প্রণয়ে_প্রলয়ের_সুর #লেখা: জবরুল ইসলাম #পর্ব_১৮

#প্রণয়ে_প্রলয়ের_সুর
#লেখা: জবরুল ইসলাম
#পর্ব_১৮
.
ঠিক সন্ধ্যা ছয়টায় কেয়া নিচে এসে তন্ময়কে দরজা খুলে দিল। কিচেন থেকে সবই খেয়াল করছে হুস্না। কলিংবেল বাজেনি অথচ উনি এসে দরজা খুলে দিলেন কেন? নিশ্চয় ফোনে যোগাযোগ আছে। দু’জন সোজা উপরে চলে গেল। হুস্না দীর্ঘ সময় চুপচাপ বসে রইল৷ খানিক পর ধীরে ধীরে বের হলো সে। নিঃশব্দে হেঁটে হেঁটে উপরে গিয়ে দেখে কেয়ার রুমের দরজা বন্ধ। অবাক হয়ে মুখে হাত দিল সে। এত সাহস হয় মানুষের? ব্যাপারটা বুঝতে পেরে রীতিমতো শরীর কাঁপছে হুস্নার। নিচে নেমে এলো সে। কল দিল ইশহাক সাহেবকে। ওপাশ থেকে রিসিভ হলো কল।

– ‘হ্যালো।’

হুস্না শুকনো ঢোক গিলে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, ‘চাচা তন্ময় সাহেব আসছিল তারপর..।’

থেমে গেল সে। ইশহাক সাহেব তাড়া দিলেন।

– ‘তারপর কি হয়েছে?’

– ‘কলিংবেল বাজার আগেই ম্যাডাম দরজা খুলে দিছে।’

– ‘পরে?’

হুস্নার গলার কাছে কথা এসে আঁটকে যাচ্ছিল। তবুও আমতা-আমতা করে বললো,

– ‘ওরা ভেতরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।’

‘ওকে, আমি রাখছি’ বলে কল কেটে দিলেন তিনি। তারপর ড্রাইভারকে কল দিয়ে বললেন গাড়ি বের করতে। দ্রুত অফিস থেকে বের হলেন। গাড়িতে উঠে সিটে বসে দীর্ঘ সময় রুমাল দিয়ে মুখ ঢেকে রইলেন। চোখ লাল হয়ে গেছে। লজ্জায়, অপমানে রীতিমতো কান্না পাচ্ছে। জ্যামে না পড়ায় বিশ মিনিটেই চলে এলেন বাসায়। সোজা ঢুকলেন ভেতরে। হুস্না কিচেনে। তিনি সিঁড়ি দিয়ে উঠলেন উপরে। বুক ধুকপুক করছে। একটা নোংরা পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে আজ। দরজার সামনে গিয়ে নক করলেন। কেউই কোনো জবাব দিল না। বেশ কয়েকবার ডাকলেন তিনি। কোনো সাড়াশব্দ নেই। ইশহাক সাহেব কড়া গলায় বললেন, ‘দরজা খুলবে না-কি পুলিশ ডাকবো?’

কেয়া এসে দরজা খুলে দিল। ওর এলোমেলো চুল। বুঝাই যাচ্ছে দ্রুত ঠিকঠাক হয়ে দরজা খুলে দিয়েছে। তন্ময় সোফায় বসে আছে। ইশহাক সাহেব লজ্জায় কারও দিকে তাকাতে পারছেন না। তিনি পালঙ্কে গিয়ে বসে বললেন, ‘ছয়টায়ই চলে এলেন তন্ময় সাহেব? কারণ কি?’

তন্ময় নিজের হাত ঘষতে ঘষতে বললো, ‘এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম, তাই ভাবলাম একেবারে জিম করেই যাই।’

– ‘তাহলে এই রুমে কেন?’

– ‘এমনিই এসেছিলাম, ভাবলাম কেয়ার সঙ্গে গল্প-টল্প করবো।’

– ‘দরজা বন্ধ কেন?’

তন্ময় আমতা-আমতা করছে আর কেয়ার দিকে তাকাচ্ছে। কেয়া নিজের ওড়না ঠিক করতে করতে বললো, ‘ভুলে লাগিয়ে ফেলেছি। ও ভেতরে এলো আর আমি ভুল করে লক করে দিয়ে এসে সোফায় বসেছি।’

ইশহাক সাহেব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘যান, তন্ময় সাহেব। আমি আর জিম করবো না। আপনার আসা লাগবে না। দারোয়ানকেও বলে রাখবো ঢুকতে না দিতে।’

তন্ময় কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল৷ ইশহাক সাহেব ঠোঁটে আঙুল রেখে বললেন, ‘চুপ, জাস্ট ইজ্জতের জন্য চেপে যাচ্ছি। সুতরাং কথা কম বলে বিদায় হোন।’

তন্ময় মাথা নিচু করে চলে গেল। ইশহাক সাহেব কপালে হাত দিয়ে মলিন মুখে বসে রইলেন বিছানায়। কেয়া এসে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, ‘বিশ্বাস করো, তুমি যা ভাবছো তেমন কিছুই না। আমরা জাস্ট গল্পই করছিলাম।’

ইশহাক সাহেব লাল টকটকে চোখে তাকিয়ে বললেন, ‘লজ্জা করছে না?’

কেয়া আর কিছু বললো না। ইশহাক সাহেব খানিক পর বললেন, ‘যাইহোক, এখন কি চাচ্ছ বলো?’

কেয়া কোনো জবাব দিল না। ইশহাক সাহেব ধমকের সুরে বললেন, ‘এটা কি বেশ্যাবাড়ি? কথা বলো। তোমাকে জোর করে বিয়ে করা হয়নি। এসব করতে হলে আমার এখানে থেকে নয়। ডিভোর্স নাও, নিয়ে বিদায় হও।’

কেয়া আবারও চুপ করে রইল। ইশহাক সাহেব শান্ত গলায় বললেন, ‘তোমাকে ডিভোর্স দেবো আমি। তোমার সঙ্গে আর সংসার করা সম্ভব হবে না।’

কেয়া পায়ে পড়ে গেল। তারপর কাঁদতে কাঁদতে বললো, ‘বিশ্বাস করো ওর সঙ্গে আমার তেমন কিছুই হয়নি। শুধু ফোনে কথা হতো। বারবার না করার পরও বিরক্ত করতো।’

– ‘তাহলে রুমে এনেছো কেন?’

– ‘ও কল দিল যে সে এদিকে এসেছে। বাসায় আসবে। আমি বললাম আসো। তারপর রুমে চলে এসে দরজা বন্ধ করে নিল।’

– ‘মিথ্যে কথা বলো না, সম্পর্ক না থাকলে এরকম আসবে?’

কেয়া মাথা নুইয়ে বললো,

– ‘সম্পর্ক ছিল, বললাম না বিরক্ত করে করে আমাকে একটু ইয়ে করে ফেলছিল। তাই বলে আমার দিক থেকে এতটা প্রশ্রয় ছিল না।’

– ‘নাটক করো না কেয়া, তোমাকে আমি তবুও সুযোগ দিচ্ছি। তুমি এক সপ্তাহ ভেবে সিদ্ধান্ত নাও কি করবে। ডিভোর্স না-কি ওই ছেলেকে চাও। এখানে থেকে নষ্টামি করার সুযোগ নেই। আর তোমার উৎপাত অনেক সহ্য করেছি। আর করা হবে না।’

কেয়া চুপ করে রইল। ইশহাক সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ওই ছেলে তোমাকে বিরক্ত করেছে, করে করে ইয়ে করে ফেলছে তাই না? তাহলে ওর ‘ইয়ে’ আমি বের করছি কীভাবে দেখো।’

কেয়া মাথা তুলে তাকিয়ে বললো, ‘ওকে কি করবে?’

– ‘তা দিয়ে তুমি কি করবে? প্রেম থাকলে ডিভোর্স নিয়ে চলে যাও। আমার মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাবে না-কি?
আমি তোমার বাড়ির লোকদের জানিয়ে দেই আপনাদের মেয়েকে হাতে-নাতে ধরেছি।’

কেয়া চুপ হয়ে গেল। তিনি পুনরায় বললেন, ‘যদি সংসার করার ইচ্ছা থাকে। আমি শেষবার ক্ষমা করে দিতে পারি। কিন্তু এখন থেকে বাড়ির বাইরে একা যাওয়া যাবে না। বাড়িতে আমার বোন আসবে। ওর সঙ্গে সুন্দর আচরণ করতে হবে। আমার ছেলের সঙ্গে গলা উঁচু করে কথা বলা যাবে না। কাজের মেয়ের সঙ্গে অকারণ চেঁচামেচি করা যাবে না। তোমার ফোনের সবকিছু আমি নিয়মিত চ্যাক করবো। এরকম থাকলে ঠিক আছে। না হয় আমি তোমার বাড়িতে সবকিছু জানাবো। ডিভোর্স দেবো। ভেবে-চিন্তে জানাও কি চাও।’

ইশহাক সাহেব বাইরে এলেন। হুস্না কিচেনে বসে আছে। হাত-পা কাঁপছে ওর। ইশহাক সাহেব এসে বললেন, ‘হুস্না।’

– ‘জি চাচা।’

– ‘আর কেউ যেন এসব না জানে, কেমন?’

– ‘জি আচ্ছা চাচা, আপনাকে চা দেবো?’

– ‘দাও, আর হ্যাঁ, কেয়া তোমার সঙ্গে এখন থেকে কোনো খারাপ আচরণ করলে আমাকে জানাবে।’

– ‘জি আচ্ছা।’

ইশহাক সাহেব সিটিংরুমে এসে সোফায় চুপচাপ বসে রইলেন। উনার ধারণা ওদের হয়তো ফোনেই টুকটাক কথা হয়েছে এতদিন। এখন সুযোগ পেয়ে দু’জন একই রুমে চলে গিয়েছিল। ঘটনা এই অবধি গড়িয়েছে হয়তো। কেয়াকে একটু টাইট দিয়ে যদি ভালো হয়ে যায়। তিনি এসব ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করবেন। বয়স কম, ভুল করে ফেলেছে। তিনি সুযোগ দিতে চান।
*
যাত্রা বিরতির পর থেকে তরু সিট নামিয়ে ঘুমোচ্ছে।
আগেই আইসক্রিম খেয়ে নিয়েছিল তারা। চকলেট, আচার কিছুই আর খাওয়া হয়নি। নির্জন নিজের সিটও নামিয়ে তরুর কাছে নিল। কি সুন্দর ঘুমোচ্ছে ও। পেটের ওপর দুই হাত। বুকে ওড়না। মাথা একদিকে কাঁত। নির্জনের ভীষণ ইচ্ছা করছে ওর গালে হাত রাখতে। তরু নিশ্চয় কিছু মনে করবে না? নিজেই তো তার হাত ধরেছিল আগে। নির্জন আস্তে-আস্তে পরম মমতায় নিজের হাতটা তরুর থুতনির দিকে নিয়ে গালে রাখে। তারপর নেশাতুর চোখে তাকিয়ে তাকে দীর্ঘ সময়। বুড়ো আঙুল দিয়ে ওর তুলতুলে গালে মৃদু ঘষছে। বাইরের হাওয়ায় কয়েক গোছা চুল উড়ছে তরুর। নির্জন কপাল থেকে সেগুলো সরিয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। হঠাৎ মনে হলো এই মিষ্টি মুহুূর্তটা ক্যামেরাবন্দি করলে কেমন হবে?
সে পকেট থেকে ফোনটা বের করে কয়েকটা সেলফি তুলে নিল। একবার তাকালো সাইটের সিটের দিকে। ওরাও ঘুমোচ্ছে। নির্জনের চোখ গেল তরুর উরুর দিকে। কামিজ সরে গেছে ওর। আস্তে-আস্তে টেনে ঢেকে দিল সে। বাসটা ঢাকার কাছাকাছি চলে এসেছে। এমনিতেই উঠতে হবে এখন। নির্জন পুনরায় শুয়ে ওর দিকে ফিরে গালে হাত রেখে ডাকলো, ‘তরু।’

সঙ্গে সঙ্গে চোখ মেলে তাকায়। প্রথমে দু’জনকে এত কাছাকাছি দেখে হকচকিয়ে উঠে বসে তরু। ওড়না ঠিক করে নিয়ে বলে, ‘কোথায় এলাম?’

নির্জন ওর সিট তুলে নিজের সিটও টেনে বললো, ‘আর বেশি বাকি নেই।’

তরু পানি খেল এক চুমুক। নির্জন সোজা হয়ে বসে বললো, ‘অবশ্য আরও কিছুক্ষণ ঘুমাতে পারতে।’

তরু বুকে হাত বেঁধে সিটে হেলান দিয়ে বসে ওর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তা হলে ডাকলে কেন শুনি?’

– ‘এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলবে।’

তরু হেসে চোখ সরিয়ে নিল।

– ‘কেন ডেকেছি শুনবে না?’

– ‘বলুন?’

– ‘এক তো একা একা ভালো লাগছিল না। আবার তোমাকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে বারবার ছুঁয়ে ফেলবার ভীষণ লোভ হচ্ছিল।’

তরু এবার পুরোপুরি জানালার বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল। লজ্জায় কুঁকড়ে যায় এসব শুনলে। আবার ভীষণ ভালোও লাগে। নির্জন পুনরায় ডাকলো, ‘তরু, এদিকে তাকাও, কিছু বলছো না যে।’

তরু ইচ্ছা হলো মানুষটার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলবে সে। এই ভালো লাগার মুহূর্তগুলো অপচয় করা ঠিক হবে না৷ প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করতে হবে। মুখ ফিরিয়ে চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আপনার নুসরাতকে গিয়ে ছুঁয়ে দিন। আমি কেন?’

নির্জন মুচকি হেসে বললো, ‘হুম দেবো, সে তো এখন এখানে নেই।’

তরু মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললো, ‘ছি, নুসরাত এলে ওকে ছুঁতে চান, এখন আমাকেও।’

– ‘হ্যাঁ, এখন তোমাকে ছুঁতে চাই। তোমার হাত ধরে বসে থাকবো। বাস একটু পরই গন্তব্যে গিয়ে থেমে যাবে৷ আমাদের ঢাকা শ্রীমঙ্গলের যাত্রার সমাপ্তি হবে।’

তরু সোজা হয়ে বসে নিজের হাতটা সিটের পাশে রাখলো। নির্জন আস্তে আস্তে হাতটা তার হাতের মুঠোয় নিল। কি অদ্ভুত এক অনুভূতি। বুকের ভেতর কিছু যেন ছলকে পড়েছে। সে গাঢ় আবেগমাখা গলায় বললো, ‘তোমার হাতটা কেমন জানো?’

তরু ওর কাঁধে কপাল ঠেকিয়ে বললো, ‘কেমন?’

– ‘নরম, গরম।’

তরু স্মিত হেসে বললো,

– ‘হাত বুঝি নরম হয়?’

– ‘হয়, তবে তোমার গাল থেকে নরম নয় হাত।’

– ‘আপনি আমার গাল নরম জানলেন কি করে?’

– ‘তুমি যখন ঘুমে ছিলে তখন।’

– ‘কি খারাপ আপনি, ঘুমে পেয়ে ছুঁয়ে নিয়েছেন।’

নির্জন ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,

– ‘কেন যেন মনে হলো অপরাধ হচ্ছে না। কেন যেন মনে হলো আমার অধিকার আছে স্পর্শ করার। কেন যেন মনে হলো তুমি জানলে কিছুই মনে করবে না। ভুল মনে হলো বুঝি? তুমি রাগ করেছো?’

তরু মাথা না তুলেই কাঁধে মাথা নাড়লো। সে রাগ করেনি। নির্জনের চোখ ছলছল করছে। এত মিষ্টি অনুভূতি আর ভালো লাগা, এর আগে কখনও অনুভব করেনি। স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে সবকিছু। এত ভালো লাগছে কেন তরুকে বুঝতে পারছে না সে। কতকিছু তার অজান্তেই যেন মুখ থেকে বের হয়ে আসছে। নিজেকে অন্যভাবে আবিষ্কার করছে আজকাল।

শেষ গন্তব্যে এসে থামলো বাস। দু’জন নেমে রিকশা নিয়ে ফিরে এলো বাসায়। তরু কাপড় পালটে হাত-মুখ ধুয়ে গেল কেয়ার রুমের দিকে। গিয়ে দেখে দরজা খোলা। পর্দা সরিয়ে ভেতরে যেতেই সবকিছু কেমন এলোমেলো লাগলো তরুর কাছে। কেয়া খাটে হেলান দিয়ে বসে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে৷ ঠোঁটের কোণে রক্ত। ডান গাল লাল হয়ে আছে। যেন কেউ কষিয়ে চড় মেরেছে। মেঝেতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে চায়ের কাপের টুকরো আর মোবাইল। ইশহাক সাহেব সোফায় বসে আছেন। তরুর কাছে খুবই অচেনা লাগলো উনার চেহারা।

___চলবে….

1 COMMENT

  1. Emn darun ekta golpo,,,,,,, vison moja Nia prtsilm,,,,,, upovog krtsilm khub,,,,,, ekhn golper jonno opekkha krte hoibo,,,,,, golper jonno opekkha Kora amr kase onk koster mne hoy,,,,,, lekhok Vai,,,,,, ektu Maya doya koira taratari baki prbo guli post dien plz,,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here