‘মনসায়রী’
১৭.
মনের মধ্যে এক সমুদ্র উত্তাল ঢেউ আছড়ে পড়লো যেনো। সামনে ফিরে দ্রুত পায়ে রোবটের মতো হাঁটতে হাঁটতে নিজের রুমে গেলো দুপুর। ঘরের দরজা আঁটকে ধপ করে বিছানায় বসলো। কপালের অর্ধাংশ ঘেমে একাকার। বুকের ঢিপঢিপ শব্দটা নিজেই শুনতে পাচ্ছে দুপুর। সায়র যখন কানের কাছে ফিসফিস করে কথা বলছিলো তা এক কান দিয়ে ঢুকে আরেক কান দিয়ে বেরিয়ে গেছে। দুপুর শুধু জানে, সেসময়টা অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছিলো। সায়রের কালো গভীরতর চোখে মুগ্ধতা খুঁজে পাচ্ছিলো সে৷ মনে একটা অজানা প্রজাতির জন্ম হচ্ছিল।ঠিক একই অনুভূতি দুপুরের আজ থেকে নয় বছর আগে হয়েছিলো। যার নিভু নিভু রেশ বুকে এখনো বিদ্যমান। ভালো লাগছেনা আর। দুপুর অসহ্য রকমের অনুভূতিতে বিদ্ধ হয়ে ওয়াশরুমে গেলো। জামা বদলে চোখেমুখে পানি ছিটালো। কী আশ্চর্য! চোখে ঘোলা হয়ে আসছে বারবার। শরীর গরম হয়ে আসছে। বিছানায় গিয়ে সটান হয়ে শুয়ে পড়লো দুপুর। চোখের পাতা কাঁপছে। শক্ত করে চোখ বুজতেই নোনাজল গড়িয়ে পড়লো। ঠোঁট চেপে কান্না দমিয়ে রেখেছে দুপুর। শরীরটা আপাতদৃষ্টিতে কক্সবাজারের একটা আলিশান হোটেলে পড়ে আছে ঠিকই, কিন্তু দুপুরের মন ছুটে গেছে অতীতের একটা পাতায়। আজ থেকে ঠিক নয় বছর আগে। টাইমমেশিনের মতো যেনো পেছনে চলে গেলো দুপুর। রুমের সানসেটের উপর বসে পা দুলিয়ে আচার খাচ্ছে তখন। বয়সে সে ষোলো বছরের কিশোরী মেয়ে। চোখে মুখে দারুণ চঞ্চলতা। দুটো সরু খসখসে বেণী। মায়ের চিৎকারে ভাবলেশহীন ভাবে উঁকি দিয়ে দেখে নিলো দুপুর। সে জানে এটা তার সেফজোন। এখানে মায়ের মার খাওয়ার অন্তত ভয় নেই। মিরা বেগম গলা ফাটানো চিৎকার করে এদিকে আসতে লাগলেন।
‘এই ফাজি’ল মেয়ে, কোথায় গেলি! আর কতো জ্বালিয়ে মারবি আমাকে! এতো বড় হয়েও ড্যাং ড্যাং করে বনবাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়! থাপ’ড়ে দাঁত না ভেঙেছি আজ!’
শুকনো ঢোক গিলে খাওয়ায় মন দিলো দুপুর। খট করে একটা আওয়াজে চমকে উঠলো। সাদা একটা টাওয়াল গলায় ঝুলানো অবস্থায় বেরিয়ে আসলো শিপু৷ তখনও দুপুরকে খেয়াল করেনি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গুনগুনিয়ে গান গাইতে গাইতে চুল মুছে নিচ্ছিলো। দুপুর বেসুরো গলার গান শুনে খিলখিল করে হেসে উঠলো। আচমকা ভয় পেয়ে শিপু আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো কার হাসির আওয়াজ। কাউকে না দেখে এরপর উপরে তাকিয়ে দেখলো দুপুর শব্দ করে হাসছে। শিপু কোমরে হাত দিয়ে চোখ গরম করে তাকালো। দুপুর নিজের মুখ জোরপূর্বক চেপে রাখলেও হাসি থামাতে পারলো না। শিপু খাটের উপর উঠে দুপুরের পা ধরে টান দিতেই শুকনো গড়নের দুপুর ঠাস করে খাটের উপর পড়লো। পড়ে গিয়েও সে পেট চেপে হাসছে। শিপু রাগী কন্ঠে বলল,
‘এতো হাসি কোথা থেকে আসে হ্যা! এই দুপি, নিশ্চয়ই কোনো কান্ড ঘটিয়েছিস আবার তাইনা?’
হাসি মুখ চুপসে গেলো দুপুরের। মুখটা কাচুমাচু করে উঠে বসে বলল,
‘পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে গো শিপুদা!’
শিপু ভ্রু কুচকে বলল,
‘পাশ করেছিস? নাকি এবারো ডাব্বা? ‘
আমতা আমতা করে দুপুর বলল,
‘বিশ্বাস করো, মাত্র এক নম্বরের জন্য পাশ করতে পারলাম না। খাটা’শ রনি স্যারের জন্য এসব হলো। ‘
‘মে’রে একদম হাড়গোড় ভে’ঙ্গে দিবো তোর। একে তো ফেল করেছিস, আবার মুখে স্যারের নামে বা’জে কথা বলিস! ‘
দুপুর জিহবা কাটলো। কেনো যে মুখ ফসকে বারবার গালি বের হয়ে যায়! মুখটা বড়ই লাগামহীন। মনে পড়লো, এখন যদি শিপুদাও এমন করে তাহলে মায়ের বকুনির সাথে ঝাঁটার বাড়িও জুটবে। তা মোটেও খেতে চায়না সে। পাক্কা অভিনেত্রীর মতো চোখ ছলছল করে মলিন মুখ করে বসে দুপুর বলল,
‘শিপুদা, মা খুব রেগে আছে। বাঁচিয়ে দাও না গো!’
শিপু জানে দুপুরের নাটকবাজী। প্রতিবার এমন মা’র খাওয়ার কাজ করে শিপুর পিছনে ঘুরঘুর করে। কখনো শিপুর মাথা টিপে দেয় আবার এসে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে মন ভুলিয়ে বেঁচে যায় সে। শিপু ঠিক করলো আজকে ছোটমা আসলে, নিজেই এটাকে তুলে দিবে। একদিন মা’ইর খেলে বুঝবে মজা। শয়তানি বুদ্ধি বেরিয়ে যাবে সব। মিরা বেগম তখনই রুমে আসলেন। দুপুরকে বিছানায় বসে থাকতে দেখে বললেন,
‘নবাবজাদি তাহলে নিরাপত্তা নিতেই এখানে এসেছে! চল তুই, আজ তোর হচ্ছে! ‘
দুপুর ভয়ে ভয়ে শিপুর দিকে তাকালো। শিপু ওর দিকে তাকালো না। চুপচাপ নিজের শার্ট ইস্ত্রি করছে সে। কী ব্যাপার! আজকে শিপুদা মায়ের কাছে থেকে বাঁচাচ্ছে না কেনো! এমন তো হওয়ার কথা নয়! মিরা এসে দুপুরের কান টেনে ধরে নিয়ে গেলেন। দুপুর হাউমাউ করে কাঁদছে। শিপু বুঝতে পারলো, ভালোই উত্তম মাধ্যম দিচ্ছে মিরা বেগম। প্রথমে একটু কঠিন মনে বসে থাকলেও, এখন আবার মায়া লাগছে। আগামী এক সপ্তাহের আগে অন্তত মহারাণী রাগে কথাই বলবেনা। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে পকেট থেকে টাকা বের করলো। উদ্দেশ্য বাহির থেকে আসার সময় চকলেট কিনে নিয়ে আসা। দুপুরের সবচেয়ে পছন্দের কিটক্যাট।
ঠিক এটাই হলো। শিপুর ধারণাই সঠিক বের হয়েছে। সেদিন আর ভাতও খায়নি দুপুর। সবার উপর অভিমান করে না খেয়ে দরজা আঁটকে ঘরবন্দী হয়ে রইলো। মিরা রাগের বশে তখন মাইর দিলেও এখন অনুনয় বিনয় করছেন। সবার বড়ই আদরের মেয়ে দুপুর। আদরে আদরে বাঁদর যাকে বলে। দুপুর হয়েছে সেই বাঁদর। এর কয়েকদিন পর সবার সাথে কথা বললেও, শিপুর দিকে ফিরেও তাকায়না দুপুর। শিপু প্রতিদিন দুপুরকে এটা ওটা এনে দিলেও, খায়না। অস্থির হয়ে শিপু সেদিন দরজাই ভেঙে ফেললো। তখন শিপুও টগবগে তরুণ। মাথায় একবার রাগ উঠলে হুঁশ থাকেনা। ভয়ে আঁতকে উঠেছিলো দুপুর। বিড়াল ছানার মতো দেয়ালের সাথে মিশেছিলো। সেই রাতের আঁধারে কেউ দেখেনি, শিপু তার নিজের অজান্তেই ষোলো বছরের কিশোরীটির কাছে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ করে বসেছিলো!
নতুন এক অনুভূতিতে সাড়া দিয়েছিলো স্বয়ং দুপুর নিজেও!
চলবে-
লেখায়-নাঈমা হোসেন রোদসী।
(জানি, অনেক পাঠকরাই প্রচুর বিরক্ত। আমি নিজেও বিরক্ত। পরীক্ষার চাপে পড়ে অলরেডি ভর্তা হয়ে গেছি। অনিয়ম করে গল্প দিচ্ছি। অনেকের পড়ার মনোযোগ নষ্ট হচ্ছে। আমি খুব খুব দুঃখীত। ক্ষমা করবেন প্লিজ। আমি যখনই একটু ফ্রি হবো, তখন আবারো নিয়মিত দেবো।)