#সুপ্ত_অনুরাগে-২২,২৩
#প্রভা_আফরিন
[২২]
সুপ্ত উত্তর না পেয়ে পুনরায় জিজ্ঞেস করল,
“ওহহ! এখন আমার কথার উত্তর দেওয়ারও প্রয়োজন মনে করছ না?”
অপু বিরক্ত হয়ে বলল,
“এমন ভাব করছেন যেন আপনার সঙ্গে আমি কমিটেড?”
“মনে মনে কমিটেড। মুখে স্বীকার করার অপেক্ষা রাখে না।”
“আপনার মন জ্যোতিষীকে অহেতুক মিথ্যাচার করতে নিষেধ করুন। না মনে আর না মুখে। আপনি কিংবা তন্ময়, কারো সঙ্গে কমিটেড নই আমি।”
“বাহ! এখন মুখে খৈ ফুটছে! সামনে তো মেনি বিড়াল হয়ে ছিলে।”
“আমাকে একটু শান্তি দেবেন প্লিজ! এসব মেনি বিড়াল, বেবী ফ্লাওয়ার, বাংলিশ ফুল, নিজস্বতা নেই বলে বলে আপনারা আমাকে পা’গল করে দিচ্ছেন।”
“কোনোটা কী মিথ্যা?”
“সত্যি জেনেও কী আমার প্রতি দুর্বল হওয়া আটকাতে পেরেছেন? তাহলে এখন কেন বদলাতে চাইছেন?”
“কারণ তোমার স্বভাব আমার দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে। তন্ময়কে তো আমি দেখে নেব। তুমি খবরদার ওকে আশকারা দেবে না। ভুলে যেও না তন্ময় বিদেশী কালচারে বড়ো হয়েছে, সেখানেই থাকে। প্রেম, লিভ ইন রিলেশনশিপ, ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড এসব ওদের কাছে রেগুলার ডাল-ভাতের মতো। কত মেয়ের সাথে লটরপটর তার হদিস পাবে না।”
অপুর কান ঝা ঝা করে উঠল। মুখ ফসকে বলে ফেলল,
“এমন ভাব করছেন যেন আপনি সাধু? লটরপটর আপনার স্বভাবে নেই?”
সুপ্ত গা দুলিয়ে হেসে ওঠে। আশকারা পূর্ণ কণ্ঠে বলে,
“তুমি সুযোগ দিচ্ছো কোথায়?”
অপু অপ্রতিভ হয়। প্রতিবাদ করে বলে,
“খবরদার! বাজে কথা বলবেন না।”
সুপ্ত সন্দিগ্ধ কণ্ঠে বলল,
“তুমি আবার কান্নাকাটি জুড়ে দাওনি তো?”
“কাঁদব কেন?”
“একটু পিছু পিছু যাওয়ায় যেভাবে কাঁদো কাঁদো হয়ে গেলে… ভাবলাম সত্যি সত্যিই বিল্ডিং-এর মানুষ জড়ো করে ফেলবে। শেষে প্রেম করতে গিয়ে গণপি’টুনি খেয়ে আসতে হতো।”
মনে হলো অপুর মুখে কেউ লাল আবির ছুড়ে দিয়েছে। মুহূর্তেই টুকটুকে হয়ে গেল মুখখানা। কান, গাল সব তাওয়ার মতো গনগনে হয়ে উঠছে। একাকী রুমের মাঝেও তার সংকোচ হচ্ছে। কপট রাগী সুরে বলল,
“আপনার সাথে জীবনেও কথা বলব না। কক্ষনো দেখা করব না।”
সুপ্ত উত্তরে স্মিত হাসল। একটু বেশিই রুড হয়ে গিয়েছিল সে মেয়েটার প্রতি। দোষটা তো অপরাজিতার নয়। দোষটা তন্ময়েরও নয়। এমনকি পরিবারকেও দেওয়া যায় না। পরিস্থিতি হুট করেই এভাবে হাতের বাইরে চলে গেল যে সুপ্ত ধাক্কাটা হজম করতে পারেনি। ফলস্বরূপ রাগারাগি হয়ে গেল। যাকে সে একটা কঠোর বাক্য শোনায় না তাকেই দুঃখ দিয়ে ফেলল। রিক্সা থেকে টেনে নামানোর সময় রুক্ষ হাতের চাপে অপরাজিতার পেলব হাতটা পিষে দিয়েছিল ক্ষণিকের জন্য। অবশ্য তার একটা ভর্তুকি দেওয়ার চেষ্টা সে করেছে। সুপ্ত বলল,
“ব্যথা দিয়েছি তাই মলমও দিয়েছি। তুমি সুযোগ দিলে আমি নিলাম। এখানে আমার কী দোষ?”
“আমি সুযোগ দিয়েছি?”
“অবশ্যই, নয়তো লজ্জাবতীর মতো লতিয়ে না গিয়ে সপাটে চড় মে’রে দিতে। আমি হলে তো তাই করতাম। তুমি দিলে না কেন, হুম?”
অপু ফোন কেটে দিলো। জড়তায় তার মুখ থেকে কথা বেরুলো না। বিছানায় গা এলিয়ে দিলো অপু। দুচোখে রাজ্যের ক্লান্তি। মাথা ধরাটা ফিরে এসেছে। একটু চা খেতে পারলে ভালো হতো। মাকে বলতে ইচ্ছে করছে না। তিনি সারাদিনই রান্নাঘরে কাটান। নিজের শরীরটাও সায় দিচ্ছে না বানিয়ে খেতে। অগত্যা আলস্য আঁকড়ে সে শুয়ে রইল সারা সন্ধ্যা। আজকে পড়াশোনা হবে বলে মনে হচ্ছে না। খানিকটা বাদেই শিমুল এলো তার কাছে। অপুকে চোখ বুজে শুয়ে থাকতে দেখে বলল,
“তুমি ঘুমাচ্ছ আপু?”
“হু।”
“তাহলে আমার কথা কী করে শুনছো?”
“ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে।”
“তুমি বড়ো আপুর মতো বিয়ে করে দূরে চলে যাবে। সত্যিই?”
“হু।”
“আমাকে নিয়ে যাবে সঙ্গে করে? আমার ভালো লাগে না এখানে।”
অপু চোখ বুজেই হাত বাড়িয়ে শিমুলকে জড়িয়ে ধরল। গাল টিপে বলল,
“ভালো লাগে না কেন?”
“বাবা সারাক্ষণ রাগী রাগী থাকে। আমার ভয় করে। তুমি জানো, রিঙ্কির বাবা ওকে স্কুলে নিয়ে যায়। একসাথে গল্প করে, বিকেল বেলা বেড়াতে নিয়ে যায়। রিঙ্কিকে ওর বাবা কখনো বকে না।”
“আচ্ছা! কখনো কী এমন হয়েছে যে তুই কিছুই করিসনি আর বাবা তোকে বকেছে?”
শিমুল কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
“বকেই তো।”
“এ্যাই মিথ্যা বলবি না। তুই দুষ্টুমি না করলে বাবা বকে?”
শিমুল এবার উত্তর দিলো না। অপু বলল,
“রিঙ্কিকে বকে না কারণ রিঙ্কি দুষ্টুমি করে না। রিঙ্কি তার বাবার কথামতো চলে। রিঙ্কির মতো আদর খেতে হলে তোকেও বাবার কথামতো চলতে হবে তো নাকি?”
“তুমি বাবার কথামতো চলো বলে বাবা তোমায় সবচেয়ে বেশি আদর করে?”
অপু এবার চোখ খুলল। শিমুল প্রশ্নক্তো দৃষ্টি মেলে আছে তার দিকে। অপু বলল,
“তোর কেন মনে হয় বাবা আমাকে বেশি আদর করে?”
“করেই তো। বাবা তোমাকে বকে না, মা’রেও না।আমাকে আর বড়ো আপাকে বকে।”
“কারণ তোরা দুজনই দুষ্টু। আর দুষ্টুদের যদি শাসন না করা হয় তাহলে তারা বিগড়ে যায়। ওই যে পাড়ার পিন্টুকে দেখেছিস না পথে পথে ঘুরে বেড়ায়। মা’রামা’রি করে। কেউ ওকে দেখতে পারে না। পিন্টুকে কেউ শাসন করেনি বলেই এমন পচা দুষ্টু লোক হয়ে গেছে। তুই অমন হতে চাস?”
শিমুল ডানে বামে মাথা নাড়ে। সে হতে চায় মা তেমন।
“গুড! পচা দুষ্টুমি করবি না। তাহলে দেখবি বাবা পরেরবার তোকে নিয়ে থাইল্যান্ড যাবে।”
শিমুলের চোখ চকচক করে ওঠে। উৎসাহিত হয়ে বলে,
“পচা দুষ্টুমি করব না। ভালো দুষ্টুমি করব।”
অপু মৃদু হেসে আবারো ঘুমের প্রস্তুতি নিল। চোখ বুজে বলল,
“এবার পড়তে যা। অনেক হয়েছে ফাঁকিবাজি।”
শিমুলের উজ্জ্বল মুখটা ধপ করে নিভে গেল। সে মূলত এসেছিল পড়া ফাঁকি দিয়ে সময় কাটাতে। আপুর কাছে ঠিক ধরা পড়ে গেল!
______________
সুপ্ত বাড়িতে ঢুকেছিল একটা ঝামেলা করার প্রস্তুতি নিয়ে। তন্ময়ের সম্বন্ধটার সঙ্গে তার মা-ও সম্পৃক্ত। সুতরাং মান-অভিমান মায়ের সঙ্গেও তুমুলে ওঠাবে এমন একটা চিন্তা তার মাথায় ছিল। কিন্তু বাড়ি ফিরে সেটা আর করা হলো না। রফিক সাহেব হুট করেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ডাক্তার এসেছে বাড়িতে। সুপ্ত তা দেখে অস্থির হয়ে উঠল। বৈশাখী আশ্বাসের সুরে বললেন,
“চিন্তা করিস না। সিজন চেঞ্জ হচ্ছে তাই একটু অসুস্থ। মেডিসিন নিয়ম মেনে নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।”
রফিক সাহেব খাটে হেলান দিয়ে শুয়ে ছিলেন।বৈশাখীর কথায় বিরোধ করলেন,
“নেব না মেডিসিন। হবো না সুস্থ। ঘরে দামড়া ছেলে এখনো বালখিল্যতা করে বেড়ায়। সারাদিন বাইরে ঘুরে বেড়ায়। আমার দুঃখ বোঝে না। আমার সুস্থ হওয়ার কোনো দরকার নেই।”
রফিক সাহেবের দুচোখ অভিমানে টইটম্বুর। সুপ্তের খেয়াল হলো অনেকদিন বাবার সঙ্গে তার সময় কাটানো হচ্ছে না। আপন পৃথিবীতে মজে এমনিতেই সে বাড়িতে থাকা কমিয়ে দিয়েছে। মা আসার পর মাকে পুরো সময় দিতে গিয়ে বাবার সঙ্গে ভালোমতো কথাই হয় না। আজ ভালোভাবে খেয়াল করতে গিয়ে বুকে চিনচিনে ব্যথার উদ্রেক হলো। তার মা-বাবা দুজনই বুড়িয়ে যাচ্ছে। বার্ধক্য তাদের দেহের ওপর আধিপত্য ছড়াতে শুরু করেছে। সেই সঙ্গে উদয় হচ্ছে বার্ধক্যজনিত রোগ। এটা তারই কোনো লক্ষণ কিনা! সুপ্ত বাবার পাশে বসে আলতো করে হাত ধরল। ডাক্তারকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আঙ্কেল, মোটা সু’ই দিয়ে একটা ইনজেকশন দেবেন। যেন এক সপ্তাহ বিছানা না ছাড়তে পারে।”
রফিক সাহেব ঝট নিজের হাতখানা ছাড়িয়ে নিলেন ছেলের হাত থেকে। মুখ ঘুরিয়ে বললেন,
“হ্যাঁ আমার তো আরো ডজনখানিক ছেলে-মেয়ে আছে যারা কাজ কমাবে। মাশাআল্লাহ একজন আছেন, আর তিনি পারেন খালি হার্টের গতি বাড়াতে।”
সুপ্ত ডাক্তারকে উদ্দেশ্য করে আবার বলল,
“এমন কোনো মে’ডি’সিন নেই যাতে এসব ফ্যাচফ্যাচ করা অভিমানও বাপ বাপ করে বিদায় হয়?”
রফিক সাহেব ধমকে উঠলেন,
“কত বড়ো বে’য়া’দব! বাপের রোগ বাপ বাপ করে তাড়াতে চায়? শুনেছো বৈশাখী?”
বৈশাখী মুখ চেপে হেসে উঠলেন। রফিক সাহেব ডাক্তারকে বললেন,
“এমন কোনো মে’ডি’সিন নেই যাতে বাইকের নে’শা ছেলে ছেলে করে মাথা থেকে নামে?”
সুপ্ত ভ্রু কুচকে বলল,
“ছেলে ছেলে করে নামে আবার কী?”
“তুমি বাপের রোগ তাড়াতে বাপ বাপ করা মে’ডি’সিন চাইলে, আমি ছেলের রোগ নামাতে ছেলে ছেলে করা মে’ডি’সিন চাইব না কেন?”
সুপ্ত হা করে তাকাল। ডাক্তার সাহেব হেসে উঠলেন। বললেন,
“তোমাদের চেয়ে বড়ো মে’ডি’সিন পৃথিবীতে দুটি নেই। তোমরা দুজনই দুজনের জাদুকরী মে’ডি’সিন।”
ডাক্তার মে’ডি’সিন প্রেসক্রাইব করে চলে গেলেন। কিছু টেস্ট করানোর নির্দেশনাও দিলেন। সুপ্ত বাবাকে চোখ উল্টানো দেখিয়ে ডাক্তারকে ফিস দিতে গেল। রুমে রফিক সাহেব ও বৈশাখী একা।
বৈশাখী প্রলম্বিত শ্বাস ফেলেন। দুটি মানুষ দুজনের একাকিত্বের সঙ্গীরূপে একে অপরকে আঁকড়ে বেঁচে আছে। তাদের মাঝে বাবা-ছেলের বৈশিষ্ট্য কম বন্ধুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য বেশি। বৈশাখীর বড়ো হিং’সে হয়। শিশির বিন্দুর মতো ফোটায় ফোটায় আক্ষেপ জমে বুকের ভেতর। ছাব্বিশ বছর আগে তিনি যদি এখনকার মতো ঠান্ডা মস্তিষ্কের মানুষ হতেন তাহলে বোধহয় সংসারটা আরেকটু পরিপূর্ণ হতো। খানিক বাদেই আবার সেই ভাবনা ঝেড়ে ফেলেন। তিনি থাকলে দুজনের সম্পর্কটা উনার ওপর নির্ভরশীল হতো। প্রতিটা পরিবারই মায়ের ওপর নির্ভরশীল হয়। বৈশাখী নেই বলেই বোধহয় রফিক সাহেব ও সুপ্তের সম্পর্কটা একে-অপরের প্রতি নির্ভরশীল। বৈশাখী বললেন,
“তোমাদের দেখলে মনটা প্রশান্তিতে ভরে ওঠে। কি সুন্দর বোঝাপড়া। আবার হিং’সেও হয়, আমি নেই সেখানে। আমি যে কেন ব’দরাগী, অসহিষ্ণু ছিলাম? বেলাশেষে আমার কিছুই রইল না।”
রফিক সাহেব বললেন,
“নিজেকে দোষ দিয়ো না বৈশাখী। দোষ আমারও ছিল। আসলে আমাদের সময়টা অনুকূলে ছিল না।”
বৈশাখী আ’ত’ঙ্কিত হয়ে বলেন,
“সুপ্ত যদি জানতে পারে ওর আগমনই আমাদের বিচ্ছেদের কারণ, আমি ওকে সহ্য করতে পারিনি, ও কী আমায় ভালোবাসবে?”
“এসব কথা কেন তুলছো বলোতো? ও কিচ্ছু জানবে না। জানলেও ভুল বুঝবে না। আমার ছেলের মন খুবই সরল।”
পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন করে বৈশাখীর চোখের কার্নিশ ভিজে ওঠে। ক্ষীণ স্বরে বলেন,
“আমি কেন তোমার মতো জোর দিয়ে ‘আমার ছেলে’ বলার অধিকার হারালাম। কেন ওই সরল মনের ছেলেটা আমার কোলে জন্মালো না? ঘর, বর, সন্তান নিয়ে ভরা সংসারের স্বপ্ন ছিল। অথচ বিধাতা আমাকে কিছুই দিলেন না।”
সুপ্ত দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে বিরাট এক ঢোক গিলল। তার আর ভেতরে যাওয়ার সাহস হলো না। নিঃশব্দে সরে গেল সেখান থেকে।
চলবে..
#সুপ্ত_অনুরাগে
#প্রভা_আফরিন
[২৩]
শীত শীত সকাল যেন একরাশ আলস্য নিয়ে ধরনীর বুকে পদার্পণ করেছে। অপুর বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে করছে না। ইচ্ছে করছে না ভার্সিটি যেতে। তার আজকাল কিছুই ভালো লাগে না। এই যে ভালো লাগে না বিষয়টা, এটাও ভালো লাগে না। কিন্তু নিরসনের কোনো উপায়ও পাচ্ছে না। যেন এক নিরবচ্ছিন্ন অমাবস্যা নেমে এসেছে মনের দেয়াল বেয়ে। যা শেষ হওয়ার নামই নিচ্ছে না। অপু হাতড়ে হাতড়ে আলো খুঁজছে। অথচ পাচ্ছে শুধু নিশ্ছিদ্র আঁধার।
অপু বিছানা থেকে উঠে ফোন হাতে নিল। উহুম, নেই। কোনো কল বা ম্যাসেজ নেই। সম্পূর্ণ একটি সপ্তাহ গড়াল অপুর ফোনে সুপ্তের কোনো সাড়া আসেনি। ভার্সিটির পথে, ফরিদ মিয়ার দোকানে কোথাও সুপ্তের অস্তিত্ব নেই। বাইকের হর্ন নেই। অপুর তো শান্তি পাওয়ার কথা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় সে শান্তি পাচ্ছে না। অপুর মনে হয় একটা লোকারণ্য পথে সে হাঁটছিল, চারপাশে গিজগিজ করছিল মানুষ। গায়ে গায়ে ধাক্কা লাগা, ঝগড়া, চিৎকারে ডুবে ছিল পথটা। অপু গরমে, ঘামে, কোলাহলে বিরক্তির ঢেকুর তুলে সেই পথে হেঁটে যাচ্ছিল। এরপর হুট করেই তা জনশূন্য হয়ে গেল। সারা রাস্তায় অপু হয়ে গেল একা। এতক্ষণ জনারন্য থাকায় যে বিরক্তি এসেছিল এখন ফাঁকা রাস্তায় তা নেই। ঠিক তখনই অপুর খেয়াল হলো শূন্য পথ তার ভালো লাগছে না। মানুষ অভ্যাসের দাস। অপু এ চিরায়ত স্বভাবের উর্ধ্বে নয়। জনাকীর্ণ পথ তার অভ্যাসে মিশে গেছিল বলেই শূন্য পথ তার ভালো লাগছে না। থেকে থেকে ছমছমে অনুভূতি তুলছে বুকের ভেতর। অবশ্য পথের সঙ্গী একজন হতে চেয়েছিল। অপু তার হাত আঁকড়ে ধরতে পারেনি। অথবা চায়নি।
অপু পিঠ ছড়ানো অমাবস্যার চুলগুলো প্যাচিয়ে খোপা করে বিছানা ছেড়ে নামল। জাহেদা বেগম বললেন,
“ঘুমিয়েই তো অর্ধেক বেলা পার করে দিচ্ছিস। ভার্সিটি, পড়াশোনা সব গুলিয়ে খাচ্ছিস ঘুমের সাথে। তুই এমন অনিয়ম শুরু করলি কবে থেকে? খাওয়া নেই, নাওয়া নেই, দিন দিন শুকিয়ে কেমন হচ্ছিস সে খেয়াল আছে? পাত্রপক্ষ দেখলে কী বলবে? মেয়েকে যত্ন করি না?”
অপু মায়ের কথায় বিশেষ গাইগুই না করে বলল,
“খেতে দাও, রেডি হয়ে আসছি।”
“আমি তো তোদের দাসীবাদী। হুকুম করবি আর মুখের সামনে সব তুলে ধরব।”
“আচ্ছা, আমি নিয়ে নেব। তোমায় করতে হবে না।”
“এখন আমাকে কাজ দেখাবে? দুটো কথাও বলা যায় না তোদের। গায়ে লেগে যায়!”
অপু চুপ রইল। মা এখন ঘন্টাখানেক ধরে গজগজ করবে। প্রেশার বাড়িয়ে, অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে একেবারে শান্ত হবে। জাহেদা বেগম বাধা কাজের লোক রাখেন না। ছুটো কাজের লোক এসে ধোয়া-মোছার কাজ করে যায়। বছর তিনেক আগে অবশ্য বাধা কাজের লোক ছিল। পুরোনো মহিলাটি প্রায় দশ বছর কাজ করেছে এ বাড়িতে। পরে অসুখে পড়ে মা’রা গেল। এরপর এজেন্সির মাধ্যমে কম বয়সী এক মেয়ে এলো বাড়িতে৷ কিছুটা চঞ্চল ধাচের মেয়ে। মুখ যেন তুবড়ি, বকর বকর করেই যেত। জাহেদার কাছে তা ভালোই লাগত। তিন ছেলেমেয়ে স্কুল-কলেজে চলে গেলে সঙ্গ দিতো মেয়েটি। কিন্তু কিছুদিন যেতেই ধরা পড়ল অসঙ্গতি। অপু-বেলীর রুম থেকে দামী সাজসজ্জার সরঞ্জাম হারিয়ে যায়। রান্নাঘরের জিনিসপত্রও সময়ের আগে ফুরায়। এরপর খেয়াল করলেন মেয়েটির কাজুর সঙ্গে চোখে লাগার মতো ভাব। কথায় কথায় ঢলে পড়ে গায়ে। কাজু তো আশকারা দিতে এক পা বাড়িয়েই আছে। একদিন হাতেনাতে ধরলেন। কাজু বুবুর থেকে টাকা নিয়ে কাজের মেয়ের পেছনে ভাঙে। জাহেদা বেগম তা সহ্য করতে পারলেন না। দুজনকেই বাড়িছাড়া করলেন। কয়েকদিন বাদেই অবশ্য কাজু বিরাট ছ্যাকা খেয়ে ফিরল। মেয়েটি নতুন প্রেমিক পেয়ে বেকার কাজুকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলে গেছে। এরপর থেকে বাধা কাজের লোক এ বাড়িতে ঠাঁই পায়নি।
ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে অপু শেষবারের মতো আশেপাশে তাকাল। এত এত মানুষ থাকার পরেও তার কাছে পথটা ফাঁকাই লাগল। তার অবস্থা দেখে মধ্য গগনের সূর্যটি তখন কটাক্ষ করে যেন বলতে চাইল,
“থাকতে তো মর্ম বুঝিসনি, তবে এখন কেন এই বৃথা আকাঙ্খা? বৃথা দেখার বাসনা?”
আসলেই! কেন এই বৃথা আকাঙ্খা? অপু নিজের কাছে কৈফিয়ত দেয়, একটা মানুষ হুট করে গায়েব হলে তাকে নিয়ে একটু ভাবনা হতেই পারে। তার জায়গায় অন্যকেউ হলেও অপু ভাবত। বাড়ির সম্মুখে পৌঁছে সে ফরিদ মিয়ার জনশূন্য দোকানে পা রাখল। ফরিদ মিয়ার তখন ঘুম লেগেছে দুচোখে। হুট করে অপুকে দেখে সে ভড়কে গেল।
“ভাবীজান আপনে? আহেন, বহেন। কী খাইবেন কন। চা, পান, বিড়ি…”
বলতে বলতেই ফরিদ জিভ কাটল। অভ্যাসবসত মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে।
অপু ফরিদের মুখে ভাবী ডাক শুনে অপ্রতিভ হয়েছে। তবে শেষ বাক্যটা শুনে হেসে ফেলল। বলল,
“পান, বিড়ি তো খাই না।”
“গুড়ের চা খাইবেন? ইস্পেশাল গুড়ের চা, ভাইজানের পছন্দের।”
অপু চা খেতে আসেনি। কিন্তু এখন খেতে ইচ্ছে করছে। সে কাঁধের ব্যাগটা বেঞ্চিতে নামিয়ে বসে বলল,
“বানান দেখি এক কাপ স্পেশাল গুড়ের চা।”
ফরিদ চায়ের কাপ এগিয়ে দিতে অপু আগ্রহ নিয়ে তাতে চুমুক দিলো।
“আপনার স্পেশাল গুড়ের চা তো খুবই স্বাদু। আপনার ভাইজান এখন আর খেতে আসে না?”
“ভাইজান তো আগে মিস দিতো না কোনোদিন। প্রত্যেকদিন পাঁচ কাপ চা খাইত। তয় এহন আর আহে না। আপনেরা কি রাগারাগি করছেন?”
“নাহ।”
“তাইলে কী ভাইজানের অসুখ?”
“জানি না।”
“আপনে কী ভাইজানরে ছ্যাকা দিছেন ভাবী?”
“আপনি আমাকে ভাবী ডাকবেন না ফরিদ মিয়া। আমি আপনার ভাবী নই। আপা ডাকবেন।”
ফরিদের মুখটা বিমর্ষ হয়ে গেল। অপু দুই চুমুক দিয়েই উঠে গেল। বিল দিতে নিলে ফরিদ বলল,
“লাগব না আপা। এক কাপ চা বেইচা কি বড়োলোক হমু? ভাইজান আপনের নামে যেই বখশিশ দিতো তা দিয়া পুরা পাড়ার মানুষরে তিনবেলা চা খাওয়ান যাইব। ভাইজান যদি আমার দোকানে আর না আহে, আপনেও আইবেন না। আমি আপনের কাছে চা বেচমু না। আপনে একটা পাত্থর।”
অপু দীর্ঘশ্বাস ফেলে দোকান থেকে বেরিয়ে গেল। লোকটা বশীকরণ জানে। সবাইকে বশ করে ফেলেছে।
_______________
শিমুলের পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে। গতবার সে বাংলায় পেয়েছিল চব্বিশ। এবার আরেকধাপ এগিয়ে পঁচিশ পেয়েছে। শুধু তাই নয়, এবার শিমুল অংকে পেয়েছে বত্রিশ। মানে একের জন্য ফেইল! রেজাল্ট কার্ডে জ্বলজ্বলে দুটো লাল কালির দাগ ও গার্ডিয়ান কল পেয়ে লজ্জায় জাহেদা বেগমের মুখখানা ছোটো হয়ে গেল। ফলস্বরূপ শিমুলের কপালে জুটল সপাৎ সপাৎ স্কেলের বা’রি। সেখানেই থেমে থাকেননি। শিমুলের শিক্ষাগুরু কাজুর কপাল বরাবর ছুড়ে মা’রা হয়েছে স্যান্ডেল। শিক্ষককে এহেন অপমান! কাজু কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। ফলস্বরূপ সে আবারো বাড়ি ছেড়ে লাপাত্তা। কাজুর বাড়ি ছেড়ে বিদায় হওয়ার আরেকটা কারণ অবশ্য আছে। বুবুর স্যান্ডেলের চেয়ে বড়ো অপমান যে দুলাভাইয়ের ঝুলিতে আছে সে নিয়ে কাজুর বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। সুতরাং জান বাঁচানো ফরজ। এবং কাজু সেই ফরজ কাজ আগে করেছে। ফেঁসে গেছে বেচারা শিমুল।
মায়ের হাতে একদফা মার খেয়ে, কেঁদেকেটে শিমুল পরবর্তী মার খাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। গতবার এক বিষয়ে ফেইল করায় জুটেছে একটা থা’প্পড়। এবার দুই বিষয়ে ফেইল করায় দুটো থা’প্পড় জোটার সম্ভাবনা আছে। বাবা আবার মায়ের মতো কাপড় ধোয়া ধোয় না। একটা মা’রবে সেটার ওজনই এক গামলা কাপড় ধোয়ার সমান৷ গতবারের মতো এবারও চশমাটার প্রাণ সংশয় আছে। একবেলা না খেয়ে থাকলেও শিমুলের ততটা কষ্ট লাগে না যতটা চশমা ভেঙে গেলে লাগে। চশমা ছাড়া শিমুল ও সূর্য ছাড়া পৃথিবী একইরকম। কিছুই স্পষ্ট দেখা যায় না। তাই শিমুল মার খেতে যাওয়ার আগে চশমা রেখে যাবে। কাঁদতে কাঁদতে পরিকল্পনা করে ফেলল সে। তবে সেই পরিকল্পনা কাজে লাগল না। আনিসুল সাহেব তার রেজাল্ট নিয়ে মাথাই ঘামালেন না। তিনি জানালেন নতুন সংবাদ। তন্ময়ের পরিবার বিয়ের পাকা কথা বলতে আসবে। সেদিনই আংটি বদল হবে। পুত্রবধূ হিসেবে উনারা অপুকেই চাইছেন।
সে কথা শুনে অপু বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। সুপ্ত থাকতে তন্ময়ের পরিবার এমন একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারল কী করে? সুপ্ত আটকাল না? নাকি চাইল না? অপুর দুই চোখে আচমকা জল জমতে শুরু করল। অনেক বছর পর সে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাল। বসার ঘরে বাবা-মায়ের সামনেই ডুকরে কেঁদে উঠল। আনিসুল-জাহেদা দম্পতি অপুর এহেন আচরণে থমকে গেলেন। জাহেদা ছুটে এসে অপুর মাথাটা বুকে চেপে ধরেন। পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ভেজা গলায় বললেন,
“কাঁদে না মা, আমরা তো তোকে এখনি দিয়ে দেব না। বিবিএ কমপ্লিট করে এরপর যাবি।”
অপুর বুকের ভেতর হুট করেই ঝড় উঠেছে। যেন এতদিন তার ভেতরটা গুমোট হয়ে ছিল এমন একটা ঝড়ের জন্যই। সে মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে কেঁদেই গেল। কেউ না জানলেও আজিজ সেই কান্নার কারণ জানল। এবং কিছুটা আভাস বেলীও পেল। খোচা দিয়ে বলল,
“তুই আদৌ পরের বাড়ি যাবি বলে কাঁদছিস নাকি তন্ময়ের সাথে বিয়ে ঠিক হচ্ছে বলে কাঁদছিস? অন্যকাউকে পছন্দ নয়তো?”
অপু উত্তর দিতে পারেনি। ছুটে নিজের রুমে চলে গিয়েছে। এরপর থেকেই তার নিমগ্ন দৃষ্টি ফোনের দিকে। অনেকক্ষণ দোনোমনা করে সে সুপ্তের ফোনে কল করল। প্রথমবার বেজে বেজে কেটে গেল। অপুর ইগোতে লাগল। তার ফোনটাও ধরল না। নির্লজ্জ মানুষের হঠাৎ এত অহং কোথা থেকে আমদানি হলো? সে রেগেই আরেকবার কল করল। এবার রিসিভ হলো। দরাজ কণ্ঠের মালিক জড়ানো স্বরে উচ্চারণ করল,
“হ্যালো!”
“আপনি একটা অসহ্য। আপনার উপস্থিতিও অসহ্য। অনুপস্থিতিও অসহ্য। কেন জ্বা’লাচ্ছেন আমায়?”
সুপ্তের উত্তেজিত কণ্ঠ পাওয়া গেল,
“কাঁদছো কেন, অপরাজিতা?”
“আপনি ফোন করেননি কেন একবারও?”
“এমনিই।” সুপ্তের গা ছাড়া উত্তর।
অপু ক্ষে’পে উঠল,
“এমনিই?”
“হু।”
“এখন আর আমি কেউ না?”
“তুমিই তো সব। আমিই কেউ না।”
“হেয়ালি করবেন না বলে দিচ্ছি। জানেন তন্ময়ের বাড়ি থেকে বিয়ের তারিখ ঠিক করতে আসছে।”
“তন্ময় ভালো ছেলে। বিয়ে করে নাও। সুখে থাকবে।”
“করে নেব? আপনি বলছেন এই কথা?”
“হু।”
“কক্ষনো কথা বলব না আপনার সাথে।”
“বোলো না। কক্ষনো বোলো না।”
চলবে..