স্বপ্নচারিণী,পর্ব_১৮

স্বপ্নচারিণী,পর্ব_১৮
সামান্তা সিমি

বিকেল হতেই বাড়িতে হৈহৈ ভাব।সকলের চোখেমুখে হাসি উপচে উঠছে।বাড়ির বড় ছেলের বিয়ের কথাবার্তা হবে আজ।বিথী চৌধুরী এবং আশা চৌধুরী বিভিন্ন রকম আইটেম রান্নায় ব্যস্ত।সবকিছু সুন্দরভাবে সম্পন্ন করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে।তবু যেন কোথাও কমতি থেকেই যাচ্ছে। তাঁদের বড় আপা থাকলে একা হাতেই সবটা সামলে নিতেন।বড় আপাকে ফোনও করা যাচ্ছে না।মফিজ চৌধুরী বলে দিয়েছেন নিশানের মা’কে এখন কিছু জানানোর দরকার নেই।বিয়ে তো আর হয়ে যাচ্ছে না।শুধুমাত্র আলোচনা হবে আজ।গ্রাম থেকে ফিরে আসলে না হয় জানানো যাবে।

মফিজ চৌধুরী ড্রয়িংরুমে সোফায় অত্যন্ত বিরক্ত মুখে বসে আছেন।যার জন্য বাড়িতে এত আয়োজন সেই লোকটিই নেই।নিশানকে অনেক বার বারণ করেছিলেন আজ অফিসে না যেতে। ছেলেটা তাঁর কথাকে পাত্তাই দিল না।তাঁর মন চাইছিল নিশানকে কিছু কঠিন কথা শুনিয়ে দেয়।কিন্তু শেষমেষ তা করলেন না।আর যাই হোক এত বড় ছেলের উপর রাগারাগি করা যায় না।উল্টে দেখা যাবে ছেলেটা মাথা গরম করে কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে।নিশানের স্বভাব চরিত্র সম্পর্কে তাঁর ভালই ধারণা আছে।এর আগেও এমন ঘটনা বহুবার ঘটেছে।তাই তিনি মেজাজ যথাসম্ভব ঠান্ডা রেখে বলে দিয়েছেন একটু তাড়াতাড়ি করে বাড়ি ফিরতে।

সন্ধ্যা হওয়ার সাথে সাথে যূথী রুমে দরজা আটকে বসে আছে।মনটা একদমই ভাল নেই তাঁর।বাড়ির সকলের চেহারায় আনন্দের রেশ।একমাত্র তাঁর মুখে হাসি নেই।ইচ্ছে করছে বাড়ি থেকে আজ রাতের জন্য কোথাও উধাও হয়ে যেতে।
বিছানার এককোণে অবহেলিত অবস্থায় গুটিয়ে থাকা গোলাপি রঙের জামাটার দিকে তাকাল যূথী।মনীষা বলে গেছে আজ যেন এ ড্রেসটা পরে।কিন্তু তাঁর এসব মনে ধরছে না।জামাটা ছিড়ে কুটি কুটি করে ফেলতে পারলে শান্তি লাগত।ড্রয়িংরুম থেকে জোরে কথাবার্তার আওয়াজ পেতেই বুঝতে পারল অতিথিরা এসে গেছে।ধক করে উঠল যূথীর হৃৎপিণ্ডটা।সত্যিই কি ওই রাগী লোকটার বিয়ে হয়ে যাবে! সে যে সহ্য করতে পারবে না এটা।কিন্তু কিচ্ছু করার নেই।যা হবে চোখের সামনে দেখে যেতে হবে।ভারাক্রান্ত মন নিয়ে যূথী জামাটা হাতে নিয়ে তৈরি হতে লাগল।

ড্রয়িংরুমের পরিবেশ অনেকটা জমে উঠেছে।অতিথিদের অ্যাপায়নে বাড়ির সকলে প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। ঐশীর বাবা মাহবুব আলমের মুখে হাসির ঝিলিক।যেসব কথায় হাসার দরকার নেই সেসব কথায়ও ঘনঘন হেসে উঠছেন।এই মুহূর্তে তাঁর মনে অনাবিল সুখ কাজ করছে।এত বড় বাড়িতে মেয়ে বিয়ে দেওয়ার সৌভাগ্য কয়জনের হয়?
মাহবুব আলম নিশানের বাবার অফিসেই কর্মরত অবস্থায় আছেন।সেদিন যখন মফিজ চৌধুরী নিশানের সাথে তাঁর মেয়ের বিয়ের আলাপ নিয়ে এসেছিলেন তখন যেন তিনি ঈদের চাঁদ হাতে পেলেন।তৎক্ষনাৎ তিনি রাজি হয়ে গেছিলেন।কিন্তু তাঁর মেয়ে মাঝখান থেকে বেঁকে বসেছিল।সে নাকি কার থেকে শুনেছে নিশান খুব বদমেজাজি। মেয়ের মুখে এসব কথা শুনে মাহবুব আলমের মেজাজ খারাপ হয়েছিল।কেনো যে তাঁর মেয়েটা এত বোকা।বোকা না হলে কি এরকম ভিত্তিহীন কথা শুনে কেউ বিয়ে করবে না বলে চেঁচায়!
দীর্ঘক্ষণ কুশল বিনিময়ের পর মফিজ চৌধুরী বললেন,

“—নিশান আর ঐশীর বিয়ে নিয়ে যে কথাবার্তা চলছিল সেটা আমরা এগিয়ে নিতে চাইছি।বাড়ির সকলের ইচ্ছে বিয়েটা এই মাসেই হয়ে যাক।এতে আপনাদের কোনো সমস্যা থাকলে বিনা দ্বিধায় বলতে পারেন মাহবুব সাহেব।”

অনেকটা জোড়হাতের ভঙ্গিতে মাহবুব আলম বললেন,

“—কোনো সমস্যা নেই।আপনাদের সাথে আত্মীয়তা করতে পারলে আমরাও ধন্য হই।কিন্তু ছেলেমেয়ে দুজনের আলাদা কথা হলে ভালো হয়।তাদেরও তো একটা মতের ব্যাপার আছে।তবে এটা বলতে পারি আমার মেয়ের তরফ থেকে কোনো ঝামেলা নেই।আমি নিশানের ব্যপারটা জানতে চাইছি।”

“—এটা নিয়ে ভাববেন না।নিশানও রাজি আছে।আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সে এসে যাবে।তখন না হয় ওরা দুজন আলাদা কথা বলতে চাইলে বলবে।”


দুতলার এক কোনায় দাঁড়িয়ে নিচের দৃশ্য দেখছিল যূথী।একধ্যানে তাকিয়ে আছে ঐশী নামের মেয়েটার দিকে।সত্যিই মেয়েটা নিশান ভাইয়ার জন্য পারফেক্ট। দেখতে যেমন সুন্দরী লেখাপড়ার দিক থেকেও শিক্ষিত।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে যূথী আশেপাশে নিশানকে খুঁজতে লাগল।কেনো জানি লোকটাকে দেখতে বড্ড ইচ্ছে করছে।
আজকাল তাঁর মনে কিছু অদ্ভুত অদ্ভুত ইচ্ছে জন্ম নেয়।মন চায় সারাদিন নিশান ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে।কিন্তু এটা কখনোই তাঁর দ্বারা হয়ে উঠে না।দুপুরে যখন বাড়ি নিরব থাকে তখন চুপিচুপি নিশানের রুমে ঢুকে পরে যূথী।রুমের প্রত্যেকটা জিনিস হাত দিয়ে ছুয়ে দেখে।কিছুদিন পর এই রুম অন্যজনের হয়ে যাবে।তখন আর এরকম অবাধে চলাচল করা যাবে না।দেয়ালে টাঙানো নিশানের বড় ছবিটার দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকে সে।হাত দিয়ে স্পর্শ করার সাহস পায় না।এই বুঝি ছবি থেকে আসল মানুষটা বেরিয়ে আসলো।

“—যূথী আপু! এখানে দাঁড়িয়ে কি করছো!”

বিদীষা’র ডাকে ভাবনার জগৎ থেকে বের হলো যূথী।কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বলল,

“—আমি…কিছু করছি না।”

“—নিচ থেকে তোমাকে হাতের ইশারা দিয়ে ডাকছি কিন্তু তুমি তো সাড়া দিচ্ছিলে না।কি হয়েছে তোমার বলোতো!”
যূথী বিদীষা’র গাল টেনে বলল,

“—কিচ্ছু হয়নি আমার।চলো নিচে যাই।”

“—হ্যাঁ চলো।মা তোমাকে ডাকছে।”

__________________

বিকেল থেকে মফিজ চৌধুরী’র মেজাজ যতটুকু খারাপ ছিল তা আরো একধাপ বেড়ে গেছে।মাথা ঠান্ডা রাখতে কষ্ট হচ্ছে।দশটা বাজতে চলল এখনো তাঁর ছেলের আসার নাম গন্ধ নেই।অতিথিরা অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত। নিশানকে ফোন করেও কোনো ফায়দা হচ্ছে না।রিং হয় কিন্তু রিসিভ করে না।এসব কান্ড করার অর্থ কি! সে তো ভালো করেই জানে বাড়িতে সকলে তাঁর জন্য অপেক্ষা করবে।
পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে মাহবুব আলম বললেন,

“—হয়তোবা নিশান কোনো কাজে আটকে গেছে।আপনাদের সাথে তো যা কথা হওয়ার দরকার ছিল তা হয়ে গেছে।ঐশী আর নিশান না হয় অন্য যেকোনো দিন দেখা করবে।আজ তাহলে উঠি।”
মফিজ চৌধুরী লজ্জিত গলায় বললেন,

“—নিশানের যে আসতে এতটা দেরি হবে এটা ভাবিনি।আমরা সত্যিই খুব দুঃখিত। ”

“—সমস্যা নেই ভাইসাহেব।আজ তাহলে যাই।এমনিতেও দেরি হয়ে গেছে।”

মফিজ চৌধুরী অতিথিদের গেইট পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন।মোবাইল হাতে নিয়ে আরেকবার নিশানের ফোনে কল দিলেন।কেউ রিসিভ করল না।



রাত এগারটার দিকে সঙ্গে কাজি নিয়ে বাড়ি ফিরল নিশান। সকলে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে নিশানের দিকে।এত রাতে কাজি আনার কারণটা কেউই ঠাওর করতে পারছে না।সবাই জানে নিশান একগুঁয়ে স্বভাবের।যখন যা মন চায় তাই করে।মাঝেমাঝে কিছু অদ্ভুত কান্ডও করে বেড়ায়।কিন্তু আজকের ব্যপারটা তো চূড়ান্ত রকমের অদ্ভুত।
এতগুলো মানুষের কৌতূহল দৃষ্টি সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে নিশান ধপ করে সোফাতে বসে পরল।তাঁর পাশের সোফাতেই কাজি গুটিশুটি মেরে বসে আছে।
নিশান পকেট থেকে ফোন বের করে মনীষাকে বলল,

“—এক গ্লাস পানি দে তো মনীষা।”

মনীষা উর্ধ্বশ্বাসে পানি আনতে ছুটল।সে বেশ বুঝতে পারছে বাড়িতে ভয়াবহ কিছু হতে চলেছে।নিশান ভাইয়ার মতিগতি ঠিক লাগছে না।
বিস্ময় ভাব কাটতেই মফিজ চৌধুরী শক্ত গলায় বললেন,

“—বাড়িতে কাজি কেনো নিশান?

নিশান দরাজ গলায় বলে উঠল,

“—বিয়ে করব।আর সেটা এখনই।”

চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here