#ধারাবাহিক_উপন্যাস
#ইতির_সংসার
পর্ব ২৬
ডাক্তার ওটি থেকে বেরিয়ে নাঈমের কাঁধে হাত রেখে বলেন -“সরি আমরা কোনভাবেই ব্লি/ডিং বন্ধ করতে পারিনি। বাধ্য হয়ে ইতির জরায়ু ফেলে দিতে হয়েছে। কিন্তু যেহেতু প্রচুর র/ক্ত গেছে সেহেতু ওর হিমোগ্লোবিন লেভেল অনেক কম। জরুরি ভিত্তিতে অন্তত দুই ব্যাগ দিতে হবে।”
-“ইতির সাথে দেখা করতে পারব?” জানতে চায় নাঈম।
-“হ্যাঁ, একটু পরে ওকে আবারও পোস্ট অপারেটিভে দেয়া হবে। তবে সাবধান, ইতি যেন আর উত্তেজিত না হয় সেটা খেয়াল রাখতে হবে। তাড়াতাড়ি ডোনার যোগাড় করুন প্লিজ।” বলে ডাক্তার চলে যায়।
নাঈম যায় ডোনার খুঁজতে। এদিকে ইতির কেবিনে আরেক ঝড় উঠেছে। খাদিজা বেগম নাঈমকে কল দিয়ে ডোনার যোগাড় করার কথা শুনে বলেন -“আমি তোমার আংকেলকে জানিয়ে দিচ্ছি। উনার কলিগদের কয়জন আছে রেগুলার ডোনেট করে। তুমি এখানে আসো, জরুরি কথা আছে।” ফোন রেখে তুলিকে বলেন -“একটু আগে আমাকে যা যা বলেছ সব নাঈমের সামনে বলবে তুমি নিজমুখে নইলে আমি যা রেকর্ড করেছি তা মুরাদের কাছে পাঠিয়ে দেব।”
নাঈম কেবিনে ফিরে আসে। খাদিজা বেগম তুলির হাত ধরে নাঈমের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলেন -“এখন বল সেদিন যা যা হয়েছিল। মিথ্যে বললে আমার শুধুমাত্র দুইটা আংগুলের স্পর্শ লাগবে সেটা তুমি জানো।”
তুলি মাথা নিচু করে বলে -“সেদিন তুমি অফিসে যাওয়ার পরে ট্যাপ ছেড়ে সব পানি বের করে দেই। মেশিনের মধ্যে একটা প্লাস্টিকের বোতলের ক্যাপ ফেলে দেই, রোটরে গিয়ে আটকে যায়, পানি তোলা যায়না। কলপাড়ের আধলাগুলোও আমি নড়বড়ে করে পানি ঢেলে দিছিলাম। সবকিছুই করছি মার সামনে দাঁড়িয়ে, মার পরামর্শে। তোমার বাবু হলে তুমি যদি মা-বাবাকে না দেখ সেইজন্য মা বলছে তোমার বাবু হওয়া যাবেনা। ”
-“উফ আমি আর সহ্য করতে পারছিনা। থাম তুই থাম। তুই কি সেই তুলি যাকে আমি সন্তানের মতো ভালোবাসি। যার সুখের জন্য আমি দিনরাত খেটে গেছি। তোকে যে পরামর্শ দিয়েছে সে কি আমার সেই মা যাকে আমি আমার আয়ের সমস্ত টাকা হাতে তুলে দিয়েছি, কোনদিন শখ করে নিজের জন্য কিছু কেনা তো দূরে থাক ইতিকেও পর্যন্ত কিছু দেইনি। আমি এ মুখ কাকে দেখাবো? আমার মা-বোন আমার সন্তানের খু/নী। এ কেমন মায়ের পেটে আমি জন্ম নিয়েছি আল্লাহ। এসব শোনার আগে তুমি আমাকে উঠিয়ে নিলা না কেন আল্লাহ। আর তো সহ্য করতে পারছিনা আমি। তোরা দুজন আর কখনো আমার সামনে আসবিনা। আমার সন্তানের হত্যাকারীদের মুখও আমি দেখতে চাইনা।” হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে নাঈম।
নাঈমের বাবা ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করেন। খাদিজা বেগম তুলিকে নিয়ে বাইরে গিয়ে বলেন -“এমন একটা খু/নী মেয়েকে আমার ছেলে বিয়ে করল? জানিনা কবে তুমি আমাদেরও খুন কর। আমি আর তোমাকে আমার বাসায় নেবনা। মুরাদ দেশে ফিরুক, ওকে সব খুলে বলি। তারপর দেখি ও কি সিদ্ধান্ত নেয়। তবে হ্যাঁ তোমার হাতখরচ আমি বন্ধ করে দেব আপাতত। এর চেয়ে বেশি শা/স্তি এই মুহুর্তে দেবনা শুধুমাত্র তুমি নাঈমের বোন এটা ভেবে। এখন যাও লোক দেখানো ভিজিটর সাজতে হবে না। বাসায় চলে যাও তোমার মায়ের কাছে। মায়ের পরামর্শে এতো কিছু করলা একটাবারেও ভাবলানা এসব আমি তোমার সাথে করলে তুমি কি করতে?”
তুলি বাসায় গিয়ে ওর মাকে সব খুলে বলে। শুনেই রেগে যায় নাজমা বেগম। -“মুখ দেখবেনা বললেই হল? জন্ম দিল কে? পেলেপুষে বড় করল কে? এখন পরের একটা মেয়ের জন্য বলে আমার মুখ দেখবেনা। বললেই হল। আসুক আজ বাসায়।” রাগে গজগজ করতে থাকে।
নাঈম শান্ত হয়ে ওর বাবার হাত ধরে বলে -“আব্বা আমি আর তোমাদের সাথে থাকতে চাচ্ছিনা। ইতিকে নিয়ে আলাদা থাকব। তার মানে এই না যে তোমাদের কোন খরচ দেবনা, সবই দেব কিন্তু একসাথে থাকব না। তোমার স্ত্রীর হাতে আমি আর নগদ টাকাও দিবনা। মাসের জন্য যা যা লাগে সব বাজার করে দেব, টাকা দেব তোমার হাতে। তুমি তোমার মতো করে চালাবে। প্লিজ বাবা আমাকে ক্ষমা কর। যে বাসায় আমার সন্তান খু/ন হয় সেই বাসায় আমি আর ফিরে যাবোনা।”
ইতির মায়ের হাত ধরে বলে নাঈম -“আপনাকে কখনো মা ডাকিনি, কারণ আমি যাকে মা ডাকতাম সে মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিল যে ছেলেদের কখনো শাশুড়িকে মা ডাকতে নেই। আজ আমি আমার এই অপরাধের জন্য ক্ষমা চাচ্ছি মা। ইতিকে রিলিজের পরে আপনার বাসায় নিয়ে যান। আমি যত দ্রুত পারি একটা বাসা দেখে ইতিকে নিয়ে উঠব। এই কয়দিন ও আপনার বাসায় থাকুক। আমি কয়েকদিন কোন বন্ধুর মেসে থাকব, সমস্যা নাই।”
-“কেন মেসে থাকবা বাবা? এইমাত্র তুমি আমাকে মা ডাকলে, আমি থাকতে তুমি কেন মেসে থাকবা? ইতি তোমাকে থাকতে দিবে বল? কোন কথা নাই বাবা, তোমরা দুজনেই আমার কাছে থাকবা।” আত্নবিশ্বাস নিয়ে বলেন ইতির মা। নাঈম উনার কথার ধরনে রাজি হয়ে যায়।
ইতির স্কুলের সবাই খবর পেয়ে ছুটির পরে দেখতে আসে ইতিকে। ওর এক জুনিয়র কলিগ রিয়া বলে -“আপু তোমার আশংকাই সত্য হল দেখছি। জানেন ভাইয়া, ইতিপু প্রায়ই বলত আমার বাচ্চাকে ওরা বাঁচতে দিবেনা। আপনার মা নাকি বলত ছোল পেটত নিয়াই এতো খুশি হলে চলেনা, আগে কোলত নেয়া লাগে। ইশ ইতিপু তুমি কেন আগেই মায়ের বাড়ি গেলেনা বলত? এখন কষ্ট কার হচ্ছে বলত? তোমার শাশুড়ী যে রিনা খান সেটা তো প্রথম দেখেই বলছি। তুমি জন্য এতোকিছু সহ্য করছ, আমি করতাম না বাবা।”
-“এই চুপ রিয়া। কি শুরু করলি? ইতিকে দেখতে আসছিস, ওর শরীরের ভালো মন্দ জিজ্ঞেস কর। অযথা পুরনো কথা তুলে কি লাভ? পাগলি মেয়ে একটা। চুপ কর।” থামিয়ে দেয় একজন।
নাঈম রিয়ার পাশে গিয়ে বলে -“চলেন আপু চা খেতে খেতে আলাপ করি, সবার জন্য চাও নিয়ে আসি।” ইতিকে বলে একটা ফ্ল্যাক্স নিয়ে রিয়াসহ ক্যানটিনে গিয়ে বসে দুই কাপ চায়ের অর্ডার দেয় নাঈম। তারপর জিজ্ঞেস করে -“ইতি কি কি বলেছিল আমাকেও একটু বলবেন প্লিজ। আমার জানা দরকার যে আমার অনুপস্থিতিতে কি কি হয় ইতির সাথে?”
রিয়া প্রথমে ভয় পেয়ে যায়। সব শুনে যদি নাঈম রেগে যায় ইতির উপর এই ভয়ে প্রথমে কিছু বলতে চায়না। কিন্তু নাঈমের বারংবার অনুরোধে বলতে শুরু করে -“ভাইয়া আপনি না থাকলে আন্টি সারাক্ষণ ইতিপুকে শাপশাপান্ত করে। বলে বাচ্চা পেটে আসলেই হয়না, সবাইই বাচ্চার মুখ দেখতে পারেনা। জীবনেও বাচ্চার মুখ দেখবেনা। আমার ছেলে কত সুন্দর আমার হাতের মুঠোয় ছিল সেই ছেলেকে বশ করছে। ছেলেকে আমার পর করে দিছে। সারাক্ষণ ইতিপুকে ডাই/নি করে বলত। ইতিপু মাঝে মাঝে বেশি বকাঝকা করলে স্কুলে মনমরা হয়ে থাকলে আমরা খুব করে ধরলে এসব বলে কান্না করে নিজেকে হালকা করত। আমরা সবাই বলছি মায়ের বাড়ি চলে যেতে। কিন্তু আপনি আপুকে ছাড়া কষ্ট পাবেন বলে যায়নি। কিন্তু সেদিন নাকি খুব বেশি চিল্লাপাল্লা করছে তাই আপু খুব কান্নাকাটি করে বলছিল আমার বাচ্চাকে ওরা বাঁচতে দিবেনা। তখন জাহানারা আপু ইতিপুর মাকে কল দিয়ে বলে উনাকে নিয়ে যেতে। আমরাও অনেক বুঝিয়ে রাজি করাই মায়ের বাড়ি যেতে। কিন্তু যা ভয় করছিল ইতিপু তা তো হয়েই গেল। সরি টু সে নাঈম ভাইয়া আপনি ইতিপুকে অনেক ভালোবাসেন সন্দেহ নাই কিন্তু বিয়ের পর থেকে আপুকে নিরাপত্তা দিতে পারেন নাই। এমনকি প্রেগ্ন্যাসির সময় তার কত কিছু খেতে ইচ্ছে করত, সেগুলোও খেয়াল রাখেননি। ইতিপুকে আমি চিনি ছোট থেকেই। ও নিজে থেকে কখনোই কাউকে কিছু বলে না। বের করে নিতে হয়। আমরা প্রতিদিন জিজ্ঞেস করতাম কি খেতে ইচ্ছে করছে, একেকদিন একেকজন বানিয়ে এনে আপুকে খাওয়াতাম। আমার কথায় কিছু মনে করবেন না ভাইয়া। এরপর আরো ভালো করে খেয়াল রাখবেন প্লিজ।”
সব শুনে নাঈমের মাথা আরো হেঁট হয়ে যায়। কিছুক্ষণ চুপ থেকে চায়ের ফ্ল্যাক্স রিয়ার হাতে দিয়ে বলে -“তুমি কেবিনে যাও, আমি আসছি।”
-“কই যান নাঈম ভাইয়া?” জিজ্ঞেস করে রিয়া।
উত্তর না দিয়ে চলে যায় নাঈম। কিন্তু কোথায়?
চলবে।
©️সৈয়দা রাজিয়া বিল্লাহ
পাঠকের গঠনমূলক মন্তব্য চাই। এই পর্যন্ত আপনাদের কাছে কেমন লাগল জানাবেন প্লিজ। খুব বেশি বাকি নাই আর এই গল্পের।