মনসায়রী’ ১৬.

‘মনসায়রী’

১৬.
দুপুরের চোখ মুখ কুঁচকানো। মুখ তখনো বিড়বিড় করে নাউজুবিল্লাহ পাঠ করছে। পাশেই ফারাহ দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমে হাসবে না কাঁদবে এই নিয়ে দ্বিধায় পড়লেও শেষমেষ হেসেই ফেললো। দুপুর করুণ চোখে তাকালো। ফারাহ হাসি থামালো। হাতে ঝুলছে একটা ছোট সাইজের খোলামেলা নাইটড্রেস আর অন্তর্বাস। গিফট বক্সে এসবই ছিলো। ফারাহ দুপুরের চিৎকার শুনে ভেতরে ঢুকেছিলো। ঘরের সাজসজ্জা দেখে অবাকও হলো।
দুপুর গিফট বক্সটা দেখাতেই ফারাহ বুঝলো কোনো গন্ডগোল হয়েছে। হোটেল ম্যানেজারের সাথে কথা বলে জানলো, তারা ভুল করে এই রুমের চাবি দিয়েছে। দুপুরের রুম এর পাশেরটা। এটা একটা নতুন বিবাহিত দম্পতির জন্য বুক করা। ভীষণ লজ্জা আর অস্বস্তিতে পড়ে গেলো দুপুর। এমন লজ্জা আগে কখনো পায়নি সে। দমবন্ধকর পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে দ্রুত চাবি নিয়ে আসল রুমে পৌঁছালো। এই রুমটাও বেশ সুন্দর। আগেরটার মতো সাজসজ্জা না থাকলেও অনেকটাই পরিপাটি গোছানো। ছোটো একটা খাট। মোটামুটি সবই আছে। ক্লান্ত শরীরে গোসল করে আসলো দুপুর। চুল মুছতে মুছতে বিছানায় বসতেই, ছোটো বাটন ফোনটার রিংটোন বেজে উঠলো। ফোন হাতে নিতেই দুপুরের চোখ খুশিতে জ্বলজ্বল করে উঠলো। কাজল কল করেছে। কল রিসিভ করে কানে নিতেই, কাজল বলল,

‘দোস্ত, একটা খবর আছে শুনবি?’

কাজলের লাজুকস্বরে কৌতূহল বাড়লো দুপুরের। আগ্রহী হয়ে বলল,

‘কী খবর?’

‘দিহান, আমাকে প্রপোজ করেছিলো। ‘

‘তুই কী করলি?’

‘এক্সেপ্ট করেছি। ‘

‘ইয়াহু! ‘

দুপুর ভীষণ খুশি হলো। কতদিন ধরে দিহান আর কাজলের মনকষাকষি চলছে। এর একটা বিহিত হওয়া দরকার ছিলো।
দুপুর খানিকটা হেঁসে বলল,

‘শেষমেষ হার মেনেই নিলি। তাহলে, এতোদিন এমন করলি কেনো!’

কাজল গাল ফুলিয়ে বলল,

‘কী করতাম বল! আমি চাইনি একটা আনএক্সপেক্টেড রিলেশনে যেতে। দিহান হঠাৎ করেই এতো অসুস্থ হলো। সেদিন আমি ওর বাসায় গিয়েছিলাম, আমি ভাবতাম ওর মা বাবা যদি কখনো আমাদের মেনে না নেয়! তখন দুজনই আরো কষ্ট পাবো। ওর বাসায় আন্টির সাথে দেখা হলো। তিনি আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, আমার আম্মা আব্বার সাথে কথা বলবে। এজন্যই আমি বিশ্বাস করলাম। ‘

দুজন আরো বেশ খানিকক্ষণ কথা বলে ফোন রেখে দিলো। আজকে কোনো কাজ নেই। দুপুর বালিশের পিঠে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লো। কালকে সকাল থেকে কাজ শুরু হবে। একটু পরই ফারাহ এসে দুপুরকে রাতের খাবারের জন্য ডাক দিলো। দুপুরের খাওয়ার কোনো ইচ্ছেই ছিলো না ৷ তবুও,ফারাহ জোর করে তুলে নিয়ে গেলো। ঘুমঘুম চোখে টেবিলে বসে আছে দুপুর। একপাশে খাবার সার্ভ করা হচ্ছে। হোটেলের পরিবেশ সুন্দর। টেবিলের একপাশে অর্কিডস দিয়ে সাজানো। সুঘ্রাণ আসছে।
রাইস, আর ভেজিটেবল সালাদ অর্ডার করলো দুপুর। এখন অতো হেভি খাবারের জন্য পেটে জায়গা নেই। ফারাহ এসে ওর বাম পাশে বসেছে। ফারাহর অপর প্রান্তে হিয়ান। সবাই যে যার মতো মোবাইলে ব্যস্ত। খাবার খেতে খেতে দুপুর খেয়াল করে, ফোনে কথা বলতে বলতে সায়র এদিকেই এগিয়ে আসছে। এক হাতে প্যান্টের পকেটে। শার্টের উপরের দুটো বোতাম খোলা। কোকড়া চুলগুলো জেল দিয়ে সেট করা। চোখে এখন চশমা নেই। সায়র আসতেই সবার নজর সেদিকে পড়লো। হাসিমুখে কথা বললো সবার সাথে। সায়রকে দেখে অফিসের একটা মেয়ে পৃথিলা আমোদিত হয়ে সায়রের পাশে বসলো। সায়র সেদিকে খেয়াল করেনি। হিয়ানের সঙ্গে কথা বলতে বলতে সায়র দুপুরের দিকে তাকালো। থতমত খেয়ে গেলো দুপুর। বুঝতে পারেনি, সায়র হঠাৎ করে তাকাবে। সায়র মুচকি হাসলো। অদ্ভুত লাগলো দুপুরের। ছেলেটা বয়সে ছোটো হলেও বেশ বড়সড় ভাব করে চলে। নিজেকে ছোটো ছোটো মনে হয়। এজন্যই আরো লজ্জা লাগে দুপুরের। এই যে আসা মাত্রই সবার সাথে আলাপ জুড়ে গল্পের আসর জমিয়েছে। অথচ,দুপুর দুই একজন বাদে কারো সাথেই কথা বলেনি। এইজন্য প্রায় অনেকেই দুপুরকে অহংকারী ভাবে। কিন্তু, একমাত্র দুপুরই জানে পৃথিবীতে অহংকার করার মতো কিছুই নেই ওর কাছে। রঙিন গাছের সবগুলো পাতা ঝড়ে গেছে। সেই মরাগাছে এখন আর কোনো সুগন্ধিমাখা ফুল নেই। যা আছে সব কাঁটায় ভরা। নিজমনে খাবার খাচ্ছিলো দুপুর। হঠাৎ করেই কানে সায়র আর পৃথিলার কথা ভেসে এলো। পৃথিলা কোমল কন্ঠে বলল,

‘স্যার, আপনার জন্য কী অর্ডার করবো?’

সায়র মৃদু হেসে বলল,

‘আমি নিজেই অর্ডার করে দিয়েছি মিস পৃথিলা। আপনার কষ্ট করার প্রয়োজন নেই। ‘

পৃথিলা সায়রের সুক্ষ্ম খোঁচাটা ধরতে পারলো না। মনে করেন খুশি হলো সায়র তাঁর নাম নিয়েছে কতো সুন্দর করে। এমন সুন্দর লাগেনি কারো মুখেই। আগ বাড়িয়ে আরো কয়েকটা কথা বললো। সায়র সবগুলোরই হাসিমুখে উত্তর দিচ্ছে। দুপুরের কেনো জানি ভালো লাগছেনা এভাবে বসে থাকতে। দুপুর ফারাহকে বলল,

‘আপু, আমার খাওয়া শেষ। আমি ঘুমাতে যাচ্ছি। ‘

ফারাহ আপত্তি করে উঠে বলল,

‘আরে কী বলছো! এখন কেনো যাবে! একটু পরই সবাই বাহিরে বসে আড্ডা দিবে। গেমসও খেলা হবে। থাকো ভালো লাগবে। ‘

দুপুর অসহায়ের মতো মুখ করে বসে রইলো। কী করবে খুঁজে না পেয়ে একটা অর্কিড হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলো। সবাই তখন গল্প করছে। সায়রের দৃষ্টি এড়ালো না। সে পৃথিলার সাথে কথা বলার মাঝেই হাত উঁচিয়ে একজন ওয়েটারকে ডাকলো। ওয়েটার কাছে আসতেই সায়র তাঁকে দুটো ডেজার্ট আইটেম দিয়ে যেতে। পৃথিলা ভাবলো, সায়র বুঝি তাঁর জন্য ডেজার্ট আইটেম অর্ডার করিয়েছে। স্বাভাবিক সে দেখতে সুন্দর। অফিসে ভালো পদে চাকরি করে। সায়র আর সে সমবয়সী। শুধু বসের ছেলে বলেই এখনো স্যার ডাকছে। ওয়েটার ডেজার্টের প্লেটটা হাতে নিয়ে আসতেই পৃথিলা উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর কাছ থেকে প্লেট হাতে নিলো। পৃথিলা কিছু বলার আগেই সায়র ভ্রু কুচকে বলল,

‘মিস পৃথিলা, প্লেটটা আমার হাতে দিন। আপনি বসুন৷ ‘

পৃথিলা বুঝতে না পেরে সায়রের হাতে দিয়ে দিলো। সায়র উঠে টেবিলে ঘুরে দুপুরের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। দুপুর বোকা বনে গেলো। কী হচ্ছে বুঝলো না৷ সায়র প্লেট নিয়ে আচমকা দুপুরের সামনে রেখে ঝুঁকে বলল,

‘খেয়ে দেখুন, ভালো লাগবে। ‘

দুপুর হা করে তাকিয়ে আছে। তা দেখে সবার অগোচরে অল্প একটু চকলেট কেক দুপুরের মুখে দিয়ে দিলো সায়র। মুখটা বন্ধ করিয়ে দিয়ে নিজের সিটে বসে পড়লো। এতক্ষণ যেনো কিছুই হয়নি। পৃথিলা রাগে ফুসছে। টেবিলে বসা দুই একজন মুখ টিপে হাসছে পৃথিলার দিকে তাকিয়ে। চোখ রাগে ছলছল করছে ওর। অসহ্য রকমের রাগ নিয়ে টেবিল ছেড়ে চলে গেলো। যেতে যেতে ইচ্ছে করে দুপুরের টেবিলের পাশে রাখা জুসের গ্লাসটা ফেলে দিয়ে গেলো। দুপুর কিছু বুঝে উঠার আগেই জুস দিয়ে পুরো জামা ভিজে গেলো। সবটা মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। সায়র আবারো উঠলো। মুখচোখ তখন কুঁচকানো। একটা টিস্যু পেপার দুপুরের দিকে এগিয়ে দিলো। দুপুর অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে উঠে চলে যাচ্ছিলো। সায়র একহাতে পকেটে রেখে দাঁড়িয়ে আছে। দুপুরকে আলতো কন্ঠে ডাকলো। দুপুর থমকে পিছনে ফিরলো। সায়র কয়েক কদম এগিয়ে এসে বলল,

‘গাছের সব পাতা ঝড়ে গিয়েই বসন্ত আসে দুপুর। শুধু বসন্তের অপেক্ষা করতে হয়। ‘

দুপুর চোখ বড় করে বলল,

‘জ্বি?’

‘যান, হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে আসুন। আমি আপনার অপেক্ষা করবো। ‘

চলবে –
লেখনীতে -নাঈমা হোসেন রোদসী।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here