#তরঙ্গিনী পর্ব-৩১
#আরশিয়া_জান্নাত
রেবা চলুন ঘুরে আসি।
এখন?
হুম, রাতের ঢাকা শহর না দেখলে চরম মিস! ঝটপট রেডি হন,,
কিন্তু…..
কোনো কিন্তু না।
অগত্যা রেবা রেডি হয়ে আরাফের সঙ্গে বের হলো রাত্রিভ্রমণ করতে। যানজটপূর্ণ ব্যস্ততম শহরটায় রাত বেশ মায়াময়। স্ট্রিট লাইটের সোডিয়াম আলোয় ওরা এগিয়ে যায় গন্তব্যহীনভাবে। একটা জায়গায় এসে আরাফ বলে আসুন, রেবা চারদিক তাকিয়ে দেখে এখানে বেশ সমাগম আছে। দেখে বোঝার উপায় নেই রাত ১১টা বাজে!
আরাফ ওকে রাস্তার পাশে একটা টুলে বসিয়ে মালাই চা আনলো, চা খেতে খেতে বলল, এখানে অনেক মজার মজার আইটেম আছে ট্রায় করবেন?
সবে না ডিনার করলাম?
কি যে বলেন! এক ঘন্টায় মানুষের পেটের সব হজম হয়ে যায়। আচ্ছা দাঁড়ান আমিই দেখছি কি কি বেস্ট হবে, আরাফ বেছে বেছে কিছু আইটেম নিলো, মসালা ডোসা, চিকেন মোমো, ভেলপুরী। ঘুরে ঘুরে এই স্টিটফুডগুলো দু’জনে ভাগ করে টেস্ট করতে মজাই লাগছিল রেবার। মানুষদের হাসি আড্ডার শব্দে মুখোরিত রাস্তার ধার, ব্যস্ততার মাঝে একটুখানি ফুরসতে সবাই জিরিয়ে নিচ্ছে যেন। এ সবকিছুই চারপাশটাকে আরো বেশি মোহনীয় করে তুলল- রাতের শহর মায়ার শহর ঢাকাকে !
পার্কিং পর্যন্ত আরাফের হাত ধরে এই আধার আলো মেশানো রাতে একসঙ্গে হেঁটে চলা রেবার কাছে স্বর্গীয় মনে হতে থাকে।
আরাফ ওর দিকে তাকিয়ে বলল, কেমন লেগেছে?
অনেক সুন্দর আর শান্তিপূর্ণ। আমি তো আরো কয়েকবার আসতে চাইবো,,
আমার শহরের প্রেমে পড়লেন বুঝি?
আপনি কেন্দ্রীয় সবকিছুই এতো আবেদনপ্রিয়, প্রেমে না পড়ে উপায় আছে?
তাই বুঝি ম্যাম?
ইয়েস স্যার।
বেশ এখন থেকে সুযোগ পেলেই আসবো কেমন? চলুন তবে ফেরা যাক,,
আচ্ছা।
এই রেবা দাঁড়ান।
জ্বি?
ঐ দেখুন,,, আরাফ ইশারায় আকাশ দেখালো,
রেবা তাকিয়ে দেখলো আকাশভর্তি তারকারাজী ঝলমল করছে। চাঁদ না থাকায় তারাদের উজ্জ্বলতা চোখের পড়ার মতোই সুন্দর দেখাচ্ছে। তখনই একটা স্টার ফল করে, আরাফ চিৎকার করে বলে উঠে “আমার সঙ্গেই রেবা সুখী হোক,,,,,
রেবা খিলখিল করে হেসে উঠে, আপনিও না এতো বাচ্চামো করতে পারেন! এসব উইশ ট্রু হয় নাকি?
আরাফ মাথা চুলকে বলে, কিছু জিনিস থাকেই সত্যি হোক বা না হোক বিশ্বাস করতে ভালো লাগে।
হুম বুঝেছি, তবে আমার তো ভয় ছিল চেঁচিয়ে নাকি বলে উঠেন সপ্তর্ষীর জনক হই,,,
ঐটা বিয়ের আগ পর্যন্ত বহুবার উইশ করা হয়ে গেছে,,,
আপনি সিরিয়াসলি এমন বলতেন?
হুম। এর পেছনে একটা বিশ্বাস আছে আমার
কি সেটা?
আমরা যখন কোনোকিছু দোআ করি বা বলি আমাদের সাথে থাকা ফেরেশতারাও আমিন বলে। তাই আমি উইশ করতে কিপ্টেমি করিনা। সবসময় মুখে বলে ফেলি।
বাহ! দারুণ তো। আপনি অনেক কিউট আরাফ! কেমন আদুরে আদুরে চিন্তাভাবনা!
গাড়ির সামনে এসে আরাফ বলল, ওয়েট এ মিনিট।
রেবা কৌতুহলী হয়ে তাকিয়ে রইলো। আরাফ গাড়ি থেকে একটা রেড ভ্যালভেট কেক এনে রেবার সামনে দাঁড়িয়ে গাইতে লাগলো, হ্যাপি বার্থডে টু ইউ ডিয়ার রেবা,
আল্লাহ, আপনার মনে ছিল! এজন্যই বুঝি এতো আয়োজন?!
আমার ১০টা না ৫টা না ১টা মাত্র বৌ। তার জন্মদিনটা কত স্পেশাল আইডিয়া আছে? আজকের দিনে সে এই পৃথিবীতে আমার জন্যই তো এসেছিল- আমাকে পরিপূর্ণ করতে,,নিন কেকটা কাটুন।
রেবা কেকটা কেটে আরাফকে খাইয়ে দিলো।আরাফ ওকে খাইয়ে দিতে গিয়ে দেখে রেবার চোখ পানিতে টলমল করছে।
কি ব্যাপার কাঁদছেন কেন?
জানেন আমি লাস্ট যে বছর জন্মদিনে কেক কেটেছিলাম সেই কেকটা আব্বু এনেছিল। উনার পর আজ আপনি আনলেন,,,,
মন খারাপ করবেন না রেবা।
উহু মন খারাপ করছিনা তো।
আরাফ ওকে জড়িয়ে ধরে বলল, আল্লাহ আপনাকে সুখী করুন। আপনি নেক হায়াৎ লাভ করুন।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। এতো সুন্দর একটা রাত উপহার দেয়ার জন্য।
ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম।
🌸🌸🌸🌸
বাড়ির সবাই একে একে ড্রইং রুমে এসে ভুত দেখার মতো চমকে যাচ্ছে। এ কে এসেছে তাদের বাড়িতে?
রেবা সবাইকে এভাবে জমা হতে দেখে কৌতুহলে সামনে এগিয়ে সোফায় বসে থাকা ছেলেটার দিকে তাকালো। মাথায় চুল ঝুটি করে রেখেছে, মুখে ফ্রেঞ্চ কাট দাঁড়ি, রোদে পুড়ে গায়ের রং তামাটে হয়ে গেছে বোঝাই যাচ্ছে। ট্র্যাভেলিং ব্যাগ পাশে দেখে রেবা অনুমান করলো এ নিশ্চয়ই তার দেবর আরুশ! যদিও ছবির সাথে তার কোনোকিছুই মিলছেনা।
হেই ভাবি! কেমন আছ? চিনতে পেরেছ আমাকে? এটা আমাদের প্রথম সাক্ষাৎ তাই না?আচ্ছা তোমরা সবাই এমন চোখ গোলগোল করে চেয়ে আছ কেন বুঝলাম না। ঘরের ছেলে ফিরেছ কোথায় সবাই জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করবা তা না এমনভাবে দেখছ লাইক চিড়িয়াখানা থেকে একটা গরিলা পালিয়ে এসেছে তোমাদের বাড়ি!
ওর কথা শুনে মেজ চাচী ওর কান মলে দিয়ে বলল, ঘরের ছেলে বনে বেড়িয়ে বাঁদর বনতে পারে আর আমরা রিয়েক্ট করলেই দোষ? হ্যাঁ রে আরুশ এতো নিষ্ঠুর তুই একটাবার এসে দেখে গেলি না!
ওহো মেঝ আম্মু লাগছে খুব, তুমিও না! সবার সামনে বেইজ্জতি করে দিচ্ছ।
মুহতাসিম বলল- ভাইয়া তুই আমাদের সবাইক যে ঝাটকা টা দিয়েছিস না! আমার তো নিজের চোখকে বিশ্বাসই হচ্ছেনা
রুহি– এলিই যখন আর ক’টা দিন আগে আসতি। বড় আপু তোকে দেখতে কত হা হুতাশ করে গেল!
আরুশ– কি রে তুই এখনো এই বাড়িতে? বিদায় হসনি? আমি আরো ভাবলাম পেত্নি দুইটা বিদেয় হয়েছে এখন গিয়ে শান্তিতে ঘুরে আসি,,
রুহি– ছোট ভাইয়া!
আরুশ– ওরে এতো জোর তোর গলায় আমার কানের পর্দা ছিড়ে গেল।
সেজ চাচী– সারাদিন কি এখানেই কাটানোর ফন্দি আছে? ছেলেটাকে একটু ফ্রেশ হয়ে খেতে দিবি না? আরুশ বাবা যা তো ফ্রেশহয়ে আয়। আমরা তোর জন্য খাবার বাড়ছি।
আরুশ–বাবা-মা কি রুমে আছেন?
রুহি–হুম। যা ঐখানে গিয়ে নিজের প্রত্যাশা পূরণ কর। কান্নাকাটি দেখে যদি তোর মন গলে!
আরুশ চুপিচুপি দোতলায় নিজের মা-বাবার রুমে গেল।
রুহি বলল, এ বছর সব কত ভালো ভালো ঘটছে তাই না ভাবী? বড় আপু এসেছিল, ছোট ভাইয়াও এসেছে সামনে কারিয়ানও আসবে। আহা সব মিলে বছরটা একদম সোনায়সোহাগা।।
রেবা টিপ্পনী কেটে বলল, কারিয়ান ভাইয়া আসবে বলে সোনায়সোহাগা? এই চলছে ননদীনির মনে হুম?
ইশশ ভাবী তুমিও না।
আমিও না কি হুম? দেখছি তো যবে থেকে তাদের আসার ডেট ফিক্সড হয়েছে তুমি আর এই পৃথিবীতে নেই, উড়ে উড়ে মহাকাশে চলে গেছ!
রুহি লাল হয়ে বলল, তা না। আসলে,
হয়েছে ভাই আর অজুহাত দিও না। আমায় মিথ্যে বলতে হবেনা। তুমি যে ওর উপর লাড্ডু আমি ভালোই জানি।
এই ভাবী একটা সত্যি কথা বলবে?
কি?
আঙ্কেলদের পক্ষ থেকে কি গ্রিন সাইন দিয়েছে? আই মিন কারিয়ানের মত আছে কি না কিছু বলেছে?
গ্রিন সাইন না দিলে কি বাড়িতে বিয়ের তোড়জোর পড়তো?
এটা তো পারিবারিকভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে। আসল খবর কি?
কারিয়ানকে জিজ্ঞাসা করো?
সে তো আমায় পাত্তাই দেয় না ভাবী! আমিও বিয়ের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করতে পারছিনা পরে যদি ভাবে তাকে বিয়ে করার জন্য মুখিয়ে আছি?
সেটাও ঠিক!
ভাইয়াকে বলো না খোঁজ নিতে।
আচ্ছা বলবো।
থ্যাঙ্ক ইউ ভাবী।
ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম।
।
।
রেবা বেলকনীতে রাখা গাছগুলোতে পানি দিচ্ছিল আর আপনমনে তাদের সাথে গল্প করছিল। এমন সময় আরাফ এসে ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। রেবা হেসে বলল, আজ হঠাৎ এ সময়ে ফিরলেন?
আরুশ ফিরেছে খবরটা পেয়ে চলে এসেছি। ওর তো ভরসা নেই দেখা যাবে এসে টুকটাক কথা বলেই ফুড়ুৎ!
তাই নাকি? উনি সবসময় এমন করেন?
হুম। ওর ভাষ্যমতে হোমসিকনেস খুব খারাপ একটা রোগ। তাই ও মায়া বাড়ায় না। পিছুটান রাখেনা। পিছুটান রাখলে বিশ্বভ্রমণ অসম্ভব!
দার্শনিক চিন্তাভাবনা! আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞাসা করার ছিল,
করেন?
রুহির বিয়ের ব্যাপারে আর কি! শুনেছি কবির আঙ্কেল বাবার অনেক ক্লোজ ফ্রেন্ড, সেই সুবাদেই কারিয়ানের সঙ্গে রুহির বিয়ের আলাপচারিতা চলছে।
হ্যাঁ এটা একটা ওপেন সিক্রেট ব্যাপার। সরাসরি ফয়সালা এখনো না হলেও দুইপক্ষই এটা ভেবে রেখেছে।
কারিয়ানের মনোভাব কি এই বিষয়ে? জানেন কিছু?
কারিয়ান ছোট থেকেই বর্ণচোরা, তবে রুহির বিষয়ে ওর মনে কি চলছে খোলাসা না করলেও নিষেধও করেনি।
ওহ।
ডোন্ট ওরি! যা হবে ভালোই হবে।
চিন্তা না করে পারছিনা আসলে। রুহি খুব আগ্রহী হয়ে অপেক্ষা করছে, ওর চোখেমুখে আনন্দ ঠিকরে পড়ছে। আমি চাই না পরিবারের হাই এক্সপেক্টশনে ভাঁটা পড়ুক। কারিয়ানের মতামত জানাটা আবশ্যক।
আরাফ চিন্তিত মুখে বলল, ও কি রুহির সাথে কনট্যাক্ট করেনা?
না!
রুহি নক করে?
বলল তো করে,, বাট রেসপন্স পায়না। তাই তো আমায় বললো আপনাকে জিজ্ঞাসা করতে।
আরাফ বলল, আচ্ছা আমি দেখছি!
চলবে,,,,