অরোনী, তোমার জন্য~১১,১২

অরোনী, তোমার জন্য~১১,১২
লিখা- Sidratul Muntaz
১১

রাবেয়া অরোনীর সাথে এখন সারাদিন গল্প করছেন। যেখানেই যান, অরোনীকে সাথে নিয়ে যান। কিছু খেলে অরোনীকেও ডেকে খাওয়ান। বাড়ির সবাই যখন একসাথে জরুরী আলোচনা করে তখন রাবেয়া উঁচু গলায় বলেন,” অরোনী কোথায়? আমাদের সাথে এসে বসো। বলো মা, এই বিষয়ে তোমার কি মতামত?”
বড় চাচীর এমন পরিবর্তন দেখে রুমা আর তানজিমা অবাক। রাবেয়া যখন সবার মাঝে অরোনীকে প্রাধান্য দেন, ননদরা তখন হিংসাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আশা মানে ছোট চাচীও অরোনীকে আগে পছন্দ করতেন না। এখন তিনিও এসব দেখে ভেতরে ভেতরে জ্বলছেন। রাবেয়া অরোনীর নাম নিলেই সকলের মুখ মলিন হয়ে যায়। আগে যখন রাবেয়া সকলের সামনে কথায় কথায় অরোনীকে অপমান করতেন তখন অনেকেই আড়ালে খুশি হতো। তারাই এখন হিংসায় জ্বলে যাচ্ছে। অরোনীর ইদানীং নিজেকে এই বাড়ির যোগ্য ছোট বউ বলেই মনে হচ্ছে। আগে যেটা কখনোই মনে হতো না। রাবেয়ার সাথে অরোনীর সুসম্পর্ক গড়ে উঠা দেখে সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছে উর্মি আর শীলা চাচী। তবে রিতু এখনও রাবেয়াকে সন্দেহ করে। তার ধারণা রাবেয়া হুট করে আবার বদলে যাবেন।
সন্ধ্যায় অরোনী টিভি দেখতে বসেছিল। তার প্রিয় একটা সিনেমা চলছে। পুরনো দিনের বলিউড মুভিগুলো এতো সুন্দর ছিল! অরোনী আমির খান আর জুঁহি চাওলার কাহিনী দেখে একা ঘরে বসেই হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাচ্ছে৷ দীপ্তি তখন অরোনীর ঘরে ঢুকল। মধুর হাসি দিয়ে বলল,” কি দেখছো অরোনী?”
অরোনী সোজা হয়ে বসে গায়ের ওরনা ঠিক করল।
” ভাবী, এসো৷ আমি একটা সিনেমা দেখছি।”
” খুব মজার সিনেমা মনে হয়?”
” হ্যাঁ অনেক মজার। আমির খান আর অজয় দেবগান দুই বন্ধু। ওদের কান্ড-কারখানা দেখলে আপনি না হেসে পারবেন না।”
দীপ্তি অরোনীর পাশে বসলেন। সিনেমা দেখার ইচ্ছে তার একদম নেই। কিন্তু রাহাত বলেছে অরোনীর সাথে খাতির করতে হবে। কারণ মা এখন অরোনীকে খুব দেখতে পারছেন। মা যাকে পছন্দ করবেন তার সাথেই ভালো সম্পর্ক রাখতে হবে। তাহলেই মা খুশি থাকবেন। আর মাকে খুশি রাখাই তাদের প্রধান কাজ। কারণ মা কোনো সাধারণ মানুষ না। অনেক ধন-সম্পদের মালকিন। সিনেমার সবচেয়ে কমেডি সিন হলো আমির আর অজয়ের পাইপ ধরে দুই বিল্ডিংয়ের মাঝে ঝুলে থাকা। ভয়ে দু’জনেই চিৎকার করছে। অজয় তার হিরোইন কাজলকে দেখতে গিয়েই এই বিপদের সম্মুখীন হয়েছে। অরোনী হাসতে হাসতে বলল,” ভাবী খুব মজা না?”
দীপ্তির একদম মজা লাগছে না। অরোনীর হাসি দেখলেই তার গা জ্বলছে। তবুও হেসে বলল,” হ্যাঁ, খুব মজা। নাম কি ছবির?”
” ছবির নাম ইষ্ক।”
” আচ্ছা অরোনী শোনো, যে কারণে এসেছিলাম সেই কারণটা বলি।”
” ও, তুমি দরকারে এসেছো? আমি ভাবলাম এমনি। ঠিকাছে বলো।”
অরোনী টিভির সাইন্ড কমিয়ে দিল। দীপ্তি বলল,” মা তোমাকে নিচে যেতে বলেছেন। সবজি পাকোড়া ভাজা হয়েছে তো। সবাই একসাথে খাবে।”
অরোনী অনীহা দেখিয়ে বলল,” আমি সবজি পাকোড়া খাবো না। মাকে বলে দাও।”
” মা শুনবেন না অরোনী। তুমি না গেলে তিনিও খাবেন না। প্লিজ চলো!”
অরোনী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে টিভি বন্ধ করল। পছন্দের মুভিটা দেখা গেল না। থাক, পরে দেখে নিবে। সে তো নেটফ্লিক্সেই দেখছিল। অরোনী দীপ্তির সাথে নিচে নামল। রাবেয়া অরোনীর জন্য সবজি পাকোড়া আলাদা করে রেখেছেন। অরোনীর একদম খেতে ইচ্ছে করল না। সে তেলে ভাজা জিনিস তেমন পছন্দ করে না। তাই পাকোড়াগুলো সে রাফাতের জন্য রেখে দিল। অফিস থেকে এসে রাফাত খাবে। রাবেয়া অরোনীকে বললেন,” এদিকে এসো মা। তোমাকে একটা জিনিস দেখাবো।”
অরোনী রাবেয়ার সাথে তার শোবার ঘরে গেল। রাবেয়া ড্রয়ার খুলে ফ্যামিলি এলবাম বের করলেন। রাফাতের ছোটবেলার ছবি অরোনীকে দেখিয়ে নানান গল্প শুরু করলেন। অরোনী ছোট্ট রাফাতকে দেখে অবাক! মনে হচ্ছে যেন মাহাথিরকেই দেখছে। শুধু ক্যামেরার রেজুলেশন একটু খারাপ। এছাড়া মাহাথির আর রাফাতের ছোটবেলার ছবিতে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। অরোনীর প্রথম প্রথম গল্প শুনতে ভালোই লাগছিল। কিন্তু এখন খুব বোরিং লাগছে। ঘুম চলে আসছে। রাবেয়া সংসার থেকে শুরু করে নিজের পরিবারের ইতিহাস পর্যন্ত সব বলে ফেলছেন। তার কোন দুঃসম্পর্কের চাচার প্রেম কাহিনীও বলতে লেগেছেন। অরোনীর রীতিমতো ঘুমের জন্য হাই উঠে গেল। রাবেয়া অরোনীর হাতের উপর হাত রেখে বললেন,” সত্যি করে একটা কথা বলোতো অরোনী, তোমার কি এখনও আমার উপর সন্দেহ হয়? ভাবছো আমি তোমাকে পছন্দ করার নাটক করছি কিন্তু মনে মনে আগের মতোই আছি?”
অরোনী আশ্চর্য কণ্ঠে বলল,” নাতো মা! এরকম আমার কেন মনে হবে?”
রাবেয়া মসৃণ হাসি দিয়ে বললেন,” মনে না হলেই ভালো। আসলে আমি অনেক ভেবে দেখেছি। তোমার সাথে রেষারেষি করে আমার কোনো লাভ নেই৷ তোমাকে কষ্ট দেওয়া মানে একই কষ্ট আমার ছেলেও পাবে। আর মা হয়ে কি আমি ছেলের কষ্ট মানতে পারি বলো? আমি খারাপ শাশুড়ী হতে পারি কিন্তু খারাপ মা নই।”
অরোনী ইতস্ততভাবে বলল,” জ্বী সেটা অবশ্যই। খারাপ মা বলে কিছু হয় না। সন্তানের ভালো সব মা-ই চায়।”
” একদম ঠিক বলেছো। তোমার যখন সন্তান হবে তখন আরও ভালো করে বুঝবে।”
অরোনীর এই কথা শুনে লজ্জা লাগছে। ইশ, তার যদি মাহাথিরের মতো ফুটফুটে একটা ছেলে হতো। যাকে দেখলেই রাফাতের কথা মনে পড়বে!
রাহাত মায়ের ঘরে উঁকি দিয়ে বলল,” দীপ্তি কি এখানে আছে মা?”
রাবেয়া জবাব দিলেন,” না তো। বসার ঘরে আছে মনে হয়। খুঁজে দ্যাখ।”
” ঠিকাছে।” রাহাত চলে যেতে নিচ্ছিল। রাবেয়া আবার ডেকে বললেন,” তুই কি অফিস থেকে ফিরলি বাবা?”
” হ্যাঁ মা।”
” তোর হাতে কি?”
রাহাত পেছনে গুটিয়ে রাখা হাতটা সামনে আনল। নেটের ভেতর বড় প্যাকেটে রঙিন ফল-মূল দেখা যাচ্ছে। রাবেয়া তাকিয়ে থেকে বললেন,” কি এগুলো?”
রাহাত অপ্রস্তুত হেসে বলল,” মাহাথির ফল ছাড়া অন্য কিছু খেতে চায় না৷ তাই ওর জন্য বেদানা আর আঙুর এনেছিলাম।”
রাবেয়া বললেন,” তাই নাকি? আমারও ইদানীং বেদানা খেতে খুব ইচ্ছে করছিল। তুই..”
রাহাত কথাটা শুনেও না শোনার মতো দীপ্তিকে খুঁজতে বের হয়ে গেল। রাবেয়া পুরো কথা শেষ করার সুযোগও পেলেন না। এর আগেই রাহাত চলে গেছে। রাবেয়া শুকনো মুখে অরোনীর দিকে তাকালেন। অরোনী শাশুড়ীকে লজ্জা দিতে চাইল না৷ তাই এমন ভাব করল যেন সে মা-ছেলের কথা কিছুই শুনতে পায়নি। তার গভীর মনোযোগ ফ্যামিলি এলবামে। রাবেয়া চুপসে যাওয়া গলায় বললেন,” তিনবছরের বাচ্চা ফল ছাড়া কিছু খায় না এটা কি বিশ্বাসযোগ্য অরোনী?”
অরোনী কি উত্তর দিবে ভেবে পেল না। তার খুব অস্বস্তি লাগছে। রাবেয়া বললেন,” এগুলো আনা হয়েছে দীপ্তির জন্য। মাহাথিরের কথা বলেছে যেন আমাকে দিতে না হয়।”
অরোনী হাসার চেষ্টা করে বলল,” কি জানি মা? হয়তো মাহাথিরই খাবে। এই বয়সে তো বাচ্চারা খাওয়া নিয়ে অনেক ঝামেলা করে।”
রাবেয়া মাথা নেড়ে বললেন,” উহুম৷ বাচ্চা-কাচ্চা কি আমরা পালিনি? তিনবছরের বাচ্চা একটা আস্তো বেদানাই খেয়ে হজম করতে পারবে না। ওকে তো এখনও ওর মা পানির মতো পাতলা খিচুড়ি খাওয়ায়। ও বেদানার বিচি গিলবে কি করে?”
” তাহলে মনে হয় বেদানার জুস করে খাওয়াবে।”
” কি জানি বাবা!”
রাবেয়া শরীর ঝাড়া দিলেন। বোঝাই গেল খুব কষ্ট পেয়েছেন। এবার তিনি সংসারের গল্প ছেড়ে বেদানা গাছের গল্প বলতে শুরু করলেন। তাদের বাড়ির পাশে একটি বেদানার গাছ ছিল৷ অরোনী শুনতে শুনতে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
নিজের ঘরে ফিরে এসেই অরোনী রাফাতকে ফোন করে বলল,
” তুমি কোথায়? অফিস থেকে বের হয়েছো?”
” হ্যাঁ কেন? তোমার কিছু লাগবে?”
” হুম লাগবে। বেদানা লাগবে।”
” কি?”
” বেদানা চেনো না? ওইযে লাল-লাল ফল।”
” হ্যাঁ চিনেছি। কিন্তু তুমি তো বেদানা পছন্দ করো না। আমি একবার এনেছিলাম তখন ছুঁয়েও দেখোনি।”
” আমি কি বলেছি আমি পছন্দ করি?”
” তাহলে আনতে বলছো কেন?”
” ফেসিয়াল করবো।”
” হোয়াট? তুমি জানো বেদানার দাম কত? ওই টাকা দিয়ে দুইটা ফেসওয়াশ কেনা যাবে।”
অরোনী হাসতে হাসতে বলল,” বেদানা আনতে বলেছি মানে আনবে। এতো কথা শুনতে চাই না। বেদানা ছাড়া আজ তোমার ঘরে ঢোকা নিষেধ। ”
এই কথা বলেই অরোনী ফোন কেটে দিল। রাফাত পড়ে গেল মহাবিপদে। এখন বেদানা কোথায় পাওয়া যায়?
রাতে এক কিলো বেদানা নিয়েই রাফাত ঘরে ফিরল। অরোনী খুশি খুশি কণ্ঠে বলল,” বেদানা এনেছো?”
” হ্যাঁ এইতো। এখন বলো তো কি করবে?”
” আমি কিছু করবো না। তুমিই করবে।”
” আমি কি করবো?”
” এগুলো নিয়ে মাকে দিয়ে আসবে।”
রাফাত হতভম্ব হয়ে বলল,” মা বেদানা খুব পছন্দ করেন এটা তুমি কিভাবে জানলে? মা তো নিজের পছন্দের কথা সহজে কাউকে বলেন না।”
” বুদ্ধি থাকলে সব জানা যায়। আর প্লিজ, আমি যে তোমাকে বেদানা আনতে বলেছি এটা আবার মাকে বলে দিও না। তুমি বলবে তুমি নিজেই এনেছো৷ বাজারে বেদানা দেখে তোমার মায়ের কথা মনে পড়েছিল তাই।”
” মিথ্যে কথা বলবো?”
” তো কি হয়েছে? মিথ্যে বললে তো আর তোমার দাঁত পড়ে যাচ্ছে না।”
” আচ্ছা ধরো বললাম। তারপর কি হবে?”
” কিছুই হবে না। তুমি যাও তো।”
অরোনী জোর করে রাফাতকে মায়ের ঘরে পাঠালো। রাফাত মায়ের হাতে বেদানা তুলে দেওয়ার পর মা খুব চমকে গেলেন। রাফাত অরোনীর শিখিয়ে দেওয়া মিথ্যে কথাটাও বলল। ওই কথা শুনে রাবেয়ার চোখে পানি চলে এলো। তিনি আঁচলে চোখের জল মুছে রাফাতের কপালে চুমু দিলেন। রাফাত বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ। সামান্য একটা জিনিস পেয়েই মা এতো খুশি হয়ে গেলেন! রাফাত তো ভাবতেই পারছে না। তার অসম্ভব অবাক লাগছে। মা এতো নরম মনের মানুষই না। আজ কি হলো তাঁর? রাফাত ঠিক করেছে এখন থেকে প্রতিদিন অফিস থেকে ফেরার সময় মায়ের পছন্দের কিছু নিয়ে আসবে। মা যখন এতো খুশি হয়! তিনি তো ছোটবেলায় রাফাতের সব আবদার মিটিয়েছেন৷ কিন্তু নিজে কখনও আবদার করেননি। তাই বলে কি তাঁর আবদার নেই? নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু মুখ ফুটে কখনও বলেন না।
রাফাত ঘরে ফিরে আসার পর অরোনী আগ্রহী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,” বেদানা দিয়েছো মাকে?”
রাফাত ঝলমলে কণ্ঠে বলল,” তুমি কি ম্যাজিক জানো অরোনী? সামান্য বেদানা কিনে আনলাম বলে মা আমাকে এমনভাবে আদর করলেন যেন আমি এখনও বাচ্চাই আছি। ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। লজ্জা লাগছে এখন।”
অরোনী খিলখিল করে হেসে ফেলল। রাফাত মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। অরোনী এখন আর রাফাতের সাথে ঝগড়া করে না। সবসময় মিষ্টি করে কথা বলে। আগে পরিবারের অশান্তি নিয়ে অরোনীর মেজাজ খারাপ থাকতো। কিছু বললেই তেতে উঠতো। কিন্তু এখন ধীরে ধীরে অরোনী আগের মতো হয়ে যাচ্ছে। ভার্সিটিতে প্রথম দিন দেখা সেই শান্ত মেয়েটি। রাফাত এই কয়েকদিনে অরোনীকে খুব ভালোমতো চিনেছে। অরোনী এমন একটি মেয়ে যাকে জয় করতে খুব বেশি কিছু দরকার নেই। শুধু ভালোবাসা হলেই চলবে। যে অরোনীর কাছে খারাপ, অরোনীও তার কাছে খারাপ। একেবারে রুদ্রমূর্তি! আর যে অরোনীর কাছে ভালো, অরোনীও তার জন্য জান-প্রাণ ঢেলে দিতে প্রস্তুত।

সকাল সকাল আবার দীপ্তির বাপের বাড়ির লোকজন এসে হাজির হয়েছে। তাদের হৈচৈ শুনে অরোনীর ঘুম ভাঙল। রাফাত তখন অফিসে চলে গেছে। অরোনী দেখল তার দরজার কাছে মাহাথির ছোট ছোট পায়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। অরোনী কোনো কথা বলল না। নিঃশব্দে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। তারপর হুট করে মাহাথিরের হাত ধরে ফেলল। মাহাথির প্রথমে ভয় পেল। তারপর অরোনীর মুখ দেখেই কিটকিট করে হেসে উঠল। অরোনী আজ এই কিউট ডাব্বাকে ইচ্ছেমতো পাপ্পা দিবে। মাহাথির অরোনীকে দেখলেই দৌড়ে পালায়। কিন্তু এখন কিভাবে পালাবে? অরোনী তাকে ধরে ফেলেছে। মাহাথিরকে কোলে নিয়ে অরোনী রুমে চলে যাচ্ছিল। পেছন থেকে একটা শীতল কণ্ঠ বলল,” হাই ভাবী, কেমন আছেন?”
অরোনী পেছনে তাকিয়ে দেখল রুবায়েত। ছেলেটাকে দেখেই অরোনীর ঠোঁটের হাসি মিলিয়ে গেল। চোখের দৃষ্টি কঠিন হলো। রুবায়েত মুচকি হেসে বলল,” আপার কাছে শুনলাম, আপনি নাকি দারুণ চা বানান? খেতে ইচ্ছে করছে। হট ভাবীর হাতে এক কাপ হট চা।”
অরোনী গরম কণ্ঠে বলল,” কি বললেন আপনি? হট ভাবী মানে কি?”
অরোনী এমনভাবে ফুঁসে উঠেছে যে রুবায়েত একটু ভড়কে গেল। মনে হচ্ছে মেয়েটা এখনি চিৎকার করে তাকে চড়- থাপ্পড় ধরণের কিছু একটা মারবে। তাই দ্রুত পরিস্থিতি সামলাতে বলল,” মানে রাগের কথা বলছি। আপনি যেভাবে চোখ গরম করে তাকিয়ে থাকেন মনে হয় খুব রাগ আপনার। রাগী ভাবী!”
অরোনী ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ছেলেটাকে কুচি কুচি করতে ইচ্ছে করছে। দীপ্তি এসে বলল,” অরোনী, সবার জন্য একটু চা বানাও তো। আমার ভাইয়ের আবার তোমার হাতে চা খাওয়ার খুব শখ। তোমার বিখ্যাত চায়ের গল্প করেছিলাম তো!”
অরোনী ভালো চা বানায় এটা সত্যি। কিন্তু এই খচ্চরকে চা খাওয়াতে ইচ্ছে করছে না। তবে যেহেতু সবাই খাবে তাই অরোনীকে চা বানাতে হলো। বড় ট্রেতে চায়ের কাপগুলো সাজিয়ে যখন অরোনী ড্রয়িংরুমে ঢুকল তখনই খেয়াল করল রুবায়েত তার দিকে চেয়ে আছে। ঠিক সেদিনের মতো নিষ্পলকভাবে। অরোনীর শরীর জ্বালা করতে লাগল। এই ছেলের হাতে চায়ের কাপ তুলে দিতেও ভয় লাগছে। যদি সুযোগ বুঝে অরোনীর হাত ছুঁয়ে দেয়? চাহনী দেখে তো মনে হচ্ছে এমনকিছুই মতলব তার। অরোনী সবাইকে একে একে চা দিল। রুবায়েত অপেক্ষা করছিল কখন তার সময়টা আসবে! অরোনী সর্বশেষ কাপটা রুবায়েতের কাছে নিয়ে এলো। রুবায়েতের ঠোঁটের হাসি আরও বিস্তৃত হলো। চোখের দৃষ্টি গাঢ় হলো। সে হাত বাড়িয়ে আছে কাপ নেওয়ার জন্য। অরোনী দীপ্তির কাছে কাপটা দিয়ে বলল,” তোমার ভাইকে পাস করোতো ভাবী।”
দীপ্তি অরোনীর থেকে কাপ নিয়ে রুবায়েতকে দিল। অরোনী খালি ট্রে নিয়ে চলে যাচ্ছে। রুবায়েতের চেহারাটা তখন দেখার মতো ছিল।

চলবে

অরোনী, তোমার জন্য~১২
লিখা- Sidratul Muntaz

অরোনী আবার ঘড়ির দিকে তাকালো৷ রাত দুইটা বাজতে চলেছে। রাফাত ক্রমাগত ম্যাসেজ দিয়ে যাচ্ছে। ফোন সাইলেন্ট করা তাই ম্যাসেজের শব্দ আসছে না। কিন্তু ম্যাসেজগুলো দেখে অরোনীর বুকে দ্রিম দ্রিম শব্দ হচ্ছে। বেচারার কি অনুরোধ, আকুতি, আহাজারি! অথচ অরোনী কিছুই করতে পারছে না। রাফাত অফিস থেকে আসার পর মাত্র পাঁচমিনিটের জন্য তার সাথে দেখা হয়েছিল। তারপর আর দেখা হয়নি। আজ মনে হচ্ছে অরোনী ঘরে না যাওয়া পর্যন্ত রাফাত ঘুমাবেও না। অরোনীর খুব খারাপ লাগছে। রাবেয়া বললেন,” দেখো বউমা, এখন মজার সিন হবে।”
অরোনী হতাশ দৃষ্টিতে টিভির দিকে তাকালো। তার চিৎকার করে বলতে মন চাইল,” আমি টিভি দেখবো না। আমি এখন একটু ঘরে যেতে চাই। আমাকে এই কারাগার থেকে মুক্তি দিন দয়া করে।”
কিন্তু বলা যাচ্ছে না। সামনের মানুষটি যখন অতিরিক্ত ভালো আচরণ করে তখন তার পিঠে অতিরিক্ত খারাপ আচরণ করা যায় না। রাবেয়ার হঠাৎ করেই ইচ্ছে হয়েছে অরোনীকে নিয়ে সিনেমা দেখবেন। রাত এগারোটা বাজে তিনি সিনেমা ছেড়েছেন। একটা সিনেমা শেষ। এখন আরেকটা চলছে। প্রথম সিনেমাটা অরোনীও খুব আগ্রহ নিয়ে দেখছিল। শাশুড়ীর সাথে বসে সিনেমা দেখা তো মজার ব্যাপার। কিন্তু মজারও একটা সীমা আছে। রাত সাড়ে বারোটায় যখন তিনি নতুন সিনেমা ছাড়লেন তখন অরোনীর ইচ্ছে হলো শক্ত কণ্ঠে বলতে, ” মা, দয়া করে আপনি নিজে ঘুমান আর আমাকেও ঘুমাতে দিন।”
অরোনী শক্ত কণ্ঠে এই কথা বলতে পারেনি। কেবল বলেছে,” মা, আমার আর ভালো লাগছে না। আমি প্লিজ ঘুমাতে যাই?”
রাবেয়া তখন অনুরোধের দৃষ্টিতে বললেন,” আর মাত্র আধঘণ্টা মা। একটু সহ্য করো। এই সিনটা না দেখলে মনে হচ্ছে সারারাত আমার আর ঘুমও আসবে না। তুমি চলে গেলে আমার একা দেখতেও ইচ্ছে করবে না। প্লিজ একটু বসো অরোনী। আমার লক্ষী মেয়ে।”
অরোনী তখন মনে মনে বলল,” আমি আপনার লক্ষী মেয়ে না। আপনার লক্ষী মেয়ে ঘরে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। আর আপনি আমাকে এখানে বসিয়ে রেখেছেন। ওইদিকে আপনার ছেলে মরে যাচ্ছে।”
রাবেয়া আধঘণ্টা বলতে বলতে দেড়ঘণ্টা সময় লাগিয়ে দিয়েছেন। অরোনী কোনোভাবেই উঠতে পারছে না। নির্মল সাহেব বিছানার দেয়ালে হেলান দিয়ে বই একটা মুখের কাছে ধরে আছেন। তিনি কি ঘুমিয়ে গেছেন নাকি জেগে আছেন তাও বোঝা যাচ্ছে না। অরোনী নিজের অবস্থা বোঝানোর জন্য চোখ বন্ধ করে দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে রাখল। যাতে রাবেয়া ভাবেন অরোনীর খুব ঘুম পেয়েছে। তখন যদি আল্লাহর ওয়াস্তে টিভিটা বন্ধ করে অরোনীকে যেতে দেন। রাফাত আবার ম্যাসেজ পাঠাল,
” তোমরা কোন রুমে আছো বলোতো? আমি এখনি আসছি।”
অরোনী দ্রুত লিখল,” প্লিজ এসো না। বাবা এখনও জেগে আছেন। তুমি কি ওদের দু’জনের সামনে থেকে আমাকে নিয়ে যাবে?”
” প্রয়োজনে তাই করবো। আমার আর ভাল্লাগছে না অরোনী!”
রাফাত চূড়ান্ত অধৈর্য্য হয়ে পড়েছে। অরোনী বিপদগ্রস্ত হয়ে লিখল,” এমন করলে আমার লজ্জা লাগবে। তুমি আমার জন্য এখনও জেগে আছো ব্যাপারটা কেমন দেখায়?”
” কেমন দেখায় মানে কি? আমার স্ত্রীর জন্য আমি জেগে থাকবো না তো কি অন্য ছেলে জেগে থাকবে? আশ্চর্য! ”
উফফ আল্লাহ, রাফাত এমন ঠোঁটকাটার মতো কথা বলছে কেন? অরোনীর অস্বস্তি লাগছে খুব। রাফাতকে নিচে আসতে দেওয়া যাবে না কিছুতেই। অরোনী ম্যাসেজ লিখল,” আমি পাঁচমিনিটের মধ্যে উপরে আসছি। তাও তুমি নিচে এসো না প্লিজ!”
” ওকে। ঘড়ি ধরে মাত্র পাঁচমিনিট অপেক্ষা করবো। এরপরেও যদি না আসো তাহলে আমি সত্যি চলে আসবো।”
অরোনী রাবেয়ার দিকে চেয়ে দ্রুত বলল,” মা আমি বাথরুমে যাচ্ছি।”
রাবেয়া টিভির দিকে চেয়ে থেকেই বললেন,
” আচ্ছা, তাড়াতাড়ি এসো কিন্তু।”
অরোনী মনে মনে উত্তর দিল,” স্যরি মা, আপনি সকালের আগে আমার চেহারা আর দেখবেন না।”
অরোনী রুম থেকে বের হয়েই হাঁফ ছাড়ল। ইশ, এই বুদ্ধিটা তার মাথায় আগে কেন আসেনি? দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে লাগল অরোনী। কিন্তু মাঝপথেই দেখা হয়ে গেল রাফাতের সঙ্গে। একই সময় রাফাতও নিচে নামছিল। দু’জন দু’জনকে দেখেই হেসে ফেলল। তারপর একসঙ্গে হাত ধরে উপরে উঠে এলো। রাফাত ঘরে ঢুকেই দরজা আটকালো। তারপর অরোনীর দিকে ঘুরে কোমড়ে হাত রেখে প্রশ্ন করল,” সমস্যা কি বলোতো? এতোরাত পর্যন্ত কি করছিলে?”
অরোনী অপরাধী কণ্ঠে জানাল,” সিনেমা দেখছিলাম।”
” তোমার সিনেমা দেখা এতো ইম্পোর্ট্যান্ট হয়ে গেছে?”
” আরে আমি তো চলেই আসতে নিয়েছিলাম৷ কিন্তু মা আমাকে আটকে রেখেছিলেন। আসতেই দিচ্ছিলেন না।”
” মা কি তোমাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে আটকে রেখেছিলেন?”
অরোনী দুইপাশে মাথা নাড়ল। রাফাত রেগে বলল,” তাহলে তুমি কেন আসতে পারবে না?”
” বাবাও জেগে ছিলেন। আমি কি বলতাম তাদের? ঘুমের কথা অনেকবার বলেছি। মা বললেন এখানে তার সঙ্গেই শুয়ে পড়তে। বাবা অন্যরুমে চলে যাবেন। তখন আমি বললাম, থাক ঘুম আসছে না। তখন মা বললেন, তাহলে আরেকটু বসো। আমি তো তখন মুখ ফুটে এটা বলতে পারি না যে তুমি জেগে অপেক্ষা করছো।”
” এইটা বললে নিশ্চয়ই তোমার দাঁত পড়ে যেতো না।”
অরোনী চুপ করে রইল। রাফাত বিছানায় বসে অস্থির গলায় বলতে লাগল,” আমার এতোক্ষণ কি যে ইচ্ছে করছিল তোমাকে বোঝাতে পারবো না। বাড়িতে আমি থাকি মাত্র বারো ঘণ্টা। এর মধ্যে মিনিমাম ছয়ঘণ্টা ঘুমাতে হয়। তুমিও দুইঘণ্টা বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকো। অর্থাৎ চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আমার জন্য তোমার সময় মাত্র চারঘণ্টা। কত কম সময়! আর আজকে তো এক্সটেন্ড হয়ে গেল। তুমি ছয়ঘণ্টা ধরেই ঘরের বাহিরে! বেশি ইনজাস্টিস হয়ে গেল না? ”
অরোনী রাফাতের পাশে বসতে বসতে বলল,” আমি কি করবো বলো? ইচ্ছা করে তো কিছু করিনি। কাল থেকে আর হবে না। এখন তুমি শুয়ে পড়ো প্লিজ। নাহলে সকালে অফিসে যেতে পারবে না।”
রাফাত ভ্রু কুচকে বলল,” অফিসে কে যাবে? আমি ঠিক করেছি কাল অফিসেই যাবো না।”
” কেন?”
” সারারাত না ঘুমিয়ে অফিসে গেলে ঝিমাতে হবে। তার চেয়ে না যাই।”
” তুমি সারারাত ঘুমাবে না কেন?”
” তোমার কি মনে হচ্ছে? তোমাকে পাশে নিয়ে ঘুমানোর জন্য আমি দুইটা পর্যন্ত অপেক্ষা করেছি?” অরোনী লজ্জিত গলায় বলল,” তাই বলে কাল অফিস মিস দেবে? এটা তো ঠিক না।”
” একটা দিন মিস দিলে এমন কোনো ক্ষতি হবে না।আমি তো ওয়েট করছি ভ্যাকেশনটার জন্য। আর মাত্র কয়টাদিন। তারপর আমরা হানিমুনে যাবো দুইমাসের জন্য।”
অরোনী চোখ বড় করে বলল,” দুইমাসের জন্য কেউ হানিমুনে যায় পাগল?”
” তাহলে কয়মাস? পাঁচ!”
অরোনী কপালে হাত দিয়ে বলল,” হায় গর্ধব!সর্বোচ্চ দশ-বারোদিনের জন্য যাওয়া যেতে পারে।”
রাফাত তাচ্ছিল্য কণ্ঠে বলল,” ধ্যাত! দশ-বারোদিনে কি হবে? চোখের পলকে কেটে যাবে।”
” এখন তোমার এটা মনে হচ্ছে। কিন্তু তখন দেখবে সময় যাচ্ছেই না। বোর লেগে যাবে।”
রাফাত অরোনীর দিকে চেয়ে নেশাবিষ্ট কণ্ঠে বলল,” তোমার বোর লাগতে পারে। কিন্তু আমার কখনোই লাগবে না৷ জানো সারাদিন অফিসে আমার কি ইচ্ছে করে? তোমাকেও যদি ব্যাগে ভরে আমার সাথে অফিসে নেওয়া যেতো! আমার ডেস্কের নিচে বড় একটা ড্রয়ার আছে। সেখানে তোমাকে লুকিয়ে রাখতাম। কেউ না থাকলে বের করে তোমাকে মন ভরে দেখতাম আর চুমু দিতাম।”
” ইশ!”
” সিরিয়াসলি! ইদানীং এই ইচ্ছেটা আমার এতো বেশি পরিমাণে হচ্ছে! মাঝে মাঝে অফিসে কাজের খুব প্রেশার থাকে। একটু রিল্যাক্স হওয়া যায় না। তখন মনে হয় অন্তত পাঁচমিনিটের জন্য যদি তুমি আমার অফিসে চলে আসতে! আমাকে জড়িয়ে ধরতে! তোমার বুকে মাথা রেখে আমার সব ক্লান্তি চলে যেতো!”
অরোনী মনখারাপের গলায় বলল,” আহারে, এইতো আমি সামনে আছি। এখন জড়িয়ে ধরলে চলবে?”
” উহুম। এখন শুধু জড়িয়ে ধরলে চলবে না। আরও.. ”
অরোনী সাথে সাথে রাফাতের মুখ চেপে বলল,” চুপ।”
রাফাত ঝট করে মুখ থেকে অরোনীর হাতটা সরিয়ে বলল,” কেন? আমার কথা শুনতে ভালো লাগছে না?”
কথা শুনতে শুনতেই তো অরোনীর চেহারা লজ্জায় লাল হয়ে গেছে। সে মাথা নিচু করে বলল,” না। একদম জঘন্য লাগছে। ”
” জঘন্য লাগলেও শুনতে হবে। মাঝে মাঝে তো ইচ্ছে করে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বাড়িতে চলে আসি। সারাদিন তোমাকে দেখি, তোমার ঠোঁটে, গলায়, গালে চুমু দিতে থাকি। তারপর..”
অরোনী কঠিন গলায় বলল,” তুমি যদি মুখ বন্ধ না করো তাহলে কিন্তু আমি আবার নিচে চলে যাবো। আর ফিরে আসবো না।”
রাফাত নিচের ঠোঁট কামড়ে হেসে ফেলল। তারপর বলল,” বুঝেছি। তুমি চাইছো আমি যেন কথা বলা বন্ধ করে সরাসরি কাজ শুরু করি।”
অরোনী দুইহাতে মুখ ঢেকে বলল,” ছিঃ, কি খারাপ! আমি এটা একবারও বলিনি।”
রাফাত ঘর কাঁপিয়ে হাসতে লাগল।

আজকের সকালটাই অরোনীর মনখারাপ দিয়ে শুরু হলো। গতকাল রাফাত অফিসে যায়নি। প্রায় সারাদিনই তাদের ঘরের দরজা বন্ধ ছিল। তখন ঘরভর্তি মানুষও ছিল। আর আজকে রাফাত সকাল সকাল অফিসে চলে গেছে। কিন্তু আজই বাড়িতে কোনো মানুষ নেই। কোনো মানুষ নেই বললে ভুল হবে। মানুষ আছে কিন্তু নিচতলায়। দুইতলাটা পুরো ফাঁকা। দীপ্তি ভাবী আজ তার বাপের বাড়ির মানুষদের নিয়ে ঘুরতে গেছেন। সে খুব শৌখিন মহিলা। কিছুদিন পর পর বেড়াতে যাওয়ার আয়োজন করা তার নেশা! রুমা, নীলিমা, তানজুও তার সাথে লাইন ধরেছে। আজ দীপ্তি রাবেয়াকেও সাথে নিয়ে গেছে। উর্মি তো এইসময় স্কুলেই থাকে। আর রিতুরও আজকে নিচে কাজ বেশি। সকাল থেকে সে একবারও উপরে আসেনি। কাজ না থাকলে নিশ্চয়ই আসতো। অতএব বলা যায় পুরো দুইতলায় অরোনী আজ একাই আছে। সবাই ফিরবে কখন বলা যায় না। এজন্যই ভালো লাগছে না অরোনীর। মন বিষণ্ণ লাগছে। একবার রাফাতকে ফোন করে কথা বলতে ইচ্ছে করল। কিন্তু রাফাত ইদানীং এতো ফাজিল হয়েছে যে তাকে ফোন দিতে গেলেও দশবার ভাবতে হয়। সে ফোন ধরেই এমন সব কথা বলতে থাকে যে লজ্জা পেয়ে অরোনীর ফোন কেটে দিতে হয়। দীপ্তিদের সাথে আজ চাইলেই অরোনী ঘুরতে যেতে পারতো। কিন্তু সে যায়নি রুবায়েতের ভয়ে। ওই ছেলের মুখোমুখি হতে তার একদম ইচ্ছে করে না। চাহনি দেখলেই মেজাজ খারাপ হয়। মন চায় কষিয়ে থাপ্পড় লাগাতে।
অরোনী রান্নাঘরে এসে চুলা জ্বালালো। কফি খেতে ইচ্ছে করছে। মগভর্তি কফি নিয়ে ছাদে বসে থাকবে। নাহলে নিচে শিলা চাচী আছেন। তার সঙ্গেও কফি খেয়ে গল্প করা যায়। মানুষটা সারাদিন এতো কাজ করতে থাকেন যে বসে দু’মিনিট গল্প করার সুযোগটুকুও হয় না। অথচ এই বাড়িতে যখন অরোনী প্রথম এসেছিল তখন শীলা চাচীই তাকে সবচেয়ে বেশি সাপোর্ট দিয়েছেন। মানুষটার কাছে অরোনী কৃতজ্ঞ! তাছাড়া শিলা চাচীর ছেলে তাহসিনও আছে। এই বাড়ির সবচেয়ে নিশ্চুপ সদস্য। তার এখন এডমিশন পিরিয়ড চলছে। সারাক্ষণ পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত থাকছে ছেলেটা। অরোনী তার কাছেও কফি নিয়ে যেতে পারে।
পেছন থেকে মনে হলো কারো পায়চারী শোনা যাচ্ছে। অরোনী তৎক্ষণাৎ পেছনে ঘুরল। কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না। বুকে থুতু দিয়ে নিল। ভয় লাগছে তার। কফিটা দ্রুত বানাতে হবে। নিচে চলে গেলেই আর ভয়টা লাগবে না। দুইতলাটা এখন পুরোপুরি নিস্তব্ধ। এজন্যই বোধহয় এমন গা ছমছম করছে। অরোনী ভয় কাটানোর জন্য শব্দ করে গান গাইতে লাগল। তার গানের কণ্ঠ বেশ সুন্দর।
” তারে আমি চোখে দেখিনি..”
রুবায়েত পর্দার আড়াল থেকে অরোনীকে দেখছে। তার শরীর উত্তেজনায় ঘামছে। মাথার মধ্যে এলোমেলো সব চিন্তা। ভেবেছিল আজ সবার সাথে অরোনীও আসবে।সেদিন যখন অরোনী চায়ের কাপটা রুবায়েতের হাতে না দিয়ে দীপ্তির হাতে দিয়ে চলে যাচ্ছিল ঠিক তখনি অরোনীকে ছুঁয়ে দেওয়ার তীব্র আকাঙ্খাটা ভালোভাবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল। যার ফলশ্রুতিতে আজ সে এতোবড় সাহস করে ফেলেছে। প্রায় ফাঁকা বাড়িতে অরোনী একা আছে জেনেই ছুটে এসেছে।
অরোনীর গানের কণ্ঠ আর চুলের গন্ধ কেমন কঠিন একটা মোহের জাল সৃষ্টি করছে। রুবায়েত নেশাগ্রস্তের মতো সেদিকে ঘনিষ্ট হচ্ছে। সে জানে অরোনী এখন তাকে দেখলে রেগে যাবে। চিৎকার করবে কিংবা আরও ভয়ংকর কাজ করবে। তাই রুবায়েত স্টোর-রুমের দরজাটা বন্ধ করে ঢুকেছে। তার মনে হচ্ছে, অরোনী যদি আজ রেগে তাকে চড় দেয় তাও কিছু হবে না। বরং ভালো লাগবে। মনে হবে অরোনীর হাতের ছোঁয়াতেও ফুলের সৌরভ মেশানো! অরোনী একমনে গান গেয়ে চলেছে। রুবায়েতের সবকিছু স্বপ্নের মতো লাগছিল। আলতো কণ্ঠে রুবায়েত ডাকল,” অরোনী।”
অরোনী পেছনে ঘুরে রুবায়েতকে দেখেই সহসা চিৎকার দিয়ে মুখে হাত চেপে ধরল। তার শরীর ধাক্কা খাওয়া দরজার মতো কাঁপতে লাগল।
রুবায়েত হালকা হাসল। অরোনীর মনে হলো এতো জঘন্য মুখের হাসি সে কোনোদিন দেখেনি! অরোনী কাঁপা কাঁপা গলায় আরেকটা চিৎকার দিয়ে বলল,” আপনি এখানে কেন এসেছেন? বের হোন। আল্লাহ, বের হোন।”
রুবায়েত নরম গলায় বলল,” বিশ্বাস করুন, আপনাকে আমি ভীষণ পছন্দ করি। আমার এই আবেগকে ঠুনকো মনে করবেন না। আপনাকে দেখার প্রথম দিন থেকেই আমার চোখের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। এরপর থেকে যতবার আপনার কথা মনে হয় ততবার আমার জ্বর আসে। এইযে দেখুন এখনও জ্বর আসছে। আমার গা কত গরম!”
অরোনীর হাতটা খপ করে ধরে নিজের গলায়, গালে স্পর্শ করাতে লাগল রুবায়েত। অরোনী চোখ বন্ধ করে গগনবিদারী চিৎকার করতে লাগল। রুবায়েত কোনো তোয়াক্কা করছে না। শক্ত করে অরোনীর কোমড় চেপে ধরল। অরোনী সমস্ত শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। লোকটাকে যে জোরে একটা ধাক্কা মারবে সেটুকু শক্তিও নেই৷ আতঙ্কে বুদ্ধি সাহস সব লোপ পেয়েছে। অরোনী চোখ দু’টো খুলে দেখার স্পর্ধাও পাচ্ছে না। তার সাথে এ কি সর্বনাশ হচ্ছে! প্রচন্ড ঘৃণা লাগছে। শরীর কাটা দিয়ে উঠেছে। অরোনী কিছু চিন্তা না করেই ফুটন্ত গরম কফির কেটলিটা হাতে নিয়ে রুবায়েতের মুখে ছুড়ে মারল। প্রথমে ভারী কেটলির আঘাতে রুবায়েতের কপাল ফুলে তারপর গরম কফিতে মুখ ঝলসে গেল। রুবায়েত হিংস্র জন্তুর মতো আর্তনাদ করে উঠল। অরোনী এই অবস্থায় রুবায়েতকে ল্যাং মেরে ফেলে দিল। রুবায়েত চিৎ হয়ে লুটিয়ে পড়ল মেঝেতে। দুইহাত দিয়ে মুখ ঢেকে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল সে। অরোনী আক্রোশে তার গোপন জায়গায় একাধারে লাথি দিল। তারপর ছুটে বেরিয়ে এলো স্টোর-রুম থেকে। দরজা খুলতে একটু অসুবিধা হয়েছিল। কিন্তু অবশেষে খুলতে পেরেছে। এই সমস্ত কাজ সে করেছে এক নিঃশ্বাসে! বাহিরে বের হতেই রিতুকে দেখল অরোনী। রিতু বড় বড় চোখে বলল,” ভাবী কি হইছে? চিল্লানি শুনলাম তো। ভিতরে কেডা?”
অরোনী জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলল। কোনো কথা বলল না। রিতুকে ঠেলে নিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দিল। তার শুধু ভয় হচ্ছে। ভয়ংকর আতঙ্ক কাজ করছে মনে। এই বুঝি রুবায়েত ওখান থেকে উঠে চলে আসল। গর্জন করতে করতে দরজা ভেঙে ফেলল। অরোনী ঘরের কোথায় লুকাবে বুঝতে পারছে না। সে দৌড়ে বাথরুমে চলে গেল। বেসিনের উপর থেকে বডিওয়াশ নিয়ে শরীরে ঘষতে লাগল। এমনভাবে ঘষছে যেন তার পুরো শরীরে নোংরা। নোংরাটা ঘষে-মেজেও তোলা যাচ্ছে না। রিতু এতো অস্বাভাবিক অবস্থা দেখে ভয়ে স্তব্ধ। একটু পর অরোনীর কাছে গিয়ে মিনতি করে বলল,” ছোট ভাবী আফনের কি হইছে? আল্লাহর দোহাই লাগে কন আফনের কি হইছে?”
অরোনী শূন্যদৃষ্টিতে একবার তাকালো রিতুর দিকে। রিতুর চোখে পানি। তাই দেখে অরোনীও বাঁধ ভাঙা নদীর মতো কেঁদে উঠল। রিতুকে জড়িয়ে ধরে তার সে কি কান্না! রিতু অবাক হয়ে গেল। একটু পর অরোনী রিতুকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে শাওয়ার ছেড়ে দিল। সাদা ফেনামাখা শরীর ধুঁয়ে যাচ্ছে। অরোনী শাওয়ারের নিচে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল। তার ছিপছিপে শরীরটা মৃদু কাঁপছে। হঠাৎ করেই অরোনী বাথরুমের দরজা বন্ধ করে দিল। রিতু জোরে জোরে দরজা ধাক্কাচ্ছে। কিন্তু অরোনীর সাড়া-শব্দ নেই। কূল-কিনারা না দেখে রিতু অরোনীর মোবাইল নিয়ে রাফাতকে ফোন দিল। ওই পাশ থেকে ফোন রিসিভ হওয়া মাত্রই রাফাতকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে এক নিঃশ্বাসে রিতু বলে গেল,” ছোটভাইয়া, আফনে বাড়িত আসেন জলদি। ছোটভাবীর অবস্থা খুব খারাপ। জলদি আসেন ছোটভাই।”
” কি হয়েছে অরোনীর?”
” আমি কইতে পারি না। আফনে আইসা দেইখা যান।”
রাফাত কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে তাড়াহুড়ো করে বলল,” আচ্ছা, আচ্ছা, আমি আসছি।”
রিতু ফোন কেটে দিয়ে আবার বাথরুমের দরজা ধাক্কাতে শুরু করল। তখনি বাহিরে থেকে রুবায়েতের চিৎকার শুনল। রিতু ভয়ে ভয়ে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখল স্টোর-রুম থেকে বের হয়ে লিভিংরুমের সোফায় বসে আছে রুবায়েত। ফ্রীজ থেকে বরফ খন্ড বের করে নিজের মুখমন্ডলে ধরে আছে। রিতু মনে মনে বলল,” হারামজা* তোর লাইগা ছোটভাবীর এই অবস্থা!”
তার ইচ্ছে করল রান্নাঘর থেকে বটি এনে একটা কোপ দিতে। নয়তো গায়ের জ্বালা মিটবে না। রিতু দৌড়ে রান্নাঘরে যাচ্ছিল। রুবায়েত তাকে দেখেই বলল,” এই মেয়ে শোনো, আমার গায়ে গরম কফি পড়ে গেছে। খুব জ্বালাপোড়া করছে। তোমার কাছে এন্টিসেপটিক হবে?”
রিতু শান্ত গলায় বলল,” জ্বী হইবো।”
” তাহলে একটু দ্রুত নিয়ে এসো।”
রিতু রান্নাঘরে গিয়ে মশলার পট নিল। একমুঠো মরিচের গুঁড়ো নিয়ে ফিরে এলো।
“এইযে নেন।”
রুবায়েত কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার সারামুখে মরিচ ডলে দিয়েছে রিতু। রুবায়েতের অকস্মাৎ চিৎকারে ভবন কেঁপে উঠল। রিতু দৌড়ে ঘরে চলে এসেছে। রুবায়েত চোখ খুলে তাকাতে পারছে না৷ তাকে কেবল দৌড়াতে হচ্ছে। রাফাত একঘণ্টার মধ্যেই বাড়ি ফিরে এলো। তখন দীপ্তিরাও ফিরে এসেছে। পুরো বাড়িতে ঘটনা জানাজানি হয়ে গেছে। রুবায়েতের চোখে মরিচ গুঁড়া মেখে দেওয়ার অপরাধে রিতুকে চড় মেরেছে দীপ্তি। রিতু গালে হাত দিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। এসব ঘটনাই এসে দেখতে পাচ্ছে রাফাত। সে এখনও বুঝতে পারেনি বাড়িতে আসলে হয়েছেটা কি! এদিকে অরোনী এখনও বাথরুমের দরজা খুলে বের হয়নি।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here