#প্রেমোত্তাপ #মম_সাহা ১২.

#প্রেমোত্তাপ
#মম_সাহা

১২.

ফোনের অপর পাশ থেকে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পরও চিত্রা ফোনটা নিজের কানেই ধরে রাখলো। তার কর্ণে কেবল প্রতিধ্বনিত হলো একটি কথা “ভালো আর রাখলে কই”! অষ্টাদশীর মনে প্রশ্নদের হামাগুড়ি, সত্যিই কী সে ভালো রাখেনি? অথচ যা ঘটেছে তা তো তার হাতের বাহিরে ছিলো তবে বাহার ভাইয়ের অভিযোগ তার উপর কেন? সে তো ভালো রাখতে চেয়েছিল কিন্তু সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছে ছিলো অন্যরকম। তাতে সেই-বা কী করতে পারে! অথচ বাহার ভাইটা তার কথা শুনলে তো! বাহার ভাই তো নিজের অভিযোগের ছড়া শুনিয়েই বিচ্ছিন্ন হলো কল থেকে। চিত্রার অসহায়ত্বের কবিতাখানা আর পাঠ করতে দিলো কই!

চিত্রা তপ্ত শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো পুকুরপাড়ের ঘাট হতে। এই গ্রামে তার মোটেও মন টিকছে না। অথচ গ্রাম তার প্রিয় একটি জায়গা। তখন দুপুরের কড়া রোদে তার শরীরে ম্লান আলো ছড়াচ্ছে। চিত্রা হেলতে দুলতে পুরোনো রাজকীয় বাড়িটায় প্রবেশ করলো। উঠোনের মাঝখানে বিরাট একটা বটগাছ আছে যা মার্বেল পাথর দিয়ে খোদাই করা। চকচক করছে। দেখে বুঝাই যাচ্ছে নিয়মিত এটা পরিচর্যা করা হয়। পরিচর্যা করাটাও স্বাভাবিক। দাদী যেমন কঠোর ও পরিষ্কার মানুষ, সে অপরিষ্কার জিনিস কখনোই পছন্দ করবেন না। চিত্রা মার্বেল পাথরে খোদাই করা বসার জায়গাটাই গিয়ে বসলো। মনের মাঝে আকাশ-পাতাল ভাবনা নিয়ে পা দুলাতে লাগলো। দুপুরের রোদের মাঝে কিছু মিঠে বাতাসও এসে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে তার শরীর। খারাপ লাগছে না। আবহাওয়াটা আরামদায়ক। এই আবহাওয়ায় খারাপ করে থাকা যায় না। দুপুরের সকল রোদ যেন শুষে নিয়ে যায় দুঃখ।

“এই, তুমি এখানে বসে আছো কেন ভরদুপুরে?”

দাদীর গম্ভীর কণ্ঠে চিত্রার ভাবুক সত্তা কেঁপে উঠলো। আমতা-আমতা করে বলল,
“আসলে ঘুম আসছিল না তো, তাই আরকি….”

“তাই আরকি ভূতের মতন এখন বসে আছো! তোমার কী ক্লান্তি টান্তি লাগে না? সারারাত জেগে এতদূর এলে। ঘুম কী নেই? তোমাদের বাড়িতে যখনই কথা হতো তখনই তো শুনতাম তুমি কুম্ভকর্ণের মতন ঘুমাচ্ছো তবে এখানে ঘুমাচ্ছো না কেন?”

চিত্রা উত্তর দিলো না বৃদ্ধার কথায়। আসলে সচারাচর এমনই হয়, আমরা যাদের পছন্দ করিনা তাদের কোনো ভালো কথাও আমাদের ভালো লাগে না আর ঠেস মারা কথা তো মনে হয় শরীর জ্বালিয়ে দেয়। কিন্তু দাদী বয়সে অনেক বড়ো দেখে হজম করতে হয় সে কথা।

চিত্রার নিরবতার মাঝেই আনোয়ারা সওদাগর আবার বললেন,
“যাও ঘরে। দেশ গ্রামে ভূতের অভাব নেই যে তোমাকে সে দায়িত্ব নিতে হবে। চুপচাপ গিয়ে ঘুমাও।”

চিত্রা আরও কিছু বলতো কিন্তু থেমে গেলো। দাদীর সাথে কথা বলা মানেই এক কথায় দু’কথা, দু’কথায় তিন কথা করে কথা বাড়বে। এরচেয়ে নিরবতা শ্রেয়।

_

চিত্রা রুমে ঢুকতেই দেখে সকলেই ঘুমে নিমজ্জিত। কেবল জেগে আছে চাঁদনী আপা। খোলা বারান্দার গ্রিল চেপে বাহিরে তাকিয়ে আছে। নাকটা লাল হয়ে আছে। নিশ্চয় কেঁদেছিল। বড় আপার আর কী কাজ! কান্না ছাড়া সে কোনো কাজই করতে পারেনা যেন!

চিত্রা ঘরময় পায়চারী করল। বাহার ভাই কল কেটে দিয়েছে দ্রুত যার কারণে সে জিজ্ঞেসই করতে পারেনি যে বনফুল ঠিক আছে কিনা! অথচ তার ভেতর ভেতর চিন্তায় হাহাকার করছে। বিরক্তিতে তেঁতো অনুভব হচ্ছে অনুভূতি।

চিত্রার পায়চারীতে চাঁদনী আপাও স্থির হয়। কপাল কুঁচকে প্রশ্ন ছুঁড়ে,
“এই চিতাবাঘ, এমন ঘরের মাঝে ছুটোছুটি কেন করছিস? কী সমস্যা?”

চিত্রা থামলো। অসহায় চোখে তাকালো আপার দিকে। তার এখন ভীষণ কান্না পাচ্ছে। এমন নাস্তানাবুদ ধরণের পরিস্থিতে সে কখনো পড়েনি। তাই জানা নেই এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায়। তার উপর চিন্তারা পেয়ে বসেছে আহ্লাদ। এবার বোধহয় বুক ভার করে জমেছে কান্না।

চাঁদনী বোধহয় বুঝলো তার বোন কিছু নিয়ে ভীষণ টানাপোড়েনে আছে তাই নিজেই এগিয়ে এলো বোনের কাছে। আশ্বস্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“কী হয়েছে আমার চিতাবাঘের? তার এত চিন্তা কিসের শুনি?”

চিত্রা এবার হামলে পড়ল এই ভরসার বক্ষস্থলে। চোখের জমিয়ে রাখা এতক্ষণের অশ্রু গঙ্গা বাঁধ ভেঙে ফেলল। অসহায় ও ক্রন্দনরত কণ্ঠে বলল,
“জানো আপা, কাল যখন এখান থেকে ফোন গেলো? তার কিছুক্ষণ আগেই বাহার ভাইদের বাড়ি থেকে আমি একটা এম্বুলেন্স বের হতে দেখেছিলাম। কিন্তু সেটা নিয়ে কিছু বলার আগেই দাদীর এমন ঘটনার কথা শুনলাম যে পরিস্থিতি হাতের বাহিরে চলে গেলো। আজ বনফুলকে কল দিলাম ধরলো বাহার ভাই। কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ব্যস্ত ভঙ্গিতে কেটে দিলো। আমার মনে হচ্ছে বিরাট গড়বড় হয়ে গেছে। আমি কী করবো, আপা!”

চিত্রার দীর্ঘ কথায় চাঁদনীর কপাল কুঁচকে এলো। চিন্তা নামক রোগটা কিছুটা সংক্রামিত। এটা একজনের মস্তিষ্ক থেকে খুব দ্রুতই আরেকজনের মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়ে। আর সেই নীতি মোতাবেক রোগটা ছুঁয়ে ফেললো চাঁদনীকে। সে হতবিহ্বল হয়ে বলল,
“তুই এত বড়ো ঘটনা এখন বলছিস, চিত্রা? কী সর্বনাশ কাহিনী হয়ে গিয়েছে আর তুই এতক্ষণ মুখে কুলুপ এঁটে ছিলিস? এটা ঠিক করিসনি।”

চাঁদনী আপার কথায় চিত্রার অপরাধবোধ যেন বেড়ে গেল তড়তড় করে। কান্নার দাপটও বাড়লো। নিস্তব্ধ কান্নারা এখন শব্দ ছুলো। চাঁদনী দ্রুত মুখ চেপে ধরলো চিত্রার। সাবধানী কণ্ঠে বলল,
“আস্তে আস্তে, চিতাবাঘ! অহি, চেরি ঘুমাচ্ছে। একবার যদি দাদী জানতে পারে তুই তোর বান্ধবীর জন্য হাউমাউ করে কাঁদছিস কী হবে ভাবতে পারিস? হৈচৈ করিস না। হৈচৈ করলে ঝামেলা বাড়বে।”

চিত্রা বহু কষ্ট করে কান্নাদের শব্দগুলো গিলে ফেলল। দু’হাতে চেপে ধরলো মুখ। যেন সেও চায় ঝামেলামুক্ত ভাবে একটা সমাধান। চাঁদনী চিত্রার অসহায়ত্ব দেখে ভরসা দিলো। আশ্বাস দিলো সে কিছু করবে।

_

দুপুরের খাবার টেবিলে জমেছে ভীড়। সওদাগর বাড়ির সকলে একসাথে খেতে বসেছে। এত মানুষ একসাথে বসার পরও কোনো রকমের টু শব্দ অব্দি হচ্ছে না। কেবল শোনা যাচ্ছে বাসনপত্রের খুটখাট শব্দ। একসাথেই খেতে বসেছে সব। খাবার বেড়ে দিচ্ছে বাড়ির কাজের মানুষেরা। চিত্রার খাবার ঠিক যেন গলা দিয়ে নামছে না। এক চিন্তা তার ভেতরে অসহ্য যন্ত্রণা দিচ্ছে। খালি চোখে ভেসে উঠছে বনফুলের মুখটা। কী স্নিগ্ধ, সহজ সরল সেই মুখমন্ডল! সদা হাস্যোজ্জ্বল মেয়ে সে বনফুল! আর এই বনফুলই না-কি গতকাল এমন বিরাট একটা কাজ করে বসেছে! ভালোবাসার মানুষটাকে পাবেনা বলে হাউমাউ করে কেঁদেছে! বিনা কারণে লজ্জায় নুইয়ে থাকা বনফুল কিনা নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে পাওয়ার লোভে বেহায়া, নির্লজ্জ কথা শুনেছে! মানুষ কী না করে একটু ভালোবাসার জন্য! আহারে ভালোবাসা!

চিত্রার চিন্তিত মুখমন্ডল দৃষ্টিগোচর হয়না চাঁদনীর। সাথে সাথে মাথায় আসে বনফুলের ভাবনাও। অতঃপর হাজার দোনোমোনো নিয়ে নিজের বাবা আফজাল সওদাগরকে শুধায়,
“আব্বু, আমরা বাড়ি ফিরবো কবে?”

খাবার পাতে দীর্ঘ নিরবতার সমাপ্তি ঘটলো। সকলে চোখ তুলে তাকালো বনফুলের দিকে। আনোয়ারা সওদাগর পছন্দ করেনা খাবার পাতে কেউ কথা বলুক। অথচ বোনের জন্য চাঁদনী সেই অপছন্দের কাজটাও করলো। সাথে সাথেই দাদীর তীক্ষ্ণ বাণও ভেসে এলো,
“কেন? এটা কী বাড়ি না? বটতলা?”

চাঁদনী থেমে গেলো। দাদী যে এমন কোনো কথা বলবে তা তার আগেই জানা ছিলো। তবুও ভেতর ভেতর একটু লজ্জা ও অপমানও বোধ করলো। চাঁদনী আপার নতজানু মুখটা দেখে মায়া হলো চিত্রার। অতঃপর বোনের পক্ষ ধরে সে বলল,
“দাদী আমিই আপাকে এটা জিজ্ঞেস করতে বলেছিলাম। আসলে কলেজে পরীক্ষার নোটিশ দিয়েছে তো তাই।”

আনোয়ারা সওদাগর কঠিন দৃষ্টিতে তাকালেন চিত্রার দিকে। তাচ্ছিল্য করে বলল,
“এখনও মানুষ হলেনা।”

ব্যস্! চিত্রার ও চাঁদনীর সকল সাজানো কথা মালার উপর পানি ঢেলে দিলো এই মহিলা। চিত্রা বলতে পারলো না তার অন্তর জ্বলে যাওয়ার কথা।

_

বাহিরে তুমুল বৃষ্টি। বনফুলদের ছোটো দু’তালা বাড়িটা অঝোর বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে ক্লান্ত। বাড়ির ভেতরে আজ তত আলো জ্বলানো নেই। করুণ স্বরে কাঁদছে যেন কেউ। সময়টা রাতের দ্বিপ্রহর। ছাঁদ থেকে আবার ভেসে আসছে গিটারের সুর। বৃষ্টির মাঝেও বাড়ির বেপরোয়া ছেলেটা নিজের পছন্দের কাজটা করছে বোধহয়। বাড়ির বাহিরের হলুদ বাল্বটা আজ বন্ধ।

এই মধ্যরাত্তিরে আঁধারের সকল গম্ভীরতা ভেদ করে বাড়ির কলিংবেলটা বেজে উঠলো। খুব ব্যস্ত গতিতে পর পর কয়েকবার বাজলো। দরজার ওপাশের মানুষটা বোধহয় বড্ড অধৈর্য। সেই শব্দে ছাঁদ থেকে ছুটে এলো এলোমেলো মানুষটা। আঁধার হাতড়ে দরজা খুলতেই আবছা এক মেয়েলী অবয়ব ভেসে এলো। বাহার সেই অবয়বকে স্বচ্ছ করার জন্য বাহিরের আলো জ্বালালো। হলুদ আলো পড়তেই সিক্ত নারী দেহখানা চোখে ভেসে উঠলো। হলুদ আলোয় অষ্টাদশীর গোল মুখটা চকচক করে উঠতেই বাহার চমকালো। মেয়েটার চোখ লাল টকটকে হয়ে আছে। বাহার বিচলিত হলো। মেয়েটার কপালে ব্যস্ত হয়ে হাত ছোঁয়াতেই চমকে উঠলো বাহার। অবাক কণ্ঠে বলল,
“এই মেয়ে, এত জ্বর কেন শরীরে? আর এত রাতে কোথা থেকে এলে? তুমি না কাল গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলে? কাঁপছো কেন রঙনা? কি হয়েছে তোমার?”

বাহারের বিচলিত কণ্ঠের বিপরীতে অষ্টাদশী নির্বাক। তার আকাশ ছোঁয়া অসুখ যেন মুহূর্তেই ভালো হয়ে গেলো। কাউকে দেখার অসুখ যে পৃথিবীর দীর্ঘতম অসুখ। জ্বর নিয়ে বাঁচা গেলেও সে অসুখ নিয়ে বাঁচা যায় আদৌও?

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here