মনসায়রী’ ৫.

‘মনসায়রী’

৫.
পুরোনো স্কুল ব্যাগটা নিয়ে মুচির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে দিতিয়া। উদ্দেশ্য নষ্ট চেইনটা ঠিক করিয়ে আরো দুই এক মাস চালিয়ে নেয়া। ব্যাগটা নিয়ে মুচির দোকানিকে বলে একপাশে দাড়ালো। আনমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলো সে। পাশ দিয়ে হঠাৎ করেই একটা সাদা গাড়ি এসে তরল কাদা ওর গায়ে ছিটিয়ে দিলো। হতভম্ব হয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলো দিতিয়া। চোখ মুখে কাদায় মাখামাখি হয়ে গেছে। চোখ দুটো চিরচির করে জ্বলে উঠলো। দিতিয়া অশ্রাব্য গালি দিয়ে ভরিয়ে দিলো গাড়ির মালিককে। যদি গাড়ি চালাতেই না পারে ঠিক করে তাহলে বের হয় কেনো ! গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে আসলো একটা ছেলে। মুচির কাছ থেকে এক বোতল পানি নিয়ে চোখ মুখ ধুয়ে সামনে তাকালো দিতিয়া। তাকিয়েই মাথায় আগুন জ্বলে উঠলো যেনো। আরে, এটা তো চাপাটি মহিলার মদন ছেলে! দিতিয়া চেঁচিয়ে উঠে বলল,
‘সমস্যা কী আপনার? আমার গায়ে কাদা ছিটালেন কেনো, বেয়াদব লোক কোথাকার! ‘
দিতিয়া এমনই। দুপুর যেমন একদিকে শান্ত নদীর মতো। ধীরস্থির স্বভাবের। দিতিয়া ঠিক ওর উল্টো। ঠোঁটকাটা টট্টর মেয়ে। সামনে পিঁপড়া থাকুক আর হাতি। ওকে একবিন্দু আঘাত করলে তাঁর হাড়পাঁজরা জ্বালিয়ে না খাওয়া পর্যন্ত শান্তি দিবে না সে। ছেলেটা চোখ বড়সড় করে এগিয়ে এসে পকেট থেকে টিস্যু দিয়ে বলল,
‘সো সরি গার্ল! আমি ইচ্ছে করে করিনি। কীভাবে যেন লেগে গেলো। নিন টিস্যু দিয়ে মুখটা মুছে নিন। ‘
দিতিয়া টিস্যু নিলো না। চোখ গরম করে তাকিয়ে বলল,
‘টিস্যুর মায়রে বাপ! এই টিস্যু সরান আমার সামনে থেকে। খুব খারাপ হয়ে যাবে বলে দিচ্ছি। ‘
ছেলেটা ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে টিস্যুটা দ্রুত পকেটে ঢুকিয়ে বলল,
‘ছিহ! আপনি গালি দিচ্ছেন কেনো!’
দিতিয়া মুখ ভেঙচিয়ে বলল,
‘এহহ,ন্যাকা ষষ্ঠী! কিছু বোঝেনা। যান দূর হন চোখের সামনে থেকে বিলাতি ছাগল আমার একদম পছন্দ না। ‘
কিছুক্ষণ অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে মাথা চুলকিয়ে গাড়িতে করে চলে গেলো। কারণ, তখনো দিতিয়া গ্রাম্য ভাষায় যাচ্ছে তাই বলে যাচ্ছে। যার মাথামুণ্ডু কিছুই উদ্ধার করতে পারেনি। গাড়ি চলে যেতেই দাঁত কিড়মিড় করে বাড়ির দিকে রওনা হলো। ছেলেটার নাম রওনক। ইংরেজি মিডিয়ামে পড়াশোনা করা বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে সে। বাংলা কথা বলতে মুখে অনেক জড়তা। বাংলা একটা পূর্ণ বাক্যও সে ঠিক করে বলতে সক্ষম নয়। প্রতিটা কথার সাথেই থাকবে ইংরেজি। যা দিতিয়ার সবচেয়ে অপছন্দের সাবজেক্ট। তার মতে দুনিয়ার সব ভাষাকে মেনে নিলেও ইংরেজিকে সে মেনে নিবেনা। অনেক ছোট থাকতে ভাবতো, যদি কখনো সে প্রধানমন্ত্রী হয় তাহলে সর্বপ্রথম ইংরেজি ভাষাকে বাংলাদেশে বয়কট করবে। সবকিছু থাকবে বাংলায়। ভোলাভালা কিসিমের রওনাককে সহ্য করতে না পারার আরেকটা কারণ হলো সে চাপাটি মহিলার ছেলে। যদিও তাঁর কোনো ছাপই তাঁর ছেলের মধ্যে দেখা যায় না৷ তবুও, মায়ের রাগটা ছেলের উপরে ঝেড়ে নেয় প্রায়শই দিতিয়া। কাদা মাখানো শরীরে বাসায় আসতেই মিরা বেগম ডালঘুটনি হাতে ছুটে আসলেন মারতে। দিতিয়া এক দৌড় দিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেলো। মিরা বেগম চিল্লাতে চিল্লাতে দিতিয়ার গুষ্টি উদ্ধার করলেন। দিতিয়া মনে মনে ঠিক করলো, সব দোষ ঐ মদনের! এর ঝাল সে মিটিয়েই ছাড়বে। একবার সামনে পড়ুক চান্দু। গোসল শেষে হলো আরেক মুসিবত। জামা কাপড় তো আনাই হয়নি। এবার বের হবে কী করে। মনে মনে আরেক দফা ঝাড়লো রওনককে। বাথরুমের দরজা খুলে উঁকি দিতেই তনয়া এসে কাপড় এগিয়ে দিলো। দিতিয়া ঠোঁট চেপে হেঁসে বলল,
‘আমার মিষ্টি ভাবী! লাভ ইউ! ‘
তনয়া হালকা হেঁসে বলল,
‘লাভ ইউ টু। এবার তাড়াতাড়ি জামা পড়ে বের হও। নাহলে, চাচী এসে আবারো বকবে। ‘
‘ঠিক আছে ভাবী। ‘

কাপড় নিয়ে পড়তে পড়তে দিতিয়া আনমনেই ভাবলো, শিপুদা কেনো যে তনয়া ভাবীর সাথে এতো খারাপ করে! ভাবী ভাইয়ার জন্য এ বাড়িতে পড়ে আছে, অথচ সে এতো বড়লোক ঘরের মেয়ে যে চাইলেই বাবার বাড়ি চলে যেতে পারে। পায়ের উপর পা তুলে আরাম করে থাকতে পারে। তা কেনো আজও করেনি ভাবী কে জানে!


ব্যাগ থেকে পানির বোতলটা বের করে খানিকটা পান করে মুখ মুছলো দুপুর। একটু পরই তাকে ইন্টারভিউ এর জন্য ডাকা হবে।
কেমন যেন ভয় লাগছে। যদিও দ্বিতীয় বার ডাকা মানেই চাকরি অর্ধেক কনফার্ম। তবুও, মনের ভয় কাটেনা। একবার আকাশপাতাল চিন্তা করে ভাবে চাকরিটা হলে রোজায় চলতে বেশ সুবিধা হবে। দিতিয়াকে নতুন জামা ব্যাগ দিবে,শিপুদাকে একটা ভালো ডক্টর দেখাবে, তনয়া ভাবির পছন্দের খাবার নিবে, মা আর চাচীর জন্যও নতুন শাড়ি। সামনে আবার ইদ। কত কেনাকাটা! বিগত তিন চারটে বছর ধরে কোনো ইদই বড় করে পালন করা হয়নি। সামান্য পায়েস খেয়েই কাটিয়েছে। এবার চাকরি হলে পরিবারের সবাইকে কিছু না কিছু কিনে দেবে। আবার, ধ্যানভঙ্গ হয়ে আঁতকে উঠে। যদি চাকরি না হয়, সব স্বপ্নকে আবারো দাফন করতে হবে। আশেপাশে সবগুলো মেয়েরাই সুন্দর স্টাইলবদ্ধ জামাকাপড় পড়েছে। নিজে যদিও এখানে আসার জন্য মায়ের কাছ থেকে একটা শাড়ি পড়ে এসেছে। নিজের তো আর তেমন কোনো কাপড় নেই। একটু পরই একটা মেয়ে এসে মিষ্টি করে হেঁসে বলল,
‘ম্যাম, আপনি ভেতরে যান। ‘
দুপুর সৌজন্য বজায় রেখে হালকা হেঁসে ভাবলো, এখনো তো চাকরি হয়নি তাঁর আগেই ম্যাম! তেমন বড় কোনো পোস্টের জন্য তো এপ্লাই করেনি সে। ছোটখাটো এমপ্লয়ি পোস্টের আবেদন ছিলো। এসব ভাবতে ভাবতেই দরজায় নক করলো। ভেতরে থেকে আসার অনুমতি পেয়ে দুরুদুরু বুকে ভেতরে আসলো।
সামনেই মধ্যবয়স্ক একজন লোককে বসা দেখলো। এলোমেলো দৃষ্টিতে তাকিয়ে সালাম দিলো দুপুর। প্রচুর নার্ভাস ফিল হচ্ছে।
লোকটি হেঁসে বললেন,
‘বসো মা বসো। ‘
তাঁর দেখানো চেয়ারে বসলো দুপুর। যেহেতু এটা ফ্যাশন ডিজাইনিং কোম্পানি, এজন্য এই সম্পর্কিত দুই একটা প্রশ্ন করলেন। দুপুর নিজেকে সাহস দিয়ে উত্তর দিলো। বোঝা গেলো তিনি সন্তোষ্ট হয়েছেন। সবশেষে তিনি মৃদু হেঁসে বললেন,
‘কাজ কবে থেকে শুরু করতে চাও?’
আকস্মিক প্রশ্নে হকচকিয়ে গেলেও, যখন বুঝতে পারলো চাকরীটা হয়ে গেছে তখন হেঁসে ফেললো দুপুর। কৃতজ্ঞতায় চোখ ভরে উঠলো জলে। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানিয়ে নিয়ে তারপর বলল,
‘থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ স্যার। আমি আজই কাজ করতে চাই। ‘
‘ঠিক আছে , আজ তেমন কোনো কাজ নেই। ফারাহকে ডেকে দিচ্ছি, তোমাকে কাজ বুঝিয়ে দিবে। কাল থেকে সময় মতো এসে পড়বে। ‘
দুপুরের ইচ্ছে করলো এখনই উঠে দাঁড়িয়ে নেচে ফেলতে। চাকরি যে এতো সহজে হয়ে যাবে তা কল্পনাও করেনি সে। ইশ! আজকের দিনটা এতো ভালো এতো সুন্দর কেনো! এবার সেই ছেলেটার টাকাগুলোও ফেরত দেয়া যাবে। ফারাহ মেয়েটা এসে দুপুরকে নিয়ে ওর কাজের জায়গাটা দেখিয়ে নিতে যাচ্ছিলো, এমন সময় এদিকেই দৌড়ে একটা ছেলে এগিয়ে আসছিলো। আকস্মিক ধাক্কায় দুপুরের পা দুটো স্লিপ কেটে ঠাস করে ফ্লোরে বসে পড়লো। উপুড় হয়ে পড়ে গিয়ে হাতের কনুইতে সাংঘাতিক ব্যাথা পেলো। তাঁর চেয়েও বেশি লজ্জায় চোখে পানি চলে আসলো। সবার সামনে এভাবে পড়াটা ভীষণ লজ্জার ব্যাপার।
একবার মাথা তুলে দেখলো আশেপাশের সবাই মিটমিট করে হাসছে। এবার হেঁচকি তুলে কেঁদে দিলো দুপুর। বয়সে এতো বড় হওয়ার পরও মনটা সেই নরমই রয়ে গেছে। গায়ের ব্যাথার চেয়ে মনের ব্যাথায় কেঁদে ফেলে সে। ফারাহ অবাক হয়ে গেলেও পরে অস্থির হয়ে বলল,
‘আরে আরে! কাঁদছো কেনো? বেশি ব্যাথা পেয়েছো নাকি? ‘
দুপুরের রেগে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করলো, নাহ আরাম পেয়েছি। পড়ে গিয়ে মানুষ আরাম পায়। এবার আরামে আরামে মরেই যাবো। কিন্তু বললো না। মুখের উপর কথা বলা দুপুরের ধাতে নেই। নাক মুখ লাল করে দেখলো যে ছেলেটার সাথে ধাক্কা লেগে পড়েছে, সে দাঁত কেলিয়ে চমৎকার হাসছে। এ যেনো তেনো হাসি নয়। একেবারে বিশ্বজয় করা হাসি। কী আশ্চর্য! এতো অভদ্র ছেলেটা। একটা মেয়েকে ধাক্কা দিয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসছে। ছেলেটা এবার দুপুরের মুখের কাছে মুখ নামিয়ে বলল,
‘ফ্লোরেই বসে থাকবেন? উঠতে ইচ্ছে করছে না বুঝি! কোলে তুলে নিবো? আমি কিন্তু অনেক সুন্দর করে তুলতে পারি।’

বলেই একচোখ টিপ দিলো। দুপুরের মুখ খুলে হা হয়ে গেলো। কান্না থেমে চোখেমুখে অদ্ভুত এক্সপ্রেশন এসে গেলো। ফারাহ দুপুরকে উঠতে সাহায্য করলো। দুপুর থমথমে কন্ঠে বলল,
‘আপনার লজ্জা করে না? একজন মেয়েকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেন। সরিও বললেন না। এতো অভদ্র কেনো আপনি! ‘

ছেলেটার মুখে তখনও ভুবনভুলানো হাসি ফুটে আছে। পারফিউমের সুবাস ভেসে আসছে। চেনা চেনা লাগলেও ক্রোধে মুখ লাল করে তাকিয়ে আছে দুপুর। ছেলেটা এতো লম্বা,তাকাতে ঘাড় একেবারে উঁচু করতে হচ্ছে। পড়নে থ্রি কোয়াটার প্যান্ট। আর পড়নে টিশার্ট। জিম করা হাত গুলো গেঞ্জি ভেদ করে ফুলে ফুলে উঠছে হাতের দুলুনিতে। মুখে একটা চুইংগাম নিয়ে বেশ আয়েশি ভঙ্গিতে চিবুচ্ছে। দুপুরের ভীষণ রাগ হলো ঐ দেমাগি মুখটা দেখে। এতো সুন্দর চেহারা পুরোটাই দেমাগে ভরপুর। কী লাভ এই চেহারার! দুই হাত দিয়ে খামচে নষ্ট করে দিতে ইচ্ছে করলো ফর্সা গাল দুটো। হাত দুটোও নিশপিশ করছে। একটা চড় মারতে পারলেও শান্তি পেতো। অতো সাহস হলো না দুপুরের। তাই কড়া চোখে তাকিয়ে বলল,
‘ম্যানার্স নেই কোনো! এক্ষুনি সরি বলুন। ‘
ফারাহ পাশ থেকে ভয়ে ভয়ে দুপুরের হাত চেপে ফিসফিস করে বলল,
‘চুপ করো মেয়ে, নাহলে কপালে দুর্দশা আছে!’
দুপুর চুপ করলো না চেচিয়ে বলল সরি বলতে। কেনো চুপ করবে সে! দোষটা তো অভদ্র ছেলেটার। এখনো সরি বলছেনা। কতবড় শয়তা’ন! ফারাহ মনে মনে ভাবলো এবার এই মেয়ের চাকরি শেষ। দুপুরের দিকে ঝুঁকে ছেলেটা ঠোঁট উঁচু করে ফুঁ দিয়ে বলল,

‘সায়র কখনো সরি বলেনা। তবে আপনি খুব শীঘ্রই আমাকে বলবেন।’

দুপুর রাগে দুঃখে দাঁতে দাঁত চেপে কিছু বলার আগে ছেলেটা আগের মতোই ধুপধাপ পা ফেলে চলে গেলো। দুপুর পেছনে তাকিয়ে চিল্লাতে নিলেই ফারাহ ওকে চেপে বলল,
‘আরে থামো থামো! নিজের চাকরি বাঁচাতে চাইলে আর একটা শব্দও বলো না। ‘
দুপুর বুঝতে না পেরে বিরক্ত হয়ে বলল,
‘কেনো আপু? দোষটা তো ঐ অভদ্র ছেলেটার! আমি চুপ থাকবো কেনো! ‘
‘কারণ, সে পলাশ স্যার মানে মালিকের ছেলে।’
‘তো কী হয়ে..’
বলতে বলতে দুই হাতে নিজের মুখ চেপে ধরলো দুপুর। হায় আল্লাহ! এবার যদি ছেলেটা গিয়ে বসের কাছে তাঁর নামে বিচার দেয়। যদিও দোষটা সে করেনি। তবুও, দুপুর তো সামান্য এমপ্লয়ি! চাকরিটা চলে গেলে! ভয়ে বুক কেঁপে উঠলো। ঘেমে একাকার হলো। একহাতে মুখ মুছে শুকনো ঢোক গিলে নিলো।

চলবে-
লেখায় -নাঈমা হোসেন রোদসী।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here