ইতির_সংসার পর্ব ৭

0
480

#ধারাবাহিক_উপন্যাস
#ইতির_সংসার
পর্ব ৭
-“আজ তো তোর টিউশনি ছিল না। এতো রাত পর্যন্ত কই ছিলি?” দরজা খুলতে খুলতে বলেন নাজমা বেগম।

-“টাকার যোগাড় করতে গেছিলাম মা।” নিস্পৃহ ভাবেই উত্তর দেয় নাঈম।

-“কিসের টাকা? হঠাৎ?” জিজ্ঞেস করেন নাজমা বেগম।

-“ইতিকে ডিভোর্স দেব মা। ওর মোহরানার বাকি তিন লাখ টাকা তো দিতে হবে। তুলির বিয়ের জন্য যে টাকা জমাচ্ছি তাতে দেড় লাখ টাকা জমেছে। সেটা তুলে নেব আর তুমি বাড়ির জায়গাটা বন্ধক রেখে বাকি দেড় লাখ টাকা দাও। ইতিকে ডিভোর্স দিয়ে ঝামেলামুক্ত হয়ে আবারও তুলির বিয়ের জন্য টাকা জমাবো, তোমার জায়গাও ছাড়িয়ে আনব।” ঘরে ঢুকে বসতে বসতে বলে নাঈম।

-“কি বলিস এসব উল্টাপাল্টা কথা? ইতিকে ডিভোর্স দিবি কেন? মাত্র এক মাস হইছে বিয়ে হয়ে। এইনা ওকে নিয়ে ঘুরতে গেলি খুশিমনে আবার এখন ডিভোর্স দেয়ার কথা বলিস। রাগ উঠছে, মায়ের বাড়ি আছে। রাগ কমলে চলে আসবে। তাই বলে ডিভোর্স দিবি এটা কেমন কথা?”

-“মা, ইতিকে ধরে রেখে কষ্ট দেয়ার চেয়ে ডিভোর্স দেই, বাচ্চাকাচ্চা নাই, মেয়েটা ভবিষ্যতে ভালো ঘর বর পেয়ে জীবনটা গুছিয়ে নিতে পারবে।”

-“ইতি ডিভোর্স চাইছে তোর কাছে? মেয়েটা আর কি কি কথা বলছে আমাদের নামে? সারাদিন বাইরে গিয়ে কানে তাহলে বিষই ঢালছে তাইনা? ফালতু মেয়ে কোথাকার। দেখছে তোর টাকা নাই তাই এখন ঢং করে ডিভোর্স নিতে হবে।”

-“ইতি ডিভোর্স চায়নি। সে ফালতু না মা, ফালতু আমরা। একবার ভাবো তো মা ওর সাথে যা যা হয়েছে এই এক মাসে তা যদি তুলির সাথে ঘটত তাহলে তুমি সহ্য করতে পারতে? না আমি পারতাম?”

-“কি হইছে তোর বউয়ের সাথে? তার কোন পাকাধানে মই দেয়া হইছে বল। এতো বড় কথা বলিস তুই আমার পেটের ছেলে হয়ে। এখন মা, বোনের চেয়ে দুই দিনের আসা পরের মেয়ে আপন হয়ে গেল? এই দিন দেখার জন্য তোকে পেটে ধরছিলাম?”

-“মা, প্লিজ, অযথা কথা অন্যদিকে ঘুরাইওনা। ইতি আপন হয়নি বলেই তো অনায়াসে তাকে ডিভোর্স দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। নইলে তো তোমাদের ছেড়ে ইতিকে নিয়ে আলাদা বাসা নিতাম। একটা দিন আমি বউকে নিয়ে বাইরে গেছি তাতে তোমরা দুজন যে সীন ক্রিয়েট করলা তাতে আমি আমার ভবিষ্যৎ বুঝে গেছি। তার চেয়ে আমি একা থাকি, তোমার ছেলে তুলির ভাই হয়ে থাকি এটাই ভালো। কারো স্বামী হবার যোগ্যতা আমার নাই মা। আমার বউ আমার কামাই করা সত্ত্বেও শুধু দুপুরের রান্না করতে পারেনি জন্য দিনের পর দিন ক্ষুধার কষ্ট সয়ে গেছে অথচ স্বামী হিসেবে আমি জানতামই না কারণ আমি অযোগ্য স্বামী। আমার স্ত্রীর প্রাইভেসি নিশ্চিত করতে পারিনি কারণ আমি অযোগ্য স্বামী। স্ত্রীর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইচ্ছে আমি জানতেও চাইনি কারণ আমি অযোগ্য স্বামী। এতোসব অযোগ্যতা নিয়ে ইতির সামনে দাঁড়িয়ে সব ভুলে ওকে বাসায় আসতে বলার সাহস আমার নাই মা। স্বামী নাহয় নাইবা হলাম। একমাসের স্মৃতি নিয়ে জীবন পার করে দেব ইনশাআল্লাহ। ভাই, ছেলে এই পরিচয়েই বাঁচি মা। এক জীবনে সবাই সবকিছু পায়না মা, আমিও নাহয় না পাওয়ার দলে নাম লিখাইলাম।”

-“কে বলছে তোর বউ না খেয়ে থাকছে? রান্না করার ভয়ে প্রতিদিন ক্যানটিনে খেয়ে আসছে। আজাইরা ঢং। আর কিসের প্রাইভেসি দিতে পারিসনি? সারাদিন কে যায় ওর ঘরে? ও তো ওর মতো একাই থাকে ওর ঘরে, কে যায়?”

-“দিনের কথা বলিনি মা। তুলি গিয়ে গিয়ে চেক করে সেজন্য রাতে রুমের দরজা খুলে ঘুমাতে হয়েছে।”

-“তাতে অসুবিধা কি? তুলি তো ছোট থেকেই অভ্যাস রাতে উঠে তোকে দেখে আসা। এতে সমস্যা কি হইছে? বোন যাবেনা ভাইয়ের ঘরে? বিয়ে করতে না করতেই এতো বদলে গেছিস।”

-“না, মা, কোন সমস্যা নাই। সমস্যা ইতির তাই ওকে ওর পাওনা টাকা দিয়ে বিদায় করে দেই। তোমার গ্রামের জমিটা বন্ধকের ব্যবস্থা কর মা জলদি। আমি পরশু ব্যাংকে গিয়ে FDR ভেঙে টাকা আনতেছি।”

-“কি তখন থেকে টাকা টাকা শুরু করছিস? আমি আমার জমি বন্ধক দেব কেন? তুইই বা তুলির বিয়ের টাকা ভাংবি কেন?”

-“এছাড়া উপায় তো দেখছি না মা। ইতির বাবার গায়ে তুলি যেভাবে হাত তুলেছে তাতে ইতি আর আমার সাথে সংসার করতে আগ্রহী নয়। যদি তুলি গিয়ে উনাদের পা ধরে ক্ষমা চায় তাহলেই কেবল ইতি এই বাড়িতে আসবে। সে অন্যায় কিছু বলেনি তাই আমিও আর কথা বাড়াইনি। কিন্তু তোমার কি মনে হয় তুলি গিয়ে ক্ষমা চাইবে? অবশ্য তুলি যদি ক্ষমা না চায় আর তুমি যদি টাকা না দাও সেক্ষেত্রে ইতিকে নিয়ে আমার আলাদা বাসাতেই উঠতে হবে। সেক্ষেত্রে আমি এখনকার মতো তোমাদের সংসার খরচের টাকা দিতে পারব না কারণ তখন আমার নিজেরই আলাদা সংসার হবে। এখন তুমি আর তুলি মিলে যেভাবে উনাদের অপমান করে আসছ সেভাবে দুজন মিলে সিদ্ধান্ত নাও আমাকে ডিভোর্স দেয়ার জন্য টাকা দিবা নাকি তুলি গিয়ে উনাদের পা ধরে ক্ষমা চেয়ে আসবে নাকি আমি ইতিকে নিয়ে আলাদা বাসায় উঠব। আমি খেয়ে আসছি বাইরে থেকে, এখন শুয়ে পরব। তুমি আর তুলি সিদ্ধান্ত নিয়ে জানাও মা।” বলে নিজের ঘরে গিয়ে দরজায় ছিটকিনি তুলে দিল।

নাঈম ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে শুয়ে পরে। এক মাসের অভ্যাসে আজ ইতি ছাড়া ঘর ফাঁকা লাগে। মাত্র এক মাসেই মেয়েটা মায়ার বাঁধনে বেঁধে ফেলেছে ওকে। আগে প্রতিরাতে বাসায় ফিরে ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে ঢুকে দেখত টেবিলে ভাত ঢাকা দেয়া। হাতমুখ ধুয়ে ক্ষুধা পেটে সেই ঠান্ডা ভাত তরকারি খেয়ে ঘুমিয়ে যেত নাঈম। কিন্তু বিয়ের পরে প্রথম যেদিন কাজ থেকে ফিরে দেখে টেবিলে ওর অপেক্ষায় না খেয়ে বসে আছে ওর বউ, ও হাতমুখ ধুয়ে আসতে আসতে খাবার গরম করে দেয়। এই আলাদা যত্নটুকুর জন্য মনটা কতদিন উন্মুখ হয়ে ছিল, কিন্তু মুখ ফুটে মা কে বলতে পারেনি কারণ উনার বয়স হয়েছে, রাত জাগতে পারবেন না আর তুলি রাত জাগলে ওর চেহারা খারাপ হয়ে যাবে এই অযুহাত দিয়ে নিজেই না করে দিয়েছে অথচ গাধার খাটুনি খেটে মাঝরাতে বাড়ি ফেরা তুলির জন্যই, যাতে ওর বিয়েতে ওর কোন সাধ অপূর্ণ না থাকে। আজ বাড়ি ফিরে খাবার আগলে বউ বসে থাকবেনা তাই সে রাতে খেলোই না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোন হাতে নেয় নাঈম, কল দেয় ইতিকে। কল যায়না। কয়েকবার চেষ্টা করে বিফল হয়ে বুঝতে পারে ইতি ওকে ব্লক করে দিয়েছে। এরপর ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো সবটাতেই চেষ্টা করে দেখে সব জায়গা থেকেই ব্লক করেছে। ইতির মা অর্থাৎ ওর শাশুড়ির ফোনে কল দেয় নাঈম। ওর শাশুড়ী ধরলে সালাম দিয়ে ইতিকে চায়। কিন্তু ইতি জানায় সে কোন নাবালক মেরুদণ্ডহীনের সাথে কথা বলতে ইচ্ছুক না।

পাগল পাগল লাগে নাঈমের। সে মুরাদকে কল দেয়, জানায় ইতি ওকে ব্লক করেছে। কিন্তু ইতির সাথে কথা বলতে না পেরে ওর দমবন্ধ লাগছে। মুরাদ ওকে বুঝায় ইতি অনেক কষ্ট পেয়েছে কারণ মানুষ নিজের অপমানটা সয়ে নিলেও মা বাবার অপমান সইতে পারেনা। সুতরাং নাঈম যদি চায় ইতিকে জীবনে ফিরে পেতে তাহলে অবশ্যই তুলিকে নিয়ে গিয়ে ইতির বাবামায়ের কাছে মাফ চাইতে হবে। নাঈম শংকিত হয়ে যায় এই কথা শুনে কারণ তুলি শুধু জেদি না বেয়াদবও। ও আদৌ ইতির বাবামায়ের কাছে মাফ চাইতে যাবে কিনা সন্দেহ আছে। মুরাদকে এই কথা জানাতেই সে বুদ্ধি দেয় সকালে বের হবার সময় যেন নাঈম নিজে তুলিকে জানায় ওর অপশন। হয় সে ইতির বাবামায়ের কাছে মাফ চাইবে নইলে সে ইতিকে নিয়ে আলাদা বাসায় উঠবে অথবা ওর বিয়ের জন্য জমানো টাকা ভেঙে ইতিকে ডিভোর্স দিয়ে দিবে।

মুরাদ খুব ভালো করেই জানে ওর বন্ধুর মানসিক শক্তি কতদূর। এতোদিন যা করছে করছে কিন্তু এখন সে বিবাহিত, বোনের প্রতি অন্ধ ভালোবাসায় সংসার নষ্ট করার কোন মানেই হয়না। তাই সে নাঈম কথা বলে বাড়ি রওনা দিলে ইতিকে কল দেয়। ওকে বুঝিয়ে বলে ওর সবকিছু থেকে নাঈমকে ব্লক দেয়ায় আর নাঈম কল দিলে যেন কথা না বলে সেটা বলে দেয়। মুরাদ নিশ্চিত ছিল ইতির কাছে এই ধাক্কা পেলে কিছুটা হলেও নাঈম মনে বেপরোয়া সাহস সঞ্চয় করতে পারবে নইলে ওর অন্ধত্ব ঘুচবে না। আর তুলিকে ও যতদূর দেখেছে সে নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছু বুঝেনা। ইতিকে নিয়ে আলাদা বাসায় উঠুক অথবা ওর বিয়ের জন্য জমানো টাকা ভেঙে ইতিকে ডিভোর্স দিক দুইটাতেই তুলির লস, তার চেয়ে মাফ চেয়ে আসা ওর জন্য অনেক সহজ। তারপরও মানুষের মন সম্পর্কে পুরোপুরি বলা মুশকিল।

সামনে বিশাল রাত, মুরাদ-নাঈম-ইতি তিনজনই অপেক্ষায় নতুন একটা ভোরের, তুলির সিদ্ধান্তের। দেখা যাক কি সিদ্ধান্ত নেয় তুলি।
চলবে।
©সৈয়দা রাজিয়া বিল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here