দুঃখ_সুখের_পাখি_তুমি,পর্ব ০৩

#দুঃখ_সুখের_পাখি_তুমি,পর্ব ০৩

ডঃ শাহানা আরমানের সাথে আজ তনুর কাউন্সিলিংয়ের দ্বিতীয় সেশন। প্রথম দিন শুধু তার সাথে পরিচিত হয়েছিলেন। ডঃ এর সহকারী তনুর সব তথ্য নিয়ে নিয়েছিল।

শাহানা মেয়েটাকে খুব ভালো করে লক্ষ্য করছে। কেমন জানি জড়োসড়ো ভাবে বসে আছে। কিন্তু উল্টো হবার কথা। দেশের বেশ নামীদামী প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি থেকে গ্রাজুয়্শন করে একটা ভালো প্রাইভেট কম্পানিতে জব করে মেয়েটা। বিয়ে করেনি। পরিবার থেকে বিয়ের চেষ্টা শুরু করবার পর থেকেই সমস্যার শুরু। তনুর মাকে বাইরে বসতে বলে শাহানা তনুর সামনে এসে বসলো।

-আরাম করে বসুন মিস তনু। আমাদের তো বেশ কিছুক্ষন গল্প করতে হবে।
তনু শুধু একটা হাত কোলের উপর থেকে নিয়ে কাউচের হাতে রাখলো।
-আমি আপনার দেয়া তথ্যগুলো দেখেছি মিস তনু। এখন আপনি আপনার মত করে বলেন দেখি। আপনি বললে হয়তো আমি সমস্যাগুলো ভাল ভাবে বুঝতে পারবো।
-আসলে বাসা থেকে আমার বিয়ে দেবার চেষ্টা করছে। কিন্তু আমি বিয়ে করতে চাই না।
-আপনাকে কি জোর করা হচ্ছে?
-জোর করছে না তো।
-তাহলে সমস্যাটা কোথায় হচ্ছে বলুন তো?
-সমস্যা শুরু হয়েছে যখন আমি পারিবারিক ভাবে পছন্দ করা প্রথম ছেলেটার সাথে কথা বলতে গেলাম। তাকে দেখেই আমার মনে হল অসংখ্য শুয়ো পোকা আমার গা বেয়ে উঠছে। এটাই শুরু। এরপর আরও যাদের সাথে দেখা করেছি ঠিক এমনটাই হয়েছে। তবে কখনও তেলাপোকা, কখনও বিছা, কখনও সাপ এমন দেখেছি। এরপর আর কারো সাথে দেখা করে যেতাম না। বাবা মা খুব অস্হির হয়ে পড়লেন। তাইতো আপনার কাছে নিয়ে আসলেন।
-আপনি বলেছেন আপনার পছন্দের একজন ছিল। তাকে বিয়ে করলেন না কেন?
-তাকে তো আমি পছন্দ করতাম। সে তো কখনও আমায় নিয়ে কিছু ভাবেনি। বরং আমি যখন ইউনিভার্সিটি পড়ি তখন সে বিয়ে করে ফেলেছিল।
-তার সাথে কি আপনার কোনো ভাবে শারিরীক কোন সম্পর্ক হয়েছিল? তিনি কি আপনার সাথে প্রতারনা করেছেন?
-না তো। তার সাথে আমার দেখা হয়েছিল খুব কম বয়সে। আমি তো তার চেহারাও ভুলে গিয়েছিলাম। চাচীর কাছে তার বিয়ের ছবি দেখলাম। খুব সুখি মনে হল। তার নাকি নিজের পছন্দের বিয়ে।
-তাহলে আপনার সাথে কোন রকম কোন সম্পর্ক ছিল না। কোন কমিটমেন্টও ছিল না। আপনার সাথে কি কোনভাবে তার যোগাযোগ হত?
-মাঝে মাঝে আমি ফোন করতাম। ফোন নাম্বার চাচুর কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছিলাম। সে নিজে দেয়নি। তবে ফোন করলে সে খুব সুন্দর করে কথা বলতো। মনে হতো আমি তার অনেক কাছের মানুষ। ম্যাসেজ পাঠাতাম। যদিও রিপ্লাই দিত না তেমন। তারপর মিশনে চলে গেল। তখন আমি এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছি। বাবা মা আমাদের দুই ভাইবোনের পড়ালেখার কথা চিন্তা করেই ঢাকায় চলে এলেন। তারপরই একদিন চাচীর কাছে তার বিয়ের খবর পেলাম।
-তারপর কি যোগাযোগ করেছিলেন?
-যোগাযোগ বলতে আমার দুইটা ফোন। আরেকটা নাম্বার সে জানতো না। আমি মাঝে মাঝে ফোন করে শুধু তার গলার স্বরটা শুনেই রেখে দিতাম।
-আপনি কি মনে হয় সে আপনার আশেপাশে আছে বা তাকে দেখতে পান বা তার কথা শুনতে পান?
-আগে এমন কিছু হত না। তবে বললাম যে প্রথম যেদিন একজনের সাথে দেখা করতে গেলাম। তখন শুয়োপোকা দেখলাম। আমার গা বেয়ে উঠছিল। বাসায় এসে অনেক্ষন ধরে সাবান ডলে গোসল করলাম। তবুও ঘিনঘিনে ভাবটা যেতে চাইছিল না। আয়নার সামনে দাঁড়াতেই মনে হল একটা ছায়া দেখলাম। চোখের ভুল ভেবে পাত্তা দিলাম না। পরের বার বাসায় এসে গোসল করে শুয়েছি। তখন শুনলাম কেউ বলছে, কি রে পিচ্চি পাত্র পছন্দ হল? আমি ভয়ে অস্হির হয়ে গেলাম। মা এসে অনেক্ষন জড়িয়ে বসে থাকলেন। বাবা কোরআন তিলাওয়াত করলেন। তারপর ঘুমিয়ে পড়েছি।
-তারপর আর হয়নি এমন?
-আসে এখন তো সে আমার পাশেই থাকে বেশিরভাগ সময়। দুজন মিলে বেশ গল্প করি।
-ব্যাপারটা অস্বাভাবিক লাগে না আপনার কাছে?
-অস্বভাবিক হবে কেন? ও তো আমার খুব ভালো বন্ধু।

-আপনি বাইরে গিয়ে আপনার মাকে পাঠিয়ে দিন। আমি ওনার সাথে একটু কথা বলি।
তনু বাইরে যেতেই তার মা ভেতরে এল।
-বসুন।
লায়লা ঠিক তনু জায়গাটাতেই বসলো।
-আপনার মেয়ের সাথে কথা হল। সমস্যাটা আসলে অনেকটা গভীর। বাচ্চা বয়সের ফ্যান্টাসী মনের মধ্যে এমনভাবে শেকড় গেড়েছে যে, সেটা থেকে সে নিজেকে বের করতে পারেনি। তার উপর ছেলেটার বিয়ে হবার কারণে অনেক মানসিক চাপের মাঝে ছিল যেটা হয়তো কাউকে বললে অনেকটা কষ্ট কমে যেত কিন্তু ভয়ে হোক বা ল্জ্জায় হোক সেটা সে কাউকে বলতে পারেনি। তারপর যখন আপনারা তাকে বিয়ে দিতে চাইলেন তখন সে বিয়ে করতে চাইছে না কিন্তু আপনাদের নিষেধ করতেও পারছিল না। তখন তার মন তাকে সাহায্য করতে শুরু করলো। মনের অসুখগুলো অনেক বিচিত্র।
-এখন কি করবো তাহলে আমরা?
-মনের অসুখগুলো এক এক জনের এক এক রকম মিসেস রহমান। অনেকে তো পাত্তাই দেয়না। আবার অনেকে তাবিজ কবজ, ঝাড়ফুঁক কত কি করে। আপনি যে আপনার মেয়েকে নিয়ে এসেছেন এটাই তো অনেক বেশী। আমরা শুধু চেষ্টা করতে পারি। আমি কিছু মেডিসিন দেব। আর ওর সাথে হয়তো আরও কথা বলতে হবে। সময় আর ধৈর্য ধরতে হবে। আল্লাহ যদি চান ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। আপাতত যেমন আছে তেমন থাকতে দিন। বিয়ের কথা বলবার দরকার নেই। তবে খুব ভালোভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে। পারলে রাতে আপনি থাকুন সাথে। অথবা কাউকে সাথে রাখতে পারেন। মেডিসিনগুলো ঠিকমত দেবেন। আর আমি পনেরো দিন পর আবার ওর সাথে কথা বলবো।
লায়লা বেরিয়ে যেতেই শাহানা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। কত রকম কষ্টের ঘূর্ণিপাকে যে মানুষের মনজগৎ লন্ডভন্ড হয়।

৪.

ফোন চেক করতে গিয়ে ছোট চাচার মিসডকল দেখে অবাক হল তারেক। সে আলাদা হয়ে যাবার পর থেকে পরিবারের সবাই তাকে বয়কট করেছে বলতে হয়। কেউ তেমন খোঁজ খবর রাখে না তার। সবাই অনেক করে বুঝিয়েছিল একসাথে থাকতে। কিন্তু তার বউ কিছুতেই থাকবে না। আপাকে তো সহ্যই করতে পারতো না। বলতো তোমার পাগল বোনের সাথে কে থাকবে? কখন যে কি করে? রোজ রোজ এই নিয়ে অশান্তি পরে আপাই বলল আলাদা বাসা নিতে। মা বেঁচে থাকতে তবুও ওই বাসায় যাওয়া হত। এখন সেটাও হয় না।তবে আপা তাকে মাঝে মাঝে ফোন করে।

আপাকে দেখে তো বোঝার উপায় ছিল না কারো যে মানসিক ভাবে এতটা আনস্ট্যাবল সে। লেখাপড়া ঠিক ভাবেই শেষ করলো, জবে ঢুকলো তারপর বিয়ের কথা শুরু হতেই বিপত্তি। ডাক্তার বলেছিলেন প্যারানয়েড স্কিটসোফ্রিনিয়া। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলেও ভুল দেখতো, অন্যের কথা শুনতে পেত। তবে কাউন্সিলিং আর মেডিসিনের কারণে অনেকটা সুস্হ্য হয়ে গিয়েছিল। প্রথম জবটা অসুস্হ্য হবার পরেই চলে গিয়েছিল। বাসায় থেকে থেকে আরও অস্হির হয়ে যেত দেখে পরে বাবা তার বন্ধুকে বলে তার বাইং হাউজে একটা জবে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন।

চাচার নাম্বারে ফোন করতেই চাচা সাথে সাথে ফোন ধরলেন।
-আসসালামুয়ালাইকুম চাচা।
-তনু কোথায় রে? দুইদিন ধরে ফোন করছি। ফোন বন্ধ।
-আমি তো জানি না চাচা।
-তুই এখুনি ওর বাসায় যা।
-কি হয়েছে চাচা?
-তুই নিউজ টা দেখিসনি? পেপার পত্রিকা ফেসবুক সবখানেই তো এসেছে।
-কোন নিউজ?
-আরে তমাল যে মিশনে গিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। আবরার মাহমুদ নামে নিউজ হয়েছে তাই চিনতে পারিসনি।
-কি বলছেন চাচা। আমি এখুনি যাচ্ছি।
-আমিও আসতেছি তোর চাচীকে নিয়ে। প্লেনে আসতে সময় লাগবে না বেশি।

বাড়িতে তালা দেখে তারেক তনুর অফিসে এল। সেখানে এসে জানতে পারলো তনু বেশ কয়েকদিনের ছুটি নিয়েছে। নাইমা আপার কাছে জানতে পারলো সে নাকি কক্সবাজার যাবার কথা বলেছে। কক্সবাজারে কোথায় খুঁজবে? ফোনও তো ধরছে না।
বাসায় ফিরে ব্যাকপ্যাকে কয়েকটা কাপড় ভরে বেরিয়ে আসলো তারেক। আপার বাসার দিকে রওনা হল। চাচা ফোন করে বলেছেন তিনি আপার বাসায় এবং তালা খোলার ব্যাবস্থা করেছেন।

বাসা পুরো এলোমেলো। আলমারির কাপড় সব বিছানায়। তমালের পুরোনো কাপড় বারান্দায মেলে দেওয়া। ছেলেদের বেশ কিছু নতুন কাপড়ের ট্যাগ চারিদিকে পড়ে আছে। দারওয়ান বলল, আপা তো আজকে সকালেই গেল। আমারে বলেছে ভাইজানের সাথে বেড়াতে যাইতেছেন। ভাইজান এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করতেছেন। আমারে কইলো বাসা দেইখা রাখতে।
আচ্ছা তুমি এখন যাও।
দারওয়ান চলে যেতেই তিনি তারেকের দিকে ফিরলেন।
-এখন তাহলে কি করবি?
-আজ তো রাত হয়ে গেছে চাচা।
-তাহলে কাল সকালেই যাই। আমি লোকেশন ট্রাক করতে বলেছি।

সকালের ফ্লাইটে কক্সবাজারে নেমে হোটেলে চেকইন করেই মাহবুব আর তারেক বের হল। ফোন নাম্বারটার লোকেশন ট্রেস করা গেছে। সেই হোটেলের কাছে আসতেই অনেক ভীড় দেখতে পেল তারা। অনেক নিউজ চ্যানেলও আছে। তারা ভীড় ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। রিসিপশনিস্ট জড়োসড়ো হয়ে দাড়িয়ে। হোটেল ম্যানেজার বাইরে কথা বলছেন। তারেক জানতে চাইলো,
-কি হয়েছে?
-আমাদের এক গেস্ট পানিতে ডুবে মারা গেছেন। আজ সকালে তার লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
-আমরা আসলে একজনের খোঁজে এসেছি। একটু দেখবেন কি তিনি এখানে উঠেছে কিনা।
-কিন্তু এভাবে তো গেস্টদের ইনফরমেশন দেয়া যাবে না।
মাহবুব তার নিজের পরিচয় দিলেন। তার পরিচয় পেয়ে রিসিপশনিস্ট ম্যানেজারকে ডেকে আনলো। ম্যানেজার এসে রিসিপশনে দাঁড়ালো। কম্পিউটারে রিসেন্ট গেস্ট লিস্ট বের করলো।
-কি নাম স্যার?
-তারানা রহমান।
ম্যানেজার ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো।
-কি হল? এসেছে এখানে?
-স্যার কিভাবে বলবো বুঝতে পারছি না। ওনাকেই সকালে বীচের কাছে পাওয়া গেছে। কাল বিকেলে বেরিয়েছিলেন। ওয়েদার ভাল ছিল না। তাই লোকও কম ছিল বীচে। একাই এসেছিলেন। যদিও দুইজনের নামে রুম বুক করেছিলেন। বিকেলে ঘুরতে বের হলেন। অনেক রাতেও ফিরছেন না দেখে আমরা খুঁজতে শুরু করি। জেলেদের ছেলেরা সকালে দেখতে পেয়েই আমাদের জানায়। সরকারী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ওনার ফোন আর হাতব্যাগ নিয়ে বেরিয়েছিলেন। সেগুলো খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে আমরা কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। অভিভাবকের জায়গায় যার নাম আর ফোন নাম্বার দেয়া সেটাও বন্ধ।

মাহবুব সোফায় এসে বসলেন। এমন কিছু হবে তা তো তিনি কল্পনাও করতে পারেন না। তারেক মেঝেতে বসে হাউমাউ করে কান্না শুরু করেছে। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। তনুকে তো আনতে যেতে হবে। মেয়েটা এতদিনে বোধহয় শান্তি পেল।

সমাপ্ত…

এমি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here