হৃদপূর্ণিমা,পর্ব ২১,২২

#হৃদপূর্ণিমা,পর্ব ২১,২২
লাবিবা_ওয়াহিদ
| পর্ব ২১ |

বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। এই কয়েকদিনে রথি যেন অতিরিক্ত জেদীতে পরিণত হয়েছে৷ রথি নাশিদের সঙ্গে অর্পিকে একদমই সহ্য করতে পারে না। এ নিয়ে রথি হুটহাট-ই রেগে যায়, নাশিদের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। নাশিদ না পেরে রথিকে জিজ্ঞেস করে,

-‘তুমি এক্সেটলি কী চাচ্ছো?’

-‘বিয়ে করতে! বিয়ে না করে একটা মেয়েকে এভাবে ফেলে রেখেছেন কেন? ওই চুন্নির জন্য? আপনি যদি আমায় বিয়ে না করেন তাহলে আমিও এই বাড়িতে থাকবো না!’

হ্যাঁ! বিয়ে বিয়ে করে রথি এখন নাশিদের মাথা খাচ্ছে। নাশিদ নিজেকে যথেষ্ট কান্ট্রোল করে বলতো তাকে কিছুটা সময় দিতে, সে মানসিকভাবে খানিকটা বিধ্বস্ত! কিন্তু রথি কিছু শোনার পাত্রী নয়। এখন নাশিদ পরেছে মহা ফ্যাসাদে! রথি তার গলায় এমনভাবে বেজেছে যে না পারে গিলতে, না পারে ফেলে দিতে।

নাশিদ রথির চিন্তা করতে করতে সবে বিছানায় শুয়ে তখনই নাফিসা দৌড়ে নাশিদের ঘরে এসে বললো,

-‘ভাইয়া, রথিকে খুঁজে পাচ্ছি না!’

নাশিদ লাফ দিয়ে উঠে বসলো এবং নাফিসার উদ্দেশ্যে বললো,

-‘কী বলছিস এসব?’

-‘সত্যি ভাই! রুমে না পেয়ে সারা বাড়ি খুঁজেছি ইভেন গার্ডেনে অবধি গিয়েছি। আমার ভয় করছে ভাই!’ ভয়ার্ত কন্ঠে বললো নাফিসা।

-‘তুই ঘরে যা৷ আমি দেখছি!’

নাফিসা বিনা-বাক্যে ঘরে চলে গেলো। নাশিদ নাফিসার কথাগুলো মনে করে। কী যেন ভেবে ছাদে চলে গেলো। যা ভেবেছিলো ঠিক তাই! রথি ম্যাম রেলিং এ হাতদুটো প্রসারিত করে চন্দ্রবিলাসে মগ্ন। এবার নাশিদের রাগ তার ধরা-ছোয়ার বাইরে চলে গেলো। নাশিদ লম্বা লম্বা পা ফেলে রথির কাছে গিয়ে রাগ দমিয়ে মৃদু সুরে বলে উঠলো,

-‘এখানে কী করছো?’

-‘আপনাকে বলতে বাধ্য নই!’ আনমনে উত্তর দিলো রথি।

নাশিদ রাগ দমাতে না পেরে রথির গায়ে হাত তোলার জন্য হাত উঠাতেই রথি চোখ-মুখ খিঁচে রইলো। নাশিদ চড় না মেরে নিজের মাথার পিছে হাত দিয়ে রাগ কান্ট্রোল করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। এদিকে রথি গালে কোনো স্পর্শ না পেয়ে রথি পিটপিট করে তাকালো। মুহূর্তেই তার চোখের কোণ ভিঁজে গেলো। এই মানুষটা তার গায়ে হাত ওঠাতে নিচ্ছিলো ভাবতেই রথি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। ফোঁপানোর শব্দে নাশিদ পিছে ফিরে তাকালো। নাশিদ রথিকে ধমকে বললো,

-‘এই মেয়ে! কাঁদছো কেন? তোমায় কী আমি মেরেছি? এন্সা মি.. ড্যাম ইট!’

নাশিদের ধমকে রথির কান্নার স্বর আরও বেড়ে গেলো! নাশিদ দ্রুত রথির সামনে গিয়ে রথির মুখ চেপে ধরলো। যতোই হোক এখন রাত। রথির কান্নার শব্দ নিচে গেলে সর্বনাশ!

-‘সমস্যা কী? চুপ থাকতে বলেছি না?’ দাঁতে দাঁত চেপে বললো নাশিদ। রথি নাশিদের থেকে দূরে সরে বললো,

-‘আপনি অনেক খারাপ পুলিশম্যান! আপনি কথায় কথায় শুধু ধমকান! আমাকে খেয়ালও করেন না।’ কেঁদে হেঁচকি তুলে বললো।

নাশিদ পরেছে মহা ঝামেলায়। রথির এমন বিহেভিয়ার তার মাথা দিয়েই ঢুকছে না। হুটহাট রথি কেন পল্টি নিচ্ছে?

-‘তোমার খেয়াল কবে করিনি?’

-‘করলে বিয়ে কেন করছেন না?’

-‘উফফ! আবার সেই বিয়ে, বিয়ে আর বিয়ে! এই মেয়ে তুমি বিয়ে নিয়ে এতো মাথা ঘামাও কেন হ্যাঁ?’

-‘করবেন না তো বিয়ে? ঠিক আছে আমি চলে যাবো এখান থেকে। এই বাড়িতে আমি কারো বোঝা হয়ে থাকতে চাই না। যেখানে আমার নিজের পরিচয় নেই সেখানে থেকে আমি কী করবো? আপনি হয়তো ভুলে গেছেন আমার যথেষ্ট সেল্ফরেসপেক্ট আছে। শুধু আপনার জন্য, আপনার জন্য এতদিন চুপ করে ছিলাম। কারণ, মনে হতো ভালোবাসায় সব জায়েজ। কিন্তু এখন আর আমার পক্ষে সম্ভব না। আপনি তো আমায় ভালোই বাসেননি শুধু দায়িত্ববোধ ভেবেছেন। আপনি থাকুন আপনার ওই অর্পি চর্বিকে নিয়ে!’

বলেই রথি চলে যেতে নেয় ওমনি নাশিদ ওর হাত ধরে আটকে নিজের কাছে টেনে নিলো। আবছা আলোয় নাশিদের রক্তিম মুখশ্রী দেখে রথি একটু না অনেকটা ঘাবড়ে গেলো। রথি মুখ দিয়ে টু-শব্দও করার সাহসটা পাচ্ছে না। নাশিদ অতি ঠান্ডা কন্ঠে বলে উঠলো,

-‘তোর বিয়ে করা লাগবে তাইতো? তাহলে চল, তোরে বিয়ে করে, বাসর করে প্রমাণ দিয়ে দেই তুই আমার কাছে কী! তোর কাছে তো বিয়ে জরুরি, বিয়ের সাথে আফকোর্স বাসরও সংযুক্ত! এতদিন ভালো কথা বলে বুঝিয়েছি কিন্তু তুই তো ভালো কথা শোনার মানুষ না। ওয়েল, আমার খারাপটার সাথেই নিজেকে এডজাস্ট করে নে!’

বলেই রথিকে টেনে-হিঁচড়ে ছাদ থেকে নামিয়ে আনলো। এদিকে রথি প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে নিজেকে নাশিদের হাত থেকে ছাড়ানোর কিন্তু নাশিদ যে এখন ক্ষ্যাপা বাঘ হয়ে গেছে। রথিকে সে কিছুতেই ছাড়ছে না। নাশিদ কোনো দিকে না তাকিয়ে সদর দরজা খুলে রথিকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। মনিকা তখন পানি খেতে ডাইনিং এ এসেছিলো। ধস্তাধস্তির শব্দে সে সদর দরজার দিকে তাকায়। কিন্তু আবছা আলোয় বুঝতে পারলো না ওরা কারা। সে দ্রুত হেঁটে সেই অবধি পৌঁছাতে পৌঁছাতেই ওরা চলে যায় গাড়ির গ্যারেজে।
মনিকা কাউকে না পেয়ে সেও বেরিয়ে আসে। নাহ কাউকে পেলো না। হতাশ হয়ে মনিকা ভেতরে চলে আসে।

-‘দেখেন! পাগলামি করবেন না! কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমায় এতো রাতে?’

-‘কেন তোকে বিয়ে করতে? তুই না বিয়ের জন্য হাঁপাচ্ছিস! তোর বিয়ে করার সখ মিটিয়ে দিতে হবে না?’ নাশিদ ড্রাইভিং করতে করতে বললো। নাশিদের তুই-তুকারিতে বেশ বোঝা যাচ্ছে রাগ এখনো কমেনি। রথি মনেপ্রাণে আল্লাহকে ডাকছে। এখন সে কী করবে? এভাবে বিয়ে তো সে চায়নি! চাওয়া তো দূরে থাক কল্পনাও অবধি করেনি।
নাশিদ ড্রাইভ করতে করতে ফোনে কিসব করলো। মাঝরাত হওয়ায় রাস্তা প্রায় ফাঁকা। রথি অনেক ভাবে নাশিদকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে কিন্তু নাশিদ তার বুঝের সীমানার বাইরে আছে। মহা কেলেঙ্কারি লাগছে এই নাশিদকে। অবশেষে ওরা থানায় পৌঁছালো।
নাশিদকে থানার সামনে গাড়ি থামাতে দেখে রথি খানিক বিস্মিত হলো। রথি ভাবনা-চিন্তা করার আগেই নাশিদ তাকে টেনে-টুনে গাড়ি থেকে নামিয়ে থানার ভেতর নিয়ে গেলো। নাশিদ সোজা তার কক্ষে ঢুকে পরলো। সেখানে নয়নসহ নাশিদের দুজন বন্ধু আর কাজী সাহেব রয়েছে।
কাজী ঘুমে ঢুলছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে কাজীকে তার বাসা থেকেই তুলে আনা হয়েছে। কাজীও মুখে কুলূপ দিয়ে আছে কারণ, যতোই হোক পুলিশের বিয়ে। পুলিশের অমতে যাওয়া মানে নিজের প্রাণভোমরা ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেয়া। রথি নাশিদের থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছিলো দেখে নাশিদ রথিকে দেয় এক ধমক।
সেই ধমকে কাজী লাফিয়ে উঠে আর চোখের চশমা ঠিক করে এদিক সেদিক তাকিয়ে ভয়ে উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলো,

-‘কার বিয়ে পড়াবো? কে কাবিননামায় স্বাক্ষর করবে?’

নাশিদ রথিকে একটি চেয়ারে বসার উদ্দেশ্য করে বললো,

-‘বসো!’

রথি ঘাবড়ে বসে পরলো। নাশিদও রথির পাশে বসে বসলো। নাশিদ রথিকে একটু খেয়াল করতেই দেখলো রথির মাথায় কাপড় নেই। নাশিদ রথির মাথায় ওড়না জড়িয়ে দিলো। যা দেখে রাতে ডিউটিরত কয়েকজন মহিলা পুলিশ অদূরে দাঁড়িয়ে মুখ চেপে হাসছিলো। নাশিদ এবার কাজীর উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,

-‘বিয়ে পড়ানো শুরু করুন!’

কাজী বিয়ে পড়ানো শুরু করলো। একপর্যায়ে সে বলে উঠলো,

-‘আপনাদের কাগজপত্র ছাড়া বিয়ে হবে কী করে?’

নাশিদ একপলক রথির দিকে তাকালো। অতঃপর নাশিদ বললো,

-‘আপনার যা যা জানার আমাদের বলুন উত্তর দিচ্ছি। আপাতত কাগজপত্র নিয়ে আসিনি আমরা।’

-‘কিন্তু কাগজপত্র ছাড়া…’

-‘ওটা সময়মতো আপনার বাসায় পৌঁছে যাবে! আর কিছু? এখন যা করার জলদি করুন!’

কাজী আর কিছু বলার সাহস পেলো না। যাবতীয় কিছু প্রশ্ন করলো আর দুজন উত্তর দিলো। অবশেষে বিয়ে সম্পন্ন হলো। রথির চোখের কোণ ভিঁজে গেলো। বিয়েটা যেভাবেই হোক, সে তার ভালোবাসাকে পবিত্ররূপে পেয়েছে। এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে? রথি প্রশান্তিতে চোখ বুজে ফেললো। বিয়েটা নিয়ে মনের মধ্যে একটা ঝড় বইলেও এখন সবকিছু কেমন শান্তি, শান্তি লাগছে। রথি যেন হাওয়ায় ভাসছে।
নাশিদ কাজীর সাথে কথা বলে কাবিননামা নিয়ে নয়নদের সাথে কথা বললো। নাশিদের এক বন্ধু হেসে বললো,

-‘তুই আর শোধরালি না! সেই কলেজ লাইফের মতো রাত করে ডেকে পাঠালি। তবে যাই বলিস, তোর বিয়েতে উপস্থিত থাকতে পেরেছি এ-ই অনেক। বিয়ে মোবারক বন্ধু!’

বলেই নাশিদকে হাগ করলো। নাশিদ ওদের সঙ্গে কথা বলে রথির কাছে গেলো! রথিকে থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নাশিদ বলে উঠলো,

-‘কী হলো? যাবে না, নাকি নিজের বাসর এই থানাতেই করার ইচ্ছে?’

রথি চোখ গরম করে নাশিদের দিকে তাকালো। তখন থেকে বাসর বাসর করেই চলেছে। শালা ঠোঁটকাটা খচ্চর পুলিশ! বিয়ে শেষ পর্যন্ত তার এই থানাতেই লিখা ছিলো? রথি দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

-‘বিয়ে করার জন্য আর কোনো প্লেস ছিলো না? থানাই কেন?’

-‘সবাই তো কাজী অফিস গিয়ে বিয়ে করে, আমি নাহয় ইতিহাস বদলে দিলাম। হলো না, একটা ইউনিক বিয়ে? আমার নাতি-নাতনীদের গল্প শোনাবো, তাদের দিদুনকে থানায় বিয়ে করেছি!’

-‘কচু! সরেন সামনে থেকে!’

নাশিদ খপ করে রথির হাত ধরে বলে,
-‘সরি, এখন আমরা বাসায় যাচ্ছি!’

বলেই নাশিদ নয়নদের থেকে বিদায় জানিয়ে রথিকে নিয়ে চলে গেলো। ভোর পাঁচটায় ওরা বাড়ি পৌঁছালো। নাশিদের কাছে ডুপ্লিকেট চাবি ছিলো তাই বাড়িতে ঢুকতে খুব বেশি অসুবিধা হলো না। বাড়িতে সাবধানে ঢুকে যে যার মতো ঘরে চলে গেলো।

~চলবে।

#হৃদপূর্ণিমা
লাবিবা_ওয়াহিদ
| পর্ব ২২ |

-‘গতকাল রাতে কোথাও গিয়েছিলে নাশিদ?’

মনিকার দিকে না তাকিয়েই খেতে খেতে নাশিদ বললো,

-‘থানায় গেছিলাম। কেন মা, আজ নতুন নাকি?’

মনিকা থতমত খেয়ে গেলো নাশিদের এরূপ ব্যবহারে। ইদানীং আগের মতো ঠিকভাবে কথা বলে না। ব্যবহারটাও কেমন পাল্টে গেছে। ইদানীং ‘আপনি’ বলেও সম্বোধন করছে তাকে। অর্পি নাশিদকে টাচ করতে গেলে নাশিদ প্লেট নিয়েই উঠে দাঁড়ায় এবং লিভিংরুমে যেতে যেতে বলে,

-‘ঢোলাঢোলির জন্য ক্লাবে যাও, এটা খাবারের টেবিল। আর আমিও তোমার সো কল্ড প্লে বয় নই যে তোমার ইশারায় সাড়া দিবো!’

নেওয়াজ নাশিদকে পিছুডাক দেয় কিন্তু নাশিদ শুনলো না। নেওয়াজ অসহায় দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকাতেই বাবা চোখ রাঙিয়ে মনিকার দিকে তাকালো। মনিকার চাল যে সে ধরতে পারেনি এমনটি নয়! বাবা মনিকাকে দাঁতে দাঁত চেপে আস্তে করে বললো,

-‘ছেলেটাকে কী খেতেও দিবে না শান্তিমতো?’

মনিকা কিছু বললো না, চুপ করে রইলো। নেওয়াজ আর বাবা কোনরকম খেয়েই চলে গেলো। নেওয়াজও যাওয়ার আগে মায়ের সাথে কথা বলেনি। ভাবী খাওয়া শেষ করে নাফিসাকে নিয়ে উঠে গেলো। কিছুক্ষণের মাঝে নাশিদ প্লেট নিয়ে কিচেনে চলে গেলো। সেখানে হাত ধুঁয়ে টিস্যু দিয়ে হাত মুছতে মুছতে সিঁড়ির সামনে গেলো এবং নাফিসার উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে বললো,

-‘ভার্সিটি কী আমি তোকে ড্রপ করে দিয়ে আসবো?’

-‘না ভাইয়া। আমার যেতে লেট হবে!’

নাশিদ আর কিছু না বলেই বেরিয়ে গেলো। মনিকা বা অর্পিতার দিকে ফিরেও তাকালো না। রথি অনেক আগেই কোচিং সেন্টারে চলে গেছে। অর্পিতা নাশিদের যাওয়ার দিক থেকে চোখ সরিয়ে মনিকার দিকে তাকালো।

-‘এরকম কেন হচ্ছে ফুপ্পি? তোমার ছেলে আমার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না!’

-‘সব ঠিক হয়ে যাবে। ধৈর্য ধর!’

অর্পিতা কিছু বললো না।
রেগে বোম হয়ে চলে গেলো।

রথি রিকশার জন্য কোচিং সেন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সে খানিক চিন্তিত। আজ ফাহাদ স্যারের ঘেঁষাঘেঁষিটা বিরক্তিকর ছিলো। তার ঘোরলাগা দৃষ্টিও রথির বুঝতে সময় লাগেনি। তার উপর গতকাল রাতের এমন আকস্মিক বিয়ে। রথির তো এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না, সে বিবাহিত, মিসেস নাশিদ। রথির ভাবনার মাঝেই কোথা থেকে নাশিদের গাড়ি এসে থামলো। রথি চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো। নাশিদ সানগ্লাস খুলে রথির দিকে তাকিয়ে বলে,

-‘গুড আফটারনুন বউ!’

নাশিদের মুখে ‘বউ’ শুনে রথির ভেতরটা শীতল হাওয়ায় ছেয়ে গেলো। এক অদ্ভুত শিহরণ অনুভব হচ্ছে তার। পরমুহূর্তে নিজেকে সামলে রথি বলে উঠলো,

-‘আপনি এখানে?’

-‘হু। আমি!’

-‘আমার কোচিং সেন্টারের এড্রেস কই পেলেন?’

নাশিদ গাড়ি থেকে নেমে রথির বরাবর দাঁড়িয়ে বললো,

-‘মাথা কী গেছে তোমার? এর আগেও তো এখানে তোমার সাথে মিট করেছি, মনে নেই?’

বলেই নাশিদ মাথা নিচু করে রথির দিকে ঝুকতেই রথি পূর্বের ন্যায় দুই পা পিছিয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগলো। রথির এরূপ রিয়েকশনে নাশিদ হেসে উঠলো।

-‘কী মনে পরেছে?’

রথি জোরে জোরে মাথা নাড়ায়। ঠিক এভাবেই! গত দেড় মাস আগে ঠিক এভাবেই নাশিদ তার উপর অদ্ভুত কারণে রাগাম্বিত হয়ে এভাবে ঝুকেছিলো। তবে আজ নাশিদ রেগে নেই, তার আজ পাগল করা হাসি।

-‘তাহলে যাওয়া যাক?’

-‘আপনার সঙ্গে যাবো না আমি!’

-‘ওরে বাচ্চাটাহ! এতো অভিযোগ, অভিমান কেন? তোমায় কী গুতা দিয়েছি?’ নাশিদ বাচ্চা বাচ্চা ফেস করে বললো! নাশিদের এমন বাচ্চামো দেখে রথির চোখ বের হয়ে যাওয়ার উপক্রম। এ কোন রূপ দেখাচ্ছে নাশিদ?

-‘কী হলো চুপ কেন? কই ভাবলাম তোমার সাথে লাঞ্চ করবো! কিন্তু তুমি তো আমার সাথে যেতেই চাও না। ঠিক আছে আমি লাঞ্চ না করেই থানায় চলে যাচ্ছি!’

-‘উফফ, এমন করেন কেন? উঠছি তো গাড়িতে!’

নাশিদ বাঁকা হাসলো। রথি গিয়ে দরজা খুলে উঠে বসলো। নাশিদ এর মাঝে কোথায় যেন গেলো। রথি এদিক সেদিক খুঁজতে গিয়েই তার পাশের ডোর খুললো নাশিদ। হাতে তার দুটো সান চিপসের প্যাকেট। নাশিদ মুখে হাসি নিয়ে বলে,

-‘বাসরে নাকি বউদের উপহার দিতে হয়। কিন্তু আমার তো বাসর হয়নি, তাই বাসরে না দিয়ে এখানে দিলাম। নেও তোমার উইদাউট বাসর গিফট!’

বলেই রথির কোলে চিপসের প্যাকেট ছুঁড়ে মেরে দরজা লাগিয়ে দিলো। আর রথি সেখানেই বেক্কলের মতো বসে রইলো৷ নাশিদ ড্রাইভিং সিটে উঠে বসতেই গাড়ি স্টার্ট দিলো। রথি চিপসের প্যাকেট উল্টে পাল্টে দেখতে দেখতে বলে,

-‘আচ্ছা ছেলেরা কী এভাবেই বিয়ের পর গিরগিটির মতো রূপ বদলায়?’

নাশিদ স্টেয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতে বাঁকা হেসে বলে,

-‘সব ছেলের কথা তো জানি না তবে আমার হৃদপূর্ণিমার খুশির জন্য এই নাশিদ তার সর্বোচ্চ করতে রাজি, তবে লিমিট বজায় রেখে। তোমার ছেলেমানুষি আবদার করলে ঠিকই বকা খাবা!’

-‘ছেলেমানুষি আবদার মানে?’

-‘যেগুলা করা ঠিক না, আমার লিমিটের বাইরে!’

রথি ভেংচি কেটে বাইরের দিকে তাকালো। নাশিদ নিঃশব্দে হেসে ড্রাইভিং-এ মনোযোগ দিলো। একটা রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করে ওরা বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলো। রাস্তাতেই নাশিদ এমন একটা প্রশ্ন করলো যা রথিকে বিষম খাইয়ে দিলো।

-‘মা তোমায় কিছু বলেছে রথি?’

রথি বিষম খায় এবং নাশিদের দিকে তাকায়। কিন্তু নাশিদের কোনোরকম পতিক্রিয়া নেই! রথি আমতা আমতা করে বললো,

-‘মা..মানে?’

-‘মানে টা তুমি আমার চেয়ে বেশি ভালো জানো! যা জিজ্ঞেস করেছি বলো, এমন চুপ করে লুকিয়ে লাভ নেই!’

রথি প্রথমে অস্বীকার করলো। পরমুহূর্তে নাশিদের কঠোর দৃষ্টিতে ঘাবড়ে বলতে বাধ্য হলো। রথি মাথা নিচু করে চিপসের প্যাকেটটার দিকে তাকিয়ে আনমনে বলে উঠলো,

-‘সেদিন আমি একা ঘরে ছিলাম, আন্টি আমার ঘরে এসে আমায় উল্টো পাল্টা কথা বলেছে। আমার কোনোরকম অধিকার নেই এই বাড়িতে থাকার। আমি থাকলে আপনি আমার প্রতি দুর্বল হবেন, অতঃপর আমার মতোন সমাজছাড়া মেয়ের সাথে সে আপনাকে কিছুতেই সহ্য করবে না। আমায় বাড়ি থেকে চলে যেতে বলেছে! তাই….’

-‘তাই তুমি আমায় বিয়ে করে আমার বউয়ের পরিচয়ে থাকতে চেয়েছিলে। আমার বিয়ের জন্য চাপ দিয়েছো তাইতো?’

রথি মাথা নাড়ায়। সে আবারও বলেছে,

-‘আমি আলাদা বাসা খোঁজাও শুরু করেছিলাম। মা তো আর আমার মুখও দেখবেন না বলেছিলেন তাই আলাদা বাসা দেখা ছাড়া আমার কোনো উপায় নেই। আর আপনি তো… মাঝেমধ্যে মনে হতো আপনি দায়িত্ব মনে করে আপনার কাছে রেখেছেন, দায়িত্ব শেষ হলে হয়তো আপনার সাথে আমারও কোনো সম্পর্ক থাকবে ন…’

রথি আর কিছু বলার আগেই নাশিদ বেশ জোরে ব্রেক কষে। রথি ভয় পেয়ে নাশিদের দিকে তাকালো। নাসজিদের চোখ-মুখ অসম্ভব লাল হয়ে আছে। রথি অনেকটা ভয় পেয়ে যায়। নাশিদ কয়েক সেকেন্ড রাগে ফোঁসফোঁস করে রথির দিকে তাকিয়ে রথির মুখ চেপে বাজখাঁই গলায় বলে উঠলো,

-‘তোর কী আমার ভালোবাসা ঠুনকো মনে হয়? কাল থেকে আমার ভালোবাসার দিকে আঙ্গুল তুলছিস! কেউ ভালোবাসি না বললেই সে ভালোবাসে না? আর এদিকে যে তোর জন্য আমি নিঃস্বার্থে সব করে গেলাম? তোকে সময় দিয়েছি, ইঙ্গিতেও বুঝিয়েছি। তুই এতোটাও বাচ্চা না যে আমার কথা, টাইম স্পেন্ড করার মানে বুঝবি না! তুই যদি এতোই বুঝ হতি বারবার এভাবে আমায় আঘাত করতি না, আমায় চলে যাওয়ার কথাও বলতি না। তুই এখন বিবাহিত! এই নাশিদের বউ তুই! তোরে যেমন ভালোবাসতে পারবো তেমনই কষ্ট দিতে পারবো। তুই ওই মহিলার কথা শুনতে যাবি কেন? আমি বলসি, ওই মহিলার কথা শুনতে? ওই মহিলা কতোটুকু জানে আমার ভালোবাসা সম্পর্কে? লাস্ট ওয়ার্নিং দিচ্ছি রথি, আমার ভালোবাসাকে খারাপ দিকে ইঙ্গিত করলে আমি যে তোকে কী করবো তা আল্লাহ’র চেয়ে ভালো কেউ জানে না। তিন কবুলে তোকে বিয়ে করেছি মনে রাখিস!’

বলেই নাশিদ রথিকে ছেড়ে নিজের সিটে গিয়ে বসলো। নাশিদ যথাসম্ভব চেষ্টা করতে লাগলো নিজের রাগকে সংগত করার। নাশিদ সরে যেতেই রথির চোখ বেয়ে টুপ করে এক ফোটা জল গড়িয়ে পরলো। তার বৃষ্টি স্তব্ধ, বিমূঢ়! নাশিদ চোখ বুজে কয়েকবার লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে গাড়ি স্টার্ট দিলো।

সারা রাস্তায় আর দুজনের মধ্যে কথা হলো না। রথিকে বাসায় পৌঁছে দিয়েই রথিকে কিছু না বলেই গাড়ি টান দিয়ে নাশিদ আবার থানাতে চলে যায়। রথি মন খারাপ করে ভেতরে চলে গেলো। এভাবে দুইদিন কেটে গেলো নাশিদ রথির সঙ্গে কথা বলে না। ভুল করেও রথি নাশিদের সামনে পরলে নাশিদ নিখুঁতভাবে তাকে এড়িয়ে চলে। এখন রথিকে নাশিদ একা ছাড়ে না। ড্রাউভার দিয়ে কোচিং পৌঁছে দেয় আবার ড্রাইভারের মাধ্যমে নিয়ে আসে। কিন্তু নাশিদ ভুল করেও রথিকে পিক করে না। রথির ইচ্ছে করছে সবকিছু তছনছ করে দিতে। নাশিদের এমন ইগনোরেন্স সে নিতে পারছে না।

সে মানছে সে ভুল করেছে, তাই সে রেগে আছে। এর জন্য তাকে মারুক, বকুক। তাই বলে কথা কেন বন্ধ করবে? নাশিদের এই ইগনোরেন্স তার বুকে ছুঁড়ি দ্বারা বারংবার ক্ষত-বিক্ষত করছে তা কী নাশিদ বুঝে না?

গত দুই রাতের মতোই আজও রথি বারান্দায় দাঁড়িয়ে চুপচাপ অপেক্ষা করছে নাশিদের জন্য। নাশিদ আজ এখনও ফিরেনি। এখন নাশিদকে না দেখলে তার ঘুম আসে না, আসে না অবস্থা। দেরী করে ফিরছে, এজন্য তার চিন্তার শেষ নেই। আচ্ছা বিয়ে হলে কী সকল মেয়েরাই এমন হয়ে যায়? আগেও তো নাশিদ দেরীতে ফিরেছে, রথির ঘুমিয়ে পরার পরে এসেছে। কিন্তু এখন? নাশিদের জন্য কতোটা উদ্বীগ্ন হয়ে আছে। বিয়ের নামক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে তাদের ভালোবাসা আরও গাঢ়তে রূপ নিয়েছে! অপেক্ষা করার মাঝেও আলাদা সুপ্ত অনুভূতি রয়েছে। রথির ভাবনার মাঝেই সে গাড়ির শব্দ পেলো। মুহূর্তেই তার মুখমন্ডলে খুশির আলোড়ন তৈরি হলো। রথি চোখ মুছে মাথায় সুন্দর করে ঘোমটা দিয়ে ভেতরে আসলো। নাফিসা ঘুমোচ্ছে। রথি মুখে এক চিলতে হাসি ঝুলিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। সিঁড়ির কাছে নাশিদকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে রথি সেখানেই থমকে গেলো।

~চলবে।

বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here