#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#পর্ব_২৩
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)
বিষন্নতায় নিস্তেজ হয়ে আসা তরীর চোখ জোড়া আশার আলো দেখলো। টলমলে চোখ সতেজ হলো। মাহমুদ তপ্ত শ্বাস ফেলে চোখের পাতা বন্ধ করে ভরসার দৃষ্টিতে তাকালো।
আয়েশা সুলতানা সামনে ঘোর বি*প*দে*র আশঙ্কা করছেন। অন্যকিছুকে ভয় পান না তিনি। ভয় শুধু সম্মান নিয়ে। কেউ যেন তার, তার ছেলেমেয়েদের শিক্ষার উপর আঙ্গুল তুলতে না পারে। এসব তার অন্তরে সহ্য হবেনা। তিনি এবার খানিকটা নরম হলেন। দরজার দিকে আগত তরী আর মাহমুদকে থামিয়ে বললেন,
-“তোমরা যা করেছো, তাতে আমার যেমন খা*রা*প লাগছে! তেমন তরীর মা-বাবার ও খা*রা*প লাগবে। এটা স্বাভাবিক। কাউকে কথা দিয়ে কথা রাখতে না পারার মতো অসম্মান আর কিছুতে নেই। তরীর বাবা ভাইয়ের কাছে অসম্মানিত হয়ে আরও উত্তেজিত হয়ে পড়বেন। তরী বাবা-মা থেকে দূরে সরে যাবে।”
তরীর ভেতরটা অজানা ব্যথায় মোচড় দিয়ে উঠলো। বাবা-মা তাকে দূরে ঠে*লে দিলে সে সইতে পারবেনা। বাবা সত্যটা জানার পর তাকে মা*রু*ক, কা*টু*ক সে কিচ্ছুটি বলবেনা। তবে তাদের কাছ থেকে দূরে থাকতে পারবেনা। তার সবাইকে চাই। কেন সবার মতের এত অমিল? বাবা তার মতামত না নিয়ে চাচাকে কথা না দিলে কি খুব ক্ষ*তি হয়ে যেত? অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করে উঠলো তরী। মাথার ভেতর বড্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। শরীর আর এগোতে চাইছেনা। মাহমুদের হাত ছাড়িয়ে ধপ করেই নিচে বসে পড়লো। চমকে উঠে দ্রুত তরীকে ধরলো মাহমুদ। রামি আর আয়েশা সুলতানাও এগিয়ে এলেন। তরীকে ধরে বসিয়ে দিলেন। পানির গ্লাস মুখের সামনে ধরে বললেন
-“পানি খেয়ে নাও। ভালো লাগবে।”
ঢকঢক করে সবটা পানি গিলে নিলো তরী। গলাটা যেন শুকনো মরুভূমি হয়ে ছিল। মাহমুদের কপালে চিন্তার ভাঁজ। উৎকণ্ঠিত গলায় জিজ্ঞেস করলো,
-“বেশি খা*রা*প লাগছে, তরী?”
তরী এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়িয়ে জানালো সে ঠিক আছে। তেজহীন গলায় বলল,
-“আমি বাসায় যেতে চাই।”
ঘন্টাখানেক আগের হাসিহাসি মেয়েটা কেমন দুঃখের সাগরে হারিয়ে গেল। ক্ষণিকেই জীবন হয়ে উঠলো দুর্বিষহ। মাহমুদ উত্তেজিত হয়ে পড়লো।
-“তুমি আগে ঠিক হও। তারপর বাসায় যাবে।”
তরীর একরোখা শান্ত জবাব।
-“এক্ষুণি বাসায় যাবো আমি।”
আয়েশা সুলতানা বাঁধ সাধলেন।
-“তোমাকে ঠিক লাগছেনা। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নাও। তারপর বাসায় যেও।”
তরী মলিন ঠোঁটে হাসলো। চোখ জোড়া নিভু নিভু। ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
-“আমি ঠিক আছি। এখন বাসায় না গেলে দেরি হয়ে যাবে। সাধারণত ক্লাসের পর আমি বেশিক্ষণ বাইরে থাকিনা।”
এবার কন্ঠে জোর দিলেন আয়েশা সুলতানা।
-“আসার আগে এসব ভাবা উচিত ছিল। খেয়ে একটু আরাম করে তারপর যাবে। নয়তো মাহমুদ তোমায় দিয়ে আসবেনা।”
তরীর এই বিষন্নতার মাঝেও বড্ড হাসি পেল। তবে চেপে রাখলো সে হাসি। যেন সে ছোট্ট অরু। বাসায় না দিয়ে আসলে সে যেতে পারবেনা।
তরীকে রেখে দিলেন আয়েশা সুলতানা। খাবার খেয়ে একেবারে বের হলো। দালানের বাইরে বেরিয়ে মাহমুদ আলতো হাসলো। তার ঠোঁটের ওই নিটোল হাসি তরীকে একবুক প্রশান্তি এনে দেয়। বরাবরের মতো এবারও মুগ্ধ হলো সে। মাহমুদ কোমল স্বরে বলল,
-“দেখলে তো, মা কেমন গলে গেল। ঠিক এভাবেই তোমার বাবাকে মানিয়ে নেব।”
তরী বিদ্রুপ হেসে বলল,
-“এত সহজ না। বাবা কঠিন মানুষ।”
চোখে চোখ রাখলো মাহমুদ। অপলক তাকিয়ে রইলো শান্ত চোখে। প্রশ্ন ছুঁড়লো,
-“যদি গলাতে পারি? কী দেবে আমায়, তরী?”
তরীও একইভাবে জবাব দিল,
-“আপনি কী চান?”
মাহমুদ মৃদু হাসলো। চোখজোড়া ক্ষীণ করে বলল,
-“সেটা নাহয় সময়ই বলবে।”
তরী তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো। তবে কিছু বললো না। মাহমুদ তাকে নিয়ে সিএনজিতে চড়লো। তরীর হাত নিজের মুঠোয় তুলে নিলো। বৃদ্ধাঙ্গুল ছুঁইয়ে দিলো তরীর হাতের তালুতে। ভুরু কুঁচকে শুধালো,
-“মেয়েদের সবার হাতই কি এমন তুলতুলে থাকে? মিতুর হাতও যতবার ধরেছি, ততবারই এমন লেগেছে।”
তরীর চোখে প্রশ্নের মেলা। বুকের ভেতর অজানা আতঙ্কের ঢেউ। ভয় ভয় চোখে তাকিয়ে রোধ হয়ে আসা গলায় শুধালো,
-“মিতু কে?”
মাহমুদ নিঃশব্দে হাসলো। তরীর এই ভয়কাতুরে চেহারা তাকে বড্ড আনন্দ দিচ্ছে। মেয়েটা তাকে নিয়ে জেলাস ফিল করে। ব্যাপারটা তার ভালোলাগলো।
জবাব না পেয়ে তরীর ভেতরটা তড়পাচ্ছে। কোথা থেকে এক আকাশসম অভিমান এসে জড়ো হলো। মুখ ঘুরিয়ে চলন্ত গাড়ির বাইরে তাকালো। গালদুটোর ফোলা ভাব ক্রমশ বাড়ছে। মাহমুদ মিটিমিটি হাসলো। আর অভিমান বাড়তে দেওয়া যায়না। অনুরাগী স্বরে ডাকলো,
-“তরী!”
লাভ হলোনা, তাকালোনা তরী। বরং তার হাতের মুঠোয় থাকা নিজের চিকন হাত ছাড়িয়ে নিলো। মাহমুদ আরেকটু কোমল হল।
-“তাকাও না,তরী!”
এবারও তরীর অবস্থার পরিবর্তন হলোনা। অভিমানে চোখজোড়া পানিতে চিকচিক করছে। মাহমুদ জোর করে তার দিকে ফেরালো। গোলগাল মুখশ্রী আঁজলা করে দু-হাতের ভাঁজে তুলে ধরলো। যত্ন করে মুছে দিল ওই নোনাজল। মাহমুদ বলল,
-“আমার অভিমানিনী, এত অভিমান কেন কর? মিতু আমার বোন। তোমার জায়গা শুধুই তোমার।”
তরী নাক টা*ন*লো। অভিমানের বরফ গলে পড়লো। নিজের কাজে এবার ভীষণ লজ্জা হলো। তার চোখে অল্পতেই পানি এসে যায়। সে চাইলেও কিছুতেই আটকাতে পারেনা। চোখের দৃষ্টি এলোমেলো ভাবে ফেললো। মাহমুদ বুঝতে পেরে হাসলো। বলল,
-“তোমার রাগ, অভিমান, পাগলামি সব তো আমার জন্যই।”
তরীর নাক টে*নে দিয়ে সোজা হয়ে বসলো মাহমুদ। সামনের পথেই সে নেমে যাবে। সিএনজি তরীকে তাদের বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে আসবে। সামনেই নেমে পড়ে ভাড়া মিটিয়ে দিল মাহমুদ। তাকে পেছনে ফেলে সিএনজি এগিয়ে গেল। তরী মাথা বের করে পেছনে তাকিয়ে রইল। যতক্ষণ না মাহমুদ দৃষ্টি সীমানার বাইরে যায়। মাহমুদ অদূরে মিলিয়ে যেতেই তরী সামনে দৃষ্টি ফেরালো। স্মৃতি রোমন্থন করে হাসলো মেয়েটা। আগে মাহমুদকে দেখলেই পালিয়ে বেড়াতে চাইতো। আর এখন তার পরিবর্তন ঘটেছে। মন সারাক্ষণ মানুষটার কাছাকাছি থাকতে চায়।
বাসায় ফিরেই দেখলো মায়ের জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। তরী জামাকাপড় পাল্টে বাবাকে ফোন করলো। মিঠু বিকেলে খেলতে বেরিয়েছে, এখনো আসেনি। মা তরীকে বাঁধা দিলেন। দুর্বল গলায় বললেন,
-“আমি ঔষধ নিয়েছি। তুই এত অস্থির হবিনা।”
কয়েকদিন ধরেই জ্বর আসছে যাচ্ছে। তরীর মা কাউকেই জানায়নি। এখনও ভালোভাবে জ্বর এসেছে। প্রচন্ড ঠান্ডায় দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে। তরী দুটো কম্বল নামিয়ে মায়ের শরীরে দিল। তবুও কাঁপুনি কমছেনা। পাশে অরু মুখ ছোটো করে দাঁড়িয়ে আছে। তরী আর মায়ের বাঁধা মানলোনা। বাবাকে বারকয়েক কল দেওয়ার পর তিনি ব্যাক করলেন। তরীর চোখে পানি, গলা ধরে আসছে। রুদ্ধ কন্ঠে বলল,
-“বাবা, মায়ের প্রচন্ড জ্বর এসেছে। শরীর কাঁপছে। কাঁথা, দুটো কম্বলেও কাঁপুনি কমছেনা।”
তরীর বাবা চিন্তিত হলেন। বললেন,
-“একটু অপেক্ষা কর। আমি এক্ষুণি এসে হাসপাতালে নিয়ে যাবো।”
কান থেকে ফোন নামিয়ে মায়ের পাশে বসলো তরী। কপালে জলপট্টি দিচ্ছে। মিঠু হেলেদুলে বাসায় ফিরলো। স্বভাবসুলভ মা মা বলে কয়েকবার হাঁক ছাড়লো। মায়ের কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে মায়ের ঘরে আসলো। অরু ভীত চোখে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একপাশে। তরী আপু মায়ের কপালে জলপট্টি দিচ্ছে। মায়ের চোখমুখ ফ্যাকাশে, কেমন শুকনো হয়ে আছে। উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো মিঠু। জিজ্ঞেস করলো,
-“মায়ের কী হয়েছে আপু?”
তরী চোখমুখ অন্ধকার করে জবাব দিলো,
-“জ্বর এসেছে। কমছেই না।”
অরু দাঁড়ানো থেকে মায়ের পাশে খাটে উঠে বসলো। মায়ের শরীরের উপর উঠে দুহাতে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা দিয়ে নিস্তেজ হয়ে রইল। তরী আস্তে করে বলল,
-“নেমে পড়, অরু। মা ব্যথা পাবে।”
অরু নামলোনা। মাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো। যেন ছেড়ে দিলেই ফুড়ুৎ করে উড়ে যাবে।
বাবা এসেই মাকে নিয়ে গেলেন হাসপাতালে। বাসায় অরু আছে বিধায় তরীকে রেখে গেলেন। মিঠুকে মানানো গেল না। পাগল হয়ে ছুটে চললো মায়ের সাথে। সে যতই পাগলামি করুক। দিন শেষে মায়ের কাছে এসেই শেষ দম ফেলে। তরীর মুঠোফোনে মাহমুদের দেওয়া কল, মেসেজের ভীড়। সেদিকে খেয়াল রইলো না তার।
★★★
রাত্রি দশটা। রাস্তার মোড়ে দানবীয় ল্যাম্পপোস্ট গুলো হরিদ্রাভ আলো ছড়িয়েছে। যানবাহনের শব্দে মাথা টনটন করে উঠছে। মাথা ধরে সিটে হেলে রইলেন তরীর মা। জ্বর এখন অনেকটাই কমে গিয়েছে। তাই ডাক্তার দেখিয়ে ঔষধ নিয়ে বাড়ি ফিরছেন তারা। তরীর বাবা চিন্তিত গলায় শুধালেন,
-“খুব কি কষ্ট হচ্ছে, রুবিনা?”
তরীর মা মাথা দুলিয়ে মিইয়ে যাওয়া গলায় জানালেন,
-“একটু খা*রা*প লাগছে।”
তরীর বাবা একহাতে আগলে রাখলেন স্ত্রীকে। ড্রাইভারকে তাড়া দিলেন দ্রুত গাড়ি টা*ন*তে।
একরোখা স্বভাবের মানুষ হলেও তরীর বাবা স্ত্রী, সন্তানের অসুস্থতায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। দো*ষ একটাই, তিনি একরোখা। নিজের সিদ্ধান্তকেই সঠিক মনে করেন।
বাসার সামনে এসে একহাতে স্ত্রীর বাহু চেপে ধরলেন। অন্যহাত হাতের মুঠোয় নিলো মিঠু। চারতলা পর্যন্ত এসে বেল দেওয়ার পরপরই দরজা খুলে গেল। যেন তরী বাবা মায়ের অপেক্ষাতেই ছিল। মাকে ধরে ঘরে পৌঁছে দিল। অরুকে অনেক কষ্টে ঘুম পাড়িয়েছে।
খাবার শেষ করে ঘরে ঢুকেছে সবাই। তরী মাত্র ফোন হাতে নিতেই মাহমুদের অনেকগুলো কল, মেসেজ পেলো। সে কল ব্যাক করলো। মাহমুদ রিসিভ করেই চিন্তিত গলায় শুধালো,
-“বাসায় কোন সমস্যা হয়েছে, তরী? এতবার কল দিলাম, মেসেজ দিলাম, রিপ্লাই করলেনা?”
তরী লম্বা শ্বাস নিলো। মায়ের অসুস্থতার কথা জানালো। মাহমুদ কী বলল শোনা গেল না। বাবার ডাক পড়তে ‘পরে ফোন করছি’ বলে তরী তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে গেল।
#চলবে………….
(সারাদিন যেমন-তেমন তারাবী সময় আসলেই শ*য়*তা*ন ঘাড়ের উপর বসে নাচানাচি করে। শুধু ঘুম পায়। নামায শেষ, ঘুমও পালিয়ে যায়। এটা কি শুধু আমার সাথেই হচ্ছে? না-কি পাঠকদের সাথেও হচ্ছে?)