আলো-২১,২২
২১
অহনা কাঁদো কাঁদো সুরে বললো যদি তেল ছিটে এসে আমার হাত পুড়ে যায়?
আসিফ শব্দ করে হো হো করে হেসে উঠলো। আচ্ছা ঠিক আছে আমি ভেজে রেখে যাবো? ঠান্ডা ডিম ভাজা খেতে পারবে?
না থাক দরকার নেই। ভার্সিটি থেকে আসার পথে কিছু কিনে খেয়ে নিব। আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না ।
আসিফ বের হয়ে যাওয়ার পর পর ওর মা ফোন করে জানাল রন্জু ভাইয়া আসবে। অহনা খুবই বিব্রত বোধ করছে। কি ভাববে ওর ভাই এসে বোনের সংসারের এ হাল দেখে।
ঘরে না আছে একটা ভালো ফার্নিচার, না আছে কোন খাবার। সে কি তার ভাইকে টোস্ট বিস্কুট আর চা খেতে দিবে!
বসতে দিবেই বা কোথায়? ওর খুব কান্না পাচ্ছে।
চোখের পানি মুছে ভাইকে বাসার ঠিকানা ম্যাসেজ করে দিয়ে ও ঘর তালা দিয়ে নিচে নামলো।
বাসার সামনে যেসব দোকান সেখানে সবাই ব্যাস্ত সকালের নাস্তা তৈরি করতে।
অহনা কি কিনবে বুঝতে পারছে না। সে মুদি দোকান থেকে কেক, বিস্কুট আর চানাচুর কিনে আনলো।
ঘরে এসে ফ্যান ছেড়ে বসা মাত্র মোবাইলটা বেজে উঠলো। ফোন হাতে নিয়ে দেখে রন্জুর ফোন।
হ্যা বল ভাইয়া।
তুই বাসায় আছিস তো?
হুম আমি বাসায় আছি। চিনতে অসুবিধা হলে নিচে এসে ফোন দিও। আমি নামব।
না না তোকে নামতে হবে না। পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছি। আমার সাথে আলোও আছে।
আচ্ছা ঠিক আছে এসো।
অহনা ফোন রেখে চিন্তায় অস্থির হয়ে গেল।
প্রচন্ড রোদের প্রখরতা এই সাত সকালে। ফ্যানের বাতাস গায়ে লাগছে না। ছাদের ওপরে রুম হবার কারণে তেতে থাকে পুরো রুম।
উফ কি যে করি।
নিচে নামলাম একটা ট্যাং কিনে আনলেও তো সরবত করে দিতে পারতাম। তার ওপরে গ্লাস একটা।
আজকে ভাইয়ার সামনে অপমানের শেষ হতে হবে।
অহনার ইচ্ছে করছে নিজের মাথার চুল নিজে টেনে ছিঁড়ে ফেলে।
হঠাৎ করে ওর মাথায় একটা বুদ্ধি এলো।
বাড়ি আলার বাসা থেকে এক বোতল ঠান্ডা পানি আর প্লেট গ্লাস নিয়ে আসলে কেমন হয়?
ও যখন উঠে দাঁড়ালো বাড়ি আলার বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে ঠিক সেই মুহূর্তে কড়া নাড়ার শব্দ।
দরোজা খুলে ও সারপ্রাইজ।
ড্রাইভার একটার পর একটা বাজার এনে রাখছে রুমে।
ও বাজার দেখবে নাকি ভাইকে বসতে বলবে!
ও হতভম্ব ভাব কাটিয়ে রন্জুর দিকে ঘুরে বললো, এগুলো কি করছিস ভাইয়া? পুরো বাজার তুলে আনছিস! আলো তুই সাথে ছিলি, না করিস নি কেন?
তুই তো আমার অবস্থা জানিস।
আলো হাসতে হাসতে বললো, বাজার কি আমাকে সাথে নিয়ে করছে নাকি? এসব ব্যাপার তোরা দুজনে বোঝ।
রন্জুর এখনো দাঁড়িয়ে আছে।
ও ভাবতে ও পারেনি অহনার মতো এমন স্টাইলিশ মেয়ে এই অবস্থায় আছে। ও চারদিক তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। রুমের মধ্যে একটা তোষক বিছানো, তার ওপরে পুরনো একটি চাদর। বিছানার ওপরে একটা মাত্র বালিশ। ফার্নিচার বলতে একটা কাঠের ছোট টেবিল। টেবিলের ওপর একটা ইলেকট্রিক চুলা, কিছু হাঁড়ি পাতিল আর মশলার কৌটা।
মাথার ওপরে একটা ফ্যান ঘুরছে কোন বাতাস গায়ে লাগছে না। পাঁচ মিনিট হলো ওরা এসেছে। কিন্তু এই অল্প সময়ে ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে গেছে ওর পোশাক।
অহনা ছলোছলো চোখে ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললো, কিরে ভাইয়া বসবি না? ফ্লোরে বসতে ঘেন্না লাগছে?
আলো কপট রাগ দেখিয়ে বললো, এগুলো কি ধরনের কথা অহনা? তোর আজ কিছু নেই, কাল সব হবে।
এতে এতো আপসেট হবার কি আছে?
আলো রন্জুর হাত ধরে বিছানায় বসালো।
তোরা দু ভাই বোন গল্প কর। আমি তোর বাজার গুছিয়ে দেই।
অহনার চোখে পানি চলে এসেছে। ও মুখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে বললো, বাজার গুছিয়ে কোথায় রাখবি?
এগুলো নিয়ে যা। সব পচবে। তোরা বোস আমি নাস্তা দেই।
ও ভাতের প্লেটে কেক, বিস্কুট, চানাচুর দিলো।
রন্জু উঠে দাঁড়ালো।
আলো তুমি অহনার সাথে গল্প করো।
আমি একটু আসছি।
অহনা বিস্ময় প্রকাশ করে বললো, কোথায় যাচ্ছিস?
এইতো যাবো আর আসবো।
রন্জু চলে যাওয়ার পর দুই বোন চানাচুর খেতে খেতে তাদের সুখ দুঃখের গল্প করলো। অহনা এক ফাঁকে আসিফকে ফোন করে জানালো, আলো আর রন্জু ভাইয়া আসছে। তুমি কি একটু বাসায় আসবে অফিসে যাওয়ার আগে?
আসিফ ও খুব খুশি হলো শুনে। ও জানালো দুটো ক্লাস শেষ করে বাসায় চলে আসবে।
আলো খুব করে ধরলো অহনা কে।
কেমন লাগছে নতুন সংসার?
একদম মিথ্যে বলবি না। সব খুলে বল আমার কাছে।
কেমন আর লাগবে বল। তুই তো নিজের চোখেই দেখতে পারছিস আমার অবস্থা।
আমি তো আভিজাত্যের মধ্যে বেড়ে উঠেছি।
খুব স্বাভাবিক ভাবে মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছে।
সব ঠিক হয়ে যাবে পাগলি।
মন খারাপ করিস না। একটু কষ্ট করে মানিয়ে নিতে হয় মেয়েদের। তাছাড়া আসিফ তো এখন বিয়ে করতে চায়নি। তুই জোর করে করছিস।
তা ঠিক।
আমি আসলে ফান্টাসিতে ভুগতাম। বাস্তব অভিজ্ঞতা তো কিছু ছিল না। এখন প্রতি পদে পদে ধাক্কা খাচ্ছি।
একবার মনে হয়, হোক না কষ্ট তাতে কি।
আমি আমার ভালবাসার মানুষটিকে তো আপন করে পেয়েছি। আবার মনে হয়, খুব ভুল করছি।
বাবার কথা শোনা উচিত ছিল।
এতো অল্পতেই ভেঙে পড়লে চলবে?
মনটা শক্ত কর বোন।
এর মধ্যে অহনার জন্য আরেকটা সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছিল, অহনা তা বুঝতে ও পারেনি।
রন্জু ফিরে এসেছে।
সাথে একটা পিক আপ ভ্যানে একটা খাট, খাটের জন্য ম্যাট্রেস, বালিশ, বেড কভার, এসি , একটা আলমারি ও দুই সিটের সোফা।
একটা ডিনার সেট। ননস্টিক হাড়ি পাতিলের সেট।
কোকারিজ। কোন কিছু আর বাদ রাখেনি।
সাথে করে মিস্ত্রিও এনেছে।
তারা সবকিছু সেট করা শুরু করেছে।
অহনা হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সম্বিত ফিরে পাওয়া মাত্র বললো, এসব কি করেছিস ভাইয়া?
আসিফ খুব রাগ করবে।
রাখ তোর আসিফের রাগ। আমার বোন কষ্ট করবে আর আমরা তা দেখবো! তোর একটা মাত্র রুম। তাই খুব বেশি কিছু কিনতে পারলাম না।
দেখি বাবাকে বলে আমাদের কলাবাগানের বাড়িটার একটা ফ্লাট খালি করা যায় কিনা। একটা ফ্লাট খালি করে সুন্দর করে সাজিয়ে দিব। তারপর ওখানে উঠবি।
আপাতত কষ্ট কর।
এরমধ্যে আসিফ চলে এসেছে।
সে এসে এতোসব জিনিস দেখে মুখ অন্ধকার করে ফেললো। সাধারণ সৌজন্য সাক্ষাৎ শেষে অহনাকে বললো, মেহমানদের কিছু খেতে দিয়েছো?
অহনা ইতস্তত করে বললো, হ্য্যা, না মানে…
রন্জু থামিয়ে দিয়ে বলল, আমরা খাওয়া দাওয়া করে এসেছি। সবকিছু সেট করা হোক। সবাই আবার একসাথে খাবো।
আসিফ সরাসরি রন্জুর দিকে তাকিয়ে বললো, ভাইয়া বেয়াদবি নিবেন না। আমরা এগুলো গ্রহণ করতে পারবো না। আমি জানি অহনার খুব কষ্ট হচ্ছে।
কিন্তু আমি কথা দিচ্ছি প্রতি মাসের বেতন পেয়ে আমি একটু একটু করে সবকিছু করে দিব আপনার বোনকে।
আমাকে একটু সময় দিন।
রন্জু বিস্ময় প্রকাশ করে বললো, এটা কেমন কথা বলো তুমি? আমরা আমার একমাত্র আদরের বোনকে কিছু দিতে পারিনা!
তোমার সংসার তুমি অবশ্যই তোমার মনের মতো করে সবকিছু কিনবে, সাজাবে। তাতে আমার কোন আপত্তি নেই। কিন্তু আমি খুশি হয়ে বোনের জন্য যা এনেছি তা তুমি ফিরিয়ে দিতে পারো না।
আমাকে মাফ করবেন ভাইয়া। আমার পক্ষে এগুলো গ্রহণ করা কোন ভাবেই সম্ভব নয়।
তারপর অহনার দিকে তাকিয়ে বললো, তোমার এসি, ফ্রিজ লাগবে আমাকে বলতে। আমি চেষ্টা করতাম লোন করে হলেও কিনতে। তোমার ভাইকে বলা ঠিক হয়নি। তুমি আমার আর্থিক অবস্থা জেনেই বিয়ে করেছো। আমি তোমার কাছে এমনটা আশা করিনি।
অহনার ইচ্ছে করছে মাটি যদি দুই ভাগ হয়ে যেতো।
ও এখন মাটির নিচে ঢুকে যেতো।
ওর কান দুটো গরম হয়ে আগুনের ফলকা বের হচ্ছে।
ও ভাবতেও পারেনি আসিফ এভাবে ওর ভাই বোনকে অপমান করবে। ওর মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেছে।
ঘরে কিছু নেই তার জন্য ও এতোটা লজ্জা পায়নি।
ভাইয়ের অপমানে যতোটা পেয়েছে।
রন্জু রাগ কন্ট্রোল করতে না পেরে কঠিন স্বরে বললো, না জেনে কেন অহনাকে দোষারোপ করছো।
আমি নিজে থেকে আমার বোনের জন্য এগুলো নিয়ে আসছি। আর কাল তোমাদের দাওয়াত আমাদের বাসায়।
আমি আসলে দাওয়াত দেওয়ার জন্য এখানে আসছি।
বাবা তোমাদের নিজে দাওয়াত দিয়েছে। এখন আর নতুন করে ঝামেলা করো না।
আসিফ বললো, বাবা যদি মেনে নেয় তাহলে তো বাবা নিজে ফোন করতেন। সরি ভাইয়া আমি এ ধরনের দাওয়াতে যেতে পারবো না।
তবে অহনা যাবে।
কিন্তু আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়।
আমার অফিসে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। আমি আসছি।
আপনারা খাওয়া দাওয়া করে যাবেন। আমি খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি।
আর যাওয়ার সময় এগুলো নিয়ে গেলে খুশি হবো।
আসিফের কন্ঠে এমন কিছু ছিল।
রন্জু আর কোন কথা বলতে পারলো না।
আলো শুধু বললো, আসিফ তোমার খাবার পাঠাতে হবে না। তুমি অফিস যাও। আমরা নিজেরাই রান্না করে খাবো।
আর আমরা সবকিছু নিয়ে যাবো । কোন সমস্যা নেই। শুধু ফ্রিজটা থাকুক। শশুর বাড়ি থেকে খাবার আসলে সেটা ফেরত পাঠানো কোন ভদ্রতার মধ্যে পড়ে না।
আর এতো খাবার রাখার জন্য ফ্রিজটা জরুরী।
ঠিক আছে আমি আসছি।
আমার কথায় আপনারা কষ্ট পেলে ক্ষমা করবেন।
রন্জু মন খারাপ করে মিস্ত্রিদের শুধু ফ্রিজটা সেট করে বাকি সব গাড়িতে তুলতে বললো।
ড্রাইভারকে পাঠিয়ে কিছু খাবার দাবার আনালো।
তিনজন একসাথে দুপুরের খাবার খেয়ে আলো আর রন্জু মন খারাপ করে বিদায় নিলো।
ওরা চলে যাওয়ার পর অহনা দরোজা আটকে হাউমাউ করে চিৎকার করে কান্না শুরু করলো।
আলো-২২
রঞ্জুর মাথাটা হঠাৎ করে চক্কর দিয়ে উঠলো।
ও গাড়ি থেকে বের হতে যেয়ে আবার বসে পড়লো।
আলো এগিয়ে এসে রন্জুর কপালে হাত দিয়ে দেখে গা পুড়ে যাচ্ছে।
ও অবাক হয়ে বলল কি ব্যাপার এইটুকু সময়ের মধ্যে তুমি জ্বর বাঁধিয়ে ফেললে কিভাবে?
এসো আমার ঘাড়ে হাত দাও। আমি ওপরে নিয়ে যাচ্ছি।
দরকার নেই আলো।
তুমি বরং গাড়ি নিয়ে বাসায় চলে যাও। মামা মামী হয়তো টেনশন করছে। সেই সকালে আমার সাথে বের হয়েছো।
আলো চোখ পাকিয়ে বললো, আমাকে নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। নিজেকে নিয়ে ভাবো।
আজকে আলোর আগেই নেমে যাওয়ার কথা ছিল।
কিন্তু অহনার বাসা থেকে বের হয়ে রন্জু ভাইয়া এতো চুপচাপ যে আলোর খুব মায়া লাগছিল।
ও ঠিক করেছে ফুপির সাথে দেখা করে ভালো করে সবকিছু বুঝিয়ে বলে নিজের বাসায় যাবে।
এরমধ্যে রন্জু ভাইয়া যে অসুস্থ হয়ে পড়বে তা সে ভুল করেও বুঝতে পারেনি।
আলো খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে যে, কয়েক ঘণ্টা অতিরিক্ত গরমে ঘামছে সাথে বোনের এমন কষ্ট মেনে নিতে না পেরে তার রন্জু ভাইয়া এমন অসুস্থ হয়ে পড়েছে।
সে তাড়াতাড়ি রন্জুকে ধরে ভেতরে নিয়ে গেল।
ওর ফুপিও ছুটে আসলো, কি হয়েছে আলো?
রন্জুর গায়ে হাত দিয়েই সে আৎকে উঠলো।
এইটুকু সময়ের মধ্যে ছেলেটার এমন জ্বর আসলো কিভাবে? ভালো মানুষ গেল আর এখন কিনা পুরো শরীর পুড়ে যাচ্ছে!
রন্জুকে দুজনে মিলে ধরে ওপরে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল। ডাক্তারকে ফোন করে আলোর ফুপি পানি এনে মাথায় পানি ঢালা শুরু করলো।
ডাক্তার এসে প্রথমে প্রেশার মাপলো। সব ঠিক আছে। প্রেশার স্বাভাবিক। জ্বরটা একটু বেশি। ১০২ ডিগ্রি।
জ্বরের জন্য ওষুধ দিয়ে, জলপট্টি দেওয়ার কথা বলে ডাক্তার সাহেব বিদায় নিলেন।
আলো কি করবে বুঝতে পারছে না।
সে কতোক্ষণ ফুপির পাশে বসে থেকে অহনার রুমে গেল। বইয়ের তাকে অনেক গল্পের বই।
সে লাল কমল আর নীল কমলের বইটা টেনে নিলো।
তারপর আবার ফুপির পাশে বসে পাতা উল্টিয়ে পড়া শুরু করলো।
ওর ফুপি আলোকে ডেকে বললো, আলো দেখতো মা গা একটু ঠান্ডা হয়েছে না?
আলো কপালে হাত রেখে বললো, হুম জ্বর মনে হয় কমেছে।
তাহলে তুই এক কাজ কর, বাসায় চলে যা।
আলো উঠে দাঁড়ালো যাওয়ার জন্য।
ও বুঝতে পারছে না, এই মুহূর্তে অহনার কথা বলা ঠিক হবে, কি হবে না। ও একটু ইতস্তত করে বললো, ফুপি বইটা নিয়ে গেলাম। পড়তে ভালো লাগছে।
কাল রন্জু ভাইয়াকে দেখতে আসার সময় নিয়ে আসবোনি।
তোর ছেলে মানুষী আর গেল না।
এটা তো বাচ্চাদের বই। অহনা কে ছোট বেলায় কিনে দিছিলাম।
হুম। আমিও তো বাচ্চা। দেখোনা নতুন করে পড়াশোনা শিখছি।
এতো ঝামেলার মধ্যে ও আলোর কথা শুনে ওর ফুপি ফিক করে হেসে দিলো।
আলোরা চলে যাওয়ার পর অহনা বিছানায় শুয়ে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে অঝোর ধারায় পানি। বদ্ধ রুমটাকে ওর কাছে জেল খানা মনে হচ্ছে।
বারবার শুধু মনে হচ্ছে আসিফ ওর ভাইকে এভাবে অপমান না করলেও পারতো। তার পর পরই ওর মনে হলো। আমি যদি আসিফের জায়গায় থাকতাম, তাহলে কি করতাম?
আমার বাবা তো আসিফকে মানুষ হিসেবেই গণ্য করেনি। ওর তো কিছুটা রাগ থাকাই স্বাভাবিক।
আসলে বদ্ধো ঘরে মানুষের চিন্তা ভাবনা গুলো মুক্ত বিহঙ্গের মতো পাখা মেলে দেয়। মন এবং শরীরের ভারসাম্য রক্ষার জন্য মুক্ত মনে চিন্তা করার কোন বিকল্প নেই। আর মহৎ চিন্তা ভাবনা গুলো একাকী সময়েই মুক্ত মনে করা যায়।
ও মনে মনে আসিফকে ক্ষমা করে দিলো।
কিন্তু তারপরও মন বিষণ্ন হয়ে রইলো।
ও উঠে চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিলো। পানিও গরমে তেতে আছে। চোখ মুখ কেমন যেন জ্বালা করছে। তাওয়েল দিয়ে মুখ মুছে চুলায় কফির জন্য পানি গরম দিয়ে ফ্রিজটা খুললো।
নতুন ফ্রিজ। অথচ খাবার দাবার দিয়ে ভরা!
আলো সবকিছু সুন্দরভাবে গুছিয়ে দিয়ে গেছে।
দুই প্যাকেট মিষ্টি ডিপে আর দুই প্যাকেট লাইটে রাখছে। দধির হাড়িও একটা ডিপে একটা লাইটে।
ওর মিষ্টি খুব পছন্দ। কিন্তু আজ খেতে ইচ্ছে করছে না। একটা আপেল ধুয়ে খেতে খেতে দেখলো পানি ফুটে উঠেছে।
ও ঝটপট কফি বানিয়ে কফির মগটা নিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালো।
ছাদের কিনারে দাঁড়িয়ে রাস্তায় মানুষের চলাফেরা দেখতে অহনার মন্দ লাগে না। কতো রকম মানুষের যে আনাগোনা। রিকশার টুং টাং শব্দ। বেশ লাগে।
কফি শেষ করে সে এক প্যাকেট মিষ্টি আর কিছু ফল নিয়ে বাড়িআলার বাসায় গেল।
বাড়িআলি খালাম্মা বেশ আদর করে অহনাকে বসালো। এসো মা এসো। সারাদিন একা একা থাকো।
আমার কাছে চলে আসবা। আমি ও একা একা থাকি।
মেয়েটার বিয়ে দিয়ে দিছি। ছেলেটা দেশের বাইরে পড়াশোনা করে।
আমরা বুড়া বুড়ি দুজনে একা একা থাকি।
তুমি আসলে খুব ভালো লাগবে।
তা মা তোমার হাতে এতো কিছু কি?
খালাম্মা আমার ভাই আসছিল আমাকে দেখতে।
ভাইয়া অনেক মিষ্টি, ফল আনছে। আপনাদের জন্য ও কিছু নিয়ে আসলাম।
খুব ভালো করছো মা। কিন্তু এতো না আনলেও পারতে।
যাকগে। তোমার বাসায় অনেক কিছু উঠাতে দেখলাম
আবার ঘন্টা খানেক পর নিয়ে যেতেও দেখলাম।
ঘটনা কি গো মা?
অহনা খুবই অপ্রস্তুত বোধ করছে। এই প্রশ্নটা আসতে পারে বুঝলে, ও এখন আসতো না এখানে।
ঠিক কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছেনা।
ও ইতস্তত করে বললো খালাম্মা আমার একটু পড়তে বসতে হবে। আরেকদিন এসে গল্প করবো।
সে কি মা, কি কথা বলো তুমি? আমি চা বানিয়ে আনি। দুজনে চা খেতে খেতে গল্প করবো। একটু পরে পড়তে বসলে কি খুব বেশি ক্ষতি হবে!
খালাম্মা একটু আগে আমি কফি খেয়েছি।
এখন আর চা খাবো না। আসি কেমন। হাতে বেশি করে সময় নিয়ে এসে একদিন খুব গল্প করব।
আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে অহনা দ্রুত নিজের রুমে এসে হাফ ছেড়ে বাঁচলো যেন।
সকালের রোদ এসে আলোর বিছানায় পড়েছে।
বাতাসে জানালার পর্দা গুলো উড়ছে। পর্দার ফাক গলে বাতাস আর রোদের খেলা দেখতে আলোর বেশ ভালো লাগছে। ওর হাতে লাল কমল আর নীল কমলের বই।
বইটা পড়তে ওর খুব ভালো লাগছে। চিড়বিড়ে রোদের মধ্যে পা রেখে ও পড়া শুরু করলো…
অনেক কাল অনেক কাল আগে বনের ধারে বাস করতেন এক রাজা। সেই রাজার দুই পুত্র–নীল কমল, লাল কমল। এই দু জন রাজার দু চোখের মণি। এরা চোখের আড়াল হলে তিনি অস্থির হয়ে পড়েন। যখন সিংহাসনে বসেন, তার দু পুত্রকে দু পাশে বসান। যখন খেতে বসেন তখনো দু ভাই দু’ পাশে। রানী সোনার থালা থেকে মাছের মুড়ো তুলে দেন রাজার পাতে। রাজা সেই মুড়ো দু’ ভাগ করে তুলে দেন দুই ছেলের থালায়। এইসব দেখে রানী ছটফট করেন হিংসায়। কারণ তিনি আসল মা– নন। তিনি লাল কমল আর নীল কমলের সৎ মা।
এই দু জন তাঁর চোখের বালি, গলার কাঁটা। দিন-রাত ফন্দি করেন কী করে এই দু’ জনকে দূর কোনো দেশে নির্বাসন দেওয়া যায়। ভাবতে ভাবতে একদিন তাঁর মাথায় বুদ্ধি এল। খাটে শুয়ে গড়াগড়ি করে কাঁদতে লাগলেন। রাজা ছুটে এসে। বললেন–
কী হয়েছে রানী?
রানী কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, আমি আর বাঁচব না গো, আমার হাড় মুড়মুড়ি ব্যারাম হয়েছে।
সে আবার কী!
এই ব্যারামে শুধু হাড় মুড়মুড় করে–ওগো, আমি আর বাঁচব না গো।
এর কি কোনো অষুধ নেই?
অষুধ থাকবে না কেন? একশ’ বার আছে। সতেরো নদী যে দেশে এক জায়গায় মিলেছে সেই দেশের রাজবাড়ির বাগানে আছে এক ডালিম গাছ। সেই ডালিম গাছে বছরে একটি মাত্র ডালিম হয়। ভয়ঙ্কর এক কালকেউটে সেই ডালিম পাহারা দেয়। ঐ ডালিম খেলেই আমার অসুখ সারবে।
তাহলে আর চিন্তা কি? ঐ ডালিম আনতে আজই আমি প্রধান সেনাপতিকে পাঠাচ্ছি।
তাতে কোনো লাভ হবে না মহারাজ। একমাত্র রাজার কুমাররাই ঐ ডালিম আনতে পারে। আর কেউ পারে না।
লাল কমল আর নীল কমলকে পাঠিয়ে দিই।
আহা, ওরা যে দুধের শিশু। তাছাড়া আমি ওদের সৎমা। সৎমার জন্যে কেউ কি আর এত কষ্ট করে?
শুনে লাল কমল আর নীল কমল বলল, আমরা করব। আমরা মা’র জন্যে ডালিম নিয়ে আসব।
রওয়ানা হল দুই রাজকুমার। কত পথ, কত গ্রাম, কত নগর, কত অরণ্য পার করে তারা চলছে তো চলছেই। দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়। যেতে যেতে যেতে যেতে তারা পৌঁছল মনা রাক্ষুসীর দেশে।
আলো মুগ্ধ হয়ে গল্প পড়েছে। রাজপুত্রদের দুঃখে তার চোখ ভিজে উঠছে। কী যে কষ্ট হচ্ছে। এমন রাগ লাগছে সৎ মা টার ওপরে। এত পাজি কেন?
ও যখন গভীর চিন্তায় মগ্ন নীল কমল আর লাল কমলকে নিয়ে।
ঠিক সেই মুহূর্তে ওর ফোনটা বেজে উঠলো…