সূর্যোদয় #পর্ব_০৬ #কারিমা_দিলশাদ

#সূর্যোদয়
#পর্ব_০৬
#কারিমা_দিলশাদ

মাত্র ক্লাস শেষ করে বেরিয়েছে ঐশী। বাকিদের কাজ থাকায় বাকিরাও চলে গেছে আজকে তাড়াতাড়ি। তাকেও টিউশনি পড়াতে যেতে হবে, তবে তার হাতে বেশ সময় আছে। তাই ঠিক করলো পার্কে কি গিয়ে কিছুক্ষণ বসে থেকে তারপর পড়াতে যাবে।

পার্কে গিয়ে একটা বেঞ্চে বসে আছে ঐশী। আজকের আবহাওয়াটা এত্তো সুন্দর। রোদ নেই। হালকা মেঘলা মেঘলা আকাশ। আর প্রচুর বাতাস। খুব শান্তি শান্তি লাগছে। ফোন বের করে একটু গান শোনার জন্য। তখন বেশ কয়েকটা মেসেজ নোটিফিকেশন চোখে পড়ায় চেক করতে গিয়ে দেখে আননোন নাম্বার থেকে একটা মেসেজ এসেছে। মেসেজ ওপেন করে দেখে,

“ ধন্যবাদ। ভীষণ ভীষণ ধন্যবাদ, আমার দ্বিধা দূর করার জন্য। স্বাভাবিক হতে সাহায্য করার জন্য। You are such a amazing girl. You are very special to me. শুভ কামনা রইলো আপনার জন্য।

– আহসান কবির জয়।”

এতদিন পর জয়ের কাছ থেকে মেসেজ পেয়ে বেশ অনেকটা অবাক হয় ঐশী। সেদিনের পর মাঝেমধ্যে মনে পড়লেও, এখন সে প্রায় ভুলতেই বসেছিল জয়কে। আজ হঠাৎ এই মেসেজ আবার তাকে মনে করিয়ে দিল। আরও কয়েকবার মেসেজটা পড়লো ঐশী।

ধন্যবাদ, স্বাভাবিক হতে সাহায্য করা!! এর মানে কি সে স্বাভাবিক হয়ে গেছে? বাহ্। বাট এতো সহজে!!

ধ্যাত একটা মানুষ প্রেমে ছ্যাকা খেয়ে ব্যাকা হয়ে থাকলেও মনে হয় বোকামি করছে, অস্বাভাবিক আচরণ করছে আবার যখন তারা মুভ অন করে তখন এতো সহজে মুভ অন করলো বলে সন্দেহ করাটা মানুষের স্বভাব হয়ে গেছে। সেও একই দলের মানুষ। না না এসব ভাবা যাবে না। বি পজিটিভ। সবসময় পজিটিভ চিন্তা ভাবনা করতে হবে তার, সে প্রচন্ড নেগেটিভ চিন্তা ভাবনা করে। ভালো হতে হবে তাকে। ভালো ভালো খুব ভালো। বসে বসে এসবই উল্টাপাল্টা চিন্তা ভাবনা করছে ঐশী।

এরপর কিছু বাদাম কিনে খেতে খেতে আবার অন্য চিন্তা ভাবনা করতে শুরু করে দেয়। এরমধ্যে আবার মেসেজের কথা মাথায় আসে। ‘ You are very special to me’ মনে পড়তে কপাল কুঁচকে আবার হেসেও ফেলে। এরপর ব্যাগ কাঁধে নিয়ে টিউশনির উদ্দেশ্য চলতে শুরু করে। আর মনে মনে বলে,

“ লোকটা ততটাও সাধাসিধে না যতটা মনে করেছিলাম। যথেষ্ট তেলমা’রতে পারে।”

এরপর বাকিসব চিন্তা ভাবনা ফেলে রিকশা নিয়ে চলতে শুরু নিজের গন্তব্য। নিজের নিয়মিত রুটিনে। আর ভাবে তার জীবনটা কেমন যেন একটা নির্দিষ্ট ছকের মধ্যে আটকে গেছে। প্রতিদিনই যেন একই জিনিস, একই ঘটনা বারবার হচ্ছে। যতক্ষণ বাইরে বন্ধুদের সাথে থাকে ততক্ষণই তার জীবনটাই একটু হাসি খুশি থাকে। বাসায় গিয়ে আবার সেই একটা রুমে চুপচাপ বসে থাকা। কারো সাথে কথা বলার সুযোগ নেই। কিছু মানুষ আছে না রোজ বাড়ি গিয়ে মা’কে সবকথা শেয়ার করে। তারই তো কয়েকটা ফ্রেন্ড আছে। তারও তো ছোটবেলা থেকেই মন চাইতো যে বাইরের কাটানো সময়টা বাড়িতে এসে মা’কে বলতে। কিন্তু তার মা তার সব কথার উল্টো এবং অদ্ভুত সব বিষয় বের করে করে সারাটাজীবন খোঁটা দিয়ে আসছে।

একবার হলো কি, স্কুলে পড়তো সে তখন। তার এক ক্লাসমেটের জন্মদিন। তো সে ঐশীসহ ক্লাসের আরও বেশ কয়েকজনকে ট্রিট দেয়। এখন একজনের জন্মদিন সে সেই উপলক্ষে তাদের ট্রিট দিচ্ছে এখন খালি হাতে তার ট্রিট কিভাবে গ্রহণ করে সে, আর যেখানে অন্যারা কিছু না কিছু দিচ্ছে। যদিও সে জানতো না জন্মদিনের বিষয়টা, কিন্তু বান্ধবী হিসেবে গিফট তো দিতেই হয় তখন। আর তখন তার কাছে তার জমানো টাকা থেকে ৫০ টাকা সাথে ছিল। সে তা দিয়েই তার ওই বান্ধবীটাকে একটা পুতুলওয়ালা কলম গিফট করে। বাসায় এসে যখন মাকে কথাটা বললো তখন তার মা রে’গে চন্ডী। তার মা’র ভাষ্য সে লোকেরটা খাওয়ার জন্য হা করে বসে থাকে, অন্যের পা ধরে বসে থাকা তার স্বভাব। আরও কতো কি। রাতে তো বাবাকে নিয়ে বিচারও বসে।

তাই তো এখন এতো লুকোচুরি। এই লুকোচুরি খেলতে খেলতে সে ক্লান্ত। মিথ্যাতে ভয় থাকে, অশান্তি থাকে। কিন্তু সত্য যেন এক শান্তি। সে তো কোনো অন্যায় করে না তবুও কেন মেয়ে বন্ধুদের সাথে কথা বলতে গেলেও মনে ভয় নিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে কথা বলতে হবে সে জানে না। উফফফ আর ভাবতে পারছে না সে। আর ভাবতে চায় না। এখন দুটো টিউশনি করে আবার বাসায় গিয়ে চুপ করে বন্দী দশায় থাকতে হবে। সেই একই রুটিন। দমবন্ধ হয়ে আসছে তার। সে এই ছকটা ভাঙতে চায়।

চট করে সে ঠিক করে নেয় আজ সে কোনো টিউশনি করাবে না। এই রিকশা নিয়েই সারা শহর ঘুরবে। যা মনে চায় খাবে। ব্যাগ থেকে ইয়ারফোন বের করে কানে লাগিয়ে নেয়। যা হওয়ার হোক আপাতত এই রিকশা রাইডটা এনজয় করা যাক। বাকিসব জাহান্নামে যাক। সেল্ফট্রিট হোক আজ।

———————-

৩টার দিকে বাসায় ফিরে ঐশী। মনটা আজকে বেশ ফুরফুরা। আজকে সারাটা শহর রিকশা নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরেছে। পেট ভরে খেয়েছে। আর আসার সময় নার্সারি থেকে দুটো গাছ কিনে ফিরেছে। গাছ তার খুব শখের, খুব প্রশান্তির একটা জিনিস। এগুলো করতে গিয়ে যদিও বেশ অনেকগুলো টাকা হাতছাড়া হয়ে গেছে। তবে থাক কোনো ব্যাপার না। মনটা হালকা হালকা লাগছে। এখন বাসায় গিয়ে গোসল করে একটা ঘুম দিলেই শান্তি।

মানুষ যা ভাবে তাই কি আর হয়৷ বাসায় গিয়ে দেখে তার বড়খালা এবং তার মেয়ে এসেছে। এই মহিলাটাকে সে দুচোক্ষে কেন এক চোক্ষেও দেখতে পারে না। এই মহিলার মতো নিচ, ছোট’লোক টাইপের মহিলা খুব কম আছে। মুখের কথা তো না যেন ধারালো ছু*রি। মানুষকে ছোট করতে না পারলে যেন তার শান্তি হয় না। তবে তার এই খাসিয়তের জন্য কম অপমানও হয় না। তারপরও তার লজ্জা হয় না কখনও। কেবল ঐশীই না মহিলার অন্যান্য আত্মীয় স্বজন, আশেপাশের প্রতিবেশী কেউই তাকে পছন্দ করে না। তবে ঐশীকে তিনি একটু মেপেই চলে। কিন্তু বলে না কুকু’রের লেজ কখনো সোজা হয় না, এই মহিলাও তেমন। নিজের ছোটলোকি কায়কারবার বেশিক্ষণ সামলে রাখতে পারে না।

ঐশীর মা’র তিনবোন দুইভাই। সবার বড় তার বড়খালা, এরপর ক্রমান্বয়ে তার বড়মামা, তার মা, ছোটমামা, ছোটখালা।

বড়খালাকে দেখে এবং তার মায়ের মুখ দেখেই বুঝে ফেলে যেই ভাবনা আর খুশি মন নিয়ে ফিরেছিল সে তা এখন এক নিমিষেই শেষ হয়ে যাবে।
তবুও হাসিমুখে সালাম দেয় তার বড় খালাকে। বড় খালাও সালাম নেন। ঐশীর হাতে গাছ দেখে বলে,

‘ কি যে কিনস না সারাক্ষণ। এইটুকু জায়গার মধ্যে এইসব লাগায়ে কোনো লাভ আছে?”

ঐশীরা তিন বেড়রুমের সাথে ড্রইং ডাইনিং রুমের একটা ফ্ল্যাট বাসায় থাকে। যদিও বেশ বড়সড় ফ্ল্যাট। এখন শহরে তো আর গ্রামের বাড়ির মতো বিশাল বিশাল বাসা তাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের থাকে না। তবু তার খালার মতে তারা খুবই গরিব। তার খালার গ্রামের বাড়িতে ছোট একটা বাড়ি থাকলেও এখানে ছেলে মেয়েদের পড়াশোনার জন্য ভাড়া থাকে। তার বড় ছেলে বিয়ে করে বৌ নিয়ে অন্যত্র থাকে, ছোট ছেলে এবার ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে আর মেয়েটা এবছর এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। ঐশীর বাবার অন্য জায়গায় জমি থাকলেও সেখানে এখনও বাসা করা হয়নি। এই ফ্ল্যাটটাও রিসেন্টলি কিনেছেন। এখনও একবছরও হয়নি। এতদিন তারাও ভাড়া থাকতো। ঐশীর বাবা চাকরি করে। বেশ ভালো বেতন, গড়পড়তা মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে বেশ মোটা অংকের বেতনই তার বাবা পায়। তাদের ফ্যামিলির অন্যান্য আত্মীয় স্বজনদের থেকেও তাদের অবস্থা বেশ স্বচ্ছল। আর তার এই বড় খালার থেকে তো অবশ্যই। বড় খালার জামাই ছোটখাট মুদি দোকান করে। দোকানের মজুদের জন্যও অন্যের কাছ থেকে ধার করে এনে মালামাল তুলতে হয়। যা যোগানের টাকা তার বাবাই বেশ কয়েকবার হাওলাত হিসেবে দেয়। তারপরও তারা গরীব আর সে বড়লোক। লোকের কাছে বলে বেড়ায় তার হাজব্যান্ড এর বড় বিজনেস আছে।

বড়খালার কথায় ঐশী ছোট করে একটু হেসে বলে,

“ তাও তো এতবড় শহরে নিজেদের নিজস্ব একটা বাসা আছে বলেন। সবার কি আর তা থাকে।”

বলেই নিজের ঘরে চলে যায়। গিয়ে গোসলটা সেরে নেয়। এরমধ্যে তার মা এসে খাওয়ার জন্য ডাকে। তার পেট তো ভরা। তাই সে না করে দেয়। তার মা জানায় কালাভুনা রান্না হয়েছে আজ। আর কালাভুনার নাম শুনেই ঐশীর আবার অল্পসল্প খিদে পেয়ে যায়। তাই খাওয়ার জন্য বের হয় রুম থেকে। রান্নাঘর থেকে খাবার নিয়ে ডাইনিং গিয়ে বসতেই তার মা খালাও গিয়ে বসে টেবিলে। সে সেদিকে মন না দিয়ে তার মতো করে খাবার খেতে থাকে। আর তার মা আর খালা কথা বলতে থাকে। এক পর্যায়ে তার খালা বলে,

“ জানিস ঐশী আমার ননদের পোলাটা আছে না৷ সামনের মাসে পিএইচডি করার জন্য নাকি বিদেশ যাব। এতো ভালো ছাত্র কি কমু। সেই তুখোড় ছাত্র। ঢাকা ভার্সিটিত পড়ে। আর আমার ননাসের মাইয়াটাও তো ঢাকা ভার্সিটিত চান্স পড়ে। তোর সাথেই। একই সনে ইন্টার পাশ করলি তোরা।”

এরপর আরও কিছুক্ষণের অমুক তমুকে দুর্নাম আর নিজেদের সুনাম গাইতে থাকে।
ঐশী কেবল মুখে হাসি রেখে শুনে গেল। খালার ননদের মেয়েটা তার সাথেই এইচএসসি পাশ করে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পায়। তার খালা যে ঘরে আগুন লাগানোর জন্য কথাটা বলে তা সে খুব ভালো করেই জানে। নইলে এমন তো না বিষয়টা তাদের অজানা। সেকেন্ড ইয়ারে এখন দুজনেই। এখন তো এটা বলার কোনো মানে হয় না। তার কোথাও চান্স হয়নি এটাই বারবার খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বলে। সে এরমধ্যেই খাওয়া শেষ করে প্লেটটা ধুয়ে রান্নাঘরে রেখে। ফ্রীজ থেকে বোতল বের করে পানি খেতে খেতে বলে,

“ খালামনি কু’টনিগিরি না করলে আপনার চলে না তাই না? আপনার ননদের মেয়ে শান্তা যে ঢাকা ভার্সিটি পড়ে তা কি আমরা জানি না? সেও যে এখন সেকেন্ড ইয়ারে, সেটাও জানা। আর আপনার ননদদের মধ্যে একজনেরই ছেলে আছে। সেও তো আমাদের কলির সাথে এইবার এসএসসি পরীক্ষা দিল। তাহলে পিএইচডি করার জন্য বিদেশ যাবে কই থেকে? আর ঢাকা ভার্সিটিতে পড়েই বা কিভাবে? এতো গালগল্প আপনাকে কে করতে বলে। আমি জানতে চাইছি নাকি আপনারে বলতে বলছি গালগল্প করার জন্য?”

“ ওমা!! আমি তো তোর ভালার জন্যই কইলাম। তুই আমার লগে এমনে কথা কস কে?”

“ ওও তাই!!! তা কি ভালোর জন্য বললেন শুনি। কি ভালো হইলো এইগুলা শুনে বলেন।”

“ ঐশী!! থা*প্পড় দিয়ে দাঁত ফেলায় দিমু বদ’মাইশ। তুই কোনডা করবার পাস নাই দেইখা কি যারা করছে তারার কথাও মানুষ কইবার পাবো না। এতো যহন তেজ তো নিজে ভালা কিছু করবার পাও নাই কে?”- ঐশীর মা বলেন।

ঐশী তার মা’র কথায় একটা দীর্ঘশৃবাস ফেলে শান্তস্বরপ বলে,

“ হ্যা আমি ভালো কিছু করতে পারি নাই। তাই বলে এইটাও কখনো বলি নাই কারো ভালো কিছু আমার সামনে না বলতে। মিথ্যা কেন বলবে? আর তোমার বোন বারবার একই কথা এমনভাবে বলে যেন আমরা জানি না বিষয়টা। তোমার বোন এই কথাগুলা আমার ভালোর জন্য বলে না সংসারে আগুন লাগানোর জন্য বলে তা তোমারও জানা আছে। আর হুদা কামে মিথ্যা কথায় বা বলবে কেন? তার ননদের ছেলে এইবার এসএসসি পরীক্ষা দিল, তাহলে সে পিএইচডি করতে বিদেশ কিভাবে যায়? তোমার বোন সবাইরে তোমার মতো ভাবে নাকি যে সে যা বলবো সবাই তোমার মতো হা করে, মাথা নিচু করে জ্বি হুজুর জ্বি হুজুর বলে মেনে নিবে?”

ঐশীর মা এবার মেয়ের গালে চ*ড় মে*রে দেন। ঐশীকে চ*ড় মা’রতে দেখে ঐশীর খালাও সুরসুর করে চলে যায় বাসা থেকে। আর বলে যায় সে আর কোনদিন এই বাসায় আসবে না। কিন্তু যতই বলুক ঐশীর জানা আছে আবার ঠিকই চলে আসবে কয়েকদিন পর মুখ উঠিয়ে। ঐশীর মাও যান বোনের পিছে পিছে। তাদের দুজনকে যেতে দেখে ঐশীও নিজের ঘরে চলে যায়৷ মন মেজাজ বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। তার বড়খালা কেমন তা তার মায়েরও জানা আছে। তারপরও তার মা সবসময় বড় বোন যা বলবে মাথা নিচু করে, চোখ বন্ধ করে তা মেনে নিবে। বড়খালা নামক এই মহিলার জন্য প্রায় তাদের ঘরে অশান্তি লেগে থাকে। কেবল তাদের বলতে না তার ছোট খালা আর মামাদের ঘরেও এভাবে অশান্তি লাগায়। কিন্তু তার ছোট খালা আর বড় মামি আবার তার মা’র মতো না, তারা মুখের উপর উচিত কথাগুলো বলে দেয়। তাই তার ছোট খালা আর বড় মামির সাথে অত পারে না। কিন্তু ছোট মামি আবার তার মা’র মতো। এই মহিলা তার মামাদের কানে তার মামিদের নামে সারাক্ষণ বি’ষ ঢালতে থাকে। এই মহিলার জন্য তারা সারাজীবনেও শান্তিতে সংসার করতে পারলো না।

ক্লান্ত লাগছে খুব তার। তাই সে বিছানায় তার গা এলিয়ে দিল।

—————–

এরমধ্যে তার মা এলো রে’গেমেগে। এসে ঐশীর চুলের মুঠি ধরে তাকে টেনে তুলে। আর এলোপাতাড়ি মা*রতে শুরু করে। তবে ঐশী নির্বিকার। না তো সে মা’রগুলো থেকে নিজেকে বাঁচানোর ট্রাই করছে আর না তো একটা টু শব্দ করছে।

আর ঐশীর মা রেহানা বেগমের রা’গ এই মেয়ের জন্য তার বড় বোন তার বাসায় আর আসবে না বলেছে। এই মেয়েকে সে আস্তো রাখবে না। মা*রতে মা*রতে এক পর্যায়ে সে ঐশীর রুমের সাথে লাগোয়া বারান্দায় চলে যায়। গিয়ে বারান্দায় যত গাছ আছে সব একটা একটা করে ভাঙতে থাকে আর বলতে থাকে,

“ মা** তোর জীবনেও ভালা হবো না৷ জামাই পোনাই (বাচ্চা) নিয়ে জীবনেও সুখে শান্তিতে ঘর করবের পারবি না। তোর জন্য আমার বইন আর আসবো না কইছে। তোর জীবনেও ভালা হবো না। একটা টেহা কামাই করার মুরোদ নাই, আমার জামাই আর ছেরার ঘাড়ে বইসা জিন্দেগী ভরা খাবি আর আমার বোইনেরার সাথে তাল বাজাবি। হা’রামি, বে’ইমান ছেরি।”

আরও অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে, আরও কিছুক্ষণ অভিশাপ দিয়ে তিনি চলে যায় নিজের রুমে। সে এখন ফোন দিয়ে এগুলো তার স্বামী এবং তার ছোটবোনকে জানাবে।

——————–

আর এদিকে ঐশী এখনো নির্বিকারভাবে বসে আছে। কিছুক্ষণ পর উঠে তার বারান্দায় যায়। গিয়ে দেখে দুয়েকটা বাদে সবগুলো গাছই ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে। এসব দেখে তার চোখ দিয়ে কেবল দু ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ে। তার মা’র এসব কথা তার গা সয়ে গেছে। তবে আজ তার আরও একটা শখের এমন করুন পরিণতি দেখে আবার মনে মনে ভেঙে পড়লো।

সে আস্তে আস্তে সবকিছু পরিষ্কার করতে শুরু করে আর ভাবতে থাকে এমন কত শখ স্বপ্নই তার অধরা থেকে গেল। বেশ রক্ষণশীল তার পরিবার। ছোটবেলা থেকেই সে খুব রেস্ট্রিকশনে বড় হয়েছে। আর ৫-১০ টা বাচ্চার মতো সে কখনো খেলতে যেতে পারতো না। তাকে সেই সুযোগ দেওয়া হতো না। আদর, এবং আরাম আয়েশেই বড় হতে থাকে সে। কিন্তু যখন তার ভাই হয় তখন এক ঝটকায় তার সব আদর আয়েশে ভাটা পড়ে গেল। তখন থেকেই মানিয়ে নেওয়া আর মেনে নেওয়াতেই তার জীবন।

বাচ্চাদের মাঝে হিংসার সৃষ্টি আমরা বড়রাই করি। একটা বাচ্চাকে যদি খুব আদর করে বড় করা হয়। এবং একসময় অন্য একটা বাচ্চার জন্য যদি আদর হঠাৎ করেই কম করা হয় তা বাচ্চাদের মাঝে হিংসা এবং খারাপ লাগার সৃষ্টি করে। আবার ধরুন একটা বাচ্চাকে যদি বলা হয় তোমার তো ভাই/বোন আসছে এখন তো সবাই তাকেই আদর করবে তোমাকে আর আদর করবে না। এতে একটা বাচ্চার মন-মস্তিষ্কে কতটা খারাপ প্রভাব ফেলে তা আমাদের ধারণার বাইরে।

ঐশীর সাথেও বিষয়টা এমন ছিল। তবে সে নিজেকে সামলে নিয়েছিল। ছোট ভাইয়ের উপর সেই বিদ্বেষটা তার তৈরি হয় নি। কিন্তু মন থেকে পরিবারের কাছ থেকে দূরে ছিটকে পড়েছিল। ঐশী খুব ভালো নাচ করে। নাচ যেন তার প্রাণ। এটা নিয়েই কিছু করার ইচ্ছে ছিল তার। বেশ ভালো সুযোগও ছিল তার। কিন্তু তার বাবা মা সেটা বন্ধ করে দেয়। তার স্বপ্নের সমাপ্তি। সে কখনোই ডাক্তারি পড়তে চাইতো না। সে তো সাইন্স নিয়েই পড়তে চাইতো না৷ কিন্তু বাবা মা’র জোরাজুরিতে নিতে বাধ্য হয়। কিন্তু তা ছিল তার কাছে জাহান্নামের ন্যায়। সে এতো চাপ নিতে পারতো না। তার বাবা মার এককথা। হয় সাইন্স নিয়ে পড়ে ডাক্তার হও নাহলে পড়ালেখা বাদ। বিয়ে দিয়ে দিবে।

বিয়ের বিষয়টা কেবল কথার কথাও ছিল না। এসএসসির পড়ে যখন সে বিভাগ চেঞ্জ করার কথা বলে এবং জেদ ধরে থাকে। তখন তার মা সত্যি সত্যি পাত্র দেখা শুরু করে। পাত্র তাকে দেখতেও আসে। অবশ্য এর পিছনে তার বড় খালায় ছিল। এরপর বাধ্য হয়ে সাইন্স নিয়েই কলেজে ভর্তি হয়। ওই সময়টাও তার কাছে আরেক আজাব ছিল। তবে এইচএসসিতেও এ প্লাস পায়। এরপর আসে এডমিশন। তবে ততদিনে সে বুঝে গেছে তার দ্বারা কি সম্ভব আর কি সম্ভব না। সে পূর্ণ উদ্দ্যেমে দেশের দূরের যেকোনো একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ চাইতো। কিন্তু মেডিকেল এক্সামের পর তার উপর দিয়ে যা যায় এতে করে যে সে বেঁচে আছে সেটাই অবাকের বিষয়। সারাদিন রাত অভিশাপ , গালিগালাজ, মা’রধোর তাকে পৃথিবীতেই প্রতি মুহুর্তে জা’হান্নাম ঘুরিয়ে নিয়ে আসে। সে পরেরবার আরও গতিতে পড়া শুরু করে। সে ভাবে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স হলেই বাবা মা’র এতো রাগ আর থাকবে না। হায় ভাগ্য!! দ্বিতীয়বারও যখন মেডিকেলে হয় না, এরপর তাকে আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষাটাও দিতে দেয় নি তার বাবা মা। ভর্তি হয় ন্যাশনালে। আর এখন সারাদিন ব’ঞ্চনা।

আমাদের দেশের বাবা মা’রা একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতায় মত্ত। এখানে তারা সন্তানের ভবিষ্যত উজ্জ্বলের নাম করে নিজেদের নাম, গালগল্প সমাজে প্রচারের প্রয়াসে মত্ত। যদি সন্তানের ভালো চাইতো তাহলে নিজেদের পাশাপাশি সন্তানের মতামত এবং তাদের প্রতিভার গুরুত্ব দিত। প্রতিবছর এডমিশন যুদ্ধ কেবল যেন যুদ্ধ নয় বরং মৃ’ত্যুর এক মিছিল বয়ে চলে। একঘন্টার একটা পরীক্ষায় যেন একটা মানুষের সারাটাজীবন নির্ধারণ করে দেয়। ডাক্তার ইন্জিনিয়ার ব্যতিত অন্য কোনো কিছুতে কারো কোনো ক্যারিয়ার নেই। কি অসুস্থ একটা ট্রেন্ড।

#চলবে…..
(কার্টেসী ব্যতিত কপি করা নিষেধ।)

[বি:দ্র: আজকের পর্বটা অগোছালো লাগবে হয়তো। কারো কারো আজকের পর্ব পড়ে মনে হবে আমি সমাজে বাবা মা’দের বিরুদ্ধে নেগেটিভ চিন্তাভাবনা স্প্রেড করছি। কিন্তু সত্যিটা তো এটাই। আমাদের সমাজের ৮৫% বাবা মা’ই এক অসুস্থ প্রতিযোগিতায় মত্ত।
আর যাদের মনে হয় যে কোন মা তার সন্তানকে কখনো এতোটা কটুবাক্য ব্যবহার করে না তাদের উদ্দেশ্য বলছি। Congratulations, You are the most luckiest person in the world. এখনই গিয়ে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করে আসুন। কারণ আপনার চিন্তা ভাবনা এবং নজরের বাইরেও অনেক কিছু আছে। যা দেখলে আপনি হতভম্ব হয়ে যাবেন।

কিছু বিষয় আছে যা আস্তে আস্তে পরের পর্বগুলোতে ক্লিয়ার করা হবে। আপনাদের মতামত প্রকাশ করার আমন্ত্রণ রইলো। ভুলত্রুটিগুলো ধরিয়ে দিবেন। ধন্যবাদ। ☺️ ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here