#ধারাবাহিক_উপন্যাস
#ইতির_সংসার
পর্ব ৬
নাঈম বাসায় ফিরে দরজা খুলে ঢুকেই অবাক হয়ে যায়। সারা উঠোন জুড়ে ছড়িয়ে আছে ইতির কাপড় ও জিনিসপত্র। তাড়াহুড়ো করে নিজেদের রুমে ঢুকে দেখে ঘুর্ণিঝড় বয়ে গেছে ওর ঘরের মধ্যে, ইতির প্রতিটা ব্যবহারের জিনিস নষ্ট করা। দিশেহারা হয়ে যায় নাঈম, কি করবে বুঝতে পারেনা। মাথায় হাত চেপে মেঝেতে বসে পড়ে। নাঈমের ফেরার আওয়াজ পেয়ে দৌড়ে ওর রুমে আসে তুলি। নাঈমকে জড়িয়ে ধরে বলে “ভাইয়া তুমি আসছ? ঐ ডাইনিটা তোমাকে মুক্তি দিছে। আলহামদুলিল্লাহ। সাহস কত আমার আর আমার ভাইয়ের মধ্যে আসে।”
হঠাৎ করে নাঈম তুলির হাত ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে উঠোনে নিয়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। বলে “ইতির সমস্ত কাপড় ধুয়ে শুকিয়ে আগের মতো করে তারপর আমাকে ভাই ডাকবি। তার আগে না।”
নাঈমের কথায় এতো অবাক হয় তুলি যে প্রথমে কথা বলতে পারেনা, কিছুক্ষণ পরে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে চিৎকার করে উঠে “ও মা, মা দেখে যাও ঐ ডাইনিটা কিভাবে তোমার ছেলেকে তাবিজ করছে মা দেখো। তোমার ছেলে কয় আমি নাকি ঐ ডাইনির কাপড় ধুয়ে দিতাম। ও মা এইদিকে আসো, দেখ তোমার ছেলের অধোঃপতন।”
তুলির হাকডাকে নাজমা বেগম এসে দেখেন সে উঠোনে মাটির উপর বসে আছে। মেয়ে যে ইতির কাপড় এভাবে নষ্ট করেছে সেটা উনি আগেই দেখেছেন, কিন্তু কিছু বলেননি। এখন মেয়ের ডাকে এসে দেখেন নাঈম দাঁড়িয়ে। চট করে নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন “ছিহ তুলি, এসব কি? কেবল একটু চোখ লেগে আসছে আর তুই তোর ভাবির কাপড় এভাবে নোংরা করছিস? এটা ঠিক না মা। আচ্ছা তুই উঠে আয় আমি রাহেলাকে ডেকে আনতেছি। ও এসে সব ধুয়ে দিবেনি।”
হাত ধরে তুলিকে তুলতে তুলতে নাঈমকে উদ্দেশ্য করে বলেন “বাবারে রক্ত রক্তই, সেটা ভুলে যাস না। বোন রক্তের, বউ গেলে বউ পাবি কিন্তু বোন গেলে বোন পাবি না রে বাপ। বউ তো আসল মাত্র এক মাস, অথচ দেখ ছোট থেকে বোন তোকে কত ভালোবাসা দিয়েছে, দুই দিনের ভালোবাসা পেয়ে ভুলে যাস না রে বাপ। নে বোনকে ঘরে নিয়ে যা, রক্ত কখনো আলাদা হয়না।”
মা বোনের কথা কখনোই ফেলতে পারেনা নাঈম, তাদের ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলের কাছে বরাবরই অসহায় সে। আর কথা না বাড়িয়ে ঘরে গিয়ে যতদূর সম্ভব ঘরটা গুছিয়ে নেয় সে। কিন্তু গত এক মাসের অভ্যাসে ইতি ছাড়া ঘর অসহ্য লাগে ওর কাছে। ভালো লাগেনা ঘরে, বের হয়ে যায়। বাইরে গিয়ে কল দেয় বন্ধু মুরাদকে। দেখা করতে ডাকে। মুরাদ এসেই নাঈমকে দেখে অবাক হয়ে যায়। গতকাল সন্ধ্যাতেই অফিস শেষে দেখা হয়েছিল অথচ ২৪ ঘন্টা পার হতেই এ কি অবস্থা ওর। কি হয়েছে জানতে চায় মুরাদ। নাঈম ওকে নিয়ে বসে পাশেই পার্কের একটা বেঞ্চে। ডায়াবেটিস রোগীদের সকাল সন্ধ্যা হাঁটাহাঁটি করার সুবিধার্থে পৌরসভা থেকে একটা ছোট পার্কমতো করে দিয়েছে এলাকার মধ্যেই।
নাঈম সেদিনের সব ঘটনা খুলে বলে মুরাদকে। মুরাদের সাথে ওর বন্ধুত্ব যে কত ছোট থেকে সেটা ওরা নিজেরাও বলতে পারেনা। পাশাপাশি বাসায় দুই মাসের ব্যবধানে জন্ম দুজনের। পরে মুরাদের বাবা বাড়ি করে অন্য এলাকায় চলে যান আর নাঈমরা এখানেই থেকে যায় কিন্তু বন্ধুত্বের ভাটা পড়েনা। দুজনেই একমাত্র ছেলে হওয়ায় দুজন দুজনের বন্ধু কম ভাই বেশি। ওরা বলেও যে আমরা দুই মায়ের পেটের দুই ভাই। একে অপরের সাথে দুষ্টুমিও যেমন করে, একে অপরকে বুঝেও তেমন। মুরাদ সব কিছু শুনে চুপ করে থাকে। সে জানে তুলির প্রতি নাঈমের ভালোবাসা অন্ধের পর্যায়ে পরে। এটা ও নাঈমকে বহুবার বুঝিয়েছে কিন্তু নাঈম নিজেকে বুঝাতে পারেনি। তুলি যে অনেকখানি বেয়াদব আর উদ্ধত সেটাও মুরাদ জানে। তাই সবকিছু শুনে কিছুক্ষণ চুপ থেকে পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা করে।
-“ভাবির দেনমোহর যেন কত ধরছিলি?” আচমকা বলে উঠে মুরাদ।
-“পাঁচ লাখ। তারমধ্যে গয়না বাবদ দুই লাখ শোধ করা হয়েছে, আরো তিন লাখ পাবে।” উত্তর দেয় নাঈম।
-“৩ লাখ টাকা দিয়ে ভাবিকে ডিভোর্স দিয়ে দে। তুলির বিয়ের জন্য যে টাকা জমাইছিলি সেটা তো তিন লাখের বেশি হওয়ার কথা, সেখান থেকে টাকাটা দিয়ে ডিভোর্স দিয়ে দে।” নির্বিকার ভাবে বলে মুরাদ।
-“কি বলিস তুই?” চমকে উঠে নাঈম। “ইতিকে ডিভোর্স দেব এসব কি আজেবাজে কথা বলছিস। তোর মাথা ঠিক আছে?”
-“হ্যাঁ আমার মাথা ঠিক আছে, আর সেজন্যই বললাম তুই ভাবিকে ডিভোর্স দে। একটা মেয়েকে বিয়ে করা মানে তার সকল দায়িত্ব নেয়া সেখানে সে একবেলা না খেয়ে থাকে তোর বাসায় এসে এটা তোর জন্য কতখানি লজ্জার তুই বুঝিস? একটা বিবাহিত মেয়ে তার স্বামীর সাথে ঘুমাবে সেটাও নাকি মাঝরাতে তার ননদ এসে চেক করে যাবে, ছিহ, এটা তার জন্য কতখানি কষ্টের তুই বুঝিস? একটা বিবাহিত মেয়ে তার স্বামীর সাথে বাইরে ঘুরতে গেলে ননদ গিয়ে তার বাবা-মাকে অপমান করবে এটা তার জন্য কতখানি কষ্টের তুই বুঝিস? বুঝিস না, তুই শুধু বুঝিস তোর বোন আর তোর মা। আরে, মা আমার নাই? তাই বলে আমি ওদের হাতে নিজের সব কিছু ছেড়ে দিয়ে জড়ভরত হয়ে আছি?” উষ্মার সাথে বলে মুরাদ।
-“আমি কি করব বল? আমি যে মা বা তুলি কিছু বললে উত্তর দিতে পারিনা।” অসহায়ের মতো বলে নাঈম।
-“তাই বলে তুই অন্যের মেয়েকে কষ্ট দিবি? ভেবে দেখতো তোর আচরণও অস্বাভাবিক না? বিয়ের পরে বউ নিয়ে ঘুমাবি তাও বোনের ভয়ে দরজা খুলে, বউকে নিয়ে ঘুরতে যাবি সেখানেও তোর বোনের সমস্যা, তোর বউ এক বেলা রান্না না করলে তার খাওয়া জুটেনা বলি তুই কি বিয়ে করে বউ আনছিস না বুয়া? তুই আগে থেকেই কখনো তুলির অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ করিসনি এতে ও তোর মাথায় এতো বেশি চেপে উঠেছে যে আর নামাতে পারছিস না। তোর এই অক্ষমতার জন্য ভাবিকে কষ্ট দিচ্ছিস কেন? তার চেয়ে ডিভোর্স দে, কিছু দিন পরে আল্লাহ চাইলে কোন পুরুষের সাথে উনার বিয়ে হবে, শান্তিতে সংসার করবে। তুই এখনো নাবালক আছিস, তোর বিয়ের বয়স হয়নি। আদৌ হবে কি না কে জানে।” একটানা বলে থামে মুরাদ।
-“আমি কি করব আমাকে বলে দে প্লিজ দোস্ত। আমি এভাবে আর পারছিনা। তুলি ভুল করছে আমি বুঝতে পারছি কিন্তু আমি ওকে বলতে পারিনা। তুই জানিস বোনটাকে আমি কত ভালোবাসি। এদিকে ইতির সাথেও ন্যায় করতে পারছিনা। আমি কি করব বা আমার কি করা উচিৎ বা আমার জায়গায় তুই থাকলে কি করতি বল।” মুরাদের দিকে তাকিয়ে বলে নাঈম।
-“বললাম তো তোর এখন উচিৎ ভাবিকে ডিভোর্স দেয়া। মুক্তি দে উনাকে কারণ তুই কোনদিনই তুলির অন্যায় চোখে দেখবিনা মাঝখানে কষ্ট পাবে ভাবি। তোদের বিয়ের মাত্র এক মাস। বেশিদিন স্মৃতিও নাই। ভাবি তোকে এই এক মাস পাইছেই কতটুকু? তার চেয়ে এই এক মাসে উনার তিক্ততা বেশি। ডিভোর্স হলে তেমন কষ্ট পাবেন না। সহজেই নতুন জীবন শুরু করতে পারবেন। তুই আবারও আগের মতো ভারবাহী পশুর মতো মুখ বুজে সংসারের ভার বইতে থাকবি। তারপরও রাত বিরেতে বউয়ের দরকার হতে পারে সেক্ষেত্রে সামনের বস্তি থেকে একটা অশিক্ষিত মেয়ে বিয়ে করিস, যে রাতে তোকে খুশি করবে আর দিনে তোর মা বোনের সকল কাজ করে দিবে। আমার পরামর্শ এটাই।” মুরাদ বলে।
-“আমার জায়গায় তুই হলে কি করতি?” জানতে চায় নাঈম।
-“সেইটা জেনে তোর লাভ নাই। তুই জীবনেও তা করতে পারবিনা।”
_”তুই বল তাও। আমার জায়গায় তুই থাকলে কি করতি?”
-“আমি হলে আগে তুলিকে দুই থাপ্পড় দিয়ে শ্বশুর বাড়ি নিয়ে গিয়ে উনাদের কাছে পা ধরে ক্ষমা চাওয়াতাম মুরুব্বিদের সাথে বেয়াদবি করার অপরাধে। তারপর বউ নিয়ে আলাদা বাসায় থাকতাম যেখানে আমার বউ পূর্ণ মর্যাদায় থাকতে পারত। তুই এক কোনটাও পারবি না আমি নিশ্চিত, তোর সেই হ্যাডমই নাই।” কিছুটা উস্কানিমূলকভাবে বলে মুরাদ।
-“ঠিক আছে আমি নিজেই আগে দেখি আমার কতখানি হ্যাডম। যা বাড়ি যা। গুডনাইট।” বলে বাড়ির দিকে পা বাড়ায় নাঈম।
মুরাদ পিছনে বসে ভাবে এইবার যদি ছেলেটার মেরুদণ্ড কিছুটা হলেও শক্ত হয়। দেখা যাক…..
চলবে
©সৈয়দা রাজিয়া বিল্লাহ
পর্ব ৫: https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=1907726152923663&id=100010588903193&mibextid=Nif5oz