#শ্রাবণধারায় (শেষ)
পরদিন বিকালের কথা..
এ্যালেক্সের সঙ্গে কথা বলার পর বেশ দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে এরিন। আজ যেন ওর কোনকিছুতেই মন নেই। গতকাল এ্যালেক্স ওকে তেমন কিছুই বলে নি। প্রথমে হালকা অভিমান-অভিযোগের পর একগাদা চিজি ডায়লগ শুনিয়ে দিয়েছে। ফিল্মি-ফিল্মি স্টাইলে কথাগুলো বলছিলো। প্রত্যুত্তরে এরিন কিছু বলতে পারে নি। চুপচাপ হু-হা করে কল কেটেছে।
ভাবতে ভাবতেই এরিন হঠাৎ খেয়াল করলো মুকুল তার আশপাশে নেই। সে একা আলপথে দাড়িয়ে আছে। অবাক হয়ে দু’ পা এগোতেই চোখে পড়লো আলের শেষে অদূরেই একটা ছোটখাটো জটলা লেগেছে। ওর মনে পড়লো ওদিকে একটা পুকুর রয়েছে। ওটাকে ঠিক পুকুর বলা চলে না, বরং বলা উচিৎ চারদিকে জংলা গাছে ঘেরা পুরোনো ডোবা। এককালে ‘বড়পুকুর’ নামে আখ্যায়িত হলেও কালের আবর্তনে আর অযত্নে-অবহেলায় তার আজ এই হাল!
কিন্তু ওখানে জটলাটা কীসের? এরিন দ্রুত পায়ে হেঁটে জটলার মধ্যে ঢুকলো। চার-পাঁচজনের ভেতর একজন বৃদ্ধা মহিলা আর কিছু গ্রামের ছোট ছোট ছেলেপুলে আছে। দেখলো, মুকুলও এখানেই আছে। সবাই কি নিয়ে যেন বলাবলি করছে। কিছু দড়ি আর লাঠি নিয়ে মুকুল কি যেন করার চেষ্টায় রত।
বিষয়টা হলো ওই ডোবার মধ্যে একটা ছাগলছানা পড়ে আছে। সর্বাঙ্গ কাদায় মাখামাখি হয়ে সে তারস্বরে ‘ম্যাঁ ম্যাঁ’ ডাক পারছে। বয়স বেশিদিন নয় ক’দিন আগেই প্রসব হয়েছে। কাদার দরুন সে উঠতেও পারছে না। নড়লে ডুবে যাচ্ছে আরো বেশি। এখনই ওটাকে তুলতে না পারলে নির্ঘাত মাlরা পড়বে! অসহায় এই প্রাণীটির বেঁচে থাকার জন্য আর্তনাদ শুনতে সত্যিই খুব খারাপ লাগলো এরিনের। মৃlত্যু কি এতই কঠিন?
অনেকের সহযোগিতায় এবং অনেকটা সময়ের প্রচেষ্টায় শেষমেষ ছাগল ছানাটাকে তুলতে সক্ষম হলো মুকুল। কাদা মাখা নোংরা ছাগলটাকে নিয়ে বৃদ্ধার সে কি উল্লাস! এই বৃদ্ধাটির ইহকুলে কেউ নেই। একপাল ছাগল চড়িয়েই জীবিকা নির্বাহ করেন তিনি। সেগুলোর যত্ন নেন। লালন-পালন করেন। তারমধ্যে একটি ছোট্ট ছানার মৃlত্যু হলে দারুণ কষ্ট পেতেন তিনি। বৃদ্ধার ঝুলে যাওয়া চামড়ায় মলিন মুখের হাসিটা দেখে ভীষণ ভালো লাগলো এরিনের।
পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের আনন্দেই অন্য মানুষের আনন্দিত হওয়ার একটা ব্যাপার আছে। একজন হাসলে সেই হাসি অকারণেই অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে। হাসি-আনন্দ এমনই একটা ব্যাপার।
হাত ধুয়ে ফেলে আবারও হাঁটতে শুরু করলো মুকুল। বাড়ির দিকে হাঁটছে। এরিনও সঙ্গে সঙ্গে চলছে। এই মুহূর্তে সে একটা বিশেষ ভাবনায় নিমজ্জিত। সেটা লক্ষ্য করে মুকুল বললো,
— “কি ব্যাপার? তুমি এমন কইরা কি ভাবতেছ?”
— “না কিছু না।”
চমকিত এরিন জবাব দিলো। মুকুল আর কিছু বললো না। এরিন আবারও বললো,
— “আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি, মুকুল। তুমি সেদিন বললে না, তুমি লন্ডন যেতে চাও? আমি তোমাকে নিয়ে লন্ডন যাবো। কেননা আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই!”
হঠাৎ এমন কথার জন্য প্রস্তুত ছিল না মুকুল। আচানক এই কথায় বিlস্ফোlরিত হলো চক্ষু জোড়া। আঁতকে উঠলো,
— “কি কইলা তুমি?”
— “বলেছি, আমি তোমাকে বিয়ে করবো। কেন, তুমি করবে না?”
এর উত্তরে কি বলা উচিত ভেবে পেল না মুকুল। হ্যাঁ, এ কথা সত্য সে এরিন নামের এই বিদেশিনীকে পছন্দ করে। হয় তো কোথাও গিয়ে ভালোও বাসে। তারমানে এই নয় যে, সে ওকে বিয়ে করে ফেলবে। এটা হয় না। কক্ষণো হবার নয়!
— “এটা হইবো না এরিন। তুমি বোকার মতো কথা কইয়ো না।”
— “কেন হয় না? আ-আমি তো তোমাকে ভালোবাসি।”
নাছোড়বান্দা সুর। আবারও জেদি কণ্ঠে জানান দিলো,
— “আমি তোমাকে ভালোবাসি। তাই তোমাকেই বিয়ে করবো মুকুল। তারপর তোমাকে নিয়ে লন্ডন চলে যাবো।”
— “কিন্তু এ্যালেক্স সাহেব? তার কি হইবো?”
হতবাক হয়ে তাকালো। এরিন খুব একটা পাত্তা দিলো না সেই প্রশ্নটা। চোখ সরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে বললো,
— “ওর কি হবে আমি জানি না। তবে ওর কোনো সমস্যা হবে না। ও অন্য কাউকে বিয়ে করে নিতে পারবে।”
— “কিন্তু সে তো তোমারে ভালোবাসে? তুমি তার ভালোবাসার মূল্য দিবা না?”
— “তুমি ভুল বললে মুকুল। এ্যালেক্স আমাকে ভালোবাসে না। আমিও না। আমাদের সম্পর্কটা শুধু পরিচয়ের। বিয়ে ঠিক হয়েছে বলেই এই পরিচয়টুকু। নয় তো..”
এরিন বুঝিয়ে বললো ওকে। মুকুল পাল্টা যুক্তি দেখিয়ে আরো কিছু বললো। কিন্তু শেষমেষ হার মানলো ওর একটা কথায়,
— “আমি তোমার সাথে আর্গুমেন্টে যাবো না। এ্যালেক্সকে আমার এমনিতেই খুব একটা পছন্দ ছিল না। পার্সোনালি অন্য কাউকে পছন্দ করি না বলেই ওকে আমি মেনে নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এখন আর সেটা সম্ভব না। এ্যালেক্সকে আমি বিয়ে করবো না। আর তোমার সমস্যা হলে প্রয়োজনে আমি বাংলাদেশেই থেকে যাবো। ইউকে ফিরবো না।..”
— “আমার জইন্যে তুমি এতবড় ত্যাগ কইরো না, এরিন। এতবড় ত্যাগ আমার জইন্যে কইরো না।”
— “আমি কোনো ত্যাগ করছি না। বরং গ্রহণ করছি। আমার বাংলাদেশ, আমার মাতৃভূমিকে আমি গ্রহণ করছি। তোমাকে ভালোবেসে, তোমার সঙ্গে থেকে যেতে চাই এখানে।”
এরপর আর কথা খাটে না। মুকুল অনেক চেষ্টা করেও এরিনকে বোঝাতে পারে না। ওর যুক্তির জোর অনেক বেশিই। এবং সুদৃঢ়। তাকে খণ্ডানোর সাধ্যি মুকুলের নেই। অগত্যা ও যা বলে, চুপচাপ সেটাই মেনে নেয় মুকুল।
____
ক্রমশ দিন ঘনিয়ে আসছে এরিনদের লন্ডনে ফেরার। আর মাত্র দুটো দিন পরই ওরা ফিরে যাবে। এরিনের কথার যদি সত্যতা থেকে থাকে তবে হয় তো মুকুলকেও সঙ্গে নিয়ে যাবে সে। শুধু শুধু নয়, বিয়ে করেই। কিন্তু মুকুল জানে এ সম্ভব নয়। কোনোদিনও নয়, কোনো অবস্থাতেও নয়!
প্রথমে সবটা এরিনের ঝোঁকের মাথায় বলা কথা ভেবে পাত্তা দেয় নি সে। কিন্তু ক্রমশ বিষয়টা বদলে গেছে। মুকুল বুঝতে পারছে এরিন হুজুগে মাতাল মেয়ে নয়। সে ‘জাতে মাতাল, তালে ঠিক’ ধাঁতের। সে বাস্তবিকই মুকুলকে বিয়ে করবার ফন্দি এঁটেছে। এবং তাতে সে অটল।
মুকুল সরাসরি ওকে না বলতে পারছে না। কেননা ভিতরে ভিতরে ভিতরে সেও এই ‘বিদেশিনী এরিন’-কে পছন্দ করে। কদিনের মধ্যেই ভালোবেসে ফেলেছে ওকে। কিন্তু সমাজ? ওদের পরিবার?
এরিনের পরিবার ওর জন্য ওর যোগ্য একটি ছেলেকে ঠিক করেছে। এ্যালেক্স ইসলাম। লন্ডনের একটি অভিজাত মুসলিম পরিবারের সদস্য। ভালো বেতনের সম্মানীয় একটি চাকরি করছে। তার তুলনায় মুকুলের যোগ্যতা কি? মুকুলকে ওরা এরিনের পাশে মেনে নিবে কি করে? তা কি কখনো হয়? আর তালুকদার বাড়ির লোকজন? তারাই বা কি ভাববে?
মুকুল তো এ-বাড়ির কেউ নয়। তালুকদার পরিবার তাকে ছোটবেলায় এখানে আশ্রয় দিয়েছিল। আপনজন না হয়েও তারা হয়ে উঠেছিল তার অতি প্রিয় মানুষ, আপনের চেয়েও আপন। তাদের সঙ্গে ওর কোনো লেনাদেনা নেই। অথচ তারপরও ওরা ওর কতো বেশি কাছের, কতটা প্রাণের!
আমরা সবসময় রক্তের সম্পর্ককে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকি। অথচ রক্তের সম্পর্কহীন যে সম্পর্ক তার বন্ধন হয় অন্যরকম। অটুট-অবিচল। সেখানে জাগতিক লেনাদেনা থাকে না বলেই হয় তো সে সম্পর্ক হয় মধুর। নিবিড় আন্তরিকতার!
এই প্রিয় মানুষগুলোকে মুকুল কষ্ট দিবে কি করে? কি করে তাদের মন ভেঙে দিয়ে, তাদের সম্মান নিয়ে ছিনিমিনি খেলে বিদেশি একটা মেয়েকে বিয়ে করে সুখী হতে চাইবে ও? এটা করা কি বেশি স্বার্থপরতা হয়ে যায় না? মুকুল কি সেটা পারবে করতে?
____
সকাল নয়টা। রোজকার মতো আজও গ্রামে ঘুরতে বেরোনোর উদ্দেশ্যে মুকুলকে ডাকছে এরিন। কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে খুঁজেও ওকে পাচ্ছে না। বাড়ির সবাই যে যার কাজে মগ্ন। মুকুলের খোঁজ কেউ জানে না। অনেকটা বাধ্য হয়েই তাই ওর ঘরে ঢুকে পড়লো। বাইরে কোথাও না থাকলে, ঘরেই থাকবে নিশ্চয়?
কিন্তু না, মুকুল ঘরেও নেই। তবে গেল কোথায় লোকটা?
এরিনের ব্যস্ত চোখ দু’টো সারা ঘরময় ঘুরে বেড়ালো। একটু পরেই নজরে পড়লো, মুকুলের ঘরটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা। অন্যান্য দিন টেবিলটার উপরে যে বইগুলো থাকে, সেগুলোর পরিমাণ কেমন কমকম দেখাচ্ছে। ভালো করে দেখতেই বুঝলো বইগুলোর অনেকগুলোই আজ নেই! মুকুলের কাপড় রাখা আলনাও আজ ফাঁকা!
চমকিত এরিন এপাশ-ওপাশে চোখ বুলাতেই মুকুলের ঘরের ছোট্ট চৌকির পাশে একটা কাগজ খুঁজে পেল। পাথর চাপা দেয়া, ভাঁজ করা সে কাগজ। হতবিহ্বল হয়ে পাথর সরিয়ে কাগজটা হাতে নিলো এরিন। চৌকির এক প্রান্তে বসে ভাঁজ খুললো,
প্রিয় এরিন,
আইজ এই চিঠিখান আমি কেন লেখতেছি জানি না। তয় একটা কথা জানি, আইজকের পর তোমার সাথে আমার আর দেখা হইবো না। তাই চইলা যাওনের আগে কিছু কথা কইয়া যাবার চাই। এরিন তুমি অনেক ভালা মাইয়া। পরীর লাখান সুন্দর। তোমার পাশে একটা রাজপুত্তুরই মানায়। আমার মতো গরীব-চাষা-ভুষা মানায় না। তুমি আমারে যে প্রস্তাব দিছো, তাতে আমার রাজি না হওনের কিছুই নাই। কিন্তু কি জানো? আমি রাজি হইতে পারি নাই। আমার বিবেক আমারে রাজি হইতে দেয় নাই। যেই বাড়িতে থাইকা আমি ছোট থেইকা মানুষ হইছি, যেই বাড়ির নুন আমার পেটে এহনো আছে, সেই বাড়ির সাথে বেইমানি করতে পারলাম না। আমি জানি তুমি যদি ওগো লগে জেদ্দাজেদি করো, ওরা আমারে মাইনা নিবো। আমারে কিচ্ছু কইবো না। কিন্তু আমি এইডা মানতে পারি না। ওরা আমারে মানলেও আমার জইন্য মনে কষ্ট পাইবো। কাউরে কষ্ট দিয়া কেউ কোনোদিন সুখী হইতে পারে না। তাই আমি কাউরে কষ্ট দিতে চাই না এরিন। আমি চইলা যাইতেছি, তুমি ভালো থাইকো!
ইতি
মুকুল
মুহূর্তেই চিঠিটা হাতের চাপে দুlমড়ে-মুlচড়ে গেল। তারপর সজোরে ছুঁড়ে দিতেই পড়ে গেল মাটিতে। ঘরের অন্য প্রান্তে। এরিন সেদিকে খেয়াল করলো না। মাথা নিচু করে বসে রইলো অটল হয়ে। স্থির-অবিচল হয়ে পার করলো দীর্ঘ সময়। ওদিকে বাড়িতে সবাই মুকুলকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। কিন্তু কোত্থাও মুকুলের হদিস পাওয়া যাচ্ছে না!
_________(সমাপ্ত)________
#মৌরিন_আহমেদ
এখানে ই শেষ। এর পরে কিছু হবে না