#প্রেমোত্তাপ
#মম_সাহা
১৩.
বাহিরে তুমুল বর্ষণ। বৃষ্টির নৃত্যে প্রকৃতি মুগ্ধ। হলুদ আলোয় জ্বলজ্বল করছে মায়াবী মুখখানি যা পুরুষের সুঠাম হাতের কবলে নিত্যান্তই নিষ্পাপ দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে দু’হাতের আঁজলে যেন ফুটন্ত পদ্ম। কন্যার চক্ষু প্রায় নিভু নিভু। শরীর থেকে অসহনীয় একটা উত্তাপ বের হচ্ছে। সেই তাপেই ঘোর নেমেছে চোখে। মস্তিষ্ক ফাঁকা অনুভব হচ্ছে। প্রেমিকের চিত্ত তা দেখে উন্মাদ প্রায়। ছটফটিয়ে উঠছে প্রেম পায়রা। চিন্তিত চেহারায় কয়েক ভাঁজ পড়লো। আলতো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“ঠিক আছো রঙ্গনা! ভীষণ জ্বর তো শরীরে।”
“শরীরের উত্তাপ দেখছেন আর মনের উত্তাপ লাগছে না বুঝি? ওটা ছুঁয়ে দেখা যায় না বলে কী ব্যাথা কম না তাপ কম? শুনি?”
চিত্রার বেসামাল কথায় বাহারের চিন্তা বাড়লো। গালে কোমল ভাবে ছুঁয়ে বলল,
“ভেতরে আসো দ্রুত। এত জ্বর নিয়ে ভিজেছো কেন? আর এত রাতে এখানে এসেছোই বা কীভাবে? ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ঢাকার পথ তো অনেক! অনেক দূরত্ব রাস্তার।”
“দূরত্বের চেয়ে গুরুত্ব বেশি ভূমিকা রেখেছে। তাই তো দূরের পথও ব্যাপার নয়।”
চিত্রার কণ্ঠস্বর প্রায় জড়িয়ে আসছে। বাহার যখন অথৈয় ভাবনায় দিক ভ্রষ্ট তখনই চিত্রার পাশে এসে উপস্থিত হলো চিত্রার বটবৃক্ষের ন্যায় বড়ো ভাই- তুহিন। তার চোখে-মুখেও একটা চিন্তা লেপটানো। বাহার অবাক হলো তুহিনকে পাশে দেখে। প্রায় বিস্মিত কণ্ঠেই বলল,
“তুহিন, তুমি এসেছো! তোমরা সবাই কী চলে এসেছো? আর এত রাতে চলে আসার কারণ কী? কোনো সমস্যা হয়েছে?”
“সমস্যা তো আপনার সামনেই দাঁড়ানো, বাহার ভাই। ওর জন্যই তো এত রাতে আমার ফিরতে হলো এখানে।”
তুহিনের কথায় ভ্রু কুঁচকালো বাহার। সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকালো চিত্রার পানে। কিছুটা সংশয় নিয়েই বলল,
“মেয়েটার তো জ্বর শরীরে। তার উপর ভিজেছে। কী বাজে অবস্থা ওর। লাল হয়ে গেছে মুখটা। কি এমন হয়েছে যে এই রাতে ফিরলে?”
বাহারের কথায় তুহিন তপ্ত একটা শ্বাস ফেলল। প্রায় অপরাধীর মতন মাথা নিচু করে বলল,
“দোষ অবশ্য আমারই। সেদিন বনফুলের সাথে এত খারাপ আচরণ করে একবারও জানতে চাইলাম না মেয়েটার অবস্থা কী। অবশ্য সুযোগই পেলাম না। সেদিন রাতেই দাদীর গুরুতর অবস্থা শুনে ছুটে গেলাম সেখানে। গতকাল খাবার টেবিলে চিত্রা আর চাঁদনী আপু হুট করে বলছে চিত্রার নাকি পরীক্ষা সে ঢাকায় আসবে। কিন্তু দাদীকে তো চেনেনই, বড্ড কঠোর। সে চিত্রাকে আসতে দিবে না। তারপরই বিকেল থেকে মেয়েটার জ্বর। ধীরে ধীরে জ্বর বাড়তে লাগলো। সেই গ্রামের বাড়িতে রাত একটা বাজে ডাক্তার ডাকা হলো। চিত্রা বেহুঁশ অবস্থায় কেবল বলছিল, ঢাকা আসবে। ডাক্তার জানালেন জ্বরটা ঋতু ভিত্তিক না, অতিরিক চিন্তার ফলে মস্তিষ্কে প্রেশার পড়াতে এই জ্বরের সৃষ্টি। ডাক্তার ওষুধ দিলেন কিন্তু জ্বর কমার নাম নেই। আজ সারাদিন সে কোনো খাবার মুখে তুলেনি। তার এক আবদার, সে বাসায় আসবে। কিন্তু দাদী এক কথার মানুষ, সে চিত্রাকে এ অবস্থায় কোনো রকমে ঢাকায় আসতে দিবেনা। অতঃপর আমি আর না পেরে তাকে আশ্বাস দিলাম আমি নিয়ে আসবো ওরে। সবাই যখন রাতের খাবার খেয়ে ঘুমালো তখন ওরে নিয়ে রওনা হলাম সাথে চাঁদনি আপুও আসছে। তিনজন কাউকে না বলে চলে আসলাম। কাল একটা তুলকালাম হবে হয়তো। মেয়েটা বকাও খাবে। কিন্তু ওর জেদের কাছে আমরা পরাজিত। ও নাকি বনফুলকে যে কোনো মূল্যে দেখবে। নাহয় শান্তি পাবেনা।”
বাহার দাঁড়িয়ে সবটা শুনলো। চিত্রাও বাহারের হাতটা আঁকড়ে ধরে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো। তন্মধ্যেই দক্ষিণ দিকের একটা ঘর থেকে বেরিয়ে এলো বনফুল। দু’দিনেই মেয়েটার লাবণ্য কমে গিয়েছে শতগুণ। চোখের নিচে দেখা দিয়েছে ক্লান্তির চিহ্ন, ডান হাতের মাঝে ব্যান্ডেজের ছোঁয়া যেন বুঝিয়ে দিলো মেয়েটার ভেঙে পড়ার মাপকাঠি। চিত্রা চোখ তুলে তাকালো, চোখ উপচে আসছে তার অবাধ্য অশ্রুরা। সে আর অপেক্ষা করলো না, ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো বনফুলকে। বাচ্চাদের মতন মুহূর্তেই কেঁদে দিলো সে। বনফুল নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো দরজার সামনে দাঁড়ানো সুঠামদেহী প্রিয় পুরুষের দিকে। বাহার খেয়াল করলো বোনের দৃষ্টি। মেয়েটা তো এ দুদিন উন্মাদের মতন করেছিল, আজও না আবার তেমন কিছু করে বসে! গা হীম হয়ে আসে তার। চিত্রার সাথে না আবার হিংস্রতা দেখিয়ে ফেলে! মেয়েটা যে তাহলে মানতে পারবে না। বনফুলকে চিত্রা কতটা ভালোবাসে তা কারোই অজানা নয়।
বাহারকে অবাক করে দিয়ে বনফুল চিত্রাকে জড়িয়ে ধরলো। মিষ্টি হেসে বলল,
“কাঁদছিস কেন চিতাবাঘ? কী হয়েছে তোর?”
চিত্রা আরও শক্ত করে বনফুলকে জড়িয়ে ধরলো। কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটার কণ্ঠ জড়িয়ে এলো। অস্পষ্ট স্বরে বলল,
“বনফুল, তুই আমায় ক্ষমা করেছিস তো?”
“ক্ষমার কথা আসছে কোথা থেকে চিতাবাঘ? তোর সাথে কী আমার সেই সম্পর্ক?”
চিত্রা মাথা তুললো। বনফুলের ব্যান্ডেজ করা হাতটা আলতো ছুঁয়ে দিলো। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললো,
“তোর হাতে ব্যান্ডেজ কেন, বনফুল? কী হয়েছে তোর?”
চিত্রার প্রশ্ন পুরোপুরি এড়িয়ে গেল বনফুল,
“তোর শরীর তো মারাত্মক গরম, চিতাবাঘ? শীতে কাঁপছিস। এই অবস্থা কেন শরীরে!”
চিত্রা উত্তর দিতে পারলো না। তার আগেই শরীরের ভার ছেড়ে দিলো। বনফুল শক্ত হাতে আগলে ধরলো মেয়েটাকে। ছুটে এলো বাহার আর তুহিনও। বোনকে জাপটে ধরলো ভাই পরম যত্নে। ক্রমশ উত্তেজিত কণ্ঠে বলল,
“চিত্রা, এই চিত্রা, কী হয়েছে তোর? কী হলো তোর? চিত্রা, শোন বাবু, কি হয়েছে তোর? ভাইকে বল।”
চিত্রা ততক্ষণে কথা বলার ক্ষমতা হারিয়েছে। জ্ঞান নেই এক ফোঁটাও। এত হৈচৈ শুনে ছুটে এলেন বাহারের মা আয়েশা খাতুন। চিত্রা আর তুহিনকে দেখেই আয়েশা খাতুনের মুখ গম্ভীর হয়ে গেলো কিন্তু চিন্তার একটা স্বচ্ছ রেখা গেল তার মুখ জুড়ে। সে ছুটে এলেন চিত্রার কাছে। চিত্রার গালে ছোটো চ ড় দিয়ে বার কয়েক ডাকলেনও মেয়েটাকে। কিন্তু ওর হুশ নেই। আয়েশা খাতুন ছুটে পানি নিয়ে এলেন কয়েক বার চোখ মুখে ছিটালেনও। তবুও ভাবান্তর ঘটেনা মেয়েটার। আয়েশা খাতুন গম্ভীর স্বরে বলে,
“ওকে ওর বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ডাক্তার ডাকো। ভীষণ জ্বর তো শরীরে।”
_
তুমুল বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে আছে চাঁদনী। তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে মৃন্ময়। ছেলেটার চোখ মুখ শুকিয়ে আছে। কতক্ষণ যাবতই এভাবে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু বলছেও না আবার চাঁদনীকেও যেতে দিচ্ছেনা। এক পর্যায়ে বিরক্ত হলো চাঁদনী, কিছুটা ধমকে বললো,
“মৃন্ময় সমস্যা কী তোমার? এত রাতে রাস্তাতে কী তোমার? আর পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
“আপনাকে আগলাতে পারছি না বলেই পথ আগলাচ্ছি।”
“উল্টোপাল্টা কথা বলে চ ড় খেও না মৃন্ময়।”
“সোজা কথা বলবো?”
“হ্যাঁ বলো।”
মৃন্ময় কিছুক্ষণ সময় নিয়ে হুট করে বললো,“ভাইয়ার মতন আমায় ভালোবাসবেন?”
কথা শেষ করতেই চাঁদনী সশব্দে একটা চ ড় বসিয়ে দিলো ছেলেটার গালে।
#চলবে