অসমাপ্ত চিঠি

অসমাপ্ত চিঠি
Suraiya Aayat
অনুগল্প

__” আজ একটু দেখা করতে আসতে পারবে ? আজ আমার কেমো থেরাপির লাস্ট দিন, তোমাকে বড্ড দেখতে ইচ্ছা করছিলো আরকি !(হালকা ফিকে গলায়)

চোখের কোনে জমে থাকা জলটা মুছে নিয়ে রিদি বলল,,,,
__”আপনার দেওয়া কষ্টটাই আমি যেমনটা ক্ষতবিক্ষত হয়েছি আজ আপনিও ঠিক তেমনটাই ক্ষতবিক্ষত হচ্ছেন তাইনা ! তবে আপনার ক্ষতের কারনটা যে সপ্মূরণ ভিন্ন,,,,রোগের জালাটা বড্ড কষ্ট দেই তাইনা?

আয়মান বারাবরের মতো ফিচেল হেসে বলল,,,,,
__” আজো তোমার মুখে সেই একই কথা তাইনা! আজো কি পুরোনো কথা গুলো না তুললেই নই?”

__” আজো কি সারা হৄদয় জুড়ে অনুসূচনার দমকা হাওয়াটা বয়ে যাই না ?”

__” হইতো বা নই ৷”

__” সার্বজনীন প্রেমিকেদের এই একই সমস্যা , কেনই বা হবে না, মনটা কি শুধু একজনের জন্য নাকি? নাহ! একদমই নই,,,,,আপনার যে প্রেয়শীর অভাব নেই ৷”

__” থাক না রিদি আজকে এ সমস্ত কথা,,,,আজ একটা দিনের জন্যও কি আমরা একটু ভালোভাবে কথা বলতে পারি না ?”

__” নাহ ,পারি না, একটা বেইমানের সাথে কথা বলতে আমার রুচিতে বাধে ৷”

কথাটা বলতেই হাউহাউ করে কেঁদে উঠলো রিদি ৷

__” কেন আপনি আমার সাথে এমনটা করলেন বলুন , কেন? আমার অনুভূতিটাকে নিয়ে খেলতে তোমার একটি বারো বাধলো না সেদিন ! কেন করলে তুমি আমার সাথে এমনটা ? কেন?”

হঠাৎই যেন চিরাচরিত সেই রক্তকাশিটা পুনরায় শুরূ হয়ে গেল,,,,,
আয়মানের হাতে ছিটেছিটে রক্তের ছাপ দৄশমান,ঠোঁটের এক কোন বেয়ে খানিকটা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে ৷
গড়িয়ে পড়া রক্তটা কোনরকম কাঁপা কাঁপা হাত দিয়ে মুছে বলতে শুরূ করল আয়মান,,,,
__” ভুলটা হইতো আমারি , তোমাকে এতটা কষ্ট দেওয়া হইতো আমার উচিত হয়নি , তোমার কষ্টের পরিনামে আল্লাহ হইতো আমার হায়াতটাকে কমিয়ে এনেছেন,,,,,,সে যাই হোক উনি যা করেন তাতেই আলহামদুলিল্লাহ,,হয়তো এই পৄথিবী থেকে একটা পাপী মানুষকে তাড়াতাড়ি নিতে চাইছেন ৷ সে যাই হোক পারলে কালকে একটু এসো , অপেক্ষায় থাকবো, তবে অপেক্ষার শেষ প্রহরে হয়তো তোমাকে পাবো না ৷ সঠিক সময়ে আমাকে দেখা না পেলে আবার আমাকে যেন পুনরায় বেইমানের খাতায় নাম লিখিওনা, তাহলে আমি যেখানে যাবো সেখানে গিয়েও হয়তো শান্তি পাবো না ৷ আর আমার ভাবি তোমাকে চেনে, ওনার কাছে আমি একটা চিঠি দিয়ে রাখবো পারলে ওটা নিয়ো ৷ আর তোমার অপেক্ষায় থাকবো, এসো কিন্ত , তুমি আসলে হয়তো আমার এই সারা বুক জুড়ে প্রশান্তির ঝড় বয়ে যাবে ৷ তবে আজো ভালোবাসি , খুব ভালোবাসি আমার এই রিদিপাখিটাকে ৷ ভালোবাসি ৷”

কথাটা শোনামাইত্র রিদির চোখদিয়ে অনবরত নোনাজলগুলো গড়িয়ে পড়ল,,,,,,
ফোনের এপাশ-ওপাশ জুড়ে কেবলই নিসত্তব্ধতা,ছেয়ে যাচ্ছে শুধু আয়মানের রিদিপাখির ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ তবে তা আয়মানের কান অবধি পৌছাচ্ছে কি তা রিদিপাখির জানা নেই ৷

ওপাশ থেকে পিনপতন শব্দটুকুও না পেয়ে রিদি পারলো না আর চুপ করে থাকতে ,,,,,,
ফিকে কন্ঠে বলে উঠলো,,,,,,
__” আমি আসবো , তবে একটিবার তোমার রিদিপাখিকে তোমার বাহুডোরে জড়িয়ে ধরবে তো! ছেড়ে যাবে না তো আর ! তোমার রিদিপাখিটা যে আজো তোমাকে অনেক ভালোবাসে ৷(বলে রিদি আবার কাদতে লাগল)

রিদি অপরপাশ থেকে অনবরত কেঁদেই চলেছে তবে ওপর পাশ থেকে কোন সাড়া শব্দ নেই,,,,,
__” তোমার রিদিপাখিটা কাঁদছে তুমি তাকে ধমক দেবে না আইমান! কি হলো কিছু বলছো না কেন?চুপ করে আছো কেন কিছু বলো আইমান কিছু তো বলো ৷”
বলে রিদির হাত থেকে ফোনটা মাটিতে পড়ে গেল,অঝোর ধারায় কাদতে লাগলো ও,,,,

হঠাৎ করে রিদির ঘুমটা ভেঙে গেল,,,, এতখন স্বপ্ন দেখছিল রিদি , তবে এখন দরদর করে সারা সরীর ওর ঘামছে ,,,, গলাটা যেন ক্রমশ শুকিয়ে আসছে ওর ৷
__” এটা আমি কি দেখলাম,,,,, আমার আইমান ! কি হয়েছে ওর ? আর আমাকে কালকেই বা যেতে বলল কেন? ওর কেমোই বা দিতে হবে কেন? কি হয়েছে ওর?”

এতসব কিছুর মাঝে রিদির মাথাই আর কিছুই আসছে না,,,,,হঠাৎ বুঝতে পারলো কেমো শব্দটার তাৎপর্য ৷ বুঝতেই হাটুতে মুখ গুজে অনবরত কাদতে লাগলো রিদি ৷ অঝোর ধারায় কাদতে লাগলো ও ৷
কিছুক্ষন পরেই চোখের জলটা মুছে বলল,,,,
__” কিছ্ছু হতে পারে না আমার আইমানের , কিছু না , এটা তো শুধু একটা দুঃসবপ্ন মাত্র ৷”

কথাটা বলেও রিদি যেনো নিজের মনটাকে শান্ত করতে পারছে না, কারন ও তো জানে যে এরপর কি হতে পারে,,,,,
ভেজা চোখে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল ভোর 4.30 বাজে,,,, চাইলেও এখন আইমানের কাছে ওর পক্ষে যাওয়া সম্ভব নই ৷
মনটাকে শান্ত করার জন্য তাড়াতাড়ি করে ওজু করে নামাজ পড়ে নিল,,,, আজকে সকালেই আইমানের সাথে দেখা করতে যাবে ও , নিজেও কষ্ট পয়ৈছে আর আয়মান ও কষ্ট পেয়েছে সমানভাবে, তবে আর নই ৷

নামাজটা পড়ে জানালার রেলিংটা ধরে এক দৄষ্টিতে তাকিয়ে রইলো বাইরের দিকে ৷

প্রায় ছয় মাস হলো আয়মানের সাথে ওর কোন যোগাযোগ নেই, তার কারনটা হইতো আইমান নিজেই ৷ শারিরীক সম্পর্কে লিপ্ত হতে চেয়েছিল আইমান , সেদিনটা হয়তো রিদির জন্য সবচেয়ে কঠিন একটা দিন ছিল ৷
সেদিন রাগের বসে আইমনাকে 2 টো চড় মেরেছিল রিদি , প্রথমে আইমান যখন ওকে বলেছিল যে ওর সাথে শারিরিক সম্পর্কে জড়াতে চাই তখন আর দ্ধিতীয়বার যখন আইমান ওকে বলেছিল,,,

__”রিদিপাখি আমি তো তোমার সাথে মজা করছিলাম ৷”

রিদি দ্বিতীয় থাপ্পরটা মেরে আইমানকে বলেছিল,,,,,
__” লজ্জা করেনা একটা মেয়েকে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হওয়ার কথা বলে তাকে এখন বলছে যে সমস্ত টা মিথ্যে , তুমি তাকে ভালোবাসো ! সত্যি আমি তোমার থেকে এটা আমি আশা করিনি, তোমাকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবেসেছিলাম আমি আর তার প্রতিদান তুমি এই দিলে ৷”

সেদিন ছলছল চোখে আইমান রিদির দিকে তাকিয়ে বলেছিল,,,,
__” আমি তো অন্য একটা কারনে তোমাকে কথটা বলেছিলাম রিদিপাখি !”

রিদি ছলছল চোখে আইমানের দিকে তাকিয়ে বলেছিল,,,,,
__” ঘৃণা করি তোমাকে, আর কখনো তোমার মুখটা দেখতে না হয় যেনো আমাকে ৷”

কথাটা ভাবতেই রিদির চোখ থেকে কয়েক ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল….

সকাল আটটা,,,,,

তাড়াতাড়ি করে খানিকটা অগোছালো হয়েই বেরিয়ে পড়েছে রিদি বাড়ি থেকে , উদ্দেশ্য আইমানের সঙ্গে দেখা করা ৷ এই ছয় মাসে আইমান রিদির সাথে অনেক যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে, আর বারবার বলেছে যে ও রিদিকে কিছু বলতে চাই তবে রিদি রাগে আর অভিমানে কথাটা শুনতে চাইনি ৷

তবে আজকে আর পারছে না যেন নিজেকে আটকে রাখতে , খুব ভালোবাসে যে ওকে আর যেকোনো কিছুর পরিবর্তে আইমানের সঙ্গে থাকতে চাই ৷

ওর যাত্রার পথটা যেন আজকে দীর্ঘ হয়ে আসছে , পা যেন এগোতেই চাইছে না আর তাতে রিদি রীতিমতো বিরক্ত , আর মনটাওকেমন অস্থির অস্থির করছে ৷
কপালের ঘামটা ওড়না দিয়ে মুছে সামনে এগোলো ৷
আর মাএ কিছুটা পথ তারপর ই আইমানের বাড়ি, কথাটা ভাবতেই মুখের কোনে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো রিদির ৷

খানিকটা এগিয়ে যেতেই সামনে অনেক মানুষের ভিড় দেখে রিদির মনে এক অজানা ঝড় বয়ে গেল ৷ সামনে এগোনোর সাহস টুকু পাচ্ছে না ও ৷
কিছুটা এগিয়ে যেতেই বছর 15 র একটা ছেলে রিদির কাছে এসে বলল,,,,,
__” তুমিই কি রিদি আপু?”

__” হমমম, কিন্ত তুমি আমাকে কি করে চিনলে?”(ফিকে গলায়)

__” আইমান ভাইয়া তোমার কথা খুব বলতো আর সবসময় তোমার রুপের কতো প্রসংশা করতো ৷ কালকেও বলছিলো যানো , যে তোমার সাথে একবার দেখা করলেই ওর প্রানে শান্তি আসবে কিন্ত দেখো আজ তুমি এসেছো কিন্ত মানুষটাই নেই !”(কতটা বলে ছেলেটা হাউহাউ করে কাদতে লাগলো )

ছেলেটাকে এভাবে কাদতে দেখে রিদির সারা শরীর শিউরে উঠলো,,,,,,
__” কেন কি হয়েছে আমার আইমানের? আর কোথাই আমার আইমান ?”

__” আইমান ভাইয়া যে আর নেই, আজ ভোরেই ভাইয়া ইন্তেকাল করেছে ৷”

কথাটাশুনে যেন রিদির পায়ে নীচে থেকে মাটি সরে গেল,,,,,,,প্রিয় মানুষটা আর নেই, ওর স্বপ্নটা সত্তি হয়ে গেল ৷

ছেলেটা রিদির হাতে চিঠিটা দিয়ে বলল,,,,
__” এটা আইমান ভাইয়া তোমার জন্য লিখে গেছেন,ভালো থেকো আপু ৷”
কথাটা বলে ছেলেটা কাদতে কাদতে চলে গেল ৷

রিদি আর নিজের মধ্যে নেই ,,,,,,,ওর প্রিয় মানূষটা যে আর নেই, চিরকালের মতো হারিয়ে ফেলেছে তাকে ৷
চিঠিটা হাতে নিয়ে একমনে হাটা দিল রিদি ৷
কোথাই যাচ্ছে তার ঠিক নেই, আইমানের দেওয়া শেষ চিঠিটাও খুলে দেখেনি এখনো,,,,
হঠাৎ করে সামনে একটা গাড়ির সাথে ধাক্কায় শরীরটা মাটির সাথে লুটিয়ে গেল আর মাথা থেকে রক্তগুলো অঝোর ধারায় বইতে লাগলো ৷ শেষ বারের মতো আইমানের মুখের আবছা ছাপ চোখে ভেসে উঠতেই চোখটা বুজিয়ে নিল আইমানের রিদিপাখি ৷
পড়া হলো না আর প্রিয়র লেখা শেষ চিঠি,বলা হলো না যে ভালোবাসি ৷

প্রিয় রিদিপাখি,,,,,,

যানোতো আমি না ভালো নেই, খুব কষ্ট হচ্ছে যানো, আর ক্রমেই মনে হচ্ছে তোমাকে হারিয়ে ফেলার দিনটা ক্রমশ এগিয়ে আসছে, কিন্ত আমি যে তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না গো বড্ড কষ্ট হবে ৷ আচ্ছা তুমি কি আমাকে ছেড়ে থাকতে পারবে?হইতো পারবে না , কারন আমি যানি আমিও যেমন তোমাকে ভালোবাসি তেমনি তুমিও আমাকে ঠিক তেমনটাই ভালোবাসো ৷ আরে পাগলি আমি যে তোমারই ৷

প্রায় 6 মাস হলো ক্যানসার ধরা পড়েছে,যখন প্রথমে শুনলাম যে 2nd stage এ আছে তখন কেবল একটা কথাই মনে হয়েছিল যে তোমাকে ছাড়া থাকবো কি করে ! যে রিদিপাখির সাথে কখনো অভিমান করিনি শুধু একবেলা কথা বন্ধ হবে বলে আর সেই রিদিপাখিকে ছাড়া কিভাবে কি ! না না এটা আমার পক্ষে সম্ভব না, তবে আমি কি করবো বলো তো ! আমি জানি এটা জানলে তুমি খুব কষ্ট পাবে সেই কথাটা ভেবে সেদিন সারাটা রাত কেদেছিলাম ৷

যানোতো তোমার কথা শুধু ভাবি জানতো , তাই ভাবি বলেছিল যে সময় থাকতে তোমার জীবন থেকে সরে আসতে তাহলে ভবিষ্যতে তুমি কষ্টের হাত থেকে মুক্তি পাবে ৷ জানোতো সেদিন ভাবির চোখের কোনে জলটা চিকচিক করছিল খুব , প্রিয় মানুষদের ছেড়ে যাওয়ার কষ্টটা সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম ৷ এখন না হয় আমি আছি কিন্ত পরে যখন আমি থাকবো না তখন কি হবে ৷ কথাগুলো ভাবতেই গায়ে কাটা দিয়ে উঠতো ৷

৷তোমাকে শারিরীক সম্পর্কের কথা বলেছিরাম যাতে তুমি আমাকে ভুল বুঝে আমার থেকে দূরে সরে যাও, কথাটা শোনার পর তুমি যখন আমাকে চড় মেরেছিল তখন ঐকটুও আঘাত পাইনি মনে, কিন্ত পর মুহূর্তে যখন মনে হলো যে সত্তিটা তোমাকে যখন একদিন জানাতেই হবে তাই এখন বলে দেওয়াই ভালো তখন তুমি যখন দ্ধীতীয়বারের মতো চড় মারলে তার আঘাতটা ছিল গুরুতর , খুব আঘাত পেয়েছিলাম মনে এটা ভেবে যে আমার রিদিপাখিকে সত্তিটা আমি জানতে পারলাম না ৷
তবে যাই হোক যেটা মুখে প্রকাশ করতে পারিনি সেটা না হয় চিঠিতেই ফুটিয়ে তুলি ৷
তুমি যখন চিঠিটা পড়বে তখন আমি থাকবো কি যানি না তবে এটুকু বলবো ,,,,
__”ভলোবাসি রিদিপাখি ৷ বড্ড বেশি ভালোবাসি ৷”

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here