হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(২) #Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)

#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(২)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)

(৩)
তরুনিমাকে এভাবে দৌড়ে চৌধুরী মেনশনের ভিতরে চলে যেতে দেখে তমালিকা সিকদার ওর পিছনে যেতে নিলে সাগরিকা চৌধুরীর কন্ঠে “দাড়াও তমা বউমা” বাক্যটি শুনামাত্র তমালিকা সিকদার সেইস্থানেই থেমে যান। সাগরিকা চৌধুরী লাঠিতে ভর দিয়ে ধীরপায়ে হেঁটে তমালিকা সিকদার এর সামনে এসে দাঁড়িয়ে শান্ত স্বরে বললেন…..

—“তরু দিদি ভাইকে এখন কিছুসময় একলা থাকতে দাও। নিজের মন ও মস্তিষ্কের সাথে বোঝাপড়া করার একটা বিষয় রয়েছে। কারণ তরু দিদি ভাই আধঘন্টা পূর্ব পর্যন্তও ভেবেছিলো ওর বিয়ে কনক দাদু ভাইয়ের সাথে হবে। হুট করে সবটা এলেমেলো হয়ে গেলো। এখন আবার পারিবারিক সম্মান ও সম্পর্ক রক্ষার খাতিরে আমি আমার কুশল দাদু ভাইয়ের সাথে ওর বিয়ের বিষয় নিয়ে কথা উঠিয়েছি। তাই এই সব কিছু একসাথে হয়ে তরু দিদিভাইয়ের মন ও মস্তিষ্কের উপর আলাদা প্রভাব ফেলেছে। তাই এখন তরু দিদিভাইকে একলা থাকতে দেয়া উচিত আমাদের। আর এই সময়ের ভিতর আমাদের বড়দের একত্রে বসে আমার উঠানো প্রস্তাবটির বিষয় নিয়েও কথা বলা উচিত বলে আমি মনে করছি।”

সাগরিকা চৌধুরীর কথাগুলো শুনে তারেক সিকদার বললেন….

—“কুশল বাবাকে নিজের মেয়ের জামাই হিসেবে অপছন্দ করার মতো কোনো কারণ আমাদের পরিবার কেনো এই পুরো শহরে বসবাসরত কোনো পরিবার বের করে তা তুলে ধরতে পারবে না। তাই কুশল বাবা আপনাদের কথানুযায়ী আমার মেয়েকে বিয়ে করার জন্য রাজি হলে আমরা কেও কোনোরূপ দ্বিমত পেষণ করবো না বড় মা।”

তারেক সিকদার এর মুখে এরূপ কথা শুনে সাগরিকা চৌধুরী স্মিত হাসলেন। সেইসময় কুশলের মা সাবরিনা চৌধুরী সাগরিকা চৌধুরীর পাশে এসে দাঁড়িয়ে থমথমে স্বরে বললেন….

—“কিন্তু সিকদার ভাইজান তরুনিমা তো আমার ছেলেকে বিয়ে করবে না বলে এক দৌড়ে বাসার ভিতরে চলে গেলো। এখন কুশল পরিবারের সম্মান ও সম্পর্ক রক্ষার কথা ভেবে তরুনিমাকে বিয়ে করার জন্য রাজি হলেও আপনার মেয়ে কি পরবর্তীতে সম্মতি প্রদান করবে?”

তারেক সিকদার ওনার স্ত্রী তমালিকা সিকদার এর দিকে একপলক তাকালেন। তমালিকা সিকদার স্মিত হেসে বললেন…

—“তরুর উপর দিয়ে অনেক ধকল গিয়েছে সন্ধ্যার পর থেকেই তাই ও এখন ঠান্ডা মাথায় কোনো বিষয় নিয়ে ভালোভাবে চিন্তাভাবনা না করেই হ্যা বা না সূচক মতামত জানিয়ে দিচ্ছে। আমরা ওর এইসব মতামতকে ধরে বসে থাকলে তো চলবে না। আপনারা কুশল বাবার সাথে বিয়ের বিষয় নিয়ে কথা বলুন তারপর তরুর সম্মতি জেনে নেওয়ায় বেশি সময় নষ্ট করতে হবে না আমাদের।”

সেইসময় কুশলের ছোট বোন সন্ধ্যা চৌধুরী ওর মায়ের পাশে এসে দাঁড়িয়ে শান্ত স্বরে বললো…

—“কিন্তু তোমরা যেই গুরুত্বপূর্ণ মানুষটির সাথে কথা বলবে বলে ঠিক করেছো সেই গুরুত্বপূর্ণ মানুষটি তার গুরুত্বপূর্ণ কাজের উদ্দেশ্যে গ্রামে গিয়েছে দুপুরের পর পরই। আর চৌধুরী বাড়ির সবাই খুব ভালো করেই জানো জনাব রওনাক আজমাইন চৌধুরী কুশলের কাছে আর গ্রামের মানুষদের সমস্যা সমাধান এর গুরুত্ব পারিবারিক সমস্যা সমাধান করার থেকে কয়েক শত গুণ বেশি।”

সাগরিকা চৌধুরী লাঠিতে ভর দিয়ে ধীর পায়ে চৌধুরী মেনশনের ভিতরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা এগোতে এগোতে বললেন…

—“সন্ধ্যা দিদিভাই…সাদিককে কল কর আর ওকে কুশল দাদু ভাইকে বলতে বল দাদীমা জরুরী বিষয়ে কথা বলার জন্য যতো দ্রুত সম্ভব ওকে বাসায় ফিরতে বলেছেন।

(৪)

বিয়ের আসরের জায়গাটি থেকে তরুনিমা এক দৌড়ে চৌধুরী মেনশনের ভিতরে নিজের জন্য বরাদ্দ করা ঘরটিতে এসে প্রবেশ করে দরজা ভিতর থেকে আটকে দেয়। অতঃপর তরুনিমা রুমের মেঝেতে পায়চারী করতে করতে শরীরে থাকা ভাড়ি ভাড়ি অলঙ্কার গুলো একটা একটা করে খুলে রুমের মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলতে ফেলতে বললো….

—“বলি তারেক সিকদারের একমাত্র মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার জন্য দুনিয়াতে কি পুরুষ মানুষের অভাব হয়ে গিয়েছে! দাদীমা আমাকে যদি বলতেন , ‘তরু তোকে আফ্রিকার জঙ্গলে আমৃত্যু বনবাস দেওয়া হলো’ তাহলেও আমি নাচতে নাচতে সকলের থেকে বিদায় নিয়ে চলে যেতাম। কিন্তু দাদীমা ওনার ঐ খা’রু’শ, এক’রো’খা, রাগী, জে’দ্দী, অতি ভদ্র ও ভালো মানুষ নাতীকে আমার মতো নিষ্পাপ, মাসুম, লক্ষী মেয়েটার গলায় ঝুলিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করছেন কেনো? এই ব্যডাকে বোঝার বয়স থেকেই আমার দুই চোক্ষে সহ্য হয় না তা কি তিনি জানেন না? জীবনে ফেলা আমার প্রতিটি কদমে কদমে বাবা-মা, চৌদ্দ গুষ্টির মুখে এই খা’রু’শ ব্যডার প্রশংসা শুনতে শুনতে কান, মাথা আর তাদের স্ব-স্থানে নেই। এখন যদি এই ব্যডা আমার জামাই হয় তাহলে তো এই চৌধুরী আর সিকদার বংশ আমাকে তাদের কথার জাতাঁকলে আ’স্ত গমের মতো পি’ষে আটা বানিয়ে ফেলবে। না, না এমনটা তো হতে দেওয়া যাবে না। দরকার পড়লে আমি চিঠি লিখে এই সংসার ত্যগ করে আফ্রিকার জঙ্গলের বনবাসীনি হয়ে যাবো তবুও ঐ খা’রু’শকে বিয়ে করবো না। হারগিজ নেহিইই………!”

(৫)

সাদিক কুশলের হাতের ডান পার্শে এসে দাঁড়াতেই কুশল বললো….

—“গেইটের ওখানে গিয়ে দেখো কিসের শোরগোলের আওয়াজ ভেসে আসছে।”

সাদিক দ্রুত পায়ে গেইটের কাছে চলে যায়।

কিছুসময় পর সাদিক একজন গরীব চাষীকে সাথে নিয়ে কুশলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললো…..

—“স্যার , উনি আপনার সাথে সাক্ষাৎে কথা বলতে চাইছিলেন। গার্ডরা তাকে ভিতরে আসতে বাঁধা দেওয়ায় শোরগোলের সৃষ্টি হয়েছিলো।

চাষীটি কুশলকে দেখা মাত্র দৌড়ে কুশলের পায়ের কাছে এসে বসতে নিলে কুশল দ্রুত হাতে তার দুই কাঁধ ধরে তাঁকে থামিয়ে দিতে দিতে বললো….

—“আরে চাচা কি করছেন আপনি! আপনি আমার গুরুজন এভাবে আমার পায়ের কাছে বসবেন না।”

এই বলে কুশল চাষিটিকে ধরে নিজের পাশের সোফায় বসিয়ে দিলেন। চাষিটি কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। কুশল তাকে শান্ত করার জন্য বললেন…..

—“চাচা , আপনি কান্না করবেন না। কান্না থামিয়ে আমাকে বলুন আপনার কি সমস্যা হয়েছে। আমি আপনাকে অবশ্যই সাহায্য করবো।”

চাষিটি কান্না করতে করতে বললেন….
—“বাবা , মেম্বার এর উ’শৃ’ঙ্খল ছেলেটা কয়েকদিন ধরেই স্কুলে যাওয়া-আসার পথে আমার ১৫ বছরের মেয়েকে উত্তক্ত করতো। আমার মেয়ে আমাকে বলায় আমি নিজের মেম্বার এর কাছে গিয়ে অনুরোধ করেছিলাম তার ছেলেকে আমার মেয়েকে উত্তক্ত করা থেকে বিরত থাকতে বলার জন্য। কিন্তু আজ আমার মেয়েটা স্কুল থেকে বাড়িতে ফেরার সময় মেম্বার এর ছেলে আমার মেয়েটাকে তুলে নিয়ে গিয়ে ওর সর্বনাশ করে দিয়েছে। পরে আমার মেয়েটাকে নদীর ধারে ফেলে রেখে গিয়েছিলো। গ্রামের কিছু মানুষ মেয়েটাকে নদীর ধারে পরে থাকতে দেখে বাড়িতে এনেছিলো। মেয়েটার অবস্থা খুব খারাপ বাবা। গ্রামেই সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছি। কিন্তু তারা বলেছেন এখানে চিকিৎসা হবে না শহরে নিয়ে যেতে হবে। আমি আমার মেয়েটাকে নিয়ে কি করবো বাবা! আপনি আমাদের কাছে আল্লাহর পাঠানোর দূতের মতো, গ্রামের সবার বিপদে-আপদে আপনি সবসময় পাশে দাঁড়ান। আমার মেয়েটারে বাঁচান বাবা।”

চাষীর কথাগুলো শুনে রাগে কুশলের কপালের রগ ফুলে উঠেছে ইতিমধ্যে। সোফার ২পাশের হাতলের উপর রাখা হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করে কুশল উচ্চস্বরে সাদিককে ডাক দেয়। সাদিক দ্রুত পায়ে হেঁটে কুশলের সামনে এসে দাঁড়াতেই কুশল বললো…

—“এক্ষুণি মালতি মায়ের সাথে কিছু গার্ডকে একটা গাড়িতে করে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করো। সেখান থেকে চাচার মেয়েকে নিরাপদে শহরে নিয়ে গিয়ে শহরের সব থেকে বেস্ট ক্লিনিকে ভর্তি করাতে বলবে। মেয়েটার চিকিৎসায় যেনো কোনো রকম ত্রুটি না হয়। দ্রুত যাও….!”

সাদিক কুশলের কথানুযায়ী কাজ করতে চলে যায়। কুশল চাষীটিকে উদ্দেশ্য করে বললো….

—“চাচা , আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। আপনার মেয়েকে সুচিকিৎসা দেওয়ার সমস্ত ব্যবস্থা হয়ে যাবে এক্ষুণি। ও সুস্থ হয়ে উঠবে খুব তাড়াতাড়িই ইনশাআল্লাহ।”

—“আল্লাহ তোমার অনেক ভালো করুক বাবা দোয়া করি।”

কিছুসময় পর সাদিক কুশলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললো….

—“স্যার সব ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছে।”

কুশল সোফা ছেড়ে উঠে নিজের দুই হাত কমোরের পিছনে রেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দৃষ্টি সামনের দিকে স্থির রেখে শান্ত স্বরে বললো….

—“সাদিক গাড়ি বের করো। চাচাকে সাথে নিয়ে একটু মেম্বার এর বাসাটা দর্শন করে আসি।”

কুশলের এই কথা শুনে সাদিক গাড়ি বের করে সামনের দিকে যেতে যেতে বিরবিরিয়ে বললো…..

—“স্যারের এই শান্ত রূপ যে কতোটা ভ’য়ং’কর হতে পারে তা আমি খুব ভালো ভাবেই জানি। আজ মেম্বার এর বাসায় তার ছেলের জান ক’ব’জ করার জন্য আ’জ’রা’ই’ল যাবে এতোটুকু বলতে পারছি।”

চলবে ইনশাআল্লাহ….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here