সুপ্ত_অনুরাগে-১৮,১৯

#সুপ্ত_অনুরাগে-১৮,১৯
#প্রভা_আফরিন
[১৮]

গতকাল বৃষ্টি হওয়ার পর আর সূর্য ওঠেনি। দিনটা মেঘলা কেটেছে। রাতে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হয়েছিল।আজকের দিনটাও মনে হচ্ছে তেমনই যাবে। সুপ্ত আজ বাইক নিয়ে বেরোয়নি। অবাক করা বিষয়! সকালে উঠেই যে বাইক ছুটিয়ে পিচঢালা পথ দাপিয়ে বেড়ায় আজ তার সাড়াশব্দ খুবই কম। বৈশাখী কাল থেকেই খেয়াল করছেন সুপ্ত কেমন থম মে’রে আছে৷ দরকারের বাইরে একটা কথাও বলেনি। রাতে ঘুমানোর সময় হুট করে মাকে টেনে এনে বলেছে,
“আমি ঘুমাতে চাই। কিন্তু ঘুম আসছে না। তুমি একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দাও না, মা।”

ছেলের শুকনো কণ্ঠ শুনে বৈশাখীর মনে প্রশ্ন উঁকি দিয়েছে। কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করেননি। ছেলেটা এখনো কিছুটা শিশুসুলভ আচরণের হলেও সে পূর্ণবয়স্ক যুবক। নিজস্ব পৃথিবী আছে। নিজস্ব চিন্তা, ভাবনা, দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছে। তাতে অযাচিত কারো হস্তক্ষেপ হয়তো মনঃপুত হবে না। বৈশাখী অনেক রাত অবধি ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছেন। ছেলের অস্থিরতায় এপাশ ওপাশ হওয়া দেখেছেন।

সকালেও ছেলের স্বভাববিরুদ্ধ আচরণ রফিক সাহেবের কপালেও ভাজের রেখা সৃষ্টি করল। ফারিহা বলল,
“ভাইজান, হয়তো সেই মেয়েটার সঙ্গে কিছু হয়েছে। আপনি বরং ওর বিয়ের ব্যবস্থা করুন। এভাবে বাংলা সিনেমার মতো পেছনে লেগে থেকে মেয়ের মন জয় করার বিষয়টা পুরোনো হয়ে গেছে! যুগ এখন আপডেট। তারওপর আজকালকার প্রেম-ভালোবাসা তো অসময়ে ভেসে আসা মেঘের মতো। ঝরে গেলেই নেই।”

রফিক সাহেব ডানেবামে মাথা দোলালেন। বললেন,
“উহুম, যার ভালোবাসা সেই জানে কীভাবে সামলাতে হয়। আমি-তুমি এসব দেখে নিজেদের মতো ভেবে নিতে পারি। কিন্তু উপলব্ধিটা যার, তার আচরণই মুখ্য যদি সে বুদ্ধিমান হয়। ভুলে যেও না আমার ছেলে বুদ্ধিমান।”

কথাটা বলে রফিক সাহেব চুপ করে গেলেন। বয়সের সঙ্গে মানুষের ভাবনার কেমন বদল ঘটে। এই ভাবনাটাই যদি আরো ছাব্বিশটা বছর আগে থাকত! থাকত এমনই ধৈর্য ও সহনশীলতা! মানুষ কেন দেখে শেখার চেয়ে ঠেকে শিখতে ভালোবাসে? রফিক সাহেব চোখ তুলে তাকালেন। কিছুটা দূরেই বৈশাখী দৃষ্টি আড়াল করে একমনে সংসারের কাজ করে যাচ্ছে। অথচ সবই সাময়িক মরিচিকা।

সুপ্ত দোতলা থেকে নামল একেবারে তৈরি হয়ে। ডাইনিং টেবিলে সবাই তারই অপেক্ষায় ছিল। সুপ্ত চেয়ার টেনে বসে হাতের তিনটে এনভেলপ টেবিলে রাখল। রফিক সাহেব বললেন,
“এগুলো কী?”
“সিভি।”
“কার?”
সুপ্ত অনিচ্ছার দৃষ্টি বিদ্ধ করে বাবার প্রতি। রফিক সাহেব সুক্ষ্ম তাচ্ছিল্যের সুরে আবার বলেন,
“এতদিন পরে শোকেসে তুলে রাখা বাসনকোসন নামাচ্ছো যে? মেহমানদারি করতে?”

সুপ্ত রাগী ভঙ্গিতে একটা কাটা চামচ তুলে খাড়াভাবে পোচ ডিমের গায়ে গেঁথে দেয়। যেন ডিমটাকে সে খু’ন করল। বৈশাখী বাধ সেধে বললেন,
“আহ! কীসব কথা বলছো? সকাল সকাল পেছনে লাগছ কেন?”

ফারিহা ঠোঁট টিপে হেসে বলল,
“বাপ-ছেলের এসব কান্ডকারখানা দেখেই আমার সকাল থেকে রাত হয়, ভাবী। মাঝে মাঝে তো বুঝেই পাই না বাড়িতে বাবা তার ছেলেকে নিয়ে বাস করে নাকি দুই হিং’সুক, ব্যাচেলর রুমমেট। যারা একজন আরেকজনকে ছেড়ে থাকতে পারে না, আবার একসাথে থাকলে অতিষ্ঠ হয়ে যায়।”

বৈশাখী বুঝল সুপ্ত সত্যি সত্যিই রেগে যাচ্ছে। প্রসঙ্গ ঘোরাতে বললেন,
“কোথাও যাচ্ছিস, সুপ্ত?”
“যাচ্ছি, সিভি ড্রপ করতে। চাকরির জন্য।”
“কিহ! তাইতো বলি আজ সূর্য কেন উঠল না!”
রফিক সাহেব কথাটা বলেই পত্রিকার মেলে ধরলেন মুখের সামনে। বৈশাখী টেবিলে মৃদু আওয়াজ তুলে ধমকালেন,
“আবার লাগছো?”
“তোমার আদরের পুত্রকে জিজ্ঞেস কর বাপ এতদিন যা বলে বলে করাতে পারল না তা আজ কোন মন্ত্রবলে সম্ভব হলো?”

সুপ্ত কাল অপরাজিতা সঙ্গে কথা হওয়ার পর থেকে চাপা রাগে জ্ব’লছিল। তার এত যত্ন, ভালোবাসা, আকুলতা সব পায়ে ঠেলে অপরাজিতা আরেকজনকে বিয়ে করবে এটা মানতে পারছিল না। সম্ভবও না। কল্পনা করেই রন্ধ্রে রন্ধ্রে অস্থিরতা ছড়িয়েছে। তারওপর অপরাজিতার বারবার উপেক্ষা। সব মিলিয়ে সুপ্ত বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। এখন বাবার কথায় সে সত্যি সত্যিই আহ’ত হলো। তাকে সবাই এতটাই অকর্মণ্য ভাবে যে চাকরি করবে শুনে আশ্চর্য হচ্ছে? পর পর অ’প’মান তার সর্বাঙ্গে ক্রো’ধের দা’বানল ছড়িয়ে দিলো। নাশতা অর্ধেক ফেলেই সে সিভি নিয়ে উঠল। রফিক সাহেব বললেন,
“কষ্ট করে জুতোর তলা খুইয়ে চাকরি খোঁজার কী দরকার? আমার কাছে চাইলেই তো পারিস। আমার যা তা তো তোরই।”
“এটা আমার যোগ্যতার প্রশ্ন বাবা। প্রমাণ করেই ছাড়ব।”
রফিক সাহেব ঠোঁট উল্টে কাঁধ ঝাকালেন,
“ওকে, বেস্ট অফ লাক।”

সুপ্ত হনহনিয়ে চলে গেল। বৈশাখী কপাল চাপড়ে বললেন,
“কেন করলে এমনটা? খাওয়ার সময় এভাবে কথা না বললে কী হচ্ছিল না?”
“ওর এবার লাইফ নিয়ে সিরিয়াস হওয়া উচিৎ, বৈশাখী। ছোটো থেকে প্রপার টাইম, কেয়ার বা সঙ্গ দিতে পারিনি বলে শাসন করিনি কখনো। যাতে খুশি তাতেই এগোতে দিয়েছি। এবার সময়টা কাজে লাগাক। যার দ্বারাই ইগোতে লাগুক বা ইনফ্লুয়েন্সড হোক না কেন, লাইফ নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবুক। যার জন্য এত ত্যাগ তাকে এই ছন্নছাড়া জীবনে রেখে ম’রেও শান্তি পাব না।”

বৈশাখীর বুকটা ধক করে ওঠে। ত্যাগ শব্দটা আজও উনার বুকে কা’টা হয়ে বিঁ’ধে। যার যন্ত্র’ণা প্রতিটা মুহূর্তে দ’গ্ধ করে।
________________

দুপুর নাগাদ আরেক পশলা বৃষ্টি হয়ে সদ্য শুকোতে থাকা প্রকৃতি আবার ভিজে উঠেছে। কাদা-জলে ভরে গেছে রাস্তাঘাটের খানাখন্দ। অপুর মেজাজ বেজায় বিগড়ে আছে। কাল বৃষ্টি তাকে যতটা মুগ্ধ করেছিল আজ যেন ততটাই বিরক্ত করছে। এখন তাকে এই শীত শীত আবহে ভাতঘুম ছেড়ে ছুটতে হবে কফিশপে! তন্ময় ইতিমধ্যে তাকে রিমাইন্ডার দিয়েছে একবার। অপু অনিচ্ছায় তৈরি হয়ে নিল। বের হওয়ার আগে ফোনটা চেক করে নিল পুনর্বার। গতকাল রাতেই মনের সাথে যু’দ্ধ করে সুপ্তকে সে আনব্লক করেছে। সরি বলতে ইচ্ছে হয়েছে। কিবোর্ড-এ আঙুল চলেও সেন্ড বাটনে ক্লিক হয়নি। সুক্ষ্ম ইগো তাকে সে কাজ করতে বারবার বাধা দিয়েছে। লোকটা যদি ভেবে বসে অপু তার প্রতি দুর্বল! নানান দ্বিধাদ্বন্দের পরে অবশ্য ঠিক করেছে সুপ্ত একটা ফোন বা ম্যাসেজ দিলেই সে সরি বলে দেবে। কিন্তু তেমন কিছুই ঘটেনি। অপুর মন এখন অনেকটা কালো মেঘাবৃত্ত আকাশের মতোই।

কফিশপের লোকেশন আগেই জানানো ছিল। অপু কাচের দরজা ঠেলে ঢুকতেই তন্ময়ের দেখা পেল। তন্ময় বিগলিত হয়ে তাকে গ্রহণ করে।
“সরি! অনেকক্ষণ যাবত অপেক্ষা করালাম।”
“ফুলের জন্য এটুকু সময় নস্যি। তুমি বসো না।”

তন্ময় চেয়ার টেনে দিলো। অপু বসতেই তন্ময় তার মুখোমুখি আসন গ্রহণ করল। তার পোশাক, চালচলনের মাঝে একটা জেন্টেলম্যান টাইপ ব্যাপার আছে। নিজের অভিব্যক্তি সরাসরি জাহির না করে একটু ঘুরিয়ে বলে। তাতে অপুর পক্ষ থেকে নিরব অথবা সরব গ্রহণযোগ্যতাই তন্ময়ের এগোনোর মাধ্যম।
অন্যদিকে সুপ্তের মাঝে অগোছালো, এলোমেলো ভাব। কণ্ঠ যেন মিছরির ছু’রি। ভয়ানক কথাও এমন মিষ্টি করে বলবে যে বিপরীতের ব্যক্তি কীভাবে রিয়েক্ট করতে হবে তা নিয়ে কনফিউশনে ভুগবে। যা বলার তা যতই শ্রুতি সংকোচের হোক না কেন, সরাসরি বলবে। অপু একটু বিরক্ত হলো। একজনের সঙ্গে দেখা করতে এসে তাকে অন্য আরেকজনের সঙ্গে তুলনা করা মোটেও সমীচীন নয়। দুজন দুটি ভিন্ন মানুষ, ভিন্ন সত্ত্বা।

তন্ময়ের ঠোঁটে মৃদু হাসি। স্থির চাউনির দ্বারা আকর্ষিত মনোযোগ অপুর পানে। বলল,
“আসতে ইচ্ছে করছিল না, তাই না?”
অপু ভড়কে গেল। তন্ময় মুচকি হেসে যোগ করল,
“জাস্ট কিডিং! আমারও ঠান্ডা ঠান্ডা ওয়েদারে আলসেমি লাগছিল।”
“ওহহ! আপনার বাংলাদেশী ওয়েদার স্যুট করেছে?”
“দারুণভাবে!”

কথার মাঝে উষ্ণ তরলে ভরা কাপ দুটি টেবিলে সার্ভ হলো। তন্ময় কফি কাপে চুমুক দিয়ে কথা এগোলো,
“এমবিএ কম্পলিট করে কী করতে চাও?”
“ভাবিনি এখনো। বাবার সঙ্গে কথা বলে ঠিক করে নেব।”
“নিজে কিছু ভাবোনি?”
“উহুম।”
“ক্লাস নাইনে সাইন্স, কমার্স নাকি হিউম্যানিটিস নেবে সেটা কার চয়েজ ছিল?”
“বাবার।”
“বিবিএ-ও বাবার পরামর্শে?”
“হ্যাঁ।”
“আর বিয়েটা?”
অপু চুপ রইল। তন্ময় প্রশ্রয়ের হাসি হেসে বলল,
“ড্যাডি’স গার্ল! তুমি তো এখনো বেবী ফ্লাওয়ার!”

অপুর একটু রাগ হলো। সাধারণ বিষয়ে তাকে বেবী বলবে? অসন্তোষের সঙ্গেই বলে উঠল,
“কেন? পরিবারের মতে চললে মানুষ বড়ো হয় না?”
“হয়, তবে সেটা বড়োমনস্ক বেবী।”
“মানে?”
“পরিবারের পরামর্শে চলা মানুষগুলো সবসময় পরিবার নির্ভরশীল হয় না। তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্তগ্রহণ ক্ষমতা থাকে। মতামত ব্যক্ত করে। পাশাপাশি প্রাধান্য পায় পরিবার। কিংবা পরিবারের জোরাজুরিতে তাদের সিদ্ধান্ত মেনে নেয়। কিন্তু যাদের পরিবারের মতের বাইরে নিজস্ব সিদ্ধান্তগ্রহণ ক্ষমতা নেই, কিংবা সেই ইচ্ছেও জন্মায়নি তারাই বড়োমনস্ক বেবী।”

অপু ভাবনায় পড়ে গেল। আসলেই তাই! সে তো নিজের ব্যাপারে কখনো কোনো বড়ো সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজনীয়তাই অনুভব করেনি। বরং সবসময় বাবার ওপর নির্ভরশীল হয়ে বাবার কথা মেনে চলেছে। এখনো তাই করছে। নিজের মনে কিছু এলোমেলো চিন্তাভাবনা উঁকি দিলেও তা কখনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর্যায়ে পৌঁছায়নি। সুদর্শন ও বাকপটু লোকটির সামনে অপু নিজেকে নিয়ে হীনমন্যতায় পড়ল। ও কি আসলেই বড়ো হতে পারেনি?

তন্ময় পাতলা ঠোঁটে চিকন হাসি টেনে ছোটো স্বরে বলল,
“অবশ্য একটা বউ মেটেরিয়াল বেবী পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।”

চলবে…

#সুপ্ত_অনুরাগে
#প্রভা_আফরিন
[১৯]

তিনদিনের বৃষ্টিঝরা আকাশ আজ ঝলমলে। অসীম শূন্যের কোথাও ছিটেফোঁটা কালো মেঘের অস্তিত্ব নেই। চড়া রোদের হলকা দেখে ভ্রম হবে এ শীত আসন্ন হেমন্ত নাকি উত্তপ্ত চৈত্র। অপু ফোন হাতে বসে আছে নিরাক পড়া দুপুরের মতো। একটা ফোন বা ম্যাসেজের অপেক্ষা, একটা সরি বলার বাহানা তাকে শান্তি দিচ্ছে না। কিন্তু বিপরীতে এখনও শিথিলতা বিরাজমান। সারাক্ষণ জ্বা’লাতন করা মানুষটা হুট করে যদি নিজেকে গুটিয়ে নেয় অদ্ভুত এক শূন্যতা না চাইতেও অনুভব হয়। অপুরও ঠিক তাই হচ্ছে। সেই সঙ্গে তন্ময়ের বলা কথাগুলো দিনরাত মাথায় ভনভন করছে। তার নিজস্বতা নেই? নিজের কোনো সিদ্ধান্ত নেই? আসলেই কী তাই? উত্তরটা অবশ্য অপু কিছুক্ষণ বাদেই পেয়ে গেল।

শিমুল বসার ঘরে সামনের শীতে বেড়াতে যাওয়া নিয়ে আগাম মায়ের সঙ্গে উচ্ছাস প্রকাশ করছিল। সামনের বার সে থাইল্যান্ড যেতে চায়। ভ্রমণ ভিডিও দেখে তারও ইচ্ছে জন্মেছে থাইল্যান্ড-এর সমুদ্রে নেমে খেলবে। কাজু তা শুনে লম্বা এক সুর দিয়ে বলল,
“এহহ! পুশকুনির পানিতে বড়ো হওয়া বল্টু যাবে থাইল্যান্ড গোসল করতে! এমন কথা শোনার আগে বাংলাদেশের নদী যে তোকে ভাসিয়ে দেয়নি তাই তোর সৌভাগ্য।”
“তুমি পুশকুনিতে বড়ো হয়েছো। মায়ের অ্যালবামে তোমার ছোটোবেলার কাপড় ছাড়া ফটো দেখেছি আমি।”
শিমুল হি হি করে হেসে উঠল। কাজু থতমত খেয়ে বলল,
“ছিহ বুবু ছিহ!, তুই সেই ফটোও দেখিয়ে দিয়েছিস বাচ্চাকাচ্চাদের? আমার মানসম্মানের কথা একবারও ভাবলি না?”
জাহেদা বেগম কাজ করতে করতে অত্যন্ত নির্লিপ্ত কণ্ঠে জবান দিলেন,
“তোর মানসম্মান আছে নাকি যে ভাববো?”

কাজু রাগে, অভিমানে উঠে দাঁড়াল। সে থাকবে না এ বাড়িতে। মাথা দুলিয়ে বলে গেল,
“চললাম আমি, মীরজাফরদের সঙ্গে থাকব না।”
অপু, শিমুল উৎসুক দৃষ্টিতে মামার কান্ডকারখানা দেখছিল। কাজু দরজা খুলে বাইরে পা দিয়ে আবার পিছু ফিরল।
“আমাকে একবার আটকানোর প্রয়োজন মনে করছিস না তোরা?’
অপু ঠোঁট টিপে হাসি আটকে চুপ রইল। শিমুল হাতের ইশারায় চলে যেতে বলছে। জাহেদা বেগম পাত্তা না দিয়ে বললেন,
“একদমই না।”
“ধুর থাকবই না।”
কাজু এবার সত্যি সত্যিই বেরিয়ে গেল। শিমুল অপুর কাছে এসে জানতে চাইল,
“তুমি কোথায় বেড়াতে যেতে চাও আপু?”
“সবাই যেখানে যাবে সেখানেই যাব।”

তখন সাধারণভাবে উত্তরটা দিয়ে দিলেও পরে অপু ভাবনায় পড়ল। ছোটো শিমুলের মতো তারও একটা চয়েজ থাকা উচিৎ ছিল। পরিবারের মতের ওপর কেন ছেড়ে দিলো? ঘুরেফিরে তন্ময়ের কথাগুলোই কেন কানে বাজে? তন্ময়ের কথা ভুল প্রমাণ করতে অপুর মনে জেদ চেপে বসল। সে নিজের ইচ্ছেয় কিছু একটা তো করবেই। করেও বসল। ইগোকে সরিয়ে চট করে সুপ্তের কাছে ম্যাসেজ করল। ছোটো তিনটে শব্দ, “সেদিনের জন্য দুঃখিত!”

অপরপাশ থেকে কোনো সাড়া এলো না। অপু আধঘন্টা একনাগারে ফোনের দিকে চেয়ে থেকে মনে মনে কিছুটা বিরক্তও হলো। কেন করল ম্যাসেজটা? সুপ্ত কী তাকে ইগনোর করল? এমন ভাবনায় ইগো ফুলেফেঁপে উঠতে যাবে তখনই সরাসরি কল এলো। অপু সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ করা থেকে নিজেকে দমালো। যেন সুপ্ত মনে না করে সে ফোনের অপেক্ষাতেই ছিল। কয়েকবার বেজে যাওয়ার পর রিসিভ করতেই সুপ্ত বলে উঠল,
“তুমি ডাকলে, আমি চলে এলাম।”

অপু চমকে বিছানা ত্যাগ করে। ছুটে গিয়ে জানালার পর্দা সরাতেই দেখতে পায় পথের ধারের বিশাল রেইনট্রি গাছের সঙ্গে হেলান দিয়ে আছে দীর্ঘাঙ্গ লোকটা। কানে ফোন, দৃষ্টি তিনতলার গোলাপি পর্দা থেকে উঁকি দেওয়া মেয়েটির দিকে। ঠোঁটে লেগে আছে প্রশ্রয়ের দুষ্টু হাসি। অপু নিজের অভিব্যক্তি লুকিয়ে কিছুটা গম্ভীর হতে চেষ্টা করল। তিনদিন ধরে পাত্তা নেই, অথচ একটা ম্যাসেজ করা মাত্রই ছুটে চলে এসেছে! হাহ! এই তার অপমানবোধ, ইগো! তাকে নিয়েই কিনা অপু কতকিছু ভেবে বসেছিল। এখন কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে হচ্ছে। সে বলল,
“আমি আবার কখন ডাকলাম আপনাকে?”

“ডেকেছো ডেকেছো। মনে মনে ডেকেছো। এসব সিম্বোলিক ভাষা তুমি না বুঝলেও তোমার মন ভালো বোঝে। সেই ভাষা মন বেতারের মাধ্যমে আমার মনে পৌঁছে গেছে।”
“কচু পৌঁছেছে।”
“বিশ্বাস করো খুব মিস করেছি তোমায়। প্রতি সেকেন্ডে, প্রতি নিশ্বাসে। সেই নিশ্বাসের তাপ যদি টের পেতে…। তাছাড়া প্রিয় মানুষের কাছে ইগো দেখাতে নেই। এতে দূরত্ব বাড়ে। তুমি তো এসব কথা বুঝবে না। বুঝবে কী করে? জন্মের সময় তো মধু দেওয়া হয়নি মুখে। তাই অন্তরেও মধু নেই, স্বভাবেও মিষ্টত্ব নেই। এখন থেকে দুইবেলা মধু খাবে।”

অপু মুখ কুচকে বলল,
“ফালতু কথা শুরু হলো।”
“তাহলে প্রেমের কথা বলি?”
“আবার?”
সুপ্ত হেসে উঠল। গাঢ় স্বরে জানতে চাইল,
“তুমিও খুব মিস করছিলে তাইনা?”
“মোটেও না। শুধু ছোট্টো একটা ভুল করেছিলাম সেটার দায় থেকে মুক্ত হতে চাইলাম।”
“এই কাজটা করতে তোমার তিনদিন সময় নিতে হলো! মানে এই তিনদিন আমি তোমার মাথায় উঠে ছিলাম? খুব বেশি জ্বা’লিয়েছি নাকি?”

অপুর বলতে ইচ্ছে হলো,
“আলবৎ জ্বা’লিয়েছেন। আপনি বিরক্ত করলেও জ্বা’লা না করলেও জ্বা’লা। আপনি আসলেই একটা অসহ্য!”
কিন্তু সে কথা এড়িয়ে গেল। মনের কথা ও মুখের কথা এক হওয়া কখনো কখনো বি’প’দজনক। এই লোকের সামনে তো বটেই। বলল,
“আমার অত সময় নেই অন্যকে নিয়ে ভাবার। এমনিতেই বিয়ে নিয়ে…”
কথাটা সম্পূর্ণ করার আগেই ঠোঁট টিপে চুপ হয়ে গেল সে। সুপ্তের কণ্ঠের নমনীয়তাও হ্রাস পেয়ে গেল।
“পাত্র কে? নাম কী? কী করে? বাড়ি কোথায়?”

দূর থেকেই সুপ্তের অভিব্যক্তির রঙ বদল দেখল অপু। বলল,
“তা জেনে আপনি কী করবেন?”
সুপ্তের চোয়াল শক্ত হয়। রাঙা চোখে জানতে চায়,
“সত্যি করে বলোতো অপরাজিতা, তুমি বিয়েতে রাজি?”
“সেটা কখন বললাম?”
“তাহলে না?”
এ কথাটার উত্তর অপু দিতে পারল না। বা কীভাবে দেবে ভেবে পেল না। সুপ্ত তার মৌনতা বুঝে আবার বলল,
“বাবার কথা ভাবার আগে নিজের মনের কথা ভেবেছো একবারও, যে তোমার মন কী চায়?”
অপু এবারও নিশ্চুপ। সুপ্ত অধৈর্য হয়ে উঠল। গাছের গায়ে ঘুষি দিয়ে বলল,
“প্লিজ মেয়ে, মনকে ফেইস করো। নিজেকে বোঝো। বোকামো করে নিজেকে তো বঞ্চিত করবেই, সাথে আমাকেও। আমি তোমাকে হারাতে চাই না। কোনোকিছুর বিনিময়ে না। শুধু একবার বলো আমায়। দরকার হলে তোমার বাবাকে আমি ফেইস করব।”

অপু জানালার পাশ থেকে সরে গেল। তার চিন্তাভাবনা ঝিমিয়ে যাচ্ছে। কী চায় তার মন?
_____________

তন্ময়ের সঙ্গে অপুর দেখা হলো দুদিন বাদেই। ভার্সিটি থেকে ফেরার পথে তন্ময় হুট করেই আবদার করে বসল তার বোন তিথি অপুর সঙ্গে দেখা করতে ইচ্ছুক। অপু অনিচ্ছায় রাজি হলো। ফুড পার্কে পৌঁছে দেখল তন্ময়, তিথি ও তাদের মা সেখানে উপস্থিত। তন্ময়ের মাকে দেখে অপু থতমত খেয়ে গেল। নিগার চৌধুরী তার অবস্থা বুঝতে পেরে বললেন,
“শপিং-এ এসেছিলাম। তোমার সাথে সেভাবে আলাপ হয়নি তাই ভাবলাম একসাথে একটু টাইম স্পেন্ড করা যাক। কষ্ট দিয়ে ফেললাম?”

বলতে বলতে নিগারের একটা হাত অপুকে জড়িয়ে ধরেছে। সরল আন্তরিকতায় অপু নরম হয়ে গেল। বলল,
“না না আন্টি। কষ্টের কিছু নেই।”
তিথি এগিয়ে এসে অপুকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“ফাইনালি। ভাইয়াকে অনেক বলেছি তোমার সঙ্গে দেখা করব।”
অপু বিনিময়ে হাসল। ওরা যেভাবে অপুর সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্ত আচরণ করছে অপু তাল মেলাতে না পেরে কেমন গুটিয়ে যাচ্ছে। নিগার অপুর চুপসানো মুখ দেখে ভাবলেন মেয়েটা ভার্সিটি থেকে এসে হয়তো ক্লান্ত ও ক্ষুদার্ত। তিনি আগে সবাইকে খাওয়ার পরামর্শ দিলেন। বিশ্রাম নিয়ে এরপর নাহয় ঘোরাঘুরি করবে। সকলে মেনে নিল। নিগার ও তিথি অপুকে নিয়ে এগিয়ে গেলে তন্ময় সুপ্তকে কল করল। সুপ্ত ইচ্ছে করেই ধরল না প্রথমবার। দ্বিতীয়বার রিসিভ করে বিতৃষ্ণায় উচ্চারণ করল,
“হ্যালো!”

তন্ময় অতি উৎসাহে বলতে লাগল,
“জানিস ভাই, ফুলকে দেখে প্রথমে ভেবেছিলাম বেশ কাঠখোট্টা একটা মেয়ে। লাইফ নিয়ে মেবি ভীষণ সিরিয়াস। কিন্তু কাছ থেকে বুঝলাম ও একদম বোকা। বেবী ফ্লাওয়ার। পরিবারের সিদ্ধান্ত মুখ বুজে মেনে নেয়। নিজের স্বকীয়তা নেই। ওকে নিকনেমটা দেওয়া সার্থক। বাংলায় ফুল মানে পুষ্প, ইংরেজিতে বোকা। ও হলো দুটোর সমন্বিত রূপ। বাংলিশ ফুল! চমৎকার না নামটা?”

সুপ্ত বিমূঢ় হয়ে সবটা শুনল। তার মাথায় তখন একে একে অনেকগুলো ভাবনা উঁকি দিয়েছে। বিয়ের কথাবার্তা ওঠার টাইমিং, নিকনেম, স্বভাবের ধরন শুনে সুপ্ত চমকে গেল। বলল,
“তোরা একসাথে?”
“হ্যাঁ, শপিং-এ এসেছি।”
“ঠিক আছে। আসছি আমি।”

তন্ময় সবেই স্টেকের ওপর নাইফ চালিয়েছে। পাশে বসে কোল্ড ড্রিংকে ছোটো ছোটো সিপ নিচ্ছে অপু। মুহূর্তেই বিষম খেল সে। চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেল তন্ময়ের পেছনে এসে দাঁড়ানো মানুষটাকে দেখে। নিগার ব্যস্ত হয়ে অপুর পিঠে মালিশ করে দিতে লাগলেন। তন্ময় ফোর্ক-নাইফ ফেলে অপুর হাত আঁকড়ে ধরে বলল,
“সাবধানে খাবে তো, ফুল।”

তন্ময়ের ধরা হাতের দিকে তাকিয়ে অপুর হাত-পা জমে গেল। ধীরে ধীরে সে কেমন অসাড় হয়ে এলো। সুপ্ত পেছন থেকে চুকচুক শব্দ তুলে তন্ময়ের প্লেটের নাইফটা তুলে নিল। হিসহিসিয়ে বলল,
“সাবধানে খাবে তো ফুল। নয়তো কোথাকার ছু’রি কোথায় গিয়ে কা’টে টেরই পাবে না।”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here