শ্রাবণধারায় (২)

#শ্রাবণধারায় (২)

আজ দুপুরের দিকে হুট করেই বৃষ্টি নামলো ঝুমঝুমিয়ে। আকাশ কালো আঁধারে ঢেকে গিয়ে, থেকে থেকে বিদ্যুত চমকাতে লাগলো। বাজ পড়ার শব্দকে বরাবরেই বেশ ভয় পায় এরিন। তাই বৃষ্টি ভালো লাগলেও বাজ পড়ার ভয়ে বৃষ্টিতে ভেজা আর হলো না। অগত্যা কফির কাপ হাতে দোতলার বারান্দায় এসে দাড়ালো। বৃষ্টি পড়ছে পশ্চিম দিক থেকে। হুর হুর করে শীতল বাতাস বইছে। পাতলা পোশাক পরার দরুণ এই বাতাসেই হাড় কাঁপানোর জোগাড় হলো ওর!

শরীরের মৃদু কম্পনে হাতে গরম গরম ধোঁয়া ওঠা কফির কাপে চুমুক, বাইরে ঝুমঝুমবৃষ্টি, ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুতের আলোর ঝলকানি, গগণবিদারী আওয়াজ, সঙ্গে হুটহাট আসা দমকা সমীরণ ছোঁয়া– প্রাণমন জুড়িয়ে দেয়ার জন্য এই তো যথেষ্ট!

বাংলাদেশের অন্যতম সুন্দর বৃষ্টির এই মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখতে ব্যস্ত এরিনের কানে হঠাৎ খুব চিৎকার-চেঁচামেচির আওয়াজ ভেসে এলো। ব্যাপারটা কি বোঝার জন্য আশপাশে তাকাতেই দেখলো, তালুকদার বাড়ির অদূরে খোলা মাঠে মুকুল সঙ্গে একদল বাচ্চা ফুটবল খেলায় মেতেছে। প্রচণ্ড বৃষ্টি, বাজ পড়ার ভয়, সবকিছুকে উপেক্ষা করে তারা খেলছে হুল্লোড় করে। ইতোমধ্যেই মাঠে পানি জমেছে। দৌড়াতে কষ্ট হচ্ছে ওদের। তবুও এই বর্ষণে আনন্দ-হর্ষে বল পাস্ করার কাজটা ওরা করছে। গোল হলেই ফেটে পড়ছে উল্লাসে। দৌড়াতে দৌড়াতে যখন কেউ পিছলে পড়ছে কর্দমাক্ত মাটিতে, পানি ছিটকে পড়ছে আশপাশে, তখন বাকিদের চিৎকার আরো বাড়ছে। বিষয়টা লক্ষ্য করতেই অন্যরকম ভালোলাগায় ছেয়ে গেল ওর মন। আচ্ছা, বৃষ্টির রূপ তো বরাবরই সুন্দর, কিন্তু ঘোর বরষার সঙ্গে এই উল্লাসের দৃশ্যটাকি আরো সুন্দর নয়?
_______

ক’দিনের জোর বৃষ্টির তোপে রাস্তা-ঘাটে প্যাঁচ-প্যাঁচে কাদা জমেছে। সাবধানে না হাঁটলে পিছলে পড়ে হাড়-গোড় ভাঙা অস্বাভাবিক কিছু না। লুঙ্গি একটু তুলে কোঁচা করে হাতে রেখে সাবধানে পথ চলছে মুকুল। পিছনে পিছনে হাঁটছে এরিন। হাঁটুর একটু উপর অব্দি লম্বা একটা ফ্রক পরনে। হাঁটুর কাছ থেকে বলেই সেটাকে টেনে তুলতে হচ্ছে না, কাদার ভয় না করেই সে নির্বিকারে হেঁটে যাচ্ছে। কোনো ভয় নেই, ডর নেই।

একটুপর প্রশস্ত পথ ছেড়ে আল পথের ধারে চলে এলো ওরা। একপাশের ক্ষেতে পাট গাছ দেখা যাচ্ছে সারি সারি। আরেক পাশে আমন ধানের ক্ষেত। চারিদিকে সবুজের সমারোহ মুহূর্তেই দেখে খুব খুশি হয়ে উঠলো এরিন। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে পায়ের গতি বাড়িয়ে দিলো। একা একা আল দিয়ে হাঁটতে শুরু করলো মুকুলকে রেখেই। অনেকটা লাফিয়ে লাফিয়েই। মুকুল পিছে পড়ে গিয়ে মানা করলো,

— “আরে আরে করো কি! করো কি! পিছলা খাইয়া পইড়া যাইবা তো। একবার পড়লে মাজা ভাইঙ্গা যাইবো, দেইখো। সাবধানে যাও।”

— “না, না। পড়বো না তো।”

প্রতিবাদ করে নিজের মতই ছুটতে লাগলো এরিন। মেয়েটা খুশিতে আটখানা হয়ে গেছে। তার দেশ, এই বাংলাদেশটা এত্তো সুন্দর? এত্তো মনোরম এর প্রকৃতি? আহা। কি বৃষ্টি, কি শ্রাবণের মেঘে ঢাকা আকাশ, কদমের গন্ধে মিলেমিশে একাকার হওয়া বাতাস। সবকিছু এতো সাজানো-গোছানো কেন?

ভালোলাগা একটা ছোঁয়াচে রোগের মতোন। কোনকিছুর প্রতি একবার ভালোলাগা শুরু হলে সেটা চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তেই থাকে, বাড়তেই থাকে। এরিনেরও তাই হলো। প্রকৃতির রূপে মুগ্ধ চোখে হুশ হারালো। খোলা চোখ মেলে চারপাশ দেখতে দেখতে ভুলেই গেল সে লন্ডনের মসৃণ রাস্তার ফুটপাথ দিয়ে নয়, বরং বাংলাদেশের এক গ্রামের কর্দমাক্ত-পিচ্ছিল মেঠোপথে হাঁটছে। ফলাফল যা হওয়ার তাই হলো। ‘ধপ্পাস’!

প্যাঁচ-প্যাঁচে কাদার ভেতর পা পিছলে আলুর দম হয়ে গেছে বিদেশিনী এরিন। হালকা হলুদ রংয়ের সুন্দর ছাপার জামাটার পুরোটাতেই লেগে গেছে কাদার দাগ। সেই সঙ্গে হাতে-মুখে, আর ওর শাইনিং সিল্কি চুলেও! আচমকা পড়ে গিয়ে একেবারে হতভম্ব হয়ে গেল এরিন। বোকা চোখে নিজের দিকে তাকালো। এটা কি হলো? এভাবে পড়লো কেন?

ওদিকে ওর এমন বেহাল দশা দেখে মুকুলের হাসি আর থামে না। অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। সারা গা কাঁপিয়ে, আকাশ-বাতাসে ঝংকার তুলে সে হাসছে। এরিন হতবিহ্বল চোখে চাইলো,

— “এটা কি হলো?”
— “কি আবার? ধুপধাপ-ধপ্পাস! হা হা হা।”
— “এ্যাই, এ্যাই। তুমি হাসি থামাও। এরকম বিশ্রী ভাবে হাসবে না একদম!”

এরিন রাগ করে চেঁচিয়ে উঠলো। মুকুল বললো,

— “কেন হাসবো না? অবশ্যই হাসবো। তুমি আমার কথা না শুইনা এইভাবে ছুটছ বইলাই তো পইড়া গেলা। হা হা হা।”

মুকুলের হাসি থামায় সাধ্যি কার? হো হো করে হাসতে লাগলো সে।

সেই হাসির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই এরিনের মনে হলো, এরকম নির্মল হাসি সে আর কখনোই দেখে নি। এই যে মুকুল নামের ছেলেটার এই নির্মল-ছন্দময় হাসি, এর মতো সৌন্দর্য কি প্রকৃতির আর কিছুতে পাওয়া যাবে? এই হাসিটা তো মুকুলের সুন্দর মনের পরিচায়ক। আসলে মানুষের মনের ছাপ তার হাসিতে পড়ে। যার মন সুন্দর তার হাসিও সুন্দর!

আলটা পেরোতেই শ্যালো মেশিনের ঘরটা নজরে পড়ে। কাদামাখা এরিনকে নিয়ে মুকুল সেদিকেই এগোলো। ওখানে শ্যালো মেশিন চলছে। পানিগুলো বের হওয়ার জন্য ঘরের একপাশে কংক্রিটের লাইন বানিয়ে দেয়া হয়েছে। সেই লাইন দিয়ে পানি বেরিয়ে আল দিয়ে ক্ষেতে গিয়ে জমা হয়।

লাইনের সামনে দাড়িয়ে এরিনের হাত-পায়ের কাদা ধুয়ে দিলো মুকুল। ওর দামী জুতো জোড়াও কাদায় মাখামাখি ছিল। সেটাও পরিষ্কার করে ফেললো দ্রুতই। কাদা ধুয়ে ওরা আবারও হাঁটতে লাগলো। গন্তব্য এখন তালুকদার বাড়ির দিকে।
____

দেখতে দেখতেই অনেকগুলো দিন পেরিয়ে গেল। এরিনদের ছুটি বাকি আছে আর মাত্র সাতদিন দিন। আসলে ওদের ছুটি কম ছিল। শুধু একমাসের জন্য এসেছিল বাংলাদেশে। এরিন সেই ছোট্টবেলায় একবার এসেছিল এখানে, দু’দিনের জন্য। তারপর আর আসতে পারে নি। ফলে এরিনের দেখা হয় নি ওর মাতৃভূমি। চেনা হয় নি কিছুই। তাই এরিনের জন্যই দেশে আসা।

রোজকার মতো বিকেলে মুকুলের সাথে গ্রামে ঘুরতে বেরিয়েছে এরিন। হাঁটতে হাঁটতেই এরিন শুধালো,

— “তুমি আমার সঙ্গে লন্ডন যাবে, মুকুল?”
— “নিয়া গেলে যাবো না ক্যান? তুমি নিয়া যাইবা?”

হাসি হাসি মুখে জবাব দিলো মুকুল। সে কথা শুনে একটু অবাক হলো এরিন। বিস্ময় ভাব ফুটে উঠলো চেহারায়। কিন্তু তা মুহূর্তের জন্য। পরক্ষণেই আনন্দিত কণ্ঠে বললো,

— “তুমি সত্যিই যেতে চাও?”

— “না চাইবো ক্যান? আমি কোনদিন এই দেশের বাইরে যাই নাই। সারাজীবন শুধু শুইনাই আইছি তোমাগো ওই দেশের কথা। শুনতে শুনতে ওই দেশ দেখনের সাধ জাগছে কতো। যাইবার পারি নাই। সেই তুমি নিয়া গেলে আমি যামু না ক্যান?”

— “আমি তোমাকে অবশ্যই লন্ডন নিয়ে যাবো। অবশ্যই!”
_______

কম্পিউটারে ছবিগুলো দেখছিল এরিন। গত কয়েকদিন ক্যামেরা হাতে নিয়ে ঘুরে ঘুরে অনেক ছবিই তোলা হয়েছে ওর। সেগুলোই এখন কম্পিউটারে দেখছে। এরমধ্যে কিছু ছবি প্রিন্ট করে ফেলবে। কয়েকটা বাঁধিয়ে এনে টাঙিয়ে রাখবে ঘরে।

হঠাৎই দরজায় ‘টুকটুক’ শব্দ হলো। স্ক্রিন থেকে দৃষ্টি না সরিয়েই গলা তুলে বললো,

— “কাম ইন, প্লিজ।”

আলতো করে আটকে রাখা দরজাটা ঠেলা দিতেই খুলে গেল। ওপাশ থেকে দৃশ্যমান হলো কফির কাপ হাতে রিদিকাকে। দু’ হাতে দু’টো কফির কাপ নিয়ে উনি এগিয়ে এলেন। ওর জন্য বরাদ্দকৃত কাপটা টেবিলের উপর রাখলেন।

— “হোয়াট আর ইয়্যু ডুইং, বেবি?”

ওনাকে দেখেই খানিক উচ্ছ্বসিত হলো এরিন,

— “ওহ্ মম্। আই ক্লিকড দিস পিকচার উইথ মাই ক্যামেরা। আরেন্ট দ্যে লুকিং সো প্রীটি?”

— “ইয়াহ্। দিস আর কিউট।”
— “আই ওয়ান্ট টু প্রিন্ট সাম পিকচারস অফ্ দিস। আই’ল টেক দেম উইদ মি টু ইউকে। ক্যান আই ডু ইট?”
— “অফকোর্স। ইয়্যু ক্যান..”

প্রশ্রয়ের হাসি হাসলেন। এরিন হেসে কফির কাপটা হাতে নিলো। চুমুক দিতেই রিদিকা আবারও বললেন,

— “বাই দা ওয়ে, তুমি কি গতকয়েকদিনে এ্যালেক্সের সঙ্গে কথা বলেছিলে? এ্যালেক্স বলছিল, হি মিসড ইয়্যু। হি কল্ড ইয়্যু বাট ইয়্যু ডিড’ন্ট পিক। হোয়াই?”

এ্যালেক্সের কথা মনে পড়তেই কেমন যেন মিইয়ে গেল এরিন। এ্যালেক্স! তার হবু স্বামীর নাম। বাংলাদেশ থেকে ফেরার পরপরই যার সাথে ওর বিয়ে হয়ে যাবে।

ছেলেটাকে নিয়ে ওর আলাদা কোনো ভাবনা নেই। নিতান্তই অপরিচিত মানুষের মতো মেশে সে ওর সঙ্গে। দু’ একটি প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া নিজে থেকে কখনোই খোশগল্পে মেতে ওঠে না। এ্যালেক্সের দিক থেকে অবশ্য কোনো ত্রুটি নেই, সে প্রাণপণে চেষ্টা করছে এরিনের মন জয় করার, ওর সঙ্গে ফ্রাঙ্কলি মেশার। কিন্তু কেন যেন এরিন সেটা পারছে না। হাজার চেষ্টা করেও না।

মাথা নিচু করে অপরাধী স্বরে বললো,

— “সরি মম্। আই ডিড’ন্ট নোটিশ দ্যাট।”
— “ইয়্যু শুড’ন্ট!”

আফসোসের সুর মেশানো কণ্ঠ। অতঃপর কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন,

— “ঠিক আছে। যা হবার হয়েছে, তুমি এখনই এ্যালেক্সকে কল করে সব ঠিক করে নাও। বেচারা মন খারাপ করে আছে।”

অনিচ্ছা ভরেই এরিন মাথা নাড়লো। ছোট্ট করে স্বীকারোক্তি দিলো,

— “ওকে। আই উইল।”

চলবে____

#মৌরিন_আহমেদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here