আলো-১৭,১৮

আলো-১৭,১৮

১৭

রাত্রে আসিফের ভালো ঘুম হয়নি। একটু পর পর ঘুম ভেঙে গেছে। কেমন ছাড়া ছাড়া ঘুম। বারবার স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেছে।

চোখ মেলে দেখে এখনো রাত কাটেনি। ও আবার চোখ বন্ধ করে ফেললো। চোখ বন্ধ করে স্বপ্ন গুলো নিয়ে ভাবার চেষ্টা করলো।

ও স্বপ্ন দেখছিলো একটা ছোট্ট ডিঙি নৌকায় ও আর অহনা। ও নিজে বৈঠা ধরেছে। চারদিকে গোলাপি শাপলা ফুটে আছে। অহনা খুব খুশি।
ও মনের আনন্দে শাপলা তুলছে আর হাসছে।
হঠাৎ করে দেখে অহনার বাবা এসে অহনাকে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে।
অহনা হাত থেকে সব শাপলা পড়ে গেল।
ও কান্না মিশ্রিত গলায় বার বার বলছে বাপি আমাকে ছেড়ে দাও। আসিফ আমাকে ছাড়া বাঁচবে না।
ঠিক সেই মুহূর্তে আসিফের ঘুম ভেঙে যায়।
ওর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।
ইচ্ছে করছে কড়া করে এক কাপ চা খেতে।

ও আবার চোখ মেলে তাকালো। আকাশ পরিস্কার হয়ে আসছে। মিষ্টি আলোয় রুমটা ভরে গেছে।
পাশে তাকিয়ে দেখে অহনা জড়ো সড়ো হয়ে ঘুমাচ্ছে।

ও উঠে গিয়ে দুকাপ “র” টি বানালো। এসে দেখে অহনা তখনো ঘুমিয়ে। খুব মিষ্টি লাগছে দেখতে। তবে রাতে যে কেঁদেছে বোঝা যায়। গালে পানির দাগ শুকিয়ে আছে।

ও চায়ের কাপ টেবিলে রেখে আস্তে করে অহনার মাথায় হাত রাখা মাত্র অহনা চোখ মেলে চাইলো।

কি ঘুম ভালো হয়েছে?

অহনা আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলো।
হুম হয়েছে। তবে শেষ রাতে। নতুন জায়গা তো ঘুম আসছিলো না।

এই নাও চা।
চা খেয়ে তাহলে আরেকটু ঘুমাও।

অহনা চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে বললো ধন্যবাদ।
না এখন আর ঘুমাবো না। হঠাৎ করে বিয়ে করে তোমাকে খুব সমস্যায় ফেলে দিয়েছি, সেটা বুঝতে পারছি।
কিন্তু বিশ্বাস করো, এ ছাড়া আর কোন পথ আমার সামনে খোলা ছিলো না।

আসিফ একটা আঙ্গুল অহনার ঠোঁটে রেখে বললো, চুপ। এসব কথা বলে শুধু শুধু মন খারাপ করার দরকার নেই। যা হবার হয়েছে।
এখন সামনে আমরা কিভাবে কি করতে পারি সেটা নিয়ে ভাবতে হবে।

আমার নিজের জন্য কোন চিন্তা নেই। সব চিন্তা তোমাকে নিয়ে। আমরা মাসে একদিন মাংস খাই।
প্রতিদিন ভর্তা ডাল সবজি এসব দিয়ে ভাত খাই।
তুমি কি পারবে আমাদের সাথে এসব খেতে?

অহনার চোখ দুটো ছলছল করছে।
ওর গলা ধরে আসছে। ও মাথা নিচু করে ফিসফিসিয়ে বললো আমি চেষ্টা করবো তোমাদের সাথে মানিয়ে চলতে।

তুমি আর আমি আজ ক্লাস শেষে বাসা দেখতে বের হবো কেমন। আমার একাউন্টে কিছু টাকা আছে।
মনে হয় বাসা ভাড়াটা আমি দিতে পারবো।
এখানে তো আর এভাবে দিনের পর দিন থাকা যায় না।
কি বলো তুমি?

আসিফের মুখ অন্ধকার হয়ে গেল অহনার কথা শুনে।
দেখো অহনা আমি জানি এখানে তোমাকে রাখা ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু আমি তো তোমার টাকা নিতে পারবো না।
মাসের এখনো অর্ধেক বাকি।
আমার হাতে ও তেমন কোন টাকা পয়সা নেই।
কথাটা বলতে যেয়েই আসিফের মনে পড়ে গেল কাল আলো দশ হাজার টাকা দিয়েছে।

ও উঠে গিয়ে টেবিলের ড্রয়ার খুলে টাকার বান্ডিলটা বের করে অহনার হাতে দিল। আলো কাল বিয়ের উপহার হিসেবে টাকাটা দিয়ে গেছে। টাকাটা তোমার কাছে রাখো। প্রয়োজনে খরচ করো।

অহনা টাকা ছুঁয়েও দেখলো না।
ও মন খারাপ করে বললো, আমার টাকা নিতে পারবে না, এটা কেমন কথা আসিফ?
আমার টাকা তোমার টাকা না?

তোমার টাকা অবশ্যই আমার টাকা। কিন্তু তুমি তো ইনকাম করো না। তাহলে টাকার আসল মালিক তোমার বাবা। আমি তোমার বাবার টাকা নিতে পারবো না।
এগুলো বাদ দাও।
মন খারাপ করো না। চলো দেখি সকলের নাস্তা কি করা যায়।

অহনা ইতস্তত করে বললো, তুমি এক কাজ করো।
অনলাইনে সবার জন্য খাবার অর্ডার দিয়ে দাও। টাকা তো আছেই। ঘরে কিছু করার দরকার নেই।

আসিফ কিছুক্ষণ চুপ করে অহনার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে মুচকি হেসে বললো, প্রতিদিন বাইরের খাবার খেলে আমরা অসুস্থ হয়ে পড়বো। আমাদের এসবে অভ্যাস নেই।

রান্না ঘর থেকে শব্দ আসছে। চলো তো দেখি ওরা কি করছে।

ওদের দুজনকে দেখে সবাই হৈ হৈ করে উঠলো।
আরে আসিফ ভাই, নতুন বউকে নিয়ে রান্না ঘরে আসতে হবে না। রান্না শেষ।
তোমরা বসো, ডিম ভাজা হলেই খাবার দিব।

আসিফ খেতে বসে দেখলো বিশাল আয়োজন।
গরম ভাত, আলু ভর্তা আর ডিম ভাজা।

অহনা ও খুব মজা করে খেলো। ও ভাবতেই পারেনি এই সাধারণ খাবার এতো অসাধারণ লাগবে।

খাওয়া শেষ করে রেডি হয়ে ওরা যখন ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য বের হবে ঠিক সেই মুহূর্তে আলো এসে উপস্থিত।

আলোকে নিয়ে ওরা আবার ঘরে এসে বসলো।
আলো ওর স্যারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো।

অহনা সালাম দিয়ে বসতে বললো।

রুমে মাত্র একটি চেয়ার।
সৈকত কে সেখানে বসতে বলে আলো বিছানায় পা তুলে বসলো।

আসিফ বললো, তোমরা গল্প করো। আমি নাস্তা পাঠিয়ে দিচ্ছি। তারপর ক্লসে চলে যাবো।
অহনা তোমার আজ আর ক্লাসে যেয়ে কাজ নেই।
তুমি ওদের সাথে সময় কাটাও।

আলো বাঁধা দিয়ে বললো, আসিফ ভাইয়া ব্যাস্ত হবেন না। আমরা খেয়েই বের হয়েছি।
আর আজকে ক্লাসে না গেলে হয় না?

হয়। তবে জরুরী ক্লাস ছিলো।

ঠিক আছে তাহলে ক্লাসে যান। এই কার্ডটা রাখুন।
ক্লাস শেষ করে এই ঠিকানায় চলে যাবেন।

এটা কার ঠিকানা? কেন যাবো?

এটা আমার বাবার কার্ড।
আপনার জন্য বাবা যদি কিছু করে, ফিরিয়ে দিবেন না প্লিজ। আর গেলেই বাকিটা জানতে পারবেন।

আসিফ চলে যাওয়ার পর আলো মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করলো কিরে কেমন লাগছে নতুন সংসার?
একদিনেই মুখ এমন শুকনো লাগছে কেন?

কি যে বলিস না। মুখ শুকনো লাগবে কেন?
আমি ভালো আছি। নতুন জায়গা একটু সময় লাগবে মানিয়ে নিতে।

আচ্ছা ঠিক আছে বুঝলাম। তোকে সময় দিতে আমাদের কোন আপত্তি নেই।
এই নে তোর দরকারি সব জিনিস। মানে আমি হাতের কাছে যা পাইছি সব ভরছি। তোর সাজুগুজুর জিনিস ও আছে। আর এই নে ফুপি একটা চেক দিয়েছে।
তোর প্রয়োজন মতো সংখ্যা লিখে টাকা উঠায় নিস।

অহনা বিস্মৃত হয়ে বললো, চেক লাগবে কেন?
আমার তো একাউন্টে টাকা আছে।

তোর জন্য সুখবর আছে। ফুপা তোর এ্যাকাউন্ট ক্লোজ করে দিছে। হা হা হা। হি হি হি।

আচ্ছা আমি আসিরে। আমার কাজ আছে।
আর ফোন বন্ধ করে রাখছিস কেন? অন কর।
ফুপির সাথে কথা বলিস। ফুপি তোর চিন্তায় নাওয়া খাওয়া ভুলে বিছানা নিয়েছে।

আলো উঠে দাঁড়ানো মাত্র অহনা হাত চেপে ধরলো।

এই এই যাচ্ছিস মানে? বোস। তোর স্যারকে এনেছিস।
আমি একটু চা করি।

তোকে কিছু করতে হবে না। ভার্সিটিতে যাবি?
গেলে বল, নামিয়ে দিয়ে যাই।

না থাক। আজ আর বের হবো না।
আজকে আমি চিন্তা দিবস পালন করবো।
আমি যা করলাম তা ভুল না সঠিক সেই ভাববো সারাদিন।

আচ্ছা ঠিক আছে, তুই বসে বসে চিন্তা দিবস পালন কর। আমি গেলাম। কোন সমস্যা হলে ফোন দিস।

আলো গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে সাভারে যেতে বললো।
ড্রাইভার যেহেতু আগেও গিয়েছে। তাই সে এক টানে মন্টু মিয়ার বাসার সামনে এসে গাড়ি থামালো।

আলো গাড়ি থেকে নেমে তার মামার ঘরের দরোজায় বিশাল এক তালা দেখে হতভম্ব হয়ে গেল।
কি ব্যাপার অসুস্থ শরীর নিয়ে মামা গেল কোথায়?

ওর চোখ ভিজে উঠেছে।
কিন্তু সে স্যারের সামনে তার চোখের পানি কিছুতেই দেখাতে চায় না।

ওর কষ্ট গুলো সব গলার কাছে দলা পাকিয়ে উঠেছে।
ও মনে মনে বললো, আমি তোমার জন্য কিছু করতে পারলাম না মামু। অথচ নিজে কতো বিলাস বহুল জীবন যাপন করছি। আর তুমি অসুস্থ শরীর নিয়ে পেটের তাগিদে নিশ্চয় আবার সেই খারাপ কাজ করতে গেছো। আমাকে মাফ করো মামু।

আলো ধরা গলায় বললো, স্যার আপনি একটু গাড়িতে গিয়ে বসুন। আমি একটু পাশের বাসায় খবর নিয়ে দেখি। মামার কোন খবর পাওয়া যায় কিনা।

সৈকত মেয়েটার কান্ড কারখানা সকাল থেকে চুপ করে শুধু দেখে যাচ্ছে। এই মেয়েটার মধ্যে যে এতো মায়া, আজ ওর সাথে না আসলে সে কখনো বুঝতে পারতো না।

সে নরম সুরে বললো, আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না আলো। আমি এখানে দাঁড়াচ্ছি। তুমি খোঁজ নিয়ে আসো।

পাশের বাসার চাচি আলোকে দেখে অবাক বিস্ময়ে জড়িয়ে ধরলো। ওমা তুই আমাদের সেই আলো!
কি সুন্দর লাগছে তোকে দেখতে। আয় আয় ঘরে আইসা বয়।

বসবো না চাচি। মন্টু মামার ঘরে তালা কেন চাচি?

তোর মামাতো বিদেশে গেছেরে ডাক্তার দেখাতে।
তোর জন্য একটা চিঠি লিখ্যা রাইখা গেছে।
দাঁড়া আমি আনতাছি।

আলো বুঝতে পারছে না, মামা কিভাবে বিদেশে যাবে?
কি বলে এসব! ও কিছুতেই মিলাতে পারছে না ঘটনা কি?

এই নে চিঠি। তুই যে আইবি তোর মামায় বুজছে।
হেরপানে চিঠি লেইখ্যা রাইখা গেছে।

আলো চিঠিটা হাতে নিয়ে বিদায় নিলো।
আসি চাচি। আমার জন্য দোয়া করো।

গাড়ি ছুটে চলেছে ঢাকার পথে। আলো চিঠিটা হাতে নিয়ে বসে আছে। খুব ইচ্ছে করছে চিঠিটা পড়তে।
আবার ভাবছে থাক বাসায় গিয়ে ধীরে সুস্থে পড়বো।

একটা সময় আর ধৈর্য ধরে থাকতে পারলো না।
চিঠিটা খুলে পড়া শুরু করল।

খুব ছোট্ট একটা চিঠি।
কিন্তু আলো বারবার পড়ছে।

মা আলো।
আমার জন্য চিন্তা করো না।
তোমার বাবা আমার উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডনে পাঠাচ্ছে। আমি তোমাকে ফোন দিয়ে জানাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মাগো তোমার ফেরেস্তার মতো বাবা ফোন দিতে দিলো না।
এটা নাকি তোমার জন্য সারপ্রাইজ।
দোয়া নিও গো মা জননী।
তোমার মন্টু মামু।

আলো চিঠিটা বুকের সাথে শক্ত করে ধরে রেখেছে।
ওর চোখ বেয়ে নেমে আসছে শ্রাবণের ধারা। ও ইচ্ছে করে চোখের পানি মুছছে না। আজ ওর বড়ো আনন্দের দিন। আজ ও শখ মিটিয়ে কান্না করবে।

সৈকত অবাক হয়ে আলোর দিকে তাকিয়ে আছে।
ও কিছুতেই বুঝতে পারছে না মেয়েটাকে।
ওর কাছে এই মুহূর্তে আলোকে খুবই দুর্বোধ্য লাগছে।
খুব ইচ্ছে করছে আলোর চোখের পানি মুছিয়ে দিতে।
কিন্তু ডিসিশন নিতে পারছে না কি করবে? মনে মনে বললো,
আলো তুমি কি খুব বেশি মাইন্ড করবে যদি তোমার চোখের পানি মুছে দেই?

আলো-১৮

অহনা পর পর দু কাপ চা খেলো। দুপর গড়িয়ে বিকেল হতে চলেছে। পেটে প্রচন্ড খিদে, কিন্তু খেতে ইচ্ছে করছে না। হঠাৎ করেই সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। ওর কিছুই ভালো লাগছে না। খিদে পেটে চা খেয়ে এখন পেটের ভেতর থেকে নাড়িভুড়ি বের হয়ে আসতে চাইছে। পুরো শরীর গুলিয়ে উঠছে।
ও রান্না ঘরে গিয়ে হাড়ি পাতিলের ঢাকনা খুলে উঁকি ঝুঁকি দিয়ে দেখলো খাবার কিছু আছে কিনা।

একটা হাঁড়িতে সামান্য ভাত। আরেকটা হাঁড়িতে ডাল।
প্লাষ্টিকের ঝুড়িতে দুটো ডিম, পেঁয়াজ, আলু রাখা।
ডিম ভেজে ভাত খাওয়া যায়। কিন্তু ওর সাহস হচ্ছে না। ও কখনো রান্না করেনি। শুধু চা, কফি তৈরি করেছে। তাও হঠাৎ শখ করে।

খাবার গুলো ঢেকে রেখে আবার মন খারাপ করে বিছানায় এসে বসলো।

বিছানায় বসা মাত্র দরোজায় কড়া নাড়ানোর শব্দ।
প্রথমে একটু ভয় পেলো। তারপর যখন আসিফের গলার আওয়াজ পেলো, তখন ছুটে গিয়ে দরোজা খুলে আসিফকে জড়িয়ে ধরলো।

আরে আরে কি করো।
ভেতরে ঢুকতে দাও। দরোজা খোলা রেখে কেউ এভাবে জড়িয়ে ধরে। মানুষ দেখলে কি ভাববে!

অহনা লজ্জায় লাল হয়ে সাথে সাথে আসিফকে ছেড়ে দিল।

অহনার কান্ড কারখানা দেখে আসিফ শব্দ করে হেসে উঠে বলল এগুলো ধরো, ভেতরে নিয়ে যাও।
আমি দরোজা আটকে আসছি।

অহনা আসিফের হাত থেকে ব্যাগ গুলো নিয়ে টেবিলে রাখলো। একটা শপিং ব্যাগে দুই প্যাকেট বিরিয়ানির প্যাকেট দেখে অহনার খিদেটা আবার মাথা চারা দিয়ে উঠলো।

আসিফ ড্রেস চেঞ্জ করতে করতে বললো, কিছু খেয়েছো?

হুম।

কি খেলে?

দু কাপ চা।

হা হা হা। চা খেয়ে কি খিদে দূর হয়। একা একা থাকতে খুব খারাপ লেগেছে তাই না? তারপর উত্তরের অপেক্ষা না করেই বললো, অহনা দুটো প্লেটে খাবার গুলো ঢালো। দেখো গরম গরম বিরিয়ানি আনছি। খুব খিদে পেয়েছে। আমি হাত মুখ ধুয়ে আসি।

দুজনে খেতে বসেছে।
অহনার প্রচুর ক্ষুধা, কিন্তু গলা দিয়ে খাবার নামছে না। খিদেটা যেন মরে গেছে। ও শুধু খাবার নাড়ছে।

আসিফ খেতে খেতে খেতে বললো, খাচ্ছো না কেন?
ঠান্ডা হয়ে গেলে আর মজা লাগবে না।
তাড়াতাড়ি খাও। খাওয়া শেষ করে বাসা দেখতে যাবো।
একটা সুখবর আছে।
তোমার মামার রেফারেন্সে একটা চাকরি হয়েছে।
পার্ট টাইম জব। দুপুরের লাঞ্চ অফিসেই করবো।
দুপুরে তিনটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত অফিস।
সকালে ভার্সিটির ক্লাস শেষ করে অফিসে চলে যাবো।
তুমি খুশি হয়েছো?

অহনার খুব কান্না পাচ্ছে। সারাদিন মানুষটা বাইরে থাকবে। তাহলে ও কি করবে সারাদিন!
নিজের আবেগ কন্ট্রোল করে বললো, হুম খুশি হয়েছি।
বেতন কতো?

নতুন হিসেবে বেতন খারাপ না। তিন মাস দেখবে আমি কাজ কেমন করি। আপাতত ত্রিশ হাজার।
কাজে সন্তুষ্ট হলে বেতন বাড়বে।

মাত্র ত্রিশ হাজার? এতে কি সংসার চলবে?

মাত্র নয় অহনা।
পার্ট টাইম জব করে ত্রিশ হাজার অনেক বেতন।
আমার ধারণা তোমার মামার হাত আছে জন্য এই বেতন দিবে।

আর সংসার চালাতে হবে।
একটু কষ্ট করতে হবে। কিছু করার নেই।

ওরা বিকেলে বাসা দেখতে বের হলো।
অনেক গুলো বাসা দেখলো। অহনা যেগুলো পছন্দ করে ভাড়া অনেক বেশি। আসিফ ভাড়া শুনেই বের হয়ে আসে।

শেষ পর্যন্ত আসিফের একটা বাসা পছন্দ হলো।
চার তলায় পুরো ছাদের ওপরে এক মাথায় এক রুমের একটা বাসা। কোন রান্না ঘর নেই। এটাচড বার্থ আছে একটা। তবে রুমটা মোটামুটি সাইজের। একেবারে ছোট নয়। ভাড়া সাড়ে তিন হাজার টাকা।

আসিফ মহা খুশি।
সে আনন্দে ঝলমল করে বললো এটা ফাইনাল করে ফেলি কি বলো?

অহনা বিস্ময় গোপন করতে পারলো না।
সে সরাসরি বলে বসলো, কি বলছো তুমি?
এক রুমের বাসায় কিভাবে থাকবো?
তাছাড়া এটা ব্যাচেলরদের জন্য করা বোঝায় যায়।
ফ্যামিলি বাসায় তো একটা রান্না ঘর থাকবে।

অহনা তুমি বুঝতে পারছ না। এর চেয়ে কম ভাড়ায় বাসা পাওয়া যাবে বলে আমার মনে হয় না।
তাছাড়া এখান থেকে অফিস এবং ভার্সিটি দুটোই কাছে হবে। কনভেন্স লাগবে না। চাইলেই আমরা হেঁটে হেঁটে ভার্সিটি যেতে পারবো। একটু কষ্ট করতেই হবে অহনা।
আর রুমটা বেশ বড়ো আছে।
আমরা টোনাটুনি, রুমের মধ্যেই রান্না করে ফেলবো।

তোমাকে বুঝতে হবে এই টাকায় বাসা ভাড়া, আমাদের থাকা খাওয়ার খরচ, পড়াশোনার খরচ এবং বাড়িতে আমার মা বোনের জন্য ও কিছু টাকা পাঠাতে হবে।

অহনার প্রচন্ড রকম মন খারাপ হয়ে গেলো।
তার কতো স্বপ্ন নিজের একটা ছোট্ট সংসার হবে। যেন তেন সংসার নয়, খুব সুন্দর করে সাজানো গোছানো সংসার।

ও মুখ অন্ধকার করে বললো, ঠিক আছে তুমি যা ভালো মনে করো।

এখানে নিয়ম হলো তিন মাসের বাসা ভাড়া এ্যাডভান্স দিয়ে উঠতে হবে।
আসিফ অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে বাড়ি আলাকে শুধু এক মাসের ভাড়া দিতে রাজি করালো ।
বাড়ি আলা যখন জানতে পারলেন ওরা গতোকাল বিয়ে করেছে, দুজনেই স্টুডেন্ট। তখন এ্যাডভান্স সিষ্টেম ওদের জন্য মাপ করে দিলো।
সাথে অফার দিলো মাস শেষ হতে তো আট দশ দিন বাকি আছে। আমার রুম যেহেতু খালি পড়ে আছে, তোমরা চাইলে আজ বা কাল উঠতে পারো।
এই কয়দিনের জন্য ভাড়া দিতে হবে না।

আসিফ সিদ্ধান্ত নিলো আজকেই উঠবে।
কাল ওর প্রথম অফিস। অফিস শেষ করে এসে ঝামেলা ভালো লাগবে না। যদিও ওদের তেমন কিছু নেই। তারপরও ওরা আজকেই উঠার সিদ্ধান্ত নিলো।
এবং ঘন্টা খানেকের মধ্যে রুমমেটদের কাছে বিদায় নিয়ে ওদের বই খাতা, তোষক, বালিশ নিয়ে নতুন বাসায় উপস্থিত হলো।

আসিফ বললো অহনা আমাদের তো সংসার শুরু করতে হলে অনেক কিছু দরকার। তেমন কিছু তো নেই। এক কাজ করলে কেমন হয়।
আলো আপার দেওয়া টাকা গুলো দিয়ে সংসারের প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস কিনে আনি।

খুব ভালো হয়।
ওখান থেকে তো সাড়ে তিন হাজার এ্যাডভান্স দিলে।
বাকি টাকা দিয়ে হবে?

হবে হবে। সব কিছু দুইটা করে কিনব।

তোমার ভয় করবে না তো নতুন জায়গায়?
কিছুক্ষণ একা থাকতে পারবে না? আমি ঝটপট বাজার গুলো করে আনি।

আমার একা থাকতে ভালো লাগবে না। আমি ও তোমার সাথে যেতে চাই।

আচ্ছা ঠিক আছে চলো।

ওরা ঘুরে ঘুরে ছোট ছোট হাড়ি পাতিল, কিছু মশলা, তেল, চিনি, চা পাতা, ভাতের চাল, ডাল আর দুটো প্লেট, একটা গ্লাস, দুটো কাপ কিনলো।

আসিফের এতো হিসাব করে বাজার করা দেখে অহনা খুব অবাক হয়ে বললো, তুমি একটা গ্লাস কিনলে যে?

আসিফ হেসে বললো, একটা গ্লাসেই আমাদের দুজনের হয়ে যাবে।

বুঝলাম আমাদের জন্য একটাই যথেষ্ট।
মেহমান আসলে?

আরে আমাদের বাসায় মেহমান পাবে কোথায়?
কেউ আসলে এটাই ধুয়ে পানি দিবে।

আর বেতন পেলে আস্তে আস্তে সব হবে। এখন আপাতত চালিয়ে নেয়া।

হুম। ঠিক আছে। কিন্তু কফি আর গুড়া দুধ কিনো।
কফি না খেলে আমার মাথা ধরে।

আসিফ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে একদম ছোট সাইজের একটা কফির বৌয়ম আর ১২০ গ্রাম দুধের প্যাকেট কিনলো। সাথে টোস্ট বিস্কুট।

ওরা বাজার নিয়ে যখন রিকশায় করে বাড়ি ফিরছিলো।
অহনার কাছে মনে হলো আসিফ খুব বেশি কৃপণ।
ও মনে মনে খুবই শংকিত হলো, কিভাবে এই মানুষটার সাথে আজীবন মানিয়ে চলবে!

বাজার নিয়ে ওপরে ওঠার সময় বাড়ি আলা বের হয়ে আসলেন। তোমাদের বাসায় গিয়ে ঘুরে আসছি তালা দেখে। আজ রাতে আর রান্না করার দরকার নেই।
আমাদের সাথে দুটো ডাল ভাত খাবা।

অহনা বলল না না চাচা। আপনাদের কষ্ট করতে হবে না। আমরা বাইরে গিয়ে খেয়ে নিব।

তা হয় না মা।
তোমার চাচি আম্মা তোমাদের জন্য রান্না করছে।
তোমরা একটু রেস্ট নিয়ে খেতে আসো।

অহনা আর আসিফ ছাদে পাটি পেতে বসে আছে।
ঝিরিঝিরি বাতাস, বেশ ভালো লাগছে। ঘরের মধ্যে অনেক গরম। ওদের রুমে ফ্যান নেই। রান্নার ব্যাবস্থা নেই।
আসিফের মাথায় শুধু ঘুরছে বেশ কিছু জিনিস কেনা দরকার। এভাবে অহনার খুব কষ্ট হবে। আজকে না হয় বাড়ি আলার বাসায় ভালো মন্দ খেলাম।
প্রতিদিন তো আর দাওয়াত খাওয়াও হবে না, বাইরে থেকে কিনে খাওয়া ও সম্ভব নয়।
একটা ইলেকট্রিক চুলা আর ফ্যান না হলেই নয়।

কি ভাবছো আসিফ?

অহনার কথায় আসিফ ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে এসে বললো, না তেমন কিছু না।
চলো ঘুমাতে যাই। রাত অনেক হলো।

হুম চলো।

অহনা কখনো ফ্লোরিং করেনি।
পাতলা একটা তোষক, নরমাল একটা বিছানার চাদর। সেই বিছানায় আবার একটাই বালিশ।
ফ্যান নেই জন্য খুব গরম লাগবে ভেবেছিলো।
কিন্তু অনেক বড়ো বড়ো জানালা। ওরা জানালা খুলে রেখে শুয়েছে। বেশ ঠান্ডা বাতাস ছেড়েছে।
হয়তো আশেপাশে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে।

আসিফ অহনাকে কাছে টেনে নিলো।
খুব আবেগীয় কন্ঠে বললো, অহনা?

হুম।

একটা বালিশ জন্য মন খারাপ করো না। তুমি আমার বুকে থাকবে সবসময়। আমাদের এই দিন থাকবে না।
একটু কষ্ট করো প্লিজ।
আমার পড়াশোনা শেষ হলেই খুব ভালো জব পেয়ে যাবো দেখে নিও।

অহনা আসিফকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।
আমি জানি আসিফ। আমি সব কষ্ট মাথা পেতে নিব।
শুধু তুমি আমাকে কখনো ছেড়ে যেও না।
খুব ভালোবাসি তোমায়, খুব।

আসিফ আরো গভীর ভাবে অহনা কে কাছে টেনে নিলো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here