#প্রেমোত্তাপ #মম_সাহা ১৪.

#প্রেমোত্তাপ
#মম_সাহা

১৪.
বাহিরে ঝড়। গাছপালা বাতাসে হেলে যাওয়ার উপক্রম। পুরো ঘরময় ছড়িয়ে গেছে ঝড়ের মিষ্টি বাতাস। শীতলতায় ছেয়ে গেছে রুম। মোটা একটা কম্বলের নিচের চিত্রার আদুরে, কোমল দেহটা চুপসে আছে। তার সামনেই অভিজ্ঞ চোখে তাকে পরোখ করছে। চিন্তিত ভঙ্গিতে দুয়ারে দাঁড়িয়ে আছে বাহার। ঘরের ভিতরেই দাঁড়িয়ে আছে তুহিন। সোফায় বসে আছে চাঁদনী। মেয়েটারও ঠান্ডায় শরীর কাঁপছে। বার কয়েক হাঁচিও দিয়েছে। ঠান্ডায় জুবুথুবু প্রায়। ডাক্তার বিজ্ঞ চোখে অনেকক্ষণ পরীক্ষা নিরীক্ষা করে অতঃপর গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“মেয়েটার তো অনেক জ্বর। আমি কিছু মেডিসিন সাজেস্ট করছি তোমরা এনে খাইয়ে দেও।”

তুহিন মাথা দুলাতেই ডাক্তার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। তুহিন বোনের ওষুধ আনতে এবং ডাক্তারকে এগিয়ে দিতে গেলো। ঘরে রইলো বাহার আর চাঁদনী। চাঁদনীর নাজেহাল অবস্থা চোখ এড়ালো না বাহারের। অতঃপর গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“চাঁদ, তোমার গিয়ে এখন ঘুমানো উচিৎ। ঘরে কোনো জ্বরের ওষুধ আছে? থাকলে অবশ্যই সেটা খেতে হবে।”

বাহারের কথায় চাঁদনী ঝিমিয়ে আসা নেত্র যুগল নিয়ে বলল,“না সমস্যা নেই, বাহার ভাই।”

“অবশ্যই সমস্যা আছে। সবাই একসাথে অসুস্থ হয়ে গেলে তো হবেনা, তাই দ্রুত যাও আর ওষুধ খেয়ে ঘুমাও।”

চাঁদনী আর দ্বিমত পোষণ করলো না বাহারের কথায়। সোফা থেকে উঠে চিত্রার মাথায় বার কয়েক হাত বুলালো। মেয়েটা এত আদুরে! চাঁদনীর মনে হয় কেবল- গোটা পৃথিবীর সুখ যদি সে মেয়েটাকে এনে দিতে পারতো! মেয়েটা কিছু আবদার করলে তা পূরণ করতে না পারলে তার নিজেকে পাগল পাগল লাগে। সে জানে, এই যে এতরাতে তারা ঢাকা চলে আসছে, এর জন্য অনেক কথাই তাদের শুনতে হবে। চাঁদনীকে খোঁটা দেওয়া হবে তার সত্তা নিয়ে। এতবছর যাবত বাবার ঘাড়ে বসে খাওয়ার খোঁটাটা তার মা নিবিড় ভাবেই দিবে। তবুও তার আফসোস নেই। মেয়েটা যে একটু স্বস্তি পেয়েছে সেটাই তার শান্তি।

বোনের মাথায় আদুরে হাত বুলিয়েই চলে গেলো চাঁদনী। পুরো ঘরে কেবল একা রইলো বাহার। চিত্রার শরীর তখন গুটিশুটি মেরে কম্বলের নিচে আরাম খুঁজতে ব্যস্ত। আর বাহার ব্যস্ত সেই চিত্রার মুখে নিজের শান্তি খুঁজে নিতে।

মেয়েটা নড়তে গিয়ে কম্বলের অনেকটা অংশ শরীর থেকে ফেলে দিয়েছে। যার ফলস্বরূপ ঠান্ডা বাতাসে সে কাঁপছে। বাহার এগিয়ে এলো, যত্ন করে কম্বলখানা তুলে দিল শরীরে। চিত্রার গভীর ঘুম মুহূর্তেই হালকা হয়ে এলো। ভেঙে যাওয়া অসুস্থ কণ্ঠ নিয়ে ক্ষীণ স্বরে ডাকলো,
“বাহার ভাই..”

বাহারের ব্যস্ত হাত থেমে গেলো। চোখ তুলে তাকালো অসুস্থ মুখটার পানে। আনমনেই সে উত্তর দিলো,
“হুম?”

“বনফুল আসেনি?”

বাহার এবার চোখ তুলে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাল চিত্রার দিকে। মেয়েটা অসুস্থ অবস্থাতেও বনফুলকে খুঁজছে! বাহার তপ্ত শ্বাস ফেলল। চিত্রার থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে বলল,
“ও অসুস্থ তো, তাই আসেনি। পরে আসবে। অনেক রাত হয়েছে না?”

“আন্টিও আসেনি তাই না?”

এবারের প্রশ্ন বাহারকে অসহায় করলো। সে অসহায় ভাবেই ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো উত্তর বিহীন। বাহিরে কালো আকাশের বুকে সোনার কাঠির ন্যায় যেন বিদ্যুৎ চমকালো। গমগমে শব্দে বজ্রপাত হলো আকাশের বুকে। চিত্রা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো বাহারের দিকে। বেশ ক্ষাণিকটা সময় তাকিয়ে থাকার পর বিধ্বস্ত কণ্ঠে বলল,
“দূরে গিয়ে দাঁড়ালেন যে বাহার ভাই? আপনিও বুঝি দূরে যাওয়ার ছন্দ আঁকছেন মনে? কতটা দূরে যাবেন? বনফুল আর আন্টির মতন দূরে? নাকি আকাশ থেকে মাটির দূরত্বের মতন দূরে?”

বাহার স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো মেয়েটার দিকে। জ্বরে কি মেয়েটা ভুলভাল বকছে! কিন্তু বাহারের হৃদয় মন্দিরতো জানে, মেয়েটা ভুল বলছে না সবটা। আকাশ যতটা কাছের মনেহয় ততটা কাছে তার বসবাস যে নয়। মেয়েটার মন কি সেটা ধরে ফেলল!

চিত্রা আবার বলল, “দূরে যাচ্ছেন?”

“কাছে ছিলামই বা কবে?”

বাহার প্রশ্ন করলো ঠিক কিন্তু উত্তর শুনলো না। চিত্রার উত্তর দেওয়ার আগেই সে প্রস্থান নিয়েছে রুম থেকে। চিত্রাও উত্তর দিলো না। কেবল দু-চোখ ভরে দেখলো সে প্রস্থানের নিয়ম। প্রেমিক পুরুষরা বড্ড পাষাণ হয় বোধহয়। নাহয় এমন করে মন ভাঙতে পারে? বুক চিরে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। চিত্রার ভীষণ কান্না পেলো কিন্তু কাঁদলো না। এই কান্নাটা বাহার ভাইকে হারানোর ভয়ে না। এই কান্নাটা নিজের বন্ধুত্ব হারানোর ভয়ের। সে আজ অনুভব করেছে, এতদিন বনফুলকে জড়িয়ে ধরলে আত্মার যে শীতলতা মিলতো আজ তা আর সে পায়নি। পরিচিত মুখ কোথাও একটা বড্ড অপরিচিত ঠেকলো তার। প্রানপ্রিয় বন্ধুত্ব হারানোর শোক চিত্রাকে আরেকটু নিস্তেজ করলো। অতঃপর সে আবার তলিয়ে গেলো গভীর নিদ্রায়।

_

পৃথিবীতে রাত অনেক আসে কিন্তু কিছু কিছু রাত নিগার মন খারাপ, শূণ্যতা নিয়ে আসে। আজ চাঁদনীর রাতটাও তেমন একটা রাতের অন্তর্ভুক্ত। চোখ ভর্তি ঘুম অথচ মন ভর্তি বিষন্নতার লড়াইয়ে হেরে গেল ঘুম এবং জিতে গেল বিষন্নতা যার ফলস্বরূপ সে জেগে রইল। দু’চোখের পাতা এক করতে পারেনা। কষ্ট হয় বুকে। চোখের সামনে যখন শাহাদাত এবং তার নববধূর সংসার ভেসে উঠে তখন গোটা একটা পৃথিবী চাঁদনীর কাছে অসহ্যকর লাগে। এই অনুভূতির বিশ্লেষণ করা যায় না, আর না কাউকে সংজ্ঞা দেওয়া যায় তার। কেবল বুকে বয়ে বেড়ানোই স্থায়ী।

চাঁদনীর মাথা ব্যাথাকে দ্বিগুণ বাড়িয়ে তার বালিশের নিচে থাকা মোবাইলটা কেঁপে উঠল। ঝিম ধরা শব্দে ভারী হয়ে গেল চাঁদনীর মাথা। অথচ ফোনটার থামারই নাম নেই! চাঁদনী আর না পেরে ফোনটা তুলল, রিসিভ করে কানে লাগাতেই অপর পাশ থেকে একটা ব্যস্ত কণ্ঠ ভেসে এলো,
“ছাঁদে আসুন। আমি আপনাদের ছাঁদে।”

কথাটুকু বলেই সাথে সাথে কলটা বিচ্ছিন্ন করা হলো। চাঁদনী হতভম্ব নয়নে কতক্ষণ তাকিয়ে রইলো। এতরাতে তাকে ছাঁদে ডাকছে! এই ছেলেটার সাহস কত বড়ো! চাঁদনীর মন একরোখা হলো। চ ড় খেয়েও যে ছেলের শিক্ষা হয়নি, লাজলজ্জার মাথা খেয়ে আবার ঘন্টা পেরুতেই তাকে ছাঁদে ডাকছে যে ছেলে সে ছেলের সাথে আর যাই হোক, চাঁদনীর কোনো সম্পর্ক নেই। চাঁদনী চোখ বন্ধ করলো। ঘুমানোর অনেক চেষ্টা চালালো। ক্ষণে ক্ষণে আকাশে তখন বজ্রপাত হচ্ছে। বিদ্যুৎ চমাকাচ্ছে নতুন ছন্দে! চারপাশ আলোকিত হয়ে যাচ্ছে। অনেকটা সময় চোখ বন্ধ করে রাখতে রাখতে চাঁদনীর ঘুম এলো। বোধহয় এক ঘন্টা সে ঘুমিয়েও নিলো নির্দ্বিধায়। কিন্তু মনের খুঁতখুঁত সে ঘুমকেও স্থায়ী হতে দিলো না। আচমকাই ঘুম কেটে গেছে তার। ঘুম ভাঙতেই মাথায় এলো মৃন্ময়ের কথা। ছেলেটা পাগল, কে জানি এখনও ছাঁদে আছে কি-না! আনমনেই চাঁদনীর ভীষণ চিন্তা হলো। শরীরে ওড়না জড়িয়ে সাবধানী পায়ে বেরিয়ে গেলো ঘর ছেড়ে। সিঁড়ি বেয়ে ছাঁদে ওঠেই হাতে থাকা ছাতাটা মেলে ধরলো মাথার উপর। বৃষ্টি হওয়ায় ছাঁদের বাতিও বন্ধ। অন্ধকারে চাঁদনী প্রায় কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক চাইলো। বার কয়েক ডাকলো ছেলেটার নাম ধরে অথচ কোনো সাড়াশব্দ নেই! চাঁদনী ভাবলো হয়তো ছেলেটা চলে গেছে। যেই না সে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াবে তখনই পুরো পৃথিবী আলোকিত করে যেন সোনার কাঠি আদুরে ভাবে তার রূপ এঁকে দিলো আকাশের বুকে। সে আলোয় দেখা গেল ভিজতে থাকা সিক্ত মৃন্ময়ের মুখ। চাঁদনী প্রথমে কিছুটা চমকে গেলেও পরে এগিয়ে গেলো তার দিকে। ছাঁদের লাইটটাও জ্বালিয়ে দিলো কিন্তু আলো খুবই নিভু নিভু। চাঁদনী এগিয়ে গিয়ে বেশ গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“এত রাতে এখানে কী? বে য়া দ বীর সীমা ছাড়াচ্ছো।”

“ভালোবাসা বেয়াদবী হলে আমি হাসিমুখে হাজার বার বেয়াদব হতে রাজি।”

মৃন্ময়ের কণ্ঠ অনেকটা বসে গেছে। কথা গুলো কেমন ভাঙা ভাঙা শোনালো। চাঁদনী ধমক দিল,
“এতটুকু একটা ছেলে কি-না প্রেম নিয়ে পড়েছে। যাও বাড়ি।”

“এই নিন ওষুধ, জানি ঠান্ডা লাগবে আপনার কিন্তু আপনি ওষুধ খাবেন না, তাই নিয়ে এলাম। এক্ষুণি খাবেন এটা তারপর আমি যাবো।”

মৃন্ময়ের কথায় তাজ্জব চাঁদনী। ছেলেটা তাকে ওষুধ খাওয়ানোর জন্য এখানে এসেছে! এতটা পা গ ল! চাঁদনীর চোখ ভরে জল এলো। বৃষ্টির জল থেকে সে জল আলাদা করার উপায় নেই তার উপর আঁধার। কিন্তু ছেলেটা কেমন যেন বুঝে গেল! অসহায় কণ্ঠে বলল,
“আমি আরও চ ড় খেতে রাজি, তবুও কাঁদবেন না।”

চাঁদনী দ্বিতীয়বারের মতন অবাক হলো। ছেলেটা এমন কেন! এই ছেলেটার জন্য আজ তার নিজেকে ভাগ্যবতী লাগছে। কত ভাগ্য করেই না এসেছে সে! নাহয় এমন একটা পা গ ল ছেলের সাথে পরিচয় হতো আদৌ! চাঁদনী ভীষণ স্নেহে মৃন্ময়ের বড়ো বড়ো চুল গুলো এলোমেলো করে দিলো। ছাঁদের হলুদ বাল্বটায় বড্ড স্নিগ্ধ দেখালো সে দৃশ্য।

_

রাত ভীষণ অন্যরকম যাওয়ার পরেই আজ সওদাগর বাড়িতে উলোটপালোট করা একটা দিন এলো। বাড়ির বড়ো মেয়ের নামে রটলো ভীষণ বাজে কথা। তাদের সোসাইটির ফেসবুক গ্রুপে ভাইরাল হলো একটা ছবি। যে ছবিতে সওদাগর বাড়ির বড়ো মেয়ের মুখ স্পষ্ট অথচ ছেলেটার কেবল পিঠ দেখা যাচ্ছে। সওদাগর পরিবার সকালেই ছুটে আসে শহরে। মেয়ের এমন কলঙ্কে দিক ভ্রষ্ট তারা। অথচ চাঁদনী তখনও কিছু জানেনা। দৈনন্দিন কাজের স্রোতে ছুটে গিয়েছে অফিস।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here