#বিবশ_রজনী
#পর্ব_নয়
…..
ঘড়ির কাটা ঠিক দুটো অতিক্রম করতেই ঈশান দরজা খুলে বাইরে বের হয়ে এলো, একমুহূর্তের জন্যে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে কিছু একটা বলল। নিজাম সাহেবের লেখা সংলাপ অনুযায়ী ঈশানের বলার কথা, “ঘর থেকে বের হলাম, যাচ্ছি ছাদে।”
ঈশানের ঠোঁট নড়া বন্ধ হওয়া মাত্র প্রতিত্তোরে জেরিনের বলার কথা ছিল, “কেন এত রাতে ছাদে যাচ্ছো কেন?”
কিন্তু জেরিন কিছু বলতে পারলো না, ঈশানকে দেখার পর থেকে সে কাঁপতে শুরু করেছে। নিজাম সাহেবের মনে হচ্ছে সে ঈশানকে সামনাসামনি এই অবস্থায় দেখে বেশ ঘাবড়ে গেছে। ঈশান সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে শুরু করলো।
নিজাম সাহেব হালকা গলায় জেরিনকে বললেন, “কি ব্যাপার আপনার কি হয়েছে? আপনি তো কিছু বললেন না।”
জেরিন ঘামতে শুরু করেছে। নিজাম সাহেব পুনরায় বললেন, “আপনার কি খুব বেশি সমস্যা হচ্ছে? আমি বুঝতে পারছি ভালোবাসার মানুষটিকে এই অবস্থায় সামনা-সামনি দেখার পর স্বাভাবিক থাকাটা বেশ কঠিন কিন্তু জেরিন আমরা এখানে একটা যুবক ছেলেকে মানসিক সমস্যা থেকে বের করে আনবার চেষ্টা করছি, তাই না?”
জেরিন ভেজা চোখে নিজাম সাহেবের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “হু।”
নিজাম সাহেব বললেন, “আমার মনে হচ্ছে আপনি মানসিকভাবে ঈশানকে কিছু বলার ক্ষেত্রে অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছেন। আজকে আপনাকে আর কিছু বলতে হবে না। আজ শুধুমাত্র ঈশান ছাদে গিয়ে কি করে না করে না করে সামনা-সামনি এক ঘণ্টা বসে থেকে দেখুন। ভিডিওতে দেখা আর সামনা-সামনি দেখার মাঝে তো আকাশ-পাতাল পার্থক্য।”
জেরিন কোনো কথা বলল না, নিজাম সাহেব সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালেন। জেরিন তাকে অনুসরণ করতে শুরু করলো।
নিজাম সাহেব ছাদে গিয়ে জেরিনকে ছাদঘরের সিঁড়িতে বসতে বললেন, জেরিন গিয়ে বসলো। নিজাম সাহেব বসলেন না, তিনি কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁর ধারণা তাঁর সামনে কাঁদতে জেরিনের সমস্যা হচ্ছে। তিনি মনে মনে বললেন, “কাঁদুক মেয়েটা, কেঁদে কেঁদে মন হালকা করুক। ভালোবাসা তো এমনই। ভালোবাসার মানুষটির বিপদে তার জন্যে চোখের জলকে কখনো আটকে রাখা যায় না। মানুষ তাদের ভালোবাসার মানুষের জন্যে চোখের জলের বিনিময়ে শান্তি কামনা করে।”
ঈশান তিনটা বাজবার অল্পকিছুক্ষণ আগে রেলিং থেকে নেমে ঘরে চলে গেল। নিজাম সাহেব জেরিনকে বললেন, “চলুন, আজকের মতো ফেরা যাক।”
নিজাম সাহেব ছাদ থেকে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালেন। জেরিন উঠে দাঁড়িয়ে নিজাম সাহেবকে অনুসরণ করতে শুরু করলো। ষোলো তলায় এসে নিজাম সাহেব লিফটে উঠে সাত তলায় গিয়ে ঈশানদের দরজায় নক করলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে মিসেস নাজিয়া এসে দরজা খুলে দিয়ে নিজাম সাহেবদেরকে দেখতেই বললেন, “আসুন ভেতরে আসুন।”
নিজাম সাহেব জেরিনকে সাথে নিয়ে বসার ঘরে গিয়ে বসলেন। মিসেস নাজিয়া বসার ঘরে এসে বললেন, “আপনারা কিছুক্ষণ বসুন, আমি চা করে নিয়ে আসি।”
নিজাম সাহেব বললেন, “এখন আর চা খাবো না। আপনি বসুন।”
মিসেস নাজিয়া বসলেন। নিজাম সাহেব জেরিনকে দেখিয়ে বললেন, “উনি হচ্ছেন জেরিন। উনি ঈশানদের বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়াশোনা করছেন। ঈশানের ব্যাপারে উনি আমাকে সহযোগিতা করছেন।”
মিসেস নাজিয়া অবাক হয়ে জেরিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তাই নাকি!”
জেরিন কিছু বলল না। মিসেস নাজিয়া জিজ্ঞাসা করলেন, “মা তোমাদের বাসা কোথায়?”
জেরিন মৃদু গলায় বলল, “ফার্মগেট, খামারবাড়িতে।”
–“ও আচ্ছা, তোমার নামের মতো তুমিও দেখতে ভীষণ সুন্দর।”
নারীরা তাদের সৌন্দর্যের প্রশংসা শুনলে খুব খুশি হয়, লজ্জা পায়, আর তা যদি ভালোবাসার মানুষটির মায়ের মুখ থেকে শোনে তাহলে তো কথাই নেই তবে জেরিনের মুখমণ্ডলে খুশি অথবা লজ্জার কোনো ছাপ নেই। সে মাথা নিচু করে বসে আছে। নিজাম সাহেব বুঝতে পারছেন, ঈশানের ব্যাপারটা তার মনে খুব তোলপাড় করছে এখনো। তিনি মিসেস নাজিয়াকে বললেন, “ঈশান এখন কয়টা বাজে ঘুম থেকে ওঠে?”
মিসেস নাজিয়া বললেন, “সকাল নয়টা থেকে দশটার মধ্যে।”
–“আপনাকে বলেছিলাম, সকাল আটটার মধ্যেই ওকে ঘুম থেকে তুলতে।”
–“আপনি বলার পর থেকেই তো চেষ্টা করছি, কিন্তু সহজে ওর ঘুম ভাঙে না।”
–“চেষ্টা টা আরও বাড়িয়ে দিন, যেভাবেই হোক, সকাল আটটার মধ্যে ঈশানকে ঘুম থেকে ওঠাবেন। ধীরে ধীরে চেষ্টা করবেন আরও সকালে তুলতে।”
–“জ্বী আচ্ছা।”
–“মালেক সাহেবকে দেখছি না।”
–“ঘুমিয়ে পড়েছে, ওর শরীরটা কিছুদিন থেকে ভালো যাচ্ছে না। ডেকে দেবো?”
–“না না, ডাকতে হবে না, উনাকে দেখছি না তো, তাই জিজ্ঞাসা করলাম।”
নিজাম সাহেব সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “আজ তাহলে উঠি।”
ঈশানদের বাড়ির নিচে এসে গাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে নিজাম সাহেব জেরিনকে বললেন, “মিস জেরিন, এভাবে ভেঙে পড়লে তো হবে না। মনকে শক্ত করুন।”
জেরিন শুধু বলল, “জ্বী।”
–“আগামীকাল কি আপনি আসবেন?”
–“জ্বী আসবো।”
–“আপনার যদি সময় লাগে তাহলে বলতে পারেন, একবারে প্রস্তুত হয়ে তারপর আমরা শুরু করি।”
–“না না, আমি কালই আসবো। আপনি চিন্তা করবেন না, কাল থেকে আর সমস্যা হবে না।”
–“ঠিক আছে তাহলে চলি, কাল দেখা হচ্ছে।”
নিজাম সাহেব গাড়িতে উঠে বসে গাড়ি স্টার্ট করলেন।
বাসায় ফিরে এসে নিজাম সাহেব বিছানায় শুয়ে পড়লেন।
সকাল পৌঁনে আটটার দিকে মিসেস নাজিয়া ঈশানকে ডাকতে শুরু করলেন। বেশকিছুক্ষণ ডাকার পরও ঈশানের ঘুম ভাঙলো না। এতদিন তিনি ঈশানকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আদুরে গলায় ডেকে উঠানোর চেষ্টা করেছেন। কখনো ঈশান এক দুবারের জন্য চোখ মেলে তাকিয়ে আবারও ঘুমিয়ে গেছে। নিজাম সাহেব বলে গেছেন যে কোনো উপায়ে ছেলেকে সকাল আটটার মধ্যেই ঘুম থেকে তুলতে হবে। তিনি আরও কয়েকবার ঈশানকে ডাকলেন কিন্তু ঈশান উঠলো না।
মিসেস নাজিয়া দ্রুত মগে করে পানি নিয়ে এসে ঈশানের চোখ-মুখে কিছুক্ষণ পর পর পানি ছিটিয়ে দিতে শুরু করলেন। চোখে-মুখে ছেটানো শুরু করার পর থেকে ঈশান নড়া-চড়া করতে শুরু করেছে।
সকাল আটটা পাঁচ মিনিটে ঈশান হুড়মুড়িয়ে বিছানায় উঠে বসে এদিক-সেদিক তাকিয়ে মিসেস নাজিয়াকে জিজ্ঞাসা করলো, “কি হয়েছে? চোখে পানি দিচ্ছো কেন?”
মিসেস নাজিয়া কি বলবেন ভাবতে ভাবতে বললেন, “বাবা একটু বাজারে যাও না।”
ঈশান বিরক্ত হয়ে বলল, “বাসায় কি কেউ নেই?”
–“তোমার বাবার শরীরটা ভালো নেই, বাজারে গিয়ে বাজার করে নিয়ে আসো।”
–“কয়টা বাজে?”
–“সকাল আটটা পেরিয়ে গেছে।”
–“এত সকালবেলা তুমি আমাকে তুললে।”
–“বাজার তো সকালেই করতে হয়।”
ঈশান বিরক্ত হয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “কি আনতে হবে?”
মিসেস নাজিয়া বললেন, “তোমার যা যা আনতে ইচ্ছা হবে তাই তাই নিয়ে এসো। যাও মুখ-হাত ধুয়ে এসো।”
ঈশান ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে দাঁত মাজতে শুরু করলো। মিসেস নাজিয়া ঘর থেকে বের হয়ে এক হাজার টাকার দুইটা নোট নিয়ে এসে ঈশানের হাতে দিয়ে বললেন, “দুই হাজার টাকা দিয়েছি, তোমার যা যা পছন্দ হয়, নিয়ে এসো। দুই হাজার টাকায় হবে না?”
ঈশান মুখ থেকে ব্রাশ বের করে বলল, “আমি কি বাজার করি? দুই হাজার টাকায় হবে কি না আমি কি করে জানবো?”
মিসেস নাজিয়া বললেন, “আচ্ছা তুমি এই টাকার যা পাওয়া যায় নিয়ে এসো।”
ঈশান মুখ-হাত ধুয়ে বাজারে চলে গেল। বাজারে গিয়ে সে সবধরনের সবজি এক কেজি করে কিনে নয়টার দিকে বাসায় ফিরে এলো। মিসেস নাজিয়া ছেলের দুই হাতে সবজি ভর্তি ব্যাগ দেখে মুগ্ধ হলেন। ঈশান বলল, “সব ধরনের সবজি নিয়ে এসেছি।”
মিসেস নাজিয়া হেসে বললেন, “মাছ-মাংস কিছু আনোনি?”
–“টাকা শেষ হয়ে গেল তো। আচ্ছা টাকা দাও, নিয়ে আসি।”
–“থাক বাবা, কাল সকালে এনো। ফ্রিজে অল্পকিছু মাছ আছে, আজ এতেই চলবে।”
–“আচ্ছা।”
বাজারের ব্যাগ রান্নাঘরে রেখে ঈশান নিজের ঘরে চলে গেল। মিসেস নাজিয়া রান্নাঘরে সবজি ঘেঁটে দেখলেন, ঈশান বেগুন দেখে কিনতে পারেনি। বেগুনগুলো অধিকাংশতেই পোকা ধরেছে তবে ঈশান বাজার করেছে এতেই তিনি খুশি। সে যদি সব পচা সবজিগুলোও নিয়ে আসতো তাহলেও তিনি খুশিই হতেন।
মিসেস নাজিয়া ডাইনিংয়ে নাস্তা দিয়ে ঈশানের ঘরে এসে বললেন, “বাবা নাস্তা করবে না? টেবিলে নাস্তা দিয়েছি এসো, নাস্তা করে যাও।”
ঈশান ঘর থেকে বের হয়ে ডাইনিংয়ে গিয়ে বসলো।
সকাল এগারোটার দিকে সৌমিত্র ঈশানকে ফোন করলো। ঈশান ফোন ধরতেই সৌমিত্র জিজ্ঞাসা করলো, “কিরে কেমন আছিস?”
ঈশান বলল, “এইতো ভালোই।”
–“কোথায় আছিস? বাসায় নাকি অন্য কোথাও?”
–“বাসাতেই আছিরে।”
–“তুই কি বাসা থেকে তেমন একটা বের হস না নাকি?”
–“বের হতে ভালো লাগে নারে।”
–“কতদিন তোকে দেখি না! আমি আর রাফাত আজকে দেখা করবো, আসবি নাকি?”
–“ভালো লাগছে নারে দোস্ত, তোরা দেখা কর।”
–“শোন, আমরা তো মতিঝিলে দেখা করবো, ওখান থেকে তো তোদের বাড়ি খুব একটা দূরে না, চলে আয় না। অনেকদিন দেখা হয় না তোর সাথে।”
–“কখন?”
–“দুপুর একটার দিকে।”
–“আচ্ছা দেখি।”
নিজাম সাহেব ঘুম থেকে উঠলেন দুপুর বারোটায়। ঘর থেকে বের হয়ে তিনি দেখলেন, হামিদুল বিউটির সাথে ডাইনিংয়ে বসে দাবা খেলছে। তিনি বেশ অবাক হলেন, হামিদুলকে তিনি দাবা খেলা শিখিয়েছেন অনেক দিন হলো, মাঝে মাঝে তিনি হামিদুলের সাথে দাবা খেলতে চান কিন্তু হামিদুল বলে ওর নাকি দাবা খেলতে ভালো লাগে না। আজ ও বিউটির সাথে খেলছে, এর মানে কী? ও কি বিউটিকে খেলাটা শেখাতে চাচ্ছে? বিউটি কি দাবা খেলতে পারে? নিজাম সাহেব ডাইনিংয়ে গিয়ে বললেন, “দাবা খেলা হচ্ছে নাকি?”
বিউটি হেসে বলল, “আপনার ঘুম ভাঙতে ছিল না, ছোটসাব বলল, দাবা খেলবো নাকি? আমি তো দাবা খেলতে পারি না, ছোটসাব আমারে শেখাচ্ছে।”
–“ও আচ্ছা।”
নিজাম সাহেব মুখ-হাত ধুতে ধুতে ভাবলেন, হামিদুল তাঁর সাথে যে কয়বার দাবা খেলেছে সে কয়বারই হেরেছে, দাবা খেলার প্রতি তার আগ্রহ রয়েছে কিন্তু তাঁর সাথে খেললেই হেরে যায় জন্যে খেলতে চায় না। অর্থাৎ সে জিততে চায়, সেজন্যেই বিউটিকে সে খেলাটা শেখাচ্ছে। এরপর বিউটির সাথে খেলে বার বার জিতবে।
নিজাম সাহেব মুখ-হাত ধুতে ধুতে বিউটি তাঁর জন্যে চা নিয়ে এসে টেবিলে রেখে আবারও দাবার দিকে মনোযোগী হলো। নিজাম সাহেব চায়ের কাপ নিয়ে ঘরে চলে গেলেন।
ঘরের চেয়ারে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে হঠাৎ নিজাম সাহেবের দৃষ্টি গিয়ে পড়লো কাঠের আলমিরার দিকে। তিনি কৌতুহলবশত চায়ের কাপ রেখে আলমিরার দরজা খুলে ড্রয়ার খুললেন। ড্রয়ারে বেশকিছু কাগজপত্রের পাশাপাশি তিনি সর্বমোট সাতটা চিঠি খুঁজে পেলেন। চিঠিগুলো তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু তৃনার লেখা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষের দিকে তৃনার সাথে ভুল বোঝাবুঝি হয়ে নিজাম সাহেবের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অনেকগুলো বছর কেটে গেছে, আর কখনো যোগাযোগ হয়নি। চিঠিগুলো দ্বিতীয় বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষে পড়া কালীন সময়ে লেখা।
নিজাম সাহেব একের পর এক সাতটা চিঠি পড়ে শেষ করলেন। চিঠিগুলো পড়ে তিনি নস্টালজিক হয়ে গেলেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের অসংখ্য উজ্জ্বল স্মৃতি তাঁর মনে পড়তে শুরু করলো। তৃনা নিজাম সাহেবের খুব কাছের বন্ধু ছিল, খুব চঞ্চল প্রকৃতির মেয়ে ছিল তৃনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের কারণে তৃনার সাথে তাঁর খুব বড় ধরনের ঝামেলা হয়েছিল, এরপর থেকেই তিনি আর কারও সাথে যোগাযোগ করেননি। এতবছর পর কেমন আছে তৃনা? নিজাম সাহেব মনে মনে বললেন, “তৃনা কেমন আছো?”
দুপুর একটার দিকে ঈশানকে রাফাত ফোন করলো। ঈশান ফোন ধরতেই রাফাত বলল, “ঈশান কই তুই?”
ঈশান বলল, “বাসায়।”
–“এখনো বাসা থেকে বের হসনি? তাড়াতাড়ি আয়, আমি টি.এন্ড.টি স্কুলের সামনে আছি।”
ঈশান বিরক্ত হয়ে বলল, “আচ্ছা থাক, আমি আসছি।”
ঈশান বাসা থেকে বের হয়ে রিকশা নিয়ে টি.এন্ড.টি স্কুলের সামনে চলে গেল। রিকশা থেকে নামতেই সৌমিত্র ছুটে এসে ঈশানকে জড়িয়ে ধরে বলল, “বন্ধু কতদিন পরে দেখলাম তোকে।”
ঈশানরা টি.এন্ড.টি স্কুলের সামনেই বসলো। গল্পগুজবের মাঝখানে সৌমিত্র ঈশানকে বলল, “কাল তো ব্যাচেলার পয়েন্টে যাব, তুই চলে আয় না।”
ঈশান বলল, “তোরা যা, আমি যাব না।”
রাফাত বলে উঠলো, “এই তুই সবকিছুতে এত না না করিস কেনরে? আমাদেরকে কি তোর বন্ধু মনে হয় না?
ঈশান রাফাতের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি কি তাই বললাম?”
–“তাহলে কোথাও যাবার কথা বললেই না বলিস কেন? শোন কালকে যদি দুপুর দুইটার মধ্যে ব্যাচেলর পয়েন্টে না আসিস, তাহলে মনে করবো তুই আমাদেরকে বন্ধুই ভাবিস না।”
ঈশান চুপ করে রইলো।
রাত দুইটা বাজতে চলেছে, নিজাম সাহেব জেরিনকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ঈশানের ঘরের দরজার পাশে। দুইটা বাজতেই ঈশান ঘর থেকে বের হয়ে এলো। দরজার সামনে একমুহূর্ত দাঁড়িয়ে সে প্রতিরাতের মতোই বিড়বিড় করে বলল, “ঘর থেকে বের হলাম, যাচ্ছি ছাদে।”
প্রতিত্তোরে জেরিন সাথে সাথে বলল, “কেন? ছাদে যাচ্ছেন কেন?”
ঈশান সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করল, পেছন পেছন নিজাম সাহেব জেরিনকে নিয়ে তাকে অনুসরণ করতে শুরু করলেন। তিনি জেরিনকে ফিসফিস করে বললেন, “ঈশানকে আপনি করে বলা যাবে না, তুমি করে বলতে হবে।”
জেরিন আস্তে করে বলল, “আচ্ছা।”
ছাদে গিয়ে ঈশান বিড়বিড় করে বলল, “কষ্ট হয়, বুঝলে, খুব কষ্ট হয়।”
জেরিন সাথে সাথে বলল, “কিসের এত কষ্ট তোমার?”
ঈশান ছাদের রেলিংয়ের উপরে গিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল, “আমি এখন কি করছি জানো?”
জেরিন বলল, “কি করছো?”
ঈশান হাঁটা থামিয়ে বলল, “ছাদের রেলিংয়ের উপর দিয়ে হাঁটছি, পরে গেলে মরে যাব। সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।”
জেরিন কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “প্লীজ পাগলামি কোরো না, নেমে দাঁড়াও।”
বেশকিছুক্ষণ চুপচাপ হাঁটার পর ঈশান পুনরায় বলল, “দেখো আমাদের সম্পর্কটা দিনকে দিন কেমন হয়ে যাচ্ছে। আমার দোষটা কোথায় বলো তো? আমার জীবনে তুমি নিজে থেকে এসেছিলে, যেই তোমাকে নিয়ে আমি কখনো ভাবিনি, একটাদিন ডিপার্টমেন্টের সহপাঠী হিসেবেও যাকে আমি জিজ্ঞাসা করবার প্রয়োজন বোধ করিনি কেমন আছো সেই তুমি একদিন আমাকে বললে, তুমি আমার সাথে মিশতে চাও। আমি তোমায় সময় দিতে পারবো কি না। তোমার এই সরলতা আমার এতোটাই ভাল লেগেছিল যে আমি তোমার সাথে না মিশে থাকতে পারিনি। তোমাকে সময় দিতে দিতে, এখানে-সেখানে ঘুরতে ঘুরতে বন্ধুদের সাথে আমার সম্পর্কের পাঠ ঘুচিয়ে গেল। ধীরে ধীরে একদিন বুঝলাম তুমি আমারই এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছো। তোমাকে ছাড়া ভালো লাগে না, তুমি নিশ্চয়ই আমার মনের অবস্থা বুঝতে পারতে। আমি মাঝে মাঝেই ভীষণ অবাক হই, যেই তোমাকে আমি কখনো জিজ্ঞাসা করার কথা ভাবিনি কেমন আছো, সেই তোমারই সাথে আমার ভালোবাসার সম্পর্ক হয়ে গেল।”
–“হয়েছে বেশ হয়েছে। তুমি রেলিং থেকে নেমে দাঁড়াও।”
ঈশান কিছুক্ষণ পর হাঁটা থামিয়ে বলতে শুরু করলো, “আমাদের সম্পর্কের কোনো পরিনতি ছিল না আমি জানি, তুমিও জানতে, ওসব মেনেই তো ভালোবেসেছিলাম। চারটা বছর কত রাগ-অভিমানের পরেও আমরা এক থেকেছি। চিরদিন তেমনই থাকবার কথা ছিল, বিশ্বাস করো আমি তোমাকে কখনোই আপন করে পেতে চাইনি, চেয়েছিলাম কেবল একটুখানি পাশে পেতে, বন্ধুর মতো, ছায়ার মতো।”
জেরিন বলল, “তাকিয়ে দেখো, আমি আছি তো। কখনো তোমাকে ছেড়ে যাব না।”
ঈশান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “অথচ একদিন তোমার পুরো আদল বদলে গেল, কেমন অচেনা হয়ে গেলে তুমি। যেই আমাকে ছাড়া তোমার একটাদিন পূর্ণতা পেত না তুমি বলতে, সেই তুমি আমার একটা খোঁজ নেবার প্রয়োজন ভুলে গেলে। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কেটে যায় একটাবার তুমি আমার খোঁজ নিতে না। জানো তো এই কষ্ট সইবার মতো সাধ্য পৃথিবীর কোনো পুরুষ মানুষের নেই। প্রতিটা মুহূর্তে তোমাকে আমার মনে পড়ে, স্মৃতিগুলো বার বার চোখের সামনে এসে জানান দেয়, তুমি আর আগের মতো নেই। আমি তোমাকে বারংবার বলেছি, তোমার কাছে তেমন কিছু তো আমি চাইনি, শুধুমাত্র একটুখানি পাশে পেতে চেয়েছি, রোজ দিন পথ চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে যার কাছে আশ্রয় নেওয়া যায় সেই মানুষটি তুমি আমার ছিলে। আমি জানি না, তুমি হঠাৎ কেন আমায় অবহেলা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে শুরু করলে। হয়তো তুমি ভেবেছিলে তোমার সুখের কথা, সংসারের কথা, তাই তো আমাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য অবহেলা করে বার বার দূরে সরিয়ে দিতে শুরু করেছিলে। তোমার জীবনে একজন এলো, হয়তো তারই জন্যে আমার স্থান হারালো, কিন্তু এমনটা কথা ছিল না, কথা ছিল চিরটাদিন বন্ধুর মতো পাশে থাকার। তাকে নিয়ে তুমি সুখী হবে সেটা আমি ভীষণ চাইতাম কিন্তু হঠাৎই তুমি হারালে। আমাকে উপেক্ষা করতে, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে, ভীষণ কষ্ট হতো, তোমার মুখখানা, তোমার গলার স্বর শুনলেই একমুহূর্তে আমি সব ভুলে যেতাম। আজ আর তোমার গলার স্বর শোনার উপায় নেই, তোমার মুখখানা একটাবার দেখতে পারি না, কোথায় হারালে তুমি?”
জেরিন কাঁদতে কাঁদতে বলল, “কোথাও হারাইনি আমি, তুমি একবার তাকিয়ে দেখো। এইতো আমি তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছি।”
রাত তিনটা বাজতে চলেছে ঈশান রেলিং থেকে নেমে সিঁড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলো। জেরিনের চোখ থেকে টপটপ করে জল পড়তে শুরু করেছে।
জেরিন প্রথমের দিকে সংলাপ অনুযায়ী ঈশানের কথার প্রতিত্তোর দিলেও পরবর্তীতে সবকিছু নিজে থেকে বলেছে। জেরিনের আবেগজড়িত কণ্ঠে বলা কথাগুলো নিজাম সাহেবের খুব মনে ধরেছে। সংলাপে তিনি প্রতিত্তোরের জায়গায় যা লিখেছেন জেরিন তার চেয়ে অনেক ভালো প্রতিত্তোর ঈশানকে দিয়েছে, নিজাম সাহেব এমনটাই আশা করছিলেন।
ঈশান ছাদ থেকে চলে যাবার পর নিজাম সাহেব জেরিনকে বললেন, “কাল আসছেন তো?”
জেরিন বলল, “হ্যাঁ, আসবো।”
–“ঠিক আছে চলুন আজ বাড়ি ফেরা যাক।”
বাড়ির পথ ধরে দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে জেরিনের গাড়ি। জেরিন গাড়ির জানালার একটা গ্লাস নামিয়ে দিয়ে রাস্তার ফুটপাতের দিকে তাকালো। তার মনে বড় সংশয় হচ্ছে, এমন একটা দিন কি কখনো তার জীবনে আসবে যেদিন ঈশান তার হাতে হাত রেখে ঐ ফুটপাতগুলো দিয়ে হেঁটে যাবে?
…..
#চলবে
লেখা,
নাহিদ হাসান নিবিড়