স্বপ্নচারিণী,পর্ব_১৭

স্বপ্নচারিণী,পর্ব_১৭
সামান্তা সিমি

বাইরে প্রবল বেগে বর্ষণ হচ্ছে। বছরের প্রথম বর্ষণ প্রকৃতিকে যেন ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে।কিছুক্ষণ পর পর আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।এ যেন অন্ধকারের বুকে গাছের শাখা-প্রশাখার মত আলোর রেখা ধিকিধিকি জ্বলছে।সত্যিই প্রকৃতির সৌন্দর্যের তুলনা হয় না।
বারান্দার এককোণে বসে সেই সৌন্দর্য মুগ্ধ হয়ে দেখছে যূথী।একটু পর পর বৃষ্টির ছাট তাঁর গায়ে লাগছে।এতে কোনো হেলদুল নেই তাঁর।উল্টে শীতল হাওয়ার আবেশে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে বারবার।
নিশান অনেকক্ষণ আগেই চলে গিয়েছে। যূথীকে বলে গেছে বাইরে বসে না থেকে তাড়াতাড়ি যেন ঘুমিয়ে পরে।কিন্তু সে এখনো ঠায় বসে আছে।

“—যূথী!”

মনীষার ডাকে যূথীর বৃষ্টিবিলাসের ধ্যান ভঙ্গ হলো।মনীষা কখন এসেছে টেরও পায়নি সে।আজ কি হলো তাঁর?এতটা উদাসীন হয়ে থাকছে কেনো?উদাস হওয়ার মত কিছু হয়েছে কি?নিজের মন থেকে কোনো উত্তর পায় না যূথী।

“—তুমি এখনো ঘুমাও নি মনীষা?

যূথীর পাশের চেয়ারটায় বসতে বসতে মনীষা বলল,

“—না।তোমাকে দেখতে এলাম।সন্ধ্যা থেকে দেখছি মনমরা হয়ে আছো?”

“—না তেমন কিছুই নয়।”

“—শোনো যূথী!আজকের ব্যপারটা নিয়ে আর ভেবো না।ভয়ের কিছু নেই।নিশান ভাইয়া সব সমস্যার সমাধান করে দিয়েছে। আর তোমার তো প্রথমেই ঘটনাটা নিশান ভাইয়াকে জানানো উচিত ছিল।তা না করে কেঁদে কেটে অস্থির।অবশ্য ওইরকম পরিস্থিতিতে মাথা ঠিক রাখাও কঠিন।যাই হোক প্লিজ এভাবে চুপ করে থেকো না।ভালো লাগে না আমার।”

মুচকি হাসলো যূথী।সবাই ভাবছে আজকের ঘটনার কারণে তাঁর মন খারাপ।কিন্তু তা তো নয়।তাঁর ভালো লাগছে এভাবে চুপচাপ বসে থাকতে।
যূথীকে নীরব থাকতে দেখে মনীষা আবার বলল,

“—যূথী! চলো আমরা চারজন মিলে হরর্ মুভি দেখব।বাইরে দেখেছো কি পরিমাণ বৃষ্টি! সাথে বজ্রপাত। ভূতের ছবি এক্কেবারে জমে যাবে।”

যূথী আঁতকে উঠে বলল,

“—কখনো না।আমি এমনিতেই ভীতু।ভূতকে আমি ভীষণ ভয় পাই।”

“—কিচ্ছু হবে না।তুমি আমাদের তিনজনের মাঝখানে বসে থাকবে।আমরা তোমাকে গার্ড দিয়ে রাখব।হাহাহা।চলো।”

যূথীও আর দ্বিরুক্তি না করে মনীষার পিছু পিছু চলে গেল।

___________________

কানে ইয়ারফোন গুঁজে বিছানায় শুয়ে আছে যূথী।তাঁর দৃষ্টি মাথার উপরে অনবরত ঘুরতে থাকা ফ্যানের দিকে।এই দুপুরের সময়টায় তাঁর প্রায়ই মন খারাপ থাকে।কারণটা সে নিজেও জানে না।মনে হয় কিসের যেন শূন্যতা,কি যেন নেই!
আজ অনেকদিন পর তাঁর গ্রামের কথা খুব মনে পরছে।সেই মেঠোপথ,পাখির কলকাকলি, সবুজ ফসলের মাঠ!কতদিন সে দেখে না এগুলো।তাঁদের বাড়িটারও বোধ হয় জরাজীর্ণ অবস্থা। ঘরের ভেতরে হয়তোবা নানা কীটপতঙ্গের বসবাস! বাড়ির উঠোনে শুকনো পাতার স্তূপ।চোখ বন্ধ করে যূথী এমন একটা দৃশ্য কল্পনা করে নিল।
রুমে কারো প্রবেশ করার আওয়াজ পেতেই ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল সে।নীলুফা চৌধুরী হাতে ব্যাগ নিয়ে রুমে ঢুকছেন।

“—যূথী তোর থেকে বিদায় নিতে এলাম।আমি গ্রামে যাচ্ছি এখন।লতিফার নাকি শরীরটা বেশ খারাপ।”

যূথী উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

“—কি হয়েছে চাচীর?আমাকে তো কিছু বলেনি!”

“—বলেনি আর কি।আমি দুই তিনদিনের ভেতর চলে আসব কেমন!তোর কিছু দরকার লাগলে মেজো মা’কে বলবি।দ্বিধা করার দরকার নেই।”

যূথী বড়মা’র পিছন পিছন মেইন ডোর পর্যন্ত গেল।একবার ভাবল বলবে যে তাঁরও গ্রামে যেতে ইচ্ছে করছে।এখন তো পরীক্ষাও শেষ।কিন্তু শেষমেষ আর বলা হলো না।কি দরকার গ্রামে যাওয়ার।হয়তোবা দেখা যাবে ফেরার সময় তাঁর খুব কান্না পেয়ে যাবে।



* ডাইনিং রুমে পাতানো বিশাল টেবিল ঘিরে সবাই ডিনার খেতে ব্যস্ত।কারিমা এবং আশা চৌধুরী খাবার পরিবেশনের তদারকি করছেন।
আজ নিশানও উপস্থিত আছে।যার কারণে মনীষা,বিদীষা এবং নীলিমা মুখে কুলুপ এঁটে ভাত গিলছে।
নীরবতা ভঙ্গ করে নিশানের বাবা মফিজ চৌধুরী বলে উঠলেন,

“—বিয়ে নিয়ে কিছু চিন্তা ভাবনা করেছো নিশান?

মফিজ চৌধুরী সবসময়ই সোজাসাপ্টা কথায় অভ্যস্ত।ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলা তাঁর ধাতে নেই।কিন্তু এই মুহূর্তে টেবিলে বসা প্রত্যেকের ভীত দৃষ্টি নিশানের দিকে।এই বুঝি সকলের উপর দিয়ে কোনো ঘূর্ণিঝড় বয়ে যাবে।
নিশান শান্ত ভঙ্গিতে ভাত খেয়ে যাচ্ছে যেন কথাটা শুনতেই পায় নি।
মফিজ চৌধুরী আবার বললেন,

“—আমি কিছু বলছি নিশান।এভাবে আর কতদিন! সামনের বছর তেত্রিশের কোঠায় পা রাখতে চলেছো।কিন্তু তোমার মধ্যে বিয়ে করার কোনো লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি না।তুমি সন্ন্যাসী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছো নাকি।বাড়ির বড় ছেলে তুমি।তোমাকে নিয়ে আমাদের অবশ্যই অনেক স্বপ্ন আছে।বাড়ির লোকের দিকটাও তো একটু দেখবে।”

“—করব বিয়ে।আমাকে নিয়ে তোমাদের আর টেনশন করতে হবে না।”

সবাই গোল গোল চোখে তাকিয়ে আছে নিশানের দিকে।কথাটা কারোই বিশ্বাস হচ্ছে না।আশা চৌধুরী ভাতের গামলা নিয়ে কিচেনে যাচ্ছিলেন।নিশানের কথা শুনে সেখানেই দাঁড়িয়ে গেলেন তিনি।
মনীষা,বিদীষা,নীলিমা খুশিতে “ইয়াহু” বলে চিৎকার দিয়ে উঠল।ওঁরা এত আনন্দ বোধ হয় বিগত কয়েক বছরেও পায় নি।
মাহির খাওয়া ছেড়ে দাঁড়িয়ে বলল,

“—প্লিজ আরেকবার কথাটা বলো বিগ ব্রো! আমি মোবাইলে রেকর্ড করে রাখতে চাই।”

নিশান রাগি চোখে তাকাতেই মাহির মেকি হেসে নিজের জায়গায় বসে পরল।তবে সকলের মুখ আনন্দে ঝলমল করছে।অবশেষে নাফিস ইমতিয়াজ নিশান বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেছে।এর থেকে সুসংবাদ আর কি হতে পারে!
মফিজ চৌধুরী বললেন,

“—ঐশীর সাথে তোমার বিয়ের একটা আলোচনা চলছিল কিছুদিন আগে।তুমি বোধ হয় আভাস পেয়ে থাকবে।মেয়েটা ভালোই।পরিবারের দিক থেকেও ভদ্র এবং শিক্ষিত। তোমার জন্য ওই মেয়েটাই পারফেক্ট। তুমি যেহেতু রাজি আছো তাহলে কাল ঐশীর বাবা-মা’কে রাতের ডিনারে ইনভাইট করি।সেখানেই না হয় বিয়ের ব্যপারে কথাবার্তা বলা যাবে।”

এতক্ষণ টেবিলের এক কোনায় বসে যূথী আপনমনে ভাত খাচ্ছিল।এত আলোচনার মধ্যে একবারও মাথা তুলে তাকায়নি।কিন্তু নিশানের বাবার বলা শেষ কথাটা তাঁকে তীক্ষ্ণ ছুরির ফলার মত আঘাত করল।ভাত গলা দিয়ে নামছে না।হাত-পা কাঁপছে খুব।মন চাইছে সব ফেলে ঘরে ছুটে যায়।কিন্তু তা বেয়াদবি হবে।
এমন কেন হচ্ছে তাঁর? এটা তো খুব ভাল খবর যে নিশান ভাইয়ার বিয়ে হবে।বাড়ির লোক কতটা খুশি সেটা সকলের চেহারা দেখলেই বুঝা যাচ্ছে। তবে তাঁর কেন এত কষ্ট হচ্ছে! এমন তো হওয়ার কথা ছিল না।ছোট্ট হৃৎপিণ্ডটার মধ্যে কেউ যেন খুব জোরে আঘাত করছে।
কারিমা যূথীর ছটফটানি ভাবটা লক্ষ্য করল।যূথীর কাঁধে হাত রেখে বলল,

“—খাচ্ছো না কেনো যূথী! শরীর খারাপ লাগছে?

“—আমি আর খেতে পারছি না ভাবি।”

“—আচ্ছা জোর করে খাওয়ার দরকার নেই।নাহলে বমি হয়ে যেতে পারে।তুমি রুমে গিয়ে শুয়ে পরো।যাও।”

যূথী আর এক সেকেন্ড দেরি না করে উপরে চলে গেল।নিশান যূথীর যাওয়ার দিকে একবার তাকিয়ে খাওয়ায় মন দিল।



মেয়েদের গ্রুপটা গোল হয়ে বসে আছে বারান্দায়। মনীষা,বিদীষা এবং নীলিমা’র মধ্যে টান টান উত্তেজনা। বাড়িতে কোনো অনুষ্ঠান মানেই তাঁদের শপিং করার হিড়িক পরে যায়।জামা থেকে শুরু করে জুতা সবই কয়েক সেট কেনা হয়।এবার তো কেনাকাটার পরিমাণ আরো বেড়ে যাবে।নিশান ভাইয়ার বিয়ে বলে কথা!ওঁরা এখন থেকেই কি কি করবে তাঁর একটা নকশা তৈরি করে নিচ্ছে।
চেয়ারে মাথা হেলিয়ে বসে আছে যূথী।মনীষাদের এত উত্তেজনা কিছুই তাঁকে স্পর্শ করছে না।একটু আগে নীলিমা তাঁকে জোর করে রুম থেকে এখানে নিয়ে এসেছে।
তিনবোন যতবারই “নিশান ভাইয়ার বিয়ে” শব্দগুলো উচ্চারণ করছে ততবারই যেন তাঁর হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। না চাইতেও চোখের কোনে জল জমে উঠছে।তাঁর মন কি চাইছে সে বুঝতে পারছে না।কেনো তাঁর এত যন্ত্রণা হচ্ছে! কেনো সে তিনবোনের মত খুশি হতে পারছে না!মেয়েগুলোর মুখের উপচে পরা হাসি সহ্য হচ্ছে না তাঁর।ওদের সামনে আর এক মুহূর্তও বসে থাকতে পারবে না সে।

“—নীলিমা, আমার সত্যিই ভালো লাগছে না।আমি রুমে যেতে চাই।”

যূথীর কথায় ওদের আলোচনায় ভাটা পরল।নীলিমা ঠোঁট উল্টে বলল,

“—আরেকটু থাকো না! গায়ে হলুদের প্রোগ্রামের প্ল্যানটা তো এখনো শোনো নি।”

“—আমি কালকে শুনব।এখন রুমে যাব আমি।প্লিজ আটকিয়ো না।”

বাকিরা আর কিছু বলল না।যূথীর অদ্ভুত ব্যবহারগুলো তারা যে খেয়াল করছে না এমন নয়।তখন ডাইনিং টেবিলে খাবার ছেড়ে উঠে যাওয়া আবার এখন আড্ডার মাঝখান থেকে হুট করে চলে যাওয়া এগুলো কি শুধুমাত্র শরীর খারাপের কারণে! কি যে হলো মেয়েটার কে জানে!
মনীষা’র রুম থেকে বেরিয়েই নিশানের সাথে দেখা হয়ে গেল যূথীর।থমকে দাঁড়িয়ে গেল যূথী।এখনই কি লোকটার সামনে আসার দরকার ছিল?
যূথী একপলক নিশানের দিকে তাকিয়েই আবার চোখ নামিয়ে নিল।কিন্তু নিশান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে যূথীর দিকে তাকিয়ে।ভাব এমন যেন চোখ দিয়ে যূথীর মনের সব না বলা কথাগুলো পড়ে নিচ্ছে যে কথাগুলোর অর্থ যূথী নিজেও উদ্ধার করতে ব্যর্থ।
ভারী গলায় জিজ্ঞেস করল,

“—খাওয়া ছেড়ে তখন উঠে গেলে কেনো?

“—ভালো লাগছিল না।”
নিশান ভ্রু কুচকে বলল,

“—ভাল না লাগার কারণ কি?যখনই দেখি মুখ গোমড়া করে ঘুরে বেড়াও।”

জবাব দিল না যূথী।বরাবরের মত নিশান ভাইয়ার সামনে এভাবে কাঠ পুতুলের দাঁড়িয়ে থাকতে অস্বস্তিতে ভুগছে সে।লোকটা এত অদ্ভুত কথাবার্তা কেনো বলছে!নিজেই তো গোমড়ামুখো হয়ে সারাদিন ঘুরে বেড়ায়।অবশ্য এখন তো আনন্দের সময়। কয়েকদিন পর বিয়ে করবে।নতুন জীবনসঙ্গী আসবে।
যূথীর মন চাইছে এখান থেকে ছুটে পালিয়ে যেতে।যে মানুষটার জন্য মনে ঝড় বয়ে যাচ্ছে তাঁরই সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কি যে কষ্টকর!

“—আমার ঘুম পাচ্ছে নিশান ভাইয়া। রুমে যাচ্ছি। ”

নিশানকে কিছু বলার অবকাশ না দিয়ে যূথী সাইড কেটে চলে যাচ্ছিল।কয়েক কদম এগুতেই ঝড়ের গতিতে নিশান যূথীকে একটান দিয়ে নিজের কাছে এনে ফেলল।এমন আচমকা আক্রমণে যূথী কিছুটা আর্তনাদ করে উঠল।হাতের কবজিটা বোধ হয় আর আস্ত নেই।
যূথীর মুখে ব্যথার ছাপ দেখেও নিশান যূথীকে ছেড়ে দিল না।বরং আরো কাছে টেনে দাঁত কটমট করে বলল,

“—আমার সাথে এটিটিউড দেখাবে না।একদম মাথায় তুৃলে আছাড় মারব।”

যূথী ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট করছে।নিশান এখনো ছাড়ছে না তাঁকে।যূথী চোখ পিটপিট করে খুলতেই নিশানের তীব্র চাহনি দেখতে পেল।বহু কষ্টে বলল,

“—হাতে ব্যথা পাচ্ছি নিশান ভাইয়া।ছেড়ে দিন আমায়।”

কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে নিশান যূথীকে হালকা ধাক্কা দিয়ে ছাদের দিকে চলে গেল।হতভম্ব যূথী দেয়াল ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে।ব্যথা পাওয়ার জায়গাটায় হাত ঘষছে ঘনঘন।মনে হচ্ছে কিছুক্ষণ আগে তাঁর উপর দিয়ে ছোট-খাটো একটা দুর্যোগ গেল।এমন কেনো লোকটা!পৃথিবীর সব রাগ,বদমেজাজ, চোখ রাঙানো উপরওয়ালা উনার মধ্যে দিয়েছে।

চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here