়া স্বাভাবিক চেহারায় বললো, ‘তরুর মামাতো বোনের বিয়ে। ও চাচ্ছে তোমাকে নিয়ে যেতে। গেলে শ্রীমঙ্গলের চা-বাগান টা-বাগান ঘুরে আসতে পারবে।’
তরু প্রতিবাদ করতে যেয়েও থেমে গেল। সে এই কথা বলেনি বললে নির্জন কী ভাববে? সে চায় না নিতে? তাই চুপ করে রইল।
নির্জন ওর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘শ্রীমঙ্গল তোমার নানাবাড়ি?’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘বাহ, ছবিতে দেখেছি, বেশ সুন্দর। চা-বাগান, পাহাড়, সবুজ গাছগাছালি। আমার শ্রীমঙ্গল যাওয়া হয়নি এখনও।’
তরু খানিক অবাক হয়ে বললো, ‘আসলেই জাননি?’
– ‘একবার যাওয়ার প্রোগ্রাম করে পরে যাওয়া হয়নি।’
– ‘তাহলে চলুন না। দেখে আসবেন।’
নির্জন এক চুমুক জল খেয়ে রানিং মেশিনের কাছে গিয়ে বললো, ‘না, এভাবে যাওয়ার ইচ্ছা নেই। তবে বন্ধু-বান্ধব মিলে কখনও ঘুরতে যাব।’
কেয়া বসা থেকে উঠে বললো, ‘তরুর এমনিতেই একা যেতে হবে। পারলে চলে যাও। ঘুরে দেখে আসবে। ভালো লাগবে।’
নির্জন কিছু একটা ভেবে বললো, ‘কবে বিয়ে?’
– ‘পরশুদিন। তোমরা কালই চলে যাবে।’
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে যাব৷ কিন্তু কাল গিয়ে বিয়ের পরেরদিন চলে আসবো।’
তরু মাথা নাড়লো।
পরদিন দুপুরে নির্জন রেডি হয়ে সিটিংরুমে বসে তরুর জন্য অপেক্ষা করছে। সঙ্গে একটা ব্লু ব্যাগ নিয়েছে। পরনে কালো ব্লেজার। নিচে সাদা গেঞ্জি। খানিক পরই দেখে সিঁড়িতে জুতোর শব্দ তুলে তরু নিচে নেমে আসছে। নির্জন মুগ্ধ হয়ে তাকালো। খুবই সাধারণ পোশাক। কালো একটি ড্রেস। সামনের দিকে কাজ করা। কনুই অবধি কামিজের হাত। মোহনীয় কালো চুল ওর কাঁধ দিয়ে বেয়ে পড়েছে। চোখে কাজল। ঠোঁটে লাল লিপস্টিক। এই লালটা একদম রক্তের মতো। মেয়েটিকে তার বেশ লাগে। ওর ফুপুর প্রতি ক্ষোভ। এবং তাকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করায় দেখার আগে থেকেই তরুর প্রতি একরকম খারাপ ধারণা ছিল তার। যখন শুনলো এই মেয়ে আসবে। এসে রীতিমতো থাকবে। তার প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হয়েছিল। নিতান্তই কেয়া আর তার বাবার কথা শুনে মেনে নেয়। বুঝতে দেয়নি ভেতরের বিরক্তি। স্টেশনে যাওয়ার পর যখনই তরু বললো, ‘একই ছাতা দিয়ে যেতে হবে না-কি?’ ব্যস, তার ভেতরের ক্ষোভটার বিস্ফোরণ হলো। এভাবেই বারবার রেগে যাচ্ছিল। কিন্তু একটা সময় বুঝতে পারে মেয়েটি তাকে উলটো রাগিয়ে বারবার মজা নিচ্ছে। ধীরে ধীরে তার রাগটাও কমে গেল। ওইদিন দরজার কাছে দাঁড়িয়ে তাকে শুনিয়ে ফোন আলাপটাও সে বুঝেছে। এগুলো তাকে রাগানোর জন্যই করা। মেয়েটির চালচলন আর কথাবার্তায় চড়ুই পাখির মতো চঞ্চলতার একটা ব্যাপার আছে। রাগারাগি, ঝগড়াঝাটির মধ্যেও ওর ভেতরের টলমলে নরম মন প্রকাশ পায়। সেটা সে প্রথমদিনই বুঝেছে। এত রাগারাগির মধ্যে রান্না করতে গেল কেন? তার জন্য ডিম সিদ্ধ করলো কেন? তখনই বুঝেছে এই মেয়ে আর যাইহোক, ফুপুর মতো না। বেচারি ঝগড়া করতে গিয়ে, রাগাতে গিয়ে, বারবারই যত্ন নিয়ে ফেলেছে তার। অজান্তেই মমতা প্রকাশ করে ফেলেছে বারবার। ওইদিন রিকশার হুড তার জন্যই তুলেছিল। এবং রাগাতে গিয়ে, ঝগড়া করতে গিয়ে মেয়েটি এত মজা পাচ্ছিল যে, নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বেশি বেশি করতো।
‘স্যরি, স্যরি, আপনি এত তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে গেছেন ভাবিনি। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করালাম।’ তরু কাছে এসে বললো।
নির্জন ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বললো, ‘দেরি করা তো মেয়েদের স্বভাবই। সাজতে সাজতে দেরি হয়ে যায়।’
– ‘এটা আমার উপর অপবাদ হয়ে গেল। আমার এত সাজগোজের অভ্যাস নেই।’
– ‘এটাও সকল মেয়ে দেরি করে এসে বলে।’
তরু দাঁত কটমট করে তাকিয়ে বললো, ‘আপনার সঙ্গে ঝগড়াঝাটি করবো না বলে ঠিক করেছিলাম। কিন্তু আপনিই শুরু করছেন আবার। আমি এসেই কিন্তু স্যরি বলেছি।’
নির্জন মুচকি হেসে বললো, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, চলো। আর তোমার ফুপুকে বলে এসেছো তো?’
– ‘হ্যাঁ, এসেছি।’
দু’জন বের হয়ে এলো বাসা থেকে। গেইট খুলে বাইরে আসার পর তরু নিজের একপাশের চুল কানে গুঁজে বললো, ‘সাজগোজ তো দেখছি আপনি করেছেন।’
– ‘আমি?’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘শার্ট, প্যান্ট তো সবাইই স্বাভাবিক পরে।’
– ‘হাতে ঘড়ি, বুকে সানগ্লাস সবই তো নিয়েছেন। ছেলেদের আর সাজগোজের কি আছে শুনি? শাড়ি-চুড়ি পরার পর কি সাজের ষোলকলা পূর্ণ হবে?’
নির্জন চেষ্টা করলো আগের মতো রেগে তাকাবে। কিন্তু হলো না। এরকম কথাবার্তা শুনলে তার কাছে উলটো ভালো লাগে। রিকশা একটা দেখে হাত তুলে থামিয়ে উঠে বসে। তরু ভ্যানিটিব্যাগ সহ উঠতে সমস্যা হচ্ছিল। সে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘ধরেই উঠো, পড়ে-টরে গেলে আবার গিয়ে নতুন করে সাজগোজ করতে করতে সূর্য ডুবিয়ে ফেলবে।’
তরু মুচকি হেসে ওড়নাটা কাঁধে ঠিক করে রেখে, বাঁ হাতে ভ্যানিটিব্যাগ নিয়ে ডান হাত বাড়িয়ে দিল। ওইদিন হাত ধরে তুলতে গিয়েই নির্জনের কাছে ভীষণ কোমল মনে হয়েছিল। আজও তাই হলো। কিন্তু ওর নখগুলো কোথায়? তরু উঠে এসে বসার পর বললো, ‘তোমার নখ না লম্বা ছিল। ওইদিন তো মোরগের মতো আঁচড়ে দিয়েছিলে।’
তরু বাঁ হাত মেলে ধরলো। অনেকটা ফুল ফোটার মতো। পরিষ্কার নখগুলো মাঝারি ধরনের লম্বা। লম্বা নখে মন্দ লাগে না মেয়েদের। যা কিছুতে মানুষকে সুন্দর লাগে, সেগুলোর ফ্যাশন কখনও পুরাতন হতে পারে না৷ এটা আজীবন চলতে পারে। তরু মুচকি হেসে বললো, ‘নখ খুঁজলেন কেন? আরেকটা খামচি খাবেন?’
– ‘না, খামচি ওইদিন খেয়েই বুঝেছি, খুব একটা টেস্টি খাবার না। তুমি ট্রাই করতে চাইলে দিতে পারি?’
তরু মুখে হাত দিয়ে হাসলো। সঙ্গে চুলগুলো সামনে চলে এলো। অবাধ্য চুলগুলো কানে গুঁজে বললো, ‘আপনার তো নখই নেই, খামচি কি দিয়ে দেবেন।’
– ‘বুঝেছি নখ রাখতে হবে।’
কথা বলতে বলতে তারা বাস স্টেশনে এসে পৌঁছে গেল। রিকশা থেকে নেমে টিকিট কেটে সিট পেল অনেকটা সামনের দিকে। ব্যাগটি উপরে রাখলো নির্জন। তরু জানালার পাশে গিয়ে বসলো। খানিকক্ষণ পর সে ওপর পাশের ফুটপাতে হাওয়াই মিঠাই দেখে বললো, ‘উফ হাওয়াই মিঠাই, এখন কি করে আনবো। বাস কি ছেড়ে দেবে?’
নির্জন ভ্রু-কুঁচকে তাকিয়ে বললো, ‘বাচ্চাদের মতো হাওয়াই মিঠাইও খেতে ইচ্ছা করে?’
‘কালারটাই দেখুন না, দেখলেই খেতে ইচ্ছা করে’ বলে সে দাঁড়িয়ে গেল।
নির্জন দাঁত কটমট করে তাকিয়ে বললো, ‘তুমি বসো, আমি নিয়ে আসছি।’
সে রাস্তা পেরিয়ে গেল হাওয়াই মিঠাই আনতে। সেখান থেকে বাসের ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে দিয়েছে দেখে হাওয়াই মিঠাই নিয়ে দৌড়ে এসে উঠলো। হাঁপাতে হাঁপাতে সিটের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললো, ‘নাও তোমার হাওয়াই মিঠাই।’
বাস তখনই টান দিল, নির্জন টাল সামলাতে না পেরে বাঁ হাতে সামনের সিট খামচে ধরলো। ডান হাতে হাওয়াই মিঠাই। চলতি বাসের জন্য বাঁ হাত টানটান হয়ে পুরো শরীর তাদের পেছনের সিটে পড়লো। মুখ গিয়ে পড়লো তরুর গলায়। নির্জনের চুলের সঙ্গে ঘষা খেল তরুর গাল। তরু দ্রুত হাত বাড়িয়ে ওকে ধরতে গিয়ে নাক ঠোঁটও ডুবে গেল চুলে। এক অজানা-অচেনা অনুভূতিতে তরুর কিশোরী মনে দোলা লাগে, শিরশির করে উঠে বুক।
___চলবে….