বিবশ_রজনী #পর্ব-০১

#বিবশ_রজনী
#পর্ব-০১

ঘড়ির কাটায় রাত ঠিক দুইটা বেজে দশ মিনিট, ঈশান ছাদের রেলিংয়ের উপর দিয়ে হাঁটছে। সামান্য এদিক সেদিক হলে ষোলো তলার উপর থেকে সে নিচে পড়ে যাবে।

ড. নিজাম আহমেদ মনোযোগ সহকারে ঈশানের দিকে তাকিয়ে আছেন। ঈশান রেলিংয়ের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে নিখুঁতভাবে হেঁটে যাচ্ছে। রেলিংয়ের শেষপ্রান্তে গিয়ে আবারও উল্টো হয়ে হাঁটতে শুরু করছে। ঈশানের দুই চোখ বন্ধ, চোখ বন্ধ রেখে এত সরু একটা রেলিংয়ের উপর দিয়ে সে হাঁটছে কি করে? নিজাম সাহেব অবাক হয়ে গেলেন। তিনি মিনিট দশেক ঈশানের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।

ঈশানের বাবা আব্দুল মালেক মৃদুস্বরে নিজাম সাহেবকে বললেন,
“ঘরে চলুন।”
নিজাম সাহেব মালেক সাহেবের পেছন পেছন ঈশানদের বসার ঘরে গিয়ে সোফায় বসলেন।
মালেক সাহেব একটা সিগারেট ধরিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বললেন,
“গত একবছর থেকে রাত ঠিক দুইটা বাজার সাথেই ঈশান বিছানা থেকে উঠে ছাদে চলে যায়। এভাবেই প্রতি রাতে রেলিংয়ের উপরে হাঁটা-হাঁটি করে। আমি বাবা হয়ে এই দৃশ্য কিছুতেই আর সহ্য করতে পারছি না। কখন জানি ছেলেটা নিচে পড়ে গিয়ে মরে যায়, আমাদের একটাই সন্তান। আপনি কি বুঝতে পারছেন?”
নিজাম সাহেব বললেন, “জ্বী, বুঝতে পারছি। ঈশানকে এর আগে কেউ দেখেছে?”
–“ডাক্তার, কবিরাজ দেখাতে বাদ রাখিনি ফলাফল শূন্য, কোনো লাভ হয়নি।”
–“কোনো সাইক্রিয়াটিস্ট দেখেছে?”
–“দুইজন দেখেছে।”
–“তারা কি বলেছে?”
–“একজন সপ্তাহখানেক চেষ্টা করে বলেছে তারপক্ষে এই রোগের চিকিৎসা করা সম্ভব না। আরেকজন সপ্তাহ তিনেক চেষ্টা করে বলেছেন, ওর ঘরের দরজা রাতে বাইরে থেকে বন্ধ রাখতে।”
–“দরজা বন্ধ রেখেছিলেন?”
–“হ্যাঁ, বেশ কয়েকদিন বন্ধ রেখেছি।”
–“দরজা বন্ধ রাখার পর কি দেখলেন?”
–“দরজা বাইরে থেকে লাগানোর পর প্রতিরাতে ও দরজায় মাথা ঠুকতো, সেটা আরও অসহনীয়। মাথা ফেটে দুই রাতে রক্ত বের হয়ে গেছে। এরপর থেকে দরজা বাইরে থেকে লাগানো বন্ধ করে দিয়েছি।”
–“ঈশান ছাদ থেকে ফিরে আসে কখন?”
–“রাত তিনটায়।”
–“ঘরে এসে কি সাথে সাথে বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে নাকি অন্যকিছু করে?”
–“সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়ে।”
–“এসব কিছুই ঘুম থেকে উঠবার পর ঈশানের মনে থাকে না তাই না?”
–“জ্বী, কিছুই মনে থাকে না।”

রাত তিনটা বাজে, সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনে আব্দুল মালেক বললেন, “শুনতে পাচ্ছেন? সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে।”
–“হ্যাঁ শোনা যাচ্ছে।”
–“ঈশান ঘরে ফিরছে।”
–“আমি ঈশানকে একটু দেখে আসি।”

নিজাম সাহেব দ্রুত ঘরের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। ঈশান সিঁড়ি দিয়ে নামছে সাধারণ মানুষের মতোই কিন্তু তার চোখ দুটো বন্ধ, ঠোঁট নড়ছে, বিড়বিড় করে সে কিছু একটা বলছে, কি বলছে তা বোঝা যাচ্ছে না। নিজাম সাহেব বেশ অবাক হয়ে ভাবলেন, ছেলেটার মস্তিষ্ক প্রত্যেকটা স্টেপ এত নিখুঁতভাবে নিচ্ছে কি করে? প্রথমে সে বিছানা থেকে উঠছে, বিছানা থেকে উঠে চোখ বন্ধ অবস্থায় গিয়ে দরজার লক খুলছে, সিঁড়ি বেয়ে ছাদে গিয়ে উঠছে, ছাদে গিয়ে রেলিংয়ের উপর উঠছে, রেলিংয়ের এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত হাঁটছে, আবার ঠিক রাত তিনটা বাজতেই সে ঘরে ফিরে এসে দরজা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে পড়ছে, পুরোটা প্রক্রিয়া সংগঠিত হচ্ছে তার চোখ বন্ধ অবস্থায়, এটা কি করে সম্ভব?

আব্দুল মালেক নিজাম সাহেবের পাশে দাঁড়িয়ে বললেন, “দেখলেন?”
নিজাম সাহেব বললেন, “জ্বী, বেশ অদ্ভুত ব্যাপার।”
–“আসুন ঘরে আসুন।”

নিজাম সাহেব পুনরায় বসার ঘরে সোফায় গিয়ে বসে বললেন, “ঈশানের মাকে দেখছি না।”
–“সে ঈশান ঘরে ফিরে আসার আগ পর্যন্ত ঈশানের পাশের ঘরে চুপচাপ বসে থাকে। আগে ছাদে গিয়ে বসে থাকতো। সাইক্রিয়াটিস্ট যারা ঈশানকে দেখেছে তাদের একজন বলেছে, ঈশান ছাদে হাঁটার সময় তার আশেপাশে কোনরকম শব্দ করা যাবে না। যদি কোনভাবে তার জ্ঞান ফিরে আসে তবে ছাদ থেকে পড়ে একটা দূর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। সেই ভয়ে এখন সে আর ছাদে যায় না।”
–“জ্বী, এরকম হবার সম্ভাবনা আছে। আচ্ছা ঈশানই কি আপনাদের প্রথম সন্তান?”
মালেক সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “ঈশান আমাদের তৃতীয় সন্তান। ঈশানের আগে দুই দুইটা বাচ্চা সন্তান আমাদের হয়েছিল, এক ছেলে, এক মেয়ে। একজন মৃত অবস্থায় জন্ম নিয়েছে, আরেকজন জন্মের সপ্তাহ খানেক পর মারা গিয়েছে।”
–“আমি দুঃখিত।”
–“দুঃখিত হবার কিছু নেই নিজাম সাহেব, যা ঘটেছে তা তো সত্য। মৃত দুই সন্তানের কথা মনে পড়লে খানিক কষ্ট হয়, তবে সৃষ্টিকর্তার উপরে তো কারও হাত নেই, তাঁর সৃষ্টি তিনি ফিরিয়ে নিয়েছেন, আমাদের কিইবা করার আছে। আমার সাথে তাদের স্মৃতি কম সেজন্যেই হয়তো খুব বেশি খারাপ লাগে না কিন্তু ওদের মা এখনো প্রায়ই ওদের জন্যে কান্নাকাটি করে।”
মালেক সাহেব কিছু সময় চুপচাপ থেকে নিজাম সাহেবের চোখে চোখ রেখে বললেন,
“নিজাম সাহেব, দুই সন্তানকে হারিয়ে ঈশানকে অবলম্বন করে আমরা বেঁচে আছি। ওকে হারালে আমাদের বেঁচে থাকবার আর কোন অবলম্বন থাকবে না। হয়তো বেঁচে থাকবো কিন্তু বাকিটা জীবন নির্জীব হয়ে থাকতে হবে।”
–“আমি বুঝতে পারছি।”

নিজাম সাহেব সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “আমি আজ যাচ্ছি।”
আব্দুল মালেক কাতর চোখে নিজাম সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন,
–“আপনি কি ওকে সুস্থ করে তুলতে পারবেন? যত টাকা লাগে আমি দেবো। দেখুন আমাদের একটাই সন্তান। ওর কিছু হয়ে গেলে আমরা বেঁচে থাকবো কি করে?”
নিজাম সাহেব বললেন, “আমি ঈশানকে এই সমস্যা থেকে মুক্ত করতে পারবো কি না জানি না, তবে চেষ্টা করবো, আজ যাচ্ছি, কাল রাতে আবার আসতে পারি।”

নিজাম সাহেব ঈশানদের বাসা থেকে গাড়ি নিয়ে বের হলেন।

ভোর চারটা বেজে গেছে। নিজাম সাহেব বাড়ির প্রধান ফটক দিয়ে গাড়ি নিয়ে ঢুকতে ঢুকতে ভাবলেন, হামিদুল নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে আছে, জেগে থাকলে এক কাপ চা বানিয়ে দিতে পারতো। এত ভোরে সচরাচর হামিদুলের ঘুম ভাঙেনা, এর উপর কয়দিন থেকে সে সর্দি-কাশির ঔষধ খাচ্ছে। এমনিতেই হামিদুল ঘুমালে তাকে ডেকে তোলা যায় না, এখন আরও সর্দি-কাশির ঔষধের ক্রিয়া-বিক্রিয়া ঘুমের সাথে যুক্ত হয়েছে সুতরাং তার সামনে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটলেও সে কিছুই বুঝবে না। তিনি হামিদুলকে ঘুম থেকে জাগানোর বিশেষ কোন কারণও খুঁজে পেলেন না। বাচ্চা একটা ছেলেকে চা বানানোর জন্যে ঘুম থেকে টেনে-হিচড়ে উঠানোর মতো বিশ্রী কাজ জগতে আর হতে পারে না।

নিজাম সাহেব গাড়ি পার্ক করে দোতলায় গিয়ে হামিদুলকে চেতন অবস্থায় বসে থাকতে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
“কিরে তুই এখনো ঘুমাসনি?”
হামিদুল কোন উত্তর না দিয়ে চুপচাপ বসে রইলো। তার মুখে ভীতির ছাপ।
নিজাম সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, “তোর মুখ এমন কেন?”
হামিদুল নিজাম সাহেবের দিকে আতংকিত চোখে তাকিয়ে বলল, “কে জানি ঢিল মেরে জানালার একটা কাঁচ ভেঙে দিছে।”
–“কোন জানালার?”
–“আপনার ঘরের।”
–“চল তো দেখি।”

হামিদুল সমেত নিজাম সাহেব ঘরে গিয়ে দেখলেন, জানালার একটা কাঁচ গোল করে ভাঙা। তিনি ঘরে ভাল ভাবে খুঁজে দেখলেন কোন পাথর বা ইটজাতীয় কিছু পড়ে আছে কি না, এমন কিছু তিনি খুঁজে পেলেন না তবে তাঁর পূর্ণ বিশ্বাস রয়েছে জানালার কাঁচ ঢিল ছুড়েই ভাঙা হয়েছে, নিচে গিয়ে খুঁজলে নিশ্চয়ই ইট বা পাথর পাওয়া যাবে। নিজাম সাহেবের নিচে গিয়ে খুঁজে দেখতে ইচ্ছা হলনা। তিনি হামিদুলকে জিজ্ঞাসা করলেন, “কয়টার দিকে ঘটনা?”
হামিদুল বলল, “এই রাত আড়াইটায়।”
–“কেউ ঢিল মেরেছে। এইসব নিয়ে ভয় পাবার কোন কারণ নেই, কিছু দুষ্ট ছেলে আছে ওরা রাত বিরাতে মানুষকে ভয় দেখানোর জন্যে এইসব করে। তুই আমাকে এক কাপ চা বানিয়ে দিয়ে যা।”

হামিদুল ঘর থেকে বের হয়ে রান্নাঘরে ঢুকে গেল। নিজাম সাহেব মুখ হাত ধুয়ে বেলকনিতে গিয়ে রিল্যাক্স চেয়ারে বসে ভাবলেন, “জানালার ঢিল ছুড়বে কে? দুষ্ট কোন ছেলে? নাকি অন্য কেউ? রাত বারোটার মধ্যে হলে ব্যাপারটা স্বাভাবিকভাবেই মেনে নেওয়া যেত কিন্তু এত রাতে নিশ্চয়ই কেউ নিছক ফাজলামি করতে বাসা থেকে বের হয়ে আসবে না। তাছাড়া গত পরশু গভীর রাতে কুকুরটা খুব চেঁচাচ্ছিল, সে কি কারও উপস্থিতি টের পেয়েছিল?”

হামিদুল চা বানিয়ে নিয়ে এসেছে। নিজাম সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, “আজ ঔষধ খেয়েছিলি?”
হামিদুল কাশতে কাশতে বলল, “আজকে খাই নাই।”
–“সেজন্যেই কাঁচ ভাঙার শব্দ শুনতে পেরেছিস, যা ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়।”

হামিদুল চলে গেল, নিজাম সাহেব চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ভাবতে শুরু করলেন, ঈশানের সমস্যা ঠিক কী? স্লিপ ওয়াকিং! ঈশান ঘুমের মধ্যে হাঁটে, একবছর থেকে সে প্রতিরাতে ঠিক দুইটা বাজে ঘর থেকে বের হয়ে ছাদে গিয়ে রেলিংয়ের উপর দিয়ে রাত তিনটা পর্যন্ত হাঁটতে থাকে। ঘর থেকে বের হয়ে ছাদে হাঁটার প্রক্রিয়া এবং ঘরে ফিরে শুয়ে পড়া পর্যন্ত পুরোটা প্রক্রিয়া সংগঠিত হয় ঈশানের চোখ বন্ধ থাকা অবস্থায় যা খুবই আশ্চর্যজনক ব্যাপার। হাঁটার সময় সে বিড়বিড় করে কি যেন বলতে থাকে। ঘুম থেকে উঠবার পর তার আর কিছুই মনে থাকে না। পৃথিবীতে এই ধরনের সমস্যায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত বিরল।

নিজাম সাহেব এর আগে এরকম কোন রোগীর দেখা পাননি। ঈশানের সমস্যার সমাধান কেমন হবে নিজাম সাহেব এখনো জানেন না, তবে তিনি বিশ্বাস করেন প্রত্যেকটা সমস্যার একটা সমাধান নিশ্চয়ই আছে, ঈশানকে তিনি সমস্যা থেকে মুক্ত করতে চান।

নিজাম সাহেব বেলকনি থেকে উঠে ল্যাবঘরে গিয়ে নাইটভিশন ক্যামেরা, মাইক্রোফোনগুলো বের করে টেবিলের উপরে রাখলেন।
…..

#চলবে

লেখা-
নাহিদ হাসান নিবিড়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here