আলো-১৫,১৬
১৫
ওকে জেলের ভাত খাওয়ায় ছাড়াবো।
মানি না আমি এ বিয়ে কিছুতেই মানি না।
ঠিক আছে জেলের ভাত খাওয়াতে চাইলে খাওয়াবেন।
তার আগে ঠান্ডা মাথায় একবার ভাবুন তো অহনার বয়স কতো? আপনি কি পারবেন ওর মতের বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু করতে? আপনার এতো রাগ কিসের জন্য বলুন তো ফুপা?
ওরা নিজেদের পছন্দে একা একা বিয়ে করেছে জন্যে?
এটা রাগ করার মতো কোনো কারণ না?
অহনার বাবা মুশফিক রহমান হতভম্ব হয়ে বললেন, এটা রাগ করার মতো কারণ না?
আলো বলল, জি-না। এটা রাগ করার মতো কোনো কারণ না। বিয়েটা সম্পূর্ণ আপনার মেয়ের নিজের ব্যাপার। সে তার নিজের সংসার করবে। সেই সংসারে আপনি কথা বলার কে?
আমি কেউ না?
না। আপনি কেউ না। অহনার সংসার অহনার। আপনারটা আপনার।
আলো সোফায় বসতে বসতে বললো, এই যে ফুপি চুপ করে আছে। কেন চুপ করে আছে?
সে আপনাকে ভয় পায়। আপনার মতের বিরুদ্ধে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। বাসায় নতুন জামাই এসেছে। কোথায় আপ্যায়ন করবে তা না ফুপি ভয়ে সিটিয়ে আছে।
আলো কিছু মনে করো না। আজকে আমি তোমাকে কিছু কঠিন কঠিন কথা শোনাতে চাই।
তোমার একটা ব্যাপার আমি লক্ষ করেছি। তুমি কোনো-না-কোনোভাবে আমার মতের বিরুদ্ধে চলে যাও। তোমার সঙ্গে একমত হতে পারছি না জন্য দুঃখিত।
আমি আমার আদরের মেয়েকে এই ছেলেটার হাতে তুলে দিতে পারি না। ও নিজেই একটা মেসে থাকে।
আমার মেয়েকে রাখবে কোথায়?
একটু দম নিয়ে বললেন, তাছাড়া অহনার বিয়ে দুই দিন পর। সব কেনাকাটা হয়ে গেছে।
তুমি এই অপদার্থ ছেলেটাকে বলো আমার মেয়েকে ডিভোর্স দিতে।
আলো হাসতে হাসতে বললো, তাহলে আপনি স্বীকার করছেন ওদের বিয়ে হয়েছে?
তোমার সাথে আমার মতের মিল হবে না সে আমি বুঝতে পারছি। অযথা সময় নষ্ট করো না।
আলো ফিসফিসিয়ে বললো, তার কারণ হয়তো এই যে, আপনি যে-মতের জগতে বাস করেন আমি সেই জগতে বাস করি না। আমাদের দুজনের মনের জগত সম্পুর্ন আলাদা। আজ আপনার বাসায় মেয়ে জামাই এসেছে।
এই উপলক্ষে সবার আনন্দিত হবার কথা। অথচ এই আনন্দের দিনে আপনি আপনার মেয়েটাকে তালাবন্ধ করে রেখেছেন।
এই মেয়ে তোমার হলে তুমি তাকে মাথায় তুলে সোহাগ করতে?
তা করতাম না। কিন্তু তাকে তালাবন্ধ করেও রাখতাম না।
চাবিটা দিন। আপনি যেহেতু ওদের দোয়া করবেন না।
তবে চলে যেতে দিন। ওরা আসতে চায়নি। আমি ওদের জোর করে নিয়ে এসেছি। এখন মনে হচ্ছে না আনলেই মঙ্গল হতো।
আলো মুশফিক রহমানকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে চাবিটা নিয়ে তালা খুলে অহনাকে বের করে আনলো।
আসিফ চলো।
তোমরা তোমাদের নতুন জীবন শুরু করো বাবা মায়ের আশীর্বাদ ছাড়াই।
অহনা চলে যাওয়ার আগে মায়ের দিকে ছলোছলো চোখে চাইলো।
ওর মা মুখে কাপড় গুঁজে দৌড়ে নিজের রুমে চলে গেলেন।
আলো ওদের আবার তাড়া দিল, চল অহনা আর সময় নষ্ট করিস না।
আলো ওদের কে নিয়ে রেস্টুরেন্টে ঢুকলো।
অহনা ফিসফিসিয়ে বললো এখানে কেন আলো?
মাথা ধরেছে রে খুব। সবাই মিলে একটু চা খাই।
আর চা খেতে খেতে ডিসিশন নেওয়া যাবে কি করা যায়।
তোদের তো কোথাও উঠতে হবে তাই না?
আলো চায়ে চুমুক দিয়ে বললো এক কাজ কর
আমাদের বাসায় চল। আসিফ একটা ব্যাবস্থা না করা পর্যন্ত আমাদের বাসায় থাকবি।
আসিফ এই পর্যন্ত কোন কথা বলেনি।
ও এমনিতেই দিশেহারা বোধ করছে, ওর হাত একদম খালি। বন্ধুদের টাকায় বিয়ে করেছে।
কিন্তু এরপর?
সে আর ভাবতে পারছে না।
মাথাটা দপদপ করে ছিঁড়ে যেতে চাইছে।
সে আরেক কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে বললো, তা হয় না আলো আপু। আপনার মা কখনো মানবে না আমাদের।
মানলেও তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে গিয়ে আমাদের আশ্রয় দিবে না।
তাহলে কি করতে চাও?
কি আর করবো। করার তো কিছু নেই। আমার সে সাহস বা সামর্থ্যও নেই।
আর সবকিছু জেনেও অহনা আমার কাছে এসেছে।
আমি ওকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করে ও ব্যার্থ হয়েছি।
আপাতত ওকে আমাদের মেসেই থাকতে হবে।
অহনা চমকে উঠে তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিলো।
তারপর খুব আস্তে করে বললো, আলো তুই এতো ভাবিস না তো। আমি ওর সাথে গাছ তলাতেও থাকতে পারবো। আমার মানসিক প্রিপারেশন আছে।
চলো আসিফ উঠা যাক।
আলো কাঁধ নাচিয়ে বললো, ওকে ফাইন।
তোরা যা ভালো মনে করিস। চল তোদেরকে নামিয়ে দিয়ে আসি।
আসিফ মুচকি হেসে বললো, তার দরকার নেই আপু।
এখান থেকে তো কাছেই। আমরা রিকশা নিয়ে চলে যেতে পারবো। এমনিতেই আজ আপনি আমাদের জন্য অনেক করেছেন।
আলো চোখ পাকিয়ে বললো, একদম বেশি কথা বলবে না। গাড়িতে ওঠো। কাল রিকশায় ঘুরো ইচ্ছে মতো।
অহনার এখন রেস্ট দরকার। ওর ওপর দিয়ে যথেষ্ট মানসিক ধকল গেছে।
ওরাও আর কথা না বাড়িয়ে গাড়িতে ওঠে বসলো।
আলো এক টানে সুলতান ডাইনের সামনে এসে গাড়ি থামালো। তোরা একটু বোস। আমি যাবো আর আসবো।
আলো যেতে গিয়ে ও আবার ঘুরে আসলো।
আসিফ তোমার মেসে কয়জন মানুষ?
মানে কতোজন থাকো সেখানে?
আপু দুই রুমে মোট আট জন আমি সহ।
ওকে ফাইন।
আলোর পেছন পেছন একটা ছেলে দশ প্যাকেট কাচ্চি নিয়ে বের হয়ে আসলো।
গাড়িতে রাখার পর ওরা আবার ছুটলো ওদের গন্তব্যে। রাস্তায় জ্যাম না থাকাতে দশ মিনিটের মধ্যে ওরা মেসে চলে আসলো।
মেসের সবাই হৈ হৈ করে উঠলো ওদেরকে পেয়ে।
সবাই অস্থির হয়ে ওদের সবচেয়ে ভালো জিনিস দিয়ে ভেতরের রুমটা গুছিয়ে দিলো। একজন তার সবচেয়ে ভালো চাদরটা বিছানায় বিছিয়ে দিলো।
আরেকজন নতুন গামছা এনে দিলো।
আলোর একটু মন খারাপ লাগছিলো এই ভেবে যে অহনা কি পারবে এখানে থাকতে?
কিন্তু রুমমেটদের আন্তরিকতা দেখে সে মুগ্ধ হলো।
আলো ওদের সবার সাথে একসাথে বসে খেলো।
রুমমেটরা তাদের সবচেয়ে ভালো প্লেট গ্লাস আলো আর অহনাকে দিলো।
আলো যাওয়ার সময় আসিফকে ডেকে বাইরে নিয়ে গেল।
আসিফ একটু আসবে।
জি আপু, আসছি।
এই খামটা রাখো।
এখানে হাজার দশেক টাকা আছে। এটা আমার পক্ষ থেকে তোমাদের বিয়ের উপহার।
সরি আপু।
আমার পক্ষে এ টাকাটা রাখা সম্ভব নয়।
আজব!
আমি কি তোমাকে এমনি এমনি দিচ্ছি! বিয়েতে আমি বোন হিসেবে কিছু দিব না? কিছু কিনে দিতে পারতাম।
কিন্তু নতুন সংসারে অনেক খরচ আছে। আপাতত টোনাটুনির সংসার গোছাও। তার পরেরটা পরে দেখা যাবে।
আমি পরে এসে আবার খবর নিয়ে যাবো আর অহনার কিছু কাপড় চোপড় দিয়ে যাবো।
ভালো থেকো। টেনশন করো না। সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে।
আলোর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে আসিফ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মনে মনে বললো, কিছুই ঠিক হবে না আপু।
আপনার বোন আমাকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিলো।
জানি না কবে এ অন্ধকার থেকে বের হয়ে আলোর মুখ দেখবো।
আলো-১৬
মবিনুর রহমান সকালের নাস্তায় কয়েক টুকরো পেঁপে, একটা সিদ্ধ ডিম আর ফলের জুস খান।
তারপর দশ মিনিট পেপারে চোখ রাখেন।
এরমধ্যে তার জন্য কড়া লিকারের চা তৈরি করে নিয়ে আসে আলো। আলো নতুন করে চা বানানো শিখেছে। প্রতিদিন সকালে নিজের হাতে চা বানিয়ে খাওয়ায় তার বাবাকে। কখনো একদম পারফেক্ট হয়, কখনো আবার পানছে হয়।
কিন্তু মবিনুর রহমান খুব আগ্রহ করে মেয়ের তৈরি করা চা পান করেন। এই সময় তার মনটা অসম্ভব রকমের ভালো থাকে।
আলো এই সময়টাকে বেছে নিলো বাবার সাথে কথা বলার জন্য।
সে খুব মনোযোগ দিয়ে চা তৈরি করে বাবার হাতে দিতে দিতে একটা চেয়ার টেনে মুখোমুখি বসলো।
তুমি কি কিছু বলতে চাও মামনি?
মবিনুর রহমান চায়ে চুমুক দিয়ে মেয়ের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো।
আলো একটু ইতস্তত করে বললো, বাবা তোমাকে আমার জরুরি কিছু কথা বলার আছে।
বলো?
তুমি কি জানো কাল অহনা বিয়ে করেছে?
জানি। সে তার সাথে পড়ে এমন একটা ছেলেকে বিয়ে করেছে। ছেলেটা খুব ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট এবং প্রফেশনাল পাইভেট টিচার।
টিউশনির টাকায় সে অনেক কষ্ট করে ঢাকা শহরে টিকে আছে। এবং তোমার ফুপা বিয়েটা মেনে নেয়নি।
এখন বলো তুমি কি বলতে চাও?
বাবা আমি ওদের সামান্য উপহার দিয়ে সহযোগিতা করতে চাই।
অবশ্যই উপহার দিবে। হাজার হলেও সে তোমার কাজিন। কতো টাকা লাগবে?
বাবা টাকা দিলে ওরা নিবে না। আসিফের আত্মসন্মান বোধ অনেক বেশি। ও একটা মেসে থাকে বন্ধুদের সাথে রুম শেয়ার করে। আমি জানি অহনার ওখানে মানিয়ে চলতে খুব কষ্ট হবে।
আমি চাই সাভারে আমাদের যে বাগান বাড়িটা আছে, এক সপ্তাহের জন্য ওদেরকে ওখানে রাখতে।
এতো সুন্দর বাড়িটাতো খালিই পড়ে আছে।
ওদের জীবনের শুরুটা খুব আনন্দে কাটবে তাহলে।
এই এক সপ্তাহের মধ্যে ওরা নিজেদের পছন্দমতো একটা ভাড়া বাড়ি ঠিক জোগাড় করে ফেলবে।
তুমি চাইলে অবশ্যই ওরা থাকবে।
কিন্তু আমার মনে হয় এটা ঠিক হবে না।
কেন ঠিক হবে না বাবা?
কারণ অহনা একটা ভুল করেছে। আসিফ ছেলেটা এখনো কোন জব করে না যে অহনাকে খুব ভালো একটা পরিবেশে রাখবে।
এক সপ্তাহ যদি ও ভালো একটা সুন্দর বাসায় থাকে, আর আসিফ যখন এক সপ্তাহ পর খুব অল্প ভাড়ার ছোট্ট একটা বাসায় তুলবে অহনা তখন ধাক্কার মতো খাবে। ঐ পরিবেশ ও সহজে মানিয়ে নিতে পারবে না।
প্রতি দিন ওদের মধ্যে নতুন নতুন সমস্যা সৃষ্টি হবে।
তার চাইতে ও প্রথম দিন থেকেই অনুভব করুক ওর জীবনটা কেমন হতে চলেছে। তাহলে ওর মানিয়ে নিতে সহজ হবে। আমি বোধহয় অতো ভালো করে তোমাকে বুঝাতে পারছি না।
আমি বুঝতে পারছি বাবা তুমি কি বলতে চাইছো।
তোমার কি খুব মন খারাপ হচ্ছে?
জি বাবা। আমার খুব খারাপ লাগছে অহনার জন্য।
তাহলে তুমি অহনার বিয়েতে সাক্ষী হলে কেন?
তুমি ওকে বুঝাতে পারতে।
অন্ততপক্ষে ছেলেটার পড়াশোনা শেষ করার সময়টুকু দেওয়া উচিত ছিল।
বাবা সেই মুহুর্তে অহনার আর দ্বিতীয় কোন পথ খোলা ছিলো না। অহনাকে ফুপা তার বন্ধুর ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দিতো।
হুম জটিল সমস্যা।
ঠিক আছে তুমি এক কাজ করো।
অহনা কে বলে আসিফকে আমার অফিসে পাঠানোর ব্যাবস্হা করো। দেখি ওদের জন্য কি করা যায়।
আলো খুশিতে ওর বাবাকে জড়িয়ে ধরল।
থ্যাংকু বাবা। আই লাভ ইউ।
লাভ ইউ ঠু মামনি। আমার দেরি হয়ে গেল।
আমি অফিসে গেলাম।
তুমি আজকেই আসিফকে পাঠাও আমার অফিসে।
আলোর মনটা আজ খুব ভালো।
সে শখ করে তার মায়ের শাড়ি পরেছে।
শাড়ি পরে হাঁটতে তার খুব সমস্যা হচ্ছে, পায়ের সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে বারবার।
ও শাড়ি হাঁটুর ওপরে তুলে ওর মায়ের কাছে গেল।
মা দেখোতো আমার শাড়ি মনে হয় এখনি খুলে যাবে।
তুমি কিভাবে সারাদিন শাড়ি পরে থাকো?
ওর মা মেয়ের হাঁটুর ওপরে শাড়ি তোলা দেখে হাসতে হাসতে শেষ। মারে এভাবে কেউ শাড়ি তুলে।
তোমার শাড়ি খুলবে না। আমি বেশি করে সেফটিপিন মেরে দিছি। আর যদি বেশি অসুবিধা মনে হয়, তাহলে খুলে ফেলো। আরেকদিন পড়ো।
আস্তে আস্তে অভ্যাস হয়ে যাবে।
না মা আমি শাড়ি খুলবো না। আমি ঠিক করেছি,
আজকে আমি সারাদিন শাড়ি পরে থাকবো।
একটু পরে স্যার আসবে।
আমি আজ স্যারকে নিয়ে অনেক গুলো কাজ করবো।
তুমি কি বাবাকে ফোন দিয়ে বলবে গাড়িটা বাসায় পাঠায় দিতে।
আলোর মা খেয়াল করলেন, স্যারের কথা বলতে যেয়ে মেয়ের মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে গেল।
তিনি মনে মনে একটু শঙ্কিত বোধ করলেন।
আলোও শেষ পর্যন্ত অহনার পথে হাঁটছে না তো!
সৈকত আজ পড়াতে এসে আলোকে দেখে ধাক্কার মতো খেলো। আলোকে এই প্রথম সে শাড়িতে দেখে তার যেন একটা হার্টবিট মিস হলো।
সে সাথে সাথে চোখ নামিয়ে ফেললো।
স্যার আজকে আমি পড়বো না।
কিন্তু আপনি বসুন। আমি আজ আপনার জন্য নিজের হাতে চা বানাবো।
সৈকত নিচের দিকে তাকিয়ে বললো, না না ঠিক আছে।
আমি আজ তাহলে যাই। আরেকদিন চা খাবো।
আলোর খুব মজা লাগছে স্যারের কান্ড কারখানা দেখতে। সে মিটমিট করে হাসতে হাসতে বললো, উহু আপনি আজ যেতে পারবেন না।
আজকে সারাদিন আপনি আমার সাথে থাকবেন।
বাবা গাড়ি পাঠাচ্ছে। গাড়ি এসে পৌছলে আমরা বের হবো। ততোক্ষণে আপনি বসে বসে পেপার দেখতে থাকেন। আমি চা নিয়ে আসছি।
আলো সৈকতের হাতে চায়ের কাপ দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে স্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
তার উদ্দেশ্য চা খেয়ে স্যারের মুখের ভঙ্গি কেমন হয় তা পর্যবেক্ষণ করা।
ভালো হলে চেহারা দেখে সে বুঝে ফেলবে কেমন হয়েছে। খারাপ হলেও বুঝবে।
সৈকত চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বসে আছে।
তার হাত ঠকঠক করে কাঁপছে। ওর মনে হচ্ছে যে কোন সময় তার হাত থেকে কাপটা পড়ে যাবে।
এমনিতেই মেয়েটা সুন্দরী। তার ওপরে পড়েছে শাড়ি।
আজ তাকে দেখাচ্ছে ইন্দ্রানীর মতো।
যে কোন ছেলে আজ আলোকে দেখে টাস্কি খাবে।
সেই মেয়টা কিনা বলছে আজ তাকে সারাদিন তার সাথে থাকতে হবে!
আজ তার বেশ কিছু জরুরী কাজ ছিল। কিন্তু আলোর ডাক উপেক্ষা করার ক্ষমতা তার নেই।
সে কিছুতেই আলোকে না বলতে পারবে না।
তার সমস্ত পৃথিবী একদিকে যাক, আর আলো একদিকে।
কি হলো চা হাতে নিয়ে বসে আছেন কেন?
খেয়ে বলুন কেমন হয়েছে?
খুব ভালো হয়েছে আলো, খুব ভালো।
আপনি তো এখনো মুখেই দেননি।
না খেয়েই বলছেন ভালো!
চেহারা দেখেই বলে দেওয়া যায় চা খুব ভালো হয়েছে।
ঠিক আছে আপনি মনে হয় আমার সামনে অসস্তি ফিল করছেন। আমি আমার ব্যাগটা নিয়ে আসি।
আপনি চা শেষ করুন।
সৈকত চায়ের কাপে শেষ চুমুক দেওয়া মাত্র গাড়ির হর্ন শুনতে পেলো।
আলো এসে তাড়া দিলো আসুন।
গাড়ি চলে এসেছে।
আলো প্রথমে তার ফুপির বাসায় আসলো।
সৈকতকে গাড়িতে বসায় রেখে সে ভেতরে ঢুকলো।
পুরো বাড়ি নিশ্চুপ হয়ে আছে। কোথাও কোন শব্দ নেই।
যেন একটা মরা বাড়ি।
রন্জু ডাইনিং এ বসে চা খাচ্ছিল, আলোকে দেখে চমকে উঠলো। তার চোখে আলোর জন্য মুগ্ধতা ঝড়ে পরছে।
আলো ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ফুপি কোথায় রন্জু ভাইয়া?
মামনি তার রুমে শুয়ে আছে।
আর ফুপা?
বাবা নাস্তা না খেয়েই অফিসে চলে গেছে।
তুমি যাওনি?
না ইচ্ছে করছে না আজ অফিসে যেতে।
তাছাড়া মামনির শরীর বেশ খারাপ করেছে।
আজকে সারাদিন মামনির কাছাকাছি থাকবো ঠিক করেছি।
গুড ডিসিশন।
আমি ফুপির সাথে দেখা করে আসি।
আলো গিয়ে ওর ফুপিকে জড়িয়ে ধরে শাসনের সুরে বললো, কি হয়েছে তোমার?
এভাবে খাওয়া দাওয়া না করে অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়তে চাও? ওঠো ওঠো। নাস্তা খাবে চলো।
আলোকে জড়িয়ে ধরে ওর ফুপি হু হু করে কেঁদে ওঠলেন। কি থেকে কি হয়ে গেল আলো।
আমার অহনা ভালো আছে তো?
ও খুব ভালো আছে।
আমি ওর কিছু দরকারি জিনিস নিতে আসছি।
চলো তুমি আগে খাবে। তারপর ওর কাপড় চোপড় গুছিয়ে দাও। আমার আজ অনেক কাজ আছে।
আমি খেয়ে নিব, তোর ভাবতে হবে না মা।
তুই অহনার রুমে যা। যা যা লাগে নে।
আমি আসছি।
আলো একটা ট্রলি নিয়ে বেশ কিছু দরকারি জিনিস ভরে নিলো। ওর ফুপি একটা ব্লাঙ্ক চেক সই করে আলোর হাতে দিলো। আলো এটা অহনা কে দিস মা।
তোর ফুপা মেয়ের একাউন্ট ক্লোজ করে দিছে।
ওর প্রয়োজনে তো ও টাকা উঠাতে পারবে না।
আচ্ছা ঠিক আছে তুমি চিন্তা করো না।
আমি দিব।
চলো নিচে চলো। আমার সামনে বসে তুমি খাবে।
তারপর আমি যাবো।
বললাম তো আমি খেয়ে নিব। তুই আগে অহনার কাছে যা। ওর খবর আমাকে ফোন করে জানা।
মেয়েটা মোবাইল ও অফ করে রাখছে।
ঠিক আছে আসি ফুপি।
আলো যাওয়ার সময় দেখলো রন্জু তখনো ডাইনিং এ বসে আছে। ও গলা খাঁকারি দিয়ে বললো, আসি রন্জু ভাইয়া। ফুপিকে কিছু খাওয়াতে পারো কিনা দেখো।
কোথায় যাচ্ছো?
আজকে আমাদের সাথে থাকো আলো।
আজ না ভাইয়া। আজ অনেক কাজ আছে।
তাহলে তোমার সাথে আমি আসি?
আলো ফিক করে হেসে দিয়ে বললো, তুমি না একটু আগে বললে আজ ফুপির কাছে থাকবে জন্য অফিস যাওনি।
রন্জু তোতলাতে তোতলাতে বললো, না মানে মানে…
থাক আর মানে মানে করতে হবে না।
আমি আসি।
ওদিকে আসিফের রুমমেটরা যত্নের চুড়ান্ত করছে।
তারা ভেতরের রুমটা আসিফদের ছেড়ে দিয়ে বলেছে ভাবি আপনি একটু ও মন খারাপ করবেন না।
আপনাদের যতোদিন ইচ্ছে এই রুমে থাকেন।
আমরা সারাদিন বাইরে থাকি সবাই।
রাতে এসে ঘুমাই। আসিফ ভাই ভালো একটা ব্যাবস্থা না করতে পারা পর্যন্ত আমরা সামনের রুমে সবাই ফ্লোরিং করবো।
অহনা সবার ব্যাবহারে মুগ্ধ হয়েছে। সে ভেবেছিল এখানে তার খুব অসুবিধা হবে। কিন্তু দেখা গেল তার তেমন কোন অসস্তি ও হচ্ছে না। সবাইকে বেশ আপন মনে হচ্ছে। যেন কতো চেনা সবাই।
কতো আপন।
তবে বাসর রাত নিয়ে প্রতিটা মেয়ের অনেক স্বপ্ন থাকে।
কিন্তু ওদের বাসর রাতটা আর দশটা মানুষের মতো স্বাভাবিক হয়নি।
খাওয়া দাওয়ার পর আসিফ বললো, আজ তোমার ওপর দিয়ে অনেক ধকল গেছে। শুয়ে পড়ো।
সকালে একসাথে ভার্সিটিতে যাবো।
এই ছিল বাসর রাতে তাদের দুজনের কথা।
দুজন দুপাশ মুখ করে শুয়ে থেকেছে সারা রাত।
অহনার চোখ গড়িয়ে নোনা জল নেমে এসেছে। জানালার ফাঁক গলে জোৎস্না রাতের চাঁদের আলো এসে পড়েছে ওদের গায়ে কিছুটা।
অহনার খুব ইচ্ছে করছিল আসিফকে নিয়ে ছাদে বসে গল্প করে সারা রাত কাটিয়ে দিতে।
কিন্তু ও ডিসিশন নিতে পারছিল না আসিফকে ডাকবে নাকি ডাকবে না।