সূর্যের_পারিজাত (পর্ব ৫)

#গল্প১৩৮

#সূর্যের_পারিজাত (পর্ব ৫)

১.
সূর্যের আজ কেসটেবিলে লেখালেখির দায়িত্ব পড়েছে। ‘আমদানি সেল’ থেকে বন্দিদের এই কেস টেবিলে পাঠানো হয়। নতুন বন্দিরা প্রথম দিন যে সেলে থাকে তাকে আমদানি সেল বলে। পরদিন এই কেসটেবিলে তাদের নাম, ঠিকানা, কেসের বিবরণসহ প্রয়োজনীয় তথ্য নথিভুক্ত হবার পর বিভিন্ন ওয়ার্ডে চালান করা হয়। এই কাজটায় প্রায়ই টাকার লেনদেন হয়। সূর্য এটা জানে, তাই প্রথম থেকেই এখানে কাজটা দারুণ অস্বস্তির ওর জন্য। তার চেয়ে জমশের চাচা, জাহাঙ্গীর ভাইয়ের সাথে ক্ষেতের কাজটা অনেক ভালো ছিল। অবশ্য একটা সুবিধা যে শারীরিক পরিশ্রমটা কম আর খবরদারিটাও। সূর্য এখানে এসে জেনেছে নানান ধরনের রাইটার আছে, কেউ কলিং রাইটার। এদের কাজ হলো জামিনপ্রাপ্ত বন্দিদের ডেকে দেওয়া অথবা কেউ দেখা করতে আসলে তখন ডেকে দেওয়া। আবার কিছু আছে মেডিকেল রাইটার, এরা কারাগারের ডাক্তারদের সাহায্য করে।

বহুদিন পর কাগজ কলম পেয়ে ওর অবশ্য লিখতে ভালোই লাগছে। আহা, কতদিন কবিতা লিখে না, গল্প লিখে না। পারিজাতের খুব ইচ্ছে ছিল ওর লেখাগুলো নিয়ে বইমেলায় একটা বই বের করবে। ভাবতেই একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে।

কেসটেবিলের কাজ যখন শেষের দিকে ঠিক তখন একজন খাটো মতো গোলগাল চেহারার লোককে উদভ্রান্তের মতো জিজ্ঞেস করতে শোনে, ‘এই, তোমাদের মধ্যে কেউ বাংলা টাইপ পারে?’

কেসটেবিলে যারা লিখছিল তারা মাথা নাড়ে। পাশ থেকে কেসটেবিলের দায়িত্বে থাকা সাহালম বলে, ‘কী হইছে হুমায়ুন ভাই?’

লোকটাকে এবার হতাশ দেখায়, ক্ষোভের সাথে বলে, ‘আর বলো না, আজকেই আমাদের কম্পিউটার অপারেটর আনোয়ার ভাই ছুটিতে, আর জেলার স্যার এদিকে একটা বাংলা চিঠি টাইপ করতে দিছে। আমি তো ভালো পারি না, কী যে হবে।’

সূর্য বাংলা টাইপ ভালোই পারে, গল্প লেখার সময় অভ্যাসটা রপ্ত হয়েছিল। বলবে কী বলবে না ভাবতেই ও হাত তুলে, নীচু গলায় বলে, ‘আমি পারি।’

হুমায়ুন নামের লোকটা এবার ঘুরে তাকায়, মুখে একটু বিস্ময়, বলে, ‘তুমি সত্যিই পারো? তাহলে একটু আসো তো আমার সাথে।’

সূর্য একবার সাহালমের দিকে তাকায়, উনি ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিতেই ও হুমায়ুনের পিছে পিছে যায়। জায়গাটা একটা অফিস মতো, দুটো কম্পিউটার আছে। হুমায়ুন নামের লোকটা একটা বাংলায় লেখা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলে, ‘এইটা টাইপ করতে হবে, পারবা তো?’

সূর্য মাথা নেড়ে কাগজটা হাতে নেয়, একটা অফিস আদেশের চিঠি। ওয়ার্ড ফাইলটা খুলে বাংলা ফন্ট সিলেক্ট করে, তারপর মনোযোগ দিয়ে লেখা শুরু করে। প্রথম দিকে বার বার ভুল হয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু কয়েক লাইন লিখতেই হাতটা চালু হয়ে যায়। লেখাটা শেষ করে একবার প্রুফ দেখে কয়েকটা বানান ঠিক করে নেয়। তারপর পুরোটা আরেকবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে সন্তুষ্ট হয়, এরপর প্রিন্ট দিয়ে কাগজটা হুমায়ুন নামের লোকটার হাতে দেয়।

হুমায়ুন কাগজটা হাতে নিয়ে তাজ্জব হয়ে তাকিয়ে থাকে, এই ছেলে তো কাজের আছে। এত অল্প সময়ে এত বড় লেখাটা কী সুন্দর নির্ভুল টাইপ করে ফেলেছে। ওর তো এক লাইন লিখতেই খবর হয়ে যাচ্ছিল। কেন জানি বাংলা টাইপটা ওর আসে না ঠিকঠাক। নাহ, এবার শিখেই নিতে হবে। হুমায়ুন মনের খুশি ভাবটা ওকে বুঝতে না দিয়ে গম্ভীরমুখে বলে, ‘তুমি এখানে দাঁড়াও, আমি স্যারকে লেখাটা দিয়ে আসি। কোনো কারেকশন থাকলে আবার লিখতে হবে।’

হুমায়ুন চলে যেতেই সূর্য পুরো রুমটা দেখে। সিলিংগুলো অনেক উঁচু করে বানানো। কয়েকজন ঘাড় গুঁজে ফাইল লেখালেখির কাজ করছে। এখানে কাজ করতে পারলে ভালো হতো। এই যখন ভাবছে তখন ও পিঠে একটা হাতের স্পর্শ পায়, ঘুরে দেখে হুমায়ুন। এবার লোকটার মুখে হাসি দেখা যায়, বলে, ‘একদম নিখুঁত কাজ করেছ, স্যার খুব খুশি হয়েছে। তুমি কম্পিউটারের অন্যান্য কাজ পারো? এই যেমন এক্সেলের কাজ?’

সূর্য মাথা নাড়ে, বলে, ‘পারি তো।’

হুমায়ুন কী যেনো ভাবে, তারপর বলে, ‘তোমার কথা আমি স্যাররে বলব যাতে কম্পিউটারের কাজটা তুমি পাও। ওই কেসটেবিলের কাজ তোমার জন্য না।’

সূর্য মনে মনে দারুণ খুশি হয়, এই কাজটাই ও চাচ্ছিল মনে মনে। সেদিন ওর ওয়ার্ডে ফিরে জমশের চাচাকে কথাটা বলতেই আনন্দে জড়িয়ে ধরেন, বলেন, ‘এখন একবার ঠিক জায়গায় কাম পাইছ। জেলার স্যারের একবার নজরে পড়লে তোমার আর চিন্তা নাই।’

সূর্য অবশ্য অন্য কথা ভাবে, আজ কম্পিউটারে টাইপ করতে গিয়ে যখন বার বার ভুল হচ্ছিল তখন একটা কথা মনে হলো, আচ্ছা, এভাবে ও দিনে দিনে ওর শেখা জিনিসগুলো ভুলে যাবে? পনের বছর পর ও যখন বের হবে তখন ওর যে লেখার ক্ষমতা ছিল সেটাও ভুলে যাবে? ভাবতেই গা শিউরে ওঠে।

রাতে ঘুমোতে যাবার সময় হঠাৎ ওর মনে হয়, যদি কম্পিউটার সেকশনে কাজটা পায় তাহলে লেখার অভ্যাসটা আবার শুরু করবে। এতগুলো বছর এখানে পশুর মতো কোনো উদ্দেশ্য ছাড়া বাঁচার কোনো মানে হয় না। ও লিখবে, জীবনের গল্প, ভালোবাসার গল্প, হারানোর গল্প। অন্তত পারিজাত তো জেনে খুশি হবে যে ও জেলে বসে থাকেনি, সৃজনশীল কাজটা করে গেছে। পারিজাত খুব পছন্দ করত এই গুণটা। কিন্তু পারিজাত কী ওর জন্য অপেক্ষা করবে? এই এতটা বছর?

২.
ঢাকার মধ্যে এত সুন্দর ক্যাম্পাসওয়ালা কলেজ আছে তা পারিজাত জানতই না। এটা মূলত শুধুমাত্র ছেলেদের জন্য। পারিজাত মূল ফটক দিয়ে ভেতরে ঢোকার পর সবুজ ঘেরা খোলা জায়গাটুকু পার হয়ে মূল দালানটার সামনে এসে দাঁড়ায়। দ্বিধান্বিত চোখে এদিক ওদিক তাকায়, কলেজের অফিস রুমটা যে কোন দিকে। ও যখন এমন ইতঃস্তত করছিল ঠিক তখন একটা ভরাট গলা শোনা যায়, ‘কোথায় যাবেন আপনি?’

পারিজাত পেছন ফিরে তাকায়, একহারা গড়নের লম্বা একটা লোক, নাকি ছেলে বলবে? মাথায় ঝাকড়া চুল, পরনে জিন্সের প্যান্টের সাথে একটা সাদা শর্ট পাঞ্জাবি, চোখে মানানসই ফ্রেমের একটা চশমা। পারিজাত নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, ‘প্রিন্সিপাল স্যারের রুম কোনটা?’

লোকটা হেসে বলে, ‘আমার পিছু পিছু আসুন, ঠিক পৌঁছে যাবেন।’

লোকটা বেশ নাটকীয়ভাবে কথা বলে, এমন পছন্দ না পারিজাতের। ও মাথা নেড়ে পেছেনে হাঁটতে হাঁটতে একটা বড় রুমের সামনে পৌঁছাতেই লোকটা ওর দিকে ফিরে বলে, ‘এই যে, ড. নাহিদ কামাল মানে প্রিন্সিপাল স্যারের রুম। উনি ভেতরেই আছেন।’

পারিজাত এবার একটু হেসে বলে, ‘ধন্যবাদ আপনাকে।’

তারপর দরজায় টোকা দিতেই ভেতর থেকে কেউ বলেন, ‘ভেতরে চলে আসুন।’

পারিজাতের বুক ঢিপঢিপ করছে, যেদিন প্রথম এই কলেজে ইংরেজি শিক্ষকের পদে ইন্টারভিউ দিতে আসে তখনই ও বুঝেছিল এই মানুষটা অনেক জ্ঞানী। ইন্টারভিউটা খুব ভালো হয়েছিল, কিন্তু ভাবেনি এমন একটা নামকরা কলেজে চাকরিটা হয়ে যাবে। ভেতরে ঢুকতেই সেই কাঁচাপাকা চুলের সৌম্য দর্শন মানুষটাকে দেখেই মনটা ভালো হয়ে যায়। প্রিন্সিপাল স্যার একটা অমায়িক হাসি দিয়ে বলেন, ‘কী ইয়াং লেডি, তাহলে মনস্থির করেই ফেললে যে এখানেই চাকরি করবে?’

পারিজাত যেন একটু লজ্জাই পায়। আসলে ওর রেজাল্ট এত ভালো ছিল যে ওনারা ভেবেছিলেন ও সুযোগ পেলেই একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে জয়েন করবে। পারিজাতও তাই ভেবেছিল মনে মনে, কিন্তু একটা দিক চিন্তা করে ও সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছে।

পারিজাত লাজুক হেসে বলে, ‘স্যার, আমি থাকব এই প্রতিষ্ঠানে, এর সুনাম যাতে বাড়ে তার আন্তরিক চেষ্টাটা থাকবে সবসময়।’

ওর কথায় খুব খুশি হন প্রিন্সিপাল স্যার, উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘চলো, তোমার ডিপার্টমেন্টের সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেই।’

প্রিন্সিপাল স্যার ওকে নিয়ে একটু হেঁটে সামনের দিকে যেতেই একটা কমন রুম পড়ে। ভেতরে অনেক মানুষজন। এরা সবাই শিক্ষক এটা বুঝতে পারে। একে একে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়, ইংরেজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, সাথে আরো অনেকে। এর মাঝে সকালের সেই লোকটাও আছে, আর সেও ইংরেজি বিভাগেরই সহকারী শিক্ষক, নাম ইশতিয়াক আহমেদ ধ্রুব। লোকটা ওর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসছে, পারিজাতের ভ্রুটা কুঁচকে ওঠে।

প্রিন্সিপাল স্যার চলে যেতেই ও সবার সাথে নিজে থেকেই এবার পরিচয় হয়। অধ্যাপক কবীর চৌধুরী ওকে স্বাগত জানায়। ধ্রুবকে ইশারা করে ওকে পুরো ক্যাম্পাসটা ঘুরিয়ে দেখিয়ে আনতে বলেন।

ধ্রুব মাথা নেড়ে পারিজাতকে নিয়ে বের হয়, তারপর বেশ উৎসাহ নিয়ে প্রথমে পুরো কলেজটা ঘুরিয়ে দেখায়, ক্যান্টিন, প্রেয়ার রুম, ক্লাব, খেলার মাঠ, ক্লাশ রুমগুলো, অফিস। পারিজাতের মনটা সত্যিই ভালো হয়ে যায়, কী সুন্দর সাজানো গোছানো। আর এই ধ্রুব লোকটাকেও এখন ভালোই মনে হচ্ছে।

ফেরার সময় ধ্রুব বলে, ‘আপনার নাম পারিজাত?’

ও মাথা নেড়ে সম্মতি দিতেই ধ্রুব নাটকীয় গলায় বলে, ‘সেই স্বর্গীয় ফুল, পারিজাত। জানেন তো এর গল্পটা?’

হুট করেই পারিজাতের নীল আকাশের মতো মনটায় একটা মেঘলা আকাশ ঢুকে পড়ে। সূর্যও প্রথম দিন এই পারিজাত ফুলের গল্পটা বলেছিল, সেটা নিয়েই তর্ক, সেখান থেকে আরো কাছে আসা।

পারিজাত মুখটা গম্ভীর করে বলে, ‘হ্যাঁ, সে গল্পটা অনেক আগেই জানা।’

ধ্রুব ভেবে পায় না, হাসিখুশি মেয়েটা এমন হঠাৎ করেই গম্ভীর হয়ে গেল কেন?

৩.
মেহেরুন্নেসার মনটা আজ একটু ভালো। শেষ পর্যন্ত অনেক ছুটোছুটি করে উচ্চ আদালতে আপিল করতে পেরেছিলেন। আজ একটা হিয়ারিং ছিল, ব্যারিস্টার তৌফিক এলাহী বেশ শক্তপোক্ত ভাবেই কেস উপস্থাপন করেছেন। হিয়ারিং শেষে উনি একটু হলেও আশ্বাস দিয়েছেন হয়তো সূর্যের শাস্তির মেয়াদ কিছুটা হলেও কমাতে পারবেন।

এই শহরে আর তার পাশের শহরে আজ তিনজন মানুষের নতুন আশা নিয়ে জীবন শুরু হলো। সূর্য লেখালেখির কথা ভাবছে যাতে অন্তত বেঁচে থাকার একটা মানে খুঁজে পায়, পারিজাত যেন খুশি হয়। আর এদিকে পারিজাতের কর্মজীবন শুরু, তারও নিজস্ব একটা পরিকল্পনা আছে সূর্যকে নিয়ে। এবং মেহেরুন্নেসা, সূর্যের জনম দুখিনী মা, নতুন আশায় বুক বাঁধেন, ছেলের সাজার মেয়াদ কমবে, ছেলে তার বুকে ফিরে আসবে।

(চলবে)

মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর
২২/০২/২০২২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here