হৃদপিন্ড পর্ব-১০
#জান্নাতুল নাঈমা
আর দশদিন আছে তারপরই ফিরে যেতে হবে মুসকান কে ইমনের সাথে ইমনের বাড়িতে।
যে বাড়িটা একদমই ইমনের নিজস্ব, যে বাড়িতে কোন সেলফিসদের জায়গা দেয়নি ইমন চৌধুরী।
যে বাড়িতে এতো এতো মানুষের ভীর না থাকলেও আলাদা এক শান্তি রয়েছে। যেখানে সে তৃপ্তি সহকারে থাকতে পারে। কোন প্রকার অশান্তি তে ভুগতে হয় না।
যে বাড়িটা সে নিজের রোজগারে তৈরী করেছে।
আঠারো বছর বয়স থেকেই সে তাঁর পরিবার থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন, মাঝে পরিবারের সাথে যোগাযোগ হলেও আরো একটা দূর্ঘটনায় সেইটুকুও বাদ দিয়ে দেয়। তারপর থেকে সে একাই থাকে।
পাঁচবছর যাবৎ সায়রী এসে থাকছে তাঁর বাড়িতে সেটা সম্পূর্ণ সায়রীর নিজের স্বার্থে। ইমন দুঃসময়ের বন্ধু হয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে তাঁর। এমনকি তাঁর জবটাও সম্পূর্ণ ইমনের সহযোগিতায় হয়েছে।
,
দাদীর কাছে ইমনের বিষয়ে টুকটাক শনে নিলো মুসকান। দাদী সবটা বললোও না তা বেশ বুঝলো মুসকান কিন্তু এতে সে একটুও মন খারাপ করলোনা। বরং যে টুকু শুনেছে এতেই সে হ্যাপি হলো।
দাদী কথার ফাঁকে মুসকান কে প্রশ্ন করলো হেরে তোর মায়ের কি হয়েছিলো।
মুসকানের মুখটা মলিন হয়ে গেলো মায়ের কথা মনে পড়তেই। চোখ দুটো পানিতে টলমল করছে।
নিজেকে স্বাভাবিক করে বললো আম্মার অনেক রোগ ছিলো।
দাদীর বুক টা কেঁপে ওঠলো প্রশ্ন করলো কি রোগ?
মুসকান বললো আমি হওয়ার পর থেকেই নাকি রোগটা হয়েছিলো। অনেকে বলে এর আগে থেকেই নাকি ছিলো আমার আগে তিনবার বাচ্চা পেটে এসেছিলো একটাও টেকে নি। তারপর অনেক বছর পরে নাকি আমি হয়েছি। আমি হওয়ার পর থেকেই আব্বা -আম্মার সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে।
আব্বা চাইছিলো একটা ছেলে সন্তান হোক।
কিন্তু হলো মেয়ে সেই নিয়ে ভীষণ রাগ ছিলো তাঁর।
বলেই মাথা নিচু করে ফেললো, মাথা নিচু করেই বললো আম্মারে চিকিৎসাও করায় নি। মানুষ বলতো চিকিৎসা করালে নাকি আমার আম্মা বাঁচতো।
বলেই হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো মুসকান, দাদীও কান্নায় ভেঙে পড়লো মুসকানকে জরিয়ে সেও কাঁদতে লাগলো।
বহুবছরের চাপা আর্তনাদ গুলো যেনো বেরিয়ে এসেছে আজ।
,
ইমন দাদীকে বলেছিলো মুসকান কিভাবে কি পরিস্থিতি থেকে ইমনের কাছে এসেছে কিন্তু তাঁর মনে প্রশ্ন থেকেই গেলো।
আর ভাবতে লাগলো তারেক এমনটা কেনো করবে?
এমনটা করায় তাঁর কি স্বার্থ থাকতে পারে?
নিজের রক্তের সাথে এমনটা করতে একটুও আত্মা কাঁপলো না ওর।
এতো ভালোবাসা কোথায় হারিয়ে গেলো?
তাহলে কি আমিই ভুল ছিলাম আর বাকি সবাই ঠিক? আমি কি নিজের হাতে নিজের মেয়ের বলি দিলাম। কিন্তু সেই সময়তো আমারো আর উপায় ছিলো না।
কারো তো কোন ক্ষতি হলো না যা হওয়ার শুধু দুইজনেরই হলো। হে আল্লাহ দুনিয়াতে তাকে সুখ,শান্তি দাওনি পরকালে যেনো তাকে সুখ দিও।
কেউ যদি তাঁর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে থাকে তাহলে তাঁর শাস্তি যেনো সে দুনিয়াতেই পেয়ে যায়।
মরার আগে একটাই চাওয়া আমি যেনো সবাই কে সব সত্যিটা জানাতে পারি। ইমন দাদুভাইকে যেনো সবটা জানিয়ে যেতে পারি। যে করেই হোক ওদের বিয়েটা আমাকে তারাতারি দিয়ে দিতে হবে।বিয়ে না হওয়া অবদি সব সত্যি সামনে আনা যাবে না। তাহলে একরামুল বাঁধা হয়ে আসতে পারে।
আর আমাকে সব সত্যি খুঁজে বের করতে হবে।
,
দাদী নিজের কান্না চেপে বললো কাঁদিস না, আমার দাদু ভাই জানলে রাগ করবে।
মুসকান চুপ হয়ে গেলো মাথা তুলে দাদীর দিকে তাকালো। দাদী বললো আমার দাদু ভাই তোকে ভীষন আপন করে নিয়েছেরে, তুইও আপন করে নিয়েছিস বুঝি, দাদু ভাইকে সারাজীবন এভাবেই আগলে রাখবি তো,,,
মুসকান লজ্জা পেয়ে গেলো, অবাক চোখে দাদীর দিকে চেয়ে রইলো।
দাদী আঁচল দিয়ে চোখ মুখ মুছলো, মুসকানের চোখ মুখ ও মুছে দিলো।
,
আমার কর্তা আমার থেকে ১৭বছরের বড় ছিলো।
আমার সাথে যখন তাঁর বিয়ে হয় তখন আমি ৯বছরের। হাফ প্যান পড়ে বারবাড়ি দৌড়াদৌড়ি করছিলাম তখনি ইয়া বড় লম্বা, খাম্বার মতো মানুষটা আমার সামনে দাঁড়ালো। আমি কোমড়ে হাত দিয়ে বললাম আপনে কেডা?তখন ওনি চোখের চশমাটা খুলে আমাকে ভালো করে দেখলো। আবার চশমা চোখে দিয়ে আমার বাড়ির ভিতরে ঢুকে আমার বাজানের সাথে কি জানি আলাপচারিতা সারলো। পরেরদিনই বাজান আমারে কোলে করে নিয়ে বসিয়ে কর্তার সাথে বিয়ে পড়িয়ে দিলো।
প্রথম দিকে বিছানা ভিজাতাম তা নিয়ে কর্তা যে কি রাগারাগি করতো। সংসার তো বুঝতামই না। স্কুলে ভর্তি করাই দিলো সিক্সে ওঠার পর থেকেই কর্তা আমার সাথে রসিকতা করা শুরু করলো আমি যে কি ক্ষেপে যেতাম,,, ওনি যে আমার স্বামী বুঝতামই না। বুঝলামতো যখন নাইনে পড়ি সে সময় ছেলে-মেয়ের প্রেম হতো চিঠি আদান-প্রদানের মাধ্যমে। আমাকেও এক ছেলে চিঠি দিলো তা দেখে কর্তা সে কি রাগ । ঐ চিঠির জন্যই তো তারাহুরো করে এক বাচ্চার মা বানিয়ে দিলো।
একরামুল কে কোলে বসিয়েই এসএসসি পরীক্ষা দিলাম। এমন পরিবারে বউ হয়ে আসছিলাম যে তাঁরা পড়াশোনাকেই প্রাধান্য দিতো বেশী সেই সুবাদে আমারো শিক্ষিত হওয়াও হয়ে গেলো।
পবিত্র মন নিয়ে কারো সাথে সারাজীবন থাকতে চাইলে, কাউকে মন থেকে ভালোবাসলে, মনের জোর থাকলে ঠিক দুজন মানুষ দুজনের আপন হয়ে ওঠতে পারে। আশেপাশের মানুষ যাই বলুক না কেনো।
মুসকান লজ্জায় মিইয়ে যাচ্ছে কেমন। বুকের ভিতর হাতুড়ি পিটা শুরু হয়ে গেছে এটা অবশ্য তাঁর দোষ না। দাদীরও দোষ না দোষটা বয়সের। এই বয়সে আবেগ ধরে রাখা তো বড়ই মষ্কিল ।
অবুজ বয়সের অবুঝ আবেগ,অবুঝ মন যাকে বলে।
অল্প অনুভূতিতে বেশীই মিইয়ে যায় মেয়েটা।
,
মুসকান নিজের সব জিনিসপত্র গুছিয়ে ব্যাগে রেখে ইমনের রুমে গেলো তাঁর জিনিস পএ গুছাতে।
ইমন বেলকুনিতে বসে সিগারেট খাচ্ছে।
মুসকান রুমে এসে ইমনের জিনিসপত্র গুছাতে লাগলো।ইমন সিগারেট টা মুখে পুরেই ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে রুমে ঢুকলো।
মুসকান স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর কাজ করতে লাগলো।
ইমন ইচ্ছে করেই বেশী বেশী ধোঁয়া ছারতে লাগলো।
বেশ মজা নিচ্ছে সে এই মূহুর্তে সে যেনো তাঁর স্বভাবের বিরুদ্ধে গিয়ে মেয়েটাকে জ্বালানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু কোনভাবেই মুসকান কে ঘায়েল করতে পারছে না। সে যেনো তাঁর সব জ্বালাতন সহ্য করার ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছে।
এই মানুষ টা কি দিয়ে তৈরী,,,অবাক লাগে ভীষন অদ্ভুত সব মায়া, অদ্ভুত সব ক্ষমতা,অদ্ভুত সব সহনশীলতা এর মাঝেই যেনো আল্লাহ তায়ালা উজার করে দিয়েছে।
প্রথম দেখাতেই যে মানুষ টা হার্টে আঘাত করতে পারে,সে মানুষ তো সত্যি অদ্ভুত। শুরুটা শারিরীক আঘাতে হলেও এরপর প্রতিটা আঘাত করেছে মনে। যে আঘাত গুলো বুকের বা পাশে লেগেছে। যে আঘাতে ছিলো শুধুই মুগ্ধতা।
“ও শুধুই আমার জন্য তৈরী, ও আমার “মুগ্ধময়ী”।
যার প্রতিটা কাজে,প্রতিটা কথায়,প্রতিটা ব্যবহারে শুধু মুগ্ধতা ছেয়ে থাকে,নমনীয়তা ভরে থাকে।
ভাবতে ভাবতেই হুশ ফিরলো মুসকানের নরম হাতের শক্ত স্পর্শে। মুসকানের আতঙ্ক ভরা চোখ মুখে বলা কথাটায়।
ঠোঁট পুরে যাবে তো,,,কি করছেন এভাবে কেউ সিগারেট খায়,,,
ইমন নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলো সিগারেটের শেষ অংশ টুকুই পড়ে আছে। আর একটু হলেই আগুনের ছ্যাঁকা খেতো।
ইমন মুসকানের দিকে চেয়ে বললো খেয়াল করিনি।
মুসকান বললো এরপর খেয়াল করবেন, নয়তো ঠোঁট পুরে ছাই হয়ে যাবে বলেই বেরিয়ে যেতে নিলো।
ইমন বললো ঠোঁট পুরে ছাই হয় কিভাবে আবার।
মুসকান থেমে চুপ রইলো ইমনের দিকে অবুঝ চাহনীতে চাইতেই ইমন বাঁকা হাসলো।
আর বললো ওখানে একটা জিনিস রয়েছে তোমার কাছে নিয়ে রাখো। ও বাড়ি গিয়ে দেখো কি আছে তাঁর আগে দেখবে না।
মুসকান ঘাড় কাত করে সম্মতি দিয়ে জিনিসটা নিয়ে বেরিয়ে গেলো।
,
ব্যাগের চেইন খুলে জিনিসটা রাখলো। ড্রেসিং টেবিলের দিক চোখ পড়তেই বললো এ বাবা আমি তো চুলের ব্যান্ডগুলো ওঠাইনি।
তারাতাড়ি গিয়ে ব্যান্ড গুলো নিয়ে ব্যাগে রাখলো। কয়েকটা সেপটিপিন ব্যাগের সামনের পকেটে রাখতে যেতেই ভ্রু কুঁচকে তাকালো।
এই গয়না কিসের বলেই একজোড়া কানের দুল বের করলো। দুলগুলো ছিলো গোল্ডের মাঝে সাদা পাথরের। ওটা যে ডায়মন্ড ছিলো মুসকান বুঝতে পারেনি। বুঝবে কি করে সে কখনো ডায়মন্ড দেখেয়নি।
সায়রী তাকে একজোরা রিং বানিয়ে দিয়েছে স্বর্নের শুধু। এছাড়া এসব গয়নার প্রতি তাঁর আকর্ষণ নেই।
সে বুঝে ওঠতে পারছেনা এই গয়না টা কোথায় থেকে এলো। তাঁর রুমে তো কেউ আসেনা তাহলে কে রাখলো এটা। কেউ ভুল করে রেখে যায় নি তো।
কাকে জিগ্যাস করবে এখন বেশ চিন্তায় পড়ে গেলো মুসকান। দুলজোরা নিয়ে ইমনের রুমে গিয়ে দেখলো ইমন সেখানে নেই।
কেমন ভয় হতে লাগলো ভীষন মুখটা চুপসে গেলো।
ভয়ে ভয়ে নিচে নেমে এলো।
ইয়ানা,ইয়াশফা বসে আছে সোফায়।দাদী চেয়ারে বসে পান চিবুচ্ছে। ইমন দাদীর সামনে বসে আছে।
একরামুল চৌধুরী নিচে নেমে এলো।
ইয়াশফা মুসকান কে দেখে শয়তানি মাখা এক হাসি দিলো
কারন মুসকান যখন সব কাপড় গুছিয়ে ইমনের রুমে যায় তখনি ইয়াশফা তাঁর মায়ের কথা অনুযায়ী তাঁর ডায়মন্ডের দুল মুসকানের ব্যাগে রেখে আসে।
তাদের প্ল্যান অনুযায়ী, সাজিয়া বেগম এইতো কিছুক্ষনের মধ্যেই চিৎকার,চেচামেচি করতে করতে নিচে নেমে আসবে। আর মুসকান কে বাজে ভাবে সকলের সামনে অপমান করবে। কিন্তু তাদের সব পরিকল্পনা যে এইভাবে মাটি হয়ে যাবে সেটা মা মেয়ে ভাবতে পারেনি।
মুসকান দাদীর পাশে দাঁড়াতেই ইমন ভ্রু কুঁচকে বললো কিছু বলবে,,,
মুসকান আরো ভয় পেয়ে গেলো। ইমনের খটকা লাগলো ভীষণ। দাদী বললো কিরে কি হয়েছে মুখটা এমন হয়ে আছে কেনো।
মুসকান এক ঢোক গিললো হাতটা সামনে এগিয়ে দিয়ে বললো এটা আমার ব্যাগে ছিলো,কিন্তু এটা তো আমার না।
ইমন মুসকানের হাতের দিকে তাকালো।
ইয়াশফা চমকে গেলো।
এটা কি হলো,,,নাটক, সিরিয়াল দেখে একটা প্ল্যান সাজালাম কিন্তু ইন্ডিং টা এমন ঘুরে গেলো কেনো?
এখন কি হবে???
ওরে মাদার বাংলাদেশী তুমি কই।
,
দাদী বললো ওমা এটাতো বউমার কানের দুল।
তোর বাবা দিয়েছে,ওটা ওর ব্যাগে কি করে গিয়েছে।
ইমনের মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো।
বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো।
মুসকানের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে একদম নিজের সামনে নিয়ে এলো।
কড়া গলায় বললো -এই মাথায় কিছু নেই,,,
এতো দামী জিনিস পেয়ে বোকার মতো সকলের সামনে নিয়ে এসেছো। নিজের কাছে রেখে দিতে এটা বিক্রি করলে কতো টাকা পেতে জানো??
দাঁতে দাঁত চেপে কথা গুলো বলেই ইয়াশফার দিকে চেয়ে বললো তাইনা ইয়াশফা মুসকানের তো এটাই করা উচিত ছিলো বল,,,মেয়েটা না ভীষণ বোকা বলেই রহস্যময় হাসি দিলো।
ইয়াশফা চমকে ওঠে দাঁড়ালো আমতা আমতা করতে লাগলো। ভয়ে বার বার ঢোক গিলতে শুরু করলো।
মুসকান মাথা নিচু করে ফেললো। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়লো কয়েক ফোঁটা।
,
ইমন মুসকানের চোখের পানি দেখে বিরক্ত হলো ভীষণ।
কিছু বলতে যাবে তাঁর আগেই শুরু হলো ড্রামা।
চলবে…………
ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।