সূর্যের_পারিজাত (পর্ব ৭)

#গল্প১৩৮

#সূর্যের_পারিজাত (পর্ব ৭)

১.
হুমায়ুন অবিশ্বাস নিয়ে মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে, একদিনে পাঁচ হাজারের বেশি লাইক পড়ে গেছে। এখনো মানুষ গল্পটা পড়ে যাচ্ছে। কী অবাক কান্ড! ফেসবুকের অনলাইন লেখালেখির গ্রুপ ‘বই পড়ি’ তে নিজের নামটার দিকে একটা ভালো লাগা নিয়ে তাকায়, হুমায়ুন আহমেদ। নিজেকে সত্যি সত্যি লেখক মনে হচ্ছে। এত সুন্দর সুন্দর মন্তব্য আসছে যে হুমায়ুন ঠিক কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। অনেকেই ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট পাঠিয়েছে। কিন্তু একটাই ভয়, কথা বললেই তো লোকজন বুঝে ফেলবে গল্পটা ওর লেখা না। ক’দিন আগে সেই অদ্ভুত কয়েদি, সূর্য নামের ছেলেটা যখন গল্প লিখতে চেয়েছিল ও অবাকই হয়েছিল। সেদিন কী মনে হতে সূর্যের লেখা গল্পটা পড়তে বসেছিল, কখন যে এক নিশ্বাসে গল্পটা পড়ে ফেলেছিল বুঝতেই পারেনি। কী মনে হতে লেখাটা চুপিচুপি কপি করে নিয়েছিল। বহুদিনের সুপ্ত একটা ইচ্ছে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল, লেখক হবার স্বপ্ন। তারপর এই অনলাইন গ্রুপে ভয়ে ভয়ে পোস্ট করে। পোস্টটা এপ্রুভ হবার পরেই দারুণ খুশি হয়েছিল, কিন্তু ভাবেনি এত মানুষ গল্পটা পছন্দ করবে। কিন্তু সমস্যা একটাই, এত এত মানুষ ইনবক্সে মেসেজ দিচ্ছে যে উত্তর দিতে খুব লোভ হচ্ছে, কিন্তু কথা বললে যদি বুঝে ফেলে যে ও আসল লেখক না?

এদিকে সূর্য হাতের কাজ শেষ করে ঠোঁট কামড়ে ভাবছিল গল্পটার পরের পর্ব লিখবে। পারিজাতের সাথে ওর পরিচয়ের প্রথম দিককার কথা, সব কেমন ছবির মতো মনে পড়ে যাচ্ছে। ভাবনার ঠিক এই সময়ে হুমায়ুন ভাইয়ের গলা পাওয়া যায়, ‘কী খবর, গল্পটার দ্বিতীয় পর্ব লিখবা না? তুমি তো দারুণ লিখো।’

সূর্য একটু থতমত খেয়ে যায়, অবাক গলায় বলে, ‘আপনি পড়েছেন?’

হুমায়ুন এবার নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, ‘হ্যাঁ, পড়ছিলাম তো। খুব সুন্দর লিখেছ। তুমি চিন্তা করো না আমি এটা যত্ন করে সেভ করে রাখব। লিখে ফেলো তাড়াতাড়ি।’

আসলে পাঠকরা তাড়া দিচ্ছে পরের পর্বের জন্য। এদিকে ও সূর্যকে তো এটার জন্য চাপাচাপিও করতে পারে না বেশি।

সূর্য মাথা নেড়ে বলে, ‘হ্যাঁ লিখে ফেলব।’

হুমায়ুন একটু ইতস্তত করে বলে, ‘আমাকে প্রতিদিন বাংলা টাইপিংটা একটু শিখিয়ে দিও তো, কিছু কিছু বানানে সমস্যা হয়।’

আসলে এখন ওকে টুকটাক কিছু হলেও মোবাইলে লিখতে হয়, গল্পটা দেবার সময় অন্তত পর্বের সংখ্যা, নিচে ওর নাম। এটুকু তো লিখতেই হয়।

সূর্য খুব অবাক হয়, বাংলা টাইপিংটা এই লোকের কাছে এলার্জির মতো ছিল। কী হলো আবার ওনার?

এর কিছুদিন পর যখন পরের পর্ব পোস্ট করে, মানুষজন যেন আরো বেশি হুমড়ি খেয়ে পড়ে গল্পটায়। বিশেষ করে গল্পের মূল নায়ক সূর্যের সাথে পারিজাতের রোমাঞ্চকর পরিচয়। এটা নিয়ে অনেকেই মন্তব্য করে। বিশেষ করে অনেক মেয়েই ইনবক্সে পরিচিত হতে চাচ্ছে, হুমায়ুনেরও খুব ইচ্ছে হচ্ছে কথা বলতে, পরিচিত হতে।

২.
পারিজাত এখন প্রতিদিন ‘বই পড়ি’ গ্রুপটা চেক করে, গল্পটার পরের পর্ব আসলো কিনা। সেই ঘটনার পর পারিজাত ‘মেঘলা আকাশ’ নামে নতুন একটা ফেসবুক আইডি খুলেছিল। অল্প কিছু মানুষ এতে ওর সাথে যোগ করা আছে, তার মধ্যে ধ্রুব একজন।

সেদিন ক্লাশের ফাঁকে নিজের চেয়ারে বসে পারিজাত সাপ্তাহিক কুইজ পরীক্ষার খাতা দেখছিল। এই কলেজে ছেলেদের পড়ার চাপটা বেশি, সপ্তাহে একটা করে কুইজ পরীক্ষা থাকেই। ছাত্রদের পাশাপাশি শিক্ষকদেরও তাই ব্যস্ত থাকতেই হয়। পারিজাতের তাতে কোনো সমস্যা নেই, ও ব্যস্ত থাকতেই পছন্দ করে।

মোবাইলে একটা নোটিফিকেশনের শব্দ হয়, পারিজাত ক্লান্ত চোখে একবার তাকায়, তারপর মোবাইলের স্ক্রিনটা আনলক করে। অনেকক্ষণ ধরে খাতা দেখছে একটু ব্রেক নেওয়া যাক। অনেকগুলো নোটিফিকেশন জমা হয়েছে। ফেসবুকটা খুলতেই ওর বুকটা ধক করে ওঠে, সেই লোকটা গল্প পোস্ট করেছে। পারিজাত কাঁপা হাতে দ্রুত ক্লিক করে পেজটাতে ঢোকে। পড়তে পড়তে নিশ্বাস ভারী হয়ে আসতে থাকে, কেউ যেন একটানে ওকে ক্যম্পাসের সেই সুন্দর দিনগুলোতে নিয়ে যায়। যখন ও প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াত, সবার সাথে মিশতে পারত। সূর্যের নরম আলোয় নিজেকে উষ্ণ রাখত, সেই সময়ে ও চলে যায়। গল্পটা শেষ করে ও শুন্য চোখে সামনে তাকিয়ে আছে, চোখের কোণে বিন্দুর মতো জল জমেছে। ওর আর কোনো সন্দেহই নেই এই লেখাটা ওর আর সূর্যকে নিয়েই লেখা। এই লোকটা কোনোভাবে হয়ত ওদের দু’জনের গল্পটা জানে। কিন্তু লোকটা কে?

এই যখন ভাবছে ঠিক তখন ধ্রুব নরম গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘কোনো সমস্যা পারিজাত?’

পারিজাত একটু চমকে তাকায়, তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, ‘নাহ, ঠিক আছে।’

ধ্রুব এই মেয়েটাকে কিছুতেই বুঝতে পারে না, এত সুন্দর একটা মেয়ে, এত ভালো সবকিছু কিন্তু বিয়ে করেনি বা ইচ্ছেও নেই। মাঝে মাঝেই উদাস চোখে তাকিয়ে থাকে, কই যেন হারিয়ে যায়।

ধ্রুব মাথা নেড়ে বলে, ‘কিচ্ছু ঠিক নেই, আমি স্পষ্ট আপনার চোখে একটা বিষাদ দেখেছি। আপনি খুব চাপা স্বভাবের মানুষ, নিজের কথা কাউকে কিছু বলেন না। একজনকে তো বলতে হয়। আমাকে বলতে পারেন, আমি শুনতে চাই।’

পারিজাত মুখটা গম্ভীর করে বলে, ‘বলার হলে আমিই বলব আপনাকে, ব্যস্ত হবার কারণ নেই।’

কথাটাতে রাগ হওয়া উচিত, কিন্তু ধ্রুব রাগে না। ও অন্তত এটুকু বুঝতে পারে মেয়েটার মনের কোথাও গভীর দুঃখ লুকিয়ে আছে। ছোট্ট করে একটা শ্বাস ফেলে বলে, ‘ঠিক আছে, আমি অপেক্ষায় থাকব।’

পারিজাত ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে, এই ছেলেটা কী চায় আসলে, ওকেই বা এমন ঘিরে রাখতে চায় কেন?

সেদিন ক্লাশ করে বের হতে যেতেই বিপত্তি, আকাশ মেঘলা হয়ে চারদিক অন্ধকার হয়ে আসে। পারিজাত উদবিঘ্ন হয়ে আকাশের দিকে তাকায়, যেন ওর ভাগ্যটার মতোই আজকের আকাশটা। বাড়ি যেতে হবে দ্রুত, কিন্তু এই আবহাওয়ায় বের হয় কী করে। এখনই বৃষ্টি নামবে। কী করবে এই যখন ভাবছিল ঠিক তখনই ধ্রুবর গলা পাওয়া যায়, ‘আকাশের যে অবস্থা, চলুন আপনাকে নামিয়ে দিয়ে আসি। যদিও আমার একটু ঘোরা হবে কিন্তু কলিগের জন্য এটুকু তো করতেই পারি, নাকি? আপনি আবার ঘাড় গুঁজে মুখ গুঁজে না করবেন না যেন।’

পারিজাত ওর কথা ভঙ্গিমায় হেসে ফেলে, ‘আপনার সাথে পারা মুশকিল। আসলেই অনেক উপকার হয়, মা খুব চিন্তা করবে।’

এটা ঠিক, সেই ঘটনার পর বাবা মা প্রতিদিন বাসায় ফিরে না আসা পর্যন্ত খুব চিন্তায় থাকেন। আজ বাসার গাড়িটা ইচ্ছে করেই আনেনি। বাবার গাড়িতে আর কতদিন চড়বে, নিজেকে ও প্রস্তুত করছে একটু একটু করে, ভবিষ্যতের জন্য।

পুরোটা পথে খুব একটা কথা হয় না, ধ্রুব নিজে থেকেই চুপ থাকে। হালকা করে নিয়াজ মুহাম্মদের গান বাজছে, ‘আজ এই বৃষ্টির কান্না দেখে মনে পড়ল তোমায়, অশ্রু ভরা দুটি চোখ, তুমি ব্যাথার কাজল মেখে লুখিয়েছিলে ওই মুখ।’

পারিজাতের মনটা আবার খারাপ হতে শুরু করে। আজ সবাই মিলে ওর সাথে যেন শত্রুতা শুরু করেছে, ওর মনটা খারাপ করেই ছাড়বে।

বাসায় যখন পৌঁছে তখন বৃষ্টিটা ধরে এসেছে। বাড়ির সামনে বাগান বিলাস গাছটা এই ঝড়ো বাতাসে নুয়ে পড়ে আছে। ঠিক যেমন পারিজাতের জীবনটা এক আচমকা ঝড়ে নুয়ে পড়েছে, উঠে দাঁড়াবার আর শক্তি নেই।

নামতে গিয়ে ও ধ্রুবকে ভদ্রতার খাতিরে একবার বলে, ‘বাসায় আসুন, চা খেয়ে যাবেন।’

ধ্রুব হেসে মাথা নাড়ে, বলে, ‘থাক, পরে আবার আপনি মনে মনে বলবেন যে একটু লিফট দিয়েছি আর ওমনি বাসায় চায়ের দাওয়াত নিচ্ছি। তার চেয়ে এই ভালো আমি সামনে কোনো কফিশপে চা মানে কফি খেয়ে নেব।’

এবার পারিজাত হেসে ফেলে, মন থেকেই বলে, ‘আসুন। মা খুব খুশি হবে আপনাকে দেখলে। ওনার দুশ্চিন্তাটা কিছু কমবে আমাকে নিয়ে।’

ধ্রুব এরপর আর না করে না। গাড়িটা পার্কিং গিয়ারে দিয়ে নেমে পড়ে। পারিজাতদের এই বাসাটা খুব সুন্দর, বেশ সাজানো গোছানো। ভেতরে ঢুকতেই ও পেছন ফিরে বলে, ‘আপনি বসুন আমি মাকে ডাকছি। আর আপনি চা না কফিই খাবেন?’

ধ্রুব গম্ভীরমুখে বলে, ‘আজ চা খাই, কফিটা আরেকদিনের জন্য উঠিয়ে রাখলাম। এই ছুতোয় আবার না হয় আসা যাবে একদিন।’

পারিজাত হাসে, যাবার সময় বলে, ‘আপনি যেকোনো দিন আসতে পারেন, তাতে কেউ আটকাবে না।’

পারিজাতের মা নিলুফার খুব খুশি হন ধ্রুবকে দেখে। যাক মেয়েটা এতদিনে একটু স্বাভাবিক হচ্ছে। এই বয়সে ওর অন্তত বিয়ে হয়ে যাবার কথা ছিল। অথচ কী হয়ে গেল!

ধ্রুব আন্টির সাথে অনেক গল্প করে, নিজের কথা, কলেজে পারিজাত কী যে সিরিয়াস মানুষ সেটাও বলে। সারাক্ষণ কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে পারিজাত, মোটেই গাল গল্পে সময় কাটায় না। নিলুফার মনে মনে ভাবেন, এমনটাই তো করার কথা। কিন্তু এই ছেলেটা মনে হয় পারিজাতকে পছন্দ করে। এর সম্পর্কে খোঁজ খবর নিতে হবে ভালো করে।

আরো কিছুক্ষণ গল্প চলে। একটা সময় ধ্রুব যখন বিদায় নেয় তখন বৃষ্টি থেমে গেছে, বাইরে তখন একটা মন খারাপ করা সন্ধ্যা। পারিজাত নিজের রুমে এসে প্রথমেই সেই হুমায়ুন আহমেদ নামের লোকটার প্রোফাইলে যায়। প্রোফাইল লক। একটু ভেবে লোকটাকে ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট পাঠায়। সাথে একটা মেসেজও, ‘আপনি এত সুন্দর লিখেন, আপনার সাথে একদিন কফি খেতে চাই।’

এই লোকটা সম্পর্কে একটু সাবধান থাকতে হবে, ভাবে পারিজাত। ওদের দু’জনের গল্প জানে এমন কেউ যাকে ও চেনে না। লোকটা ভালো কিনা মন্দ এখনো জানা নেই। তবে যে এমন সুন্দর করে লিখে সে ভালো হবেই।

৩.
হুমায়ুন মনোযোগ দিয়ে একটা প্রোফাইলে ছবি দেখছে। কী সুন্দর মেয়েটা, একদম নাটকের নায়িকাদের মতো, স্নিগ্ধ। নামটাও বেশ কাব্যিক, ‘মেঘলা আকাশ’। যদিও বানানো নাম, কিন্তু খুব ভালো লাগে শুনতে। হুমায়ুন মেয়েটার প্রোফাইল পুরোটা দেখে, কয়েকটা ছবি আর কিছু কবিতা আছে। আর তেমন কিছু নেই, কোথায় থাকে বা কী করে, কিছুই নেই। মেয়েটা কাল রাতে মেসেজ করেছিল, ওর গল্প পড়ে মুগ্ধ, কফি খেতে চায়। হুমায়ুন জীবনেও ভাবেনি এমন সুন্দর একটা মেয়ে ওকে মেসেজ দেবে আবার কফিও খেতে চাবে। খুব ইচ্ছে করছে যেতে কিন্তু যদি সব বুঝে ফেলে? সাহিত্য নিয়ে যদি কথা বলে তাহলেই তো ও ফেঁসে যাবে। কী যে এক যন্ত্রণা! নাহ, যা থাকে কপালে, শেষ পর্যন্ত ও সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেলে, দেখা করবে। তার আগে বিখ্যাত কিছু লেখকের নাম আর তাদের বিখ্যাত গল্পগুলোর বিষয়বস্তু পড়ে ফেলতে হবে।

৪.
পারিজাত ভাবেনি লোকটা উত্তর দেবে। ওর মেসেজ দেবার ঠিক চৌদ্দ দিন বাদে উত্তর আসল, হ্যাঁ, দেখা করবে। ও ভেবেছিল লোকটা বুঝি আর উত্তরই দেবে না, যাক একটা দারুণ স্বস্তি। পারিজাত এবার একটা কফি শপের নাম বলতেই ওপাশ থেকে লোকটা জায়গাটার ঠিকানা জানতে চায়। আর সেইসাথে বলে যেকোনো শুক্রবার ও দেখা করতে পারবে।

পারিজাত এবার ভালো করে কফি শপটার ঠিকানা বুঝিয়ে দেয়, সাথে তারিখ আর সময়টাও জানিয়ে দেয়। বুকটা কেমন ঢিপঢিপ করছে পারিজাতের। কার মুখোমুখি যে হতে যাচ্ছে ও নিজেই জানে না, শুধু এতটুকু জানে ও সূর্যের কাছাকাছি কোথাও পৌঁছাতে যাচ্ছে।

(চলবে)

মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর
২৫/০২/২০২২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here