#রঙ_বেরঙের_অনুভূতি,পর্ব_১৭
#তানজিলা_খাতুন_তানু
অরুণ নার্সের দেওয়া ডাইরিটা খুললো। প্রথম পাতাতেই বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা আছে
“রঙ বেরঙের অনুভূতি” শেষের দিকে সুহানির ছোট একটা সই। ডাইরিটা আর কারোর নয় সুহানির, সুহানি নার্সের্ কাছে দিয়ে গিয়েছিলো অরুণকে দেবার জন্য। নার্স সুহানির দেওয়া শেষ স্মৃতিটা অরুণের হাতে দিয়ে হাসপাতালের চাকরি ত্যাগ করে অন্য চাকরি করতে শুরু করে। চাকরি ছাড়ার কারন জানতে চাইলে উনি সহজেই বলে উঠলেন…
– মানসিক হাসপাতালে থাকতে থাকতে আমিও একটা মানসিক রোগীতে পরিনত হয়ে যাচ্ছি। এই অসহায় নিস্পাপ মেয়েগুলোকে এইভাবে অসহায় অবস্থাতে দেখেও কিছুই করতে পারি না তখন বড্ড ক’ষ্ট হয়,দ’ম বন্ধ লাগে। আর সুহানি আমার সন্তানের মতো ছিলো, এই ২ টো বছরে ওকে আমি আগলে রেখেছিলাম সেই সুহানির চলে যাওয়াটা আমি মেনে নিতে পারছি না, হাসপাতালে আসলেই সুহানির স্মৃতিগুলো আমাকে তাড়া করে বেড়ায় তাই আমি এই হাসপাতালের চাকরি ছেড়ে দিচ্ছি স্যার। আর যাবার আগে সুহানির শেষ স্মৃতিটা যেটা আপনার আমানত ছিলো সেটা আপনার হাতে তুলে দিয়ে গেলাম।
চোখ মুছতে মুছতে উনি কেবিন ত্যাগ করেছিলেন। সুহানি নামক মেয়েটাই যে বড্ড মায়াবী,সহজেই সবাইকে নিজের মায়ার বাঁধনে বেঁধে ফেলে তাই তো ওর চলে যাওয়াটা সবার কাছে এতটা বেদনাদায়ক।
অরুন ডাইরিটা নিজের টেবিলে রেখে চোখ বন্ধ করে সুহানি অসুস্থ হয়ে পড়ার একদিন আগের কথাতে ডুব দিলো…
অতীত….
অরুণঃ সুহানি ওষুধ গুলো খেয়ে নাও।
সুহানিঃ কিন্তু আমি তো পুরোপুরি সুস্থ তাহলে ওষুধ খাবো কেন?
সুহানির এইরকম কথা শুনে অরুণ অবাক হয়ে যায়। ভাবে হয়তো সুহানি এমনি এমনি বলছে, পুনরায় ঔষুধ খাওয়াতে গেলে, সুহানি রেগে উঠে।
সুহানিঃ বলছি তো আমি সুস্থ তাহলে কেন আমাকে ওষুধ খাওয়াচ্ছেন।
অরুণঃ মানে?
সুহানিঃ আমি পাগল নয় বুঝতে পেরেছেন আপনি।আমি আপনার মতোই একটা সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ।
সুহানির কথা শুনে অরুণ খুশি হয়ে যায়।
অরুণঃ সত্যি বলছো।
সুহানিঃ আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে?
অরুণঃ কি কথা?
সুহানিঃ ব্যক্তিগত কিছু কথা আছে আমার আপনার সাথে।
অরুণঃ হ্যা বলো।
সুহানিঃ একটাও প্রশ্ন করবেন না শুধুমাত্র শুনে যাবেন।
অরুণঃ আচ্ছা।
সুহানিঃ আজকে আমি আমার জীবনের কিছু কালো অধ্যায় আপনাকে বলবো।
বাবা মায়ের আদরের মেয়ে সুহানি, কিভাবে তার জীবনটা নরকে পরিণত হয় সেটা তো আগেই জেনে গেছেন। প্রতিশোধের আ”গুনে দ”গ্ধ হয়ে নোহান সুহানীর জীবনটা ছাড়খাড় করে দেয়। সকলে সবটা জানলেও কিছু কিছু কথা সকলেরই অজানা রয়ে গেছে। আচ্ছা আপনার মনে প্রশ্ন জাগছে না ” নোহা কেন সু’ই’সাইড করলো?” “নোহানের এক্সিডেন্ট কিভাবে হলো?” “রাহাত কেন জেলে গেলো?”
প্রশ্নগুলো মনের মাঝে হাজারবার করলেও উত্তর পাবেন না,কারন বিধাতা আর আমি ছাড়া এই ধ্রুবসত্যি গুলো আর কারোরই জানা নেয়। আমার কি হয়েছে আমি জানি না তবে আমার আপনাকে সত্যি গুলো বড্ড বলতে ইচ্ছা করছে, জানাতে ইচ্ছা করছে ওদের করুন পরিনতির গল্প।
নোহা কোনো সু’ই’সাইড করেনি নোহাকে খু”ন করেছি আমি। কারনটা কি জানেন? নোহা কখনোই ভালো মেয়ে ছিলো না।
অতীত…..
বিয়ের সাজে সজ্জিত হয়েছে সুহানি। এলোমেলো ভাবনাগুলো মনের মাঝে ঘুরেফিরে আসছে বারবার, তখনি একটা কথা মনে পড়লো…দিয়া ওকে একটা গিফট্ দিয়েছিলো। আর বলেছিলো
– যেদিন তোর বিয়ে হবে এটা সেদিন খুলবি।
সুহানি তাড়াতাড়ি করে সেই প্যাকেটটা খুলতে লাগলো। দিয়াকে বড্ড বেশি ভালোবাসতো তাই দিয়ার কোনো কথাই অমান্য করেনি। দিয়ার কথামতোই আজকে প্যাকেটটা খুলবে। সুহানি প্যাকেটটা খুলে দেখলো তাতে একটা পেনড্রাইভ আছে। সুহানি তাড়াতাড়ি করে ল্যাপটপে পেনড্রাইভটা লাগিয়ে দেখলো,
দিয়া আর সুহানি সমস্ত ছবি দিয়ে খুব সুন্দর করে এডিট করা একটা ভিডিও। সুহানি চোখের কোনো পানি জমা হচ্ছে, আজ দিয়া থাকলে ওর জীবনটা এরকম হতো না। সকলেই সুখে শান্তিতে বসবাস করতো।
ভিডিওটা শেষ হতেই সুহানি পেনড্রাইভ টা খুলে নেবে কিন্তু একটা ফোল্ডার দেখে সন্দেহ জাগলো। “সিক্রেট” বলে লেখা আছে। কৌতুহল বশত সুহানি সেটাকে চালু করে দেখলো একটা ভয়েস রেকর্ড করা।
১ ঘন্টা পর….
সুহানি বিয়ের সাজেই বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে নোহানদের বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে নোহার ঘরের্ সামনে দাঁড়িয়ে দরজায় কড়া নাড়লো।
গোটা বাড়ি ফাঁকা কেউ কোথাও নেয় এমনকি কোনো মেড ওহ নেয় গোটা বাড়িতে নোহা একাই ছিলো,এইসময়ে নিজের দরজার সামনে কাউকে কড়া নাড়তে দেখে নোহা অনেকটাই অবাক হলো। চোখে মুখে বিরক্তি নিয়ে দরজা খুলে সমানে সুহানিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললো…
নোহাঃ তুমি?
সুহানিঃ আমাকে দেখে অবাক হচ্ছো কেন?
নোহাঃ তোমার তো বিয়ে তুমি এখানে কি করছো?
সুহানিঃ কিছু প্রশ্নের উত্তর জানতে এসেছি। সাথে অনেককিছুর হিসাব মেলাতে এসেছি।
নোহাঃ কি প্রশ্ন,আর কি হিসাব।
সুহানিঃ কেন প্রতারনা করেছো নোহানের সাথে?
নোহাঃ কি বলছো এসব তুমি
সুহানিঃ আমি সবটা জানতে পেরে গেছি। আর সবকিছুর প্রমান আমার হাতে আছে। তাই আমার কাছ থেকে লুকিয়ে বা নাটক করার কোন প্রয়োজন নেয় নোহা শিকদার।
নোহাঃ কি প্রমান, কিসের প্রমানের কথা তুমি বলছো?( আমতা আমতা করে)
সুহানিঃ নিজেই শুনে নাও।
সুহানি দিয়ার সিক্রেট ফাইলে থাকা ভয়েসটা নোহার সামনে প্লে করলো। প্লে করতেই একটা মেয়ে কন্ঠস্বর ভেসে আসলো….
– সুহা আমি দিয়া বলছি, তোকে আমার অনেক কিছু বলার আছে। সবটা ভালো করে শোন। নোহানের দিদি নোহা আছে না উনি একদম ভালো নয়, উনি অনেক রকমের বেআইনি কাজের সাথে যুক্ত। নোহানের কোম্পানির পেছনে অনেক অনেক বেআইনি কাজ করেন। নোহানকে উনি বাঁচতে দেবেন না। তুই নোহানকে দেখে রাখিস। আর ওনার সব বেআইনি কাজের প্রমান পত্র আমার লকারে রাখা আছে। আর আমার লকারের নম্বর ……., তুই সবকিছুর হাত থেকে আমার নোহানকে রক্ষা কর সুহানি ওই মেয়ে আমাদের কাউকে বাঁ’চ’তে দেবে না কাউকে না তুই কিছু একটা কর।
ভয়েসটা শুনে নোহা চমকে উঠলো। কপালে ঘাম জমা হতে থাকলো।
সুহানিঃ কি হলো চমকে উঠলেন কেন? (বাঁকা হেসে)
নোহা একটা ছুড়ি বের করে বললোঃ আমার পথে যে যে বাধা হয়ে এসেছে আমি তাকেই সরিয়ে দিয়েছি। তোমাকেও ম’র’তে হবে।
সুহানিঃ আমার আর দিয়ার কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। আমরা তো তোমার কেউ নয় কিন্তু নোহানের উপর এর রাগ কেন তোমার? ওহ তো তোমার ভাই ।
নোহাঃ ভাই (তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে) নোহান আমার সৎ ভাই। আমার বাবার দ্বিতীয় পক্ষের সন্তান। ওর জন্য আমি আমার বাপির ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়েছি। ওর জন্য আমার এত বড়ো সাম্রাজ্য হাত ছাড়া হয়ে গেছে। ওর জন্য আমি সবকিছু হারিয়েছি। আমি ওকে কিছুতেই ছাড়বো না,কিছূতেই না।
সুহানিঃ পাগলের মতো কথা বলো না। নোহান তোমাকে ঠিক কতটা ভালোবাসে সেটা তো তুমি জানো,নিজের দিদি ভাবে তোমাকে।
নোহাঃ পাগলের মতো না সঠিক কথা। ওহ না যদি আসতো তাহলে এই শিকদার পরিবারের সবকিছু আমার হতো। বাপি আমার একার থাকতো আমাকে ভালোবাসতো একাকে সবকিছুর রানি আমি হতাম। আর আমি সেটা হবোই আমি নোহানকে ধ্বং”স করে দেবো। আর ভালোবাসা আমার ওইরকম ভালোবাসা লাগবে না, আমার এই সাম্রাজ্য চাই এই সবকিছু চাই।
সুহানিঃ আমি থাকতে সেটা হতে দেবো না।
নোহাঃ কিছু করতে পারবে না। ঠিক যে ভাবে আমি বাপি-মম আর দিয়াকে শে”ষ করেছি ঠিক সেভাবেই তোমাকে শে’ষ করবো।
সুহানিঃ বাপি মম মানে?
নোহা হেসে বললোঃ ওনাদেরকেও আমি নিজের পথ থেকে সরিয়ে দিয়েছি । আমি সেইদিন ওনাদের গাড়ির অ্যাক্সিডেন্ট করিয়েছিলাম । ভাগ্য ভালো থাকাতে সেদিন একটুর জন্য নোহান বেঁচে যায় আর আমার সব প্ল্যান নষ্ট করে দেয়। তারপরে দিয়া এসে নোহানের জীবনটা গুছিয়ে দেয় সবই ঠিক ছিলো কিন্তু কোথা থেকে দিয়া সব কিছু জানতে পেরে গিয়ে আমাকে থ্রেট দেয়। আর উপরে চলে গেলো। দিয়াকে বলেছিলাম আমার পেছনে পড়ো না শেষ হয়ে যাবে কিন্তু কথা শুনলো না। আর মাঝ খান থেকে তোমাকেও জড়িয়ে দিলো সবকিছুর প্রমান তোমার কাছে রেখে দিলো তাই তোমাকেও তো উপরে যেতে হবে।
সুহানি হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। একজন মেয়ে সম্পত্তির জন্য তার বাবা মার সাথে এরকম করতে পারে সেটা ওর ধারনার মাঝেই ছিলো না। অর্থের লোভ মারাত্মক।
সুহানিঃ এতটা খারাপ তুমি ছিঃ।
নোহাঃ হ্যা আমি খুব খারাপ খুব স্বার্থপর আমার সবকিছু চাই সবকিছু।
সুহানি নোহার ঘর থেকে বের হয়ে গেল। আর অন্যদিকে নোহার র”ক্তা’ক্ত শরীরটা বিছানায় পড়ে থাকলো। এই পৃথিবীতে বেঈমান দের থাকার কোনো অধিকার নেই। বেইমানি করলে একটাই শাস্তি মৃ’ত্যু।
সুহানি নিজের ঘরে গিয়ে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললোঃ দিয়া আমি তোকে কথা দিয়েছিলাম তোর খু’নীকে নিজের হাতে শাস্তি দেবো আমি দিয়েছি এবার তুই খুশি তো।
দিয়ার কন্ঠস্বর শোনা গেলোঃ আমি খুশি কিন্তু তোকে একটা কথা দিতে হবে তূই আমার নোহানকে দেখে রাখবি।
বাকিটা সবারই জানা। সুহানি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। যদিও দিয়াকে বারবার দেখাটা ওর হ্যালুয়েশনের কারনে হচ্ছিলো।
#চলবে…